Monday, February 28, 2011

কবি চন্দ্রাবতী ও সেই শিবমন্দির




চন্দ্রাবতী (১৫৫০-১৬০০) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি। তার পিতা 'মনসামঙ্গল' কাব্যের অন্যতম রচয়িতা দ্বিজবংশী দাশ এবং মা সুলোচনা। জন্ম ষোড়শ শতাব্দীতে। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাটোয়ারী গ্রামে। তার স্মৃতিবিজড়িত পাটোয়ারী গ্রাম আজও আছে। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে ওই গ্রাম। আর আছে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির।



ষোড়শ শতকের মনসামঙ্গলের বিখ্যাত কবি দ্বিজবংশী দাশের কন্যা ও বাংলার আদি মহিলা কবিরূপে খ্যাত চন্দ্রাবতী পূজিত ও বহু কাহিনী সম্পৃক্ত এ মন্দিরটি খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দিতে নির্মিত। নয়ন ঘোষ প্রণীত পালাগান 'চন্দ্রাবতী' থেকে জানা যায়, চন্দ্রাবতীর সঙ্গে বিয়ের কথা ছিল ছোটবেলার সাথী ও প্রেমিক জয়ানন্দের। কিন্তু জয়ানন্দ এক মুসলমান নারীর প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হন। এতে চন্দ্রাবতীর হৃদয় ভেঙে যায়। পরে পিতা দ্বিজবংশী দাশের কাছে চন্দ্রাবতী দুটি প্রার্থনা করেন_এক. ফুলেশ্বরী নদীর তীরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা এবং খ. চিরকুমারী থাকার ইচ্ছা। তার রচনাগুলোর মধ্যে মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা ও রামায়ণ কথা (অসমাপ্ত) অন্যতম। মৈমনসিংহ গীতিকায় তার কথা পাওয়া যায়। তার নিজের জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারিপাড়া গ্রামে কবি চন্দ্রাবতীর সুবিখ্যাত শিবমন্দিরটির অবস্থান। পুরাকীর্তির দিক থেকে কিশোরগঞ্জের দর্শনীয় নিদর্শনের মধ্যে যে নামগুলো প্রথমেই আসে তার মধ্যে কবি চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির অন্যতম।

চন্দ্রাবতী পালায় তার বর্ণনা : 'অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে।' এভাবেই এক সময়ের খরস্রোতা নদী ফুলেশ্বরীর তীরে শিবমন্দিরটি স্থাপিত হয়। এক সময় জয়ানন্দ ভুল বুঝতে পেরে চন্দ্রাবতীর কাছে ফিরে আসেন। কিন্তু চন্দ্রাবতী তাকে গ্রহণ করেননি। অন্তর্জ্বালায় একসময় জয়ানন্দ ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। বর্তমানে নদীটির কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু মন্দিরটি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দীনেশ চন্দ্র সেন 'মৈমনসিংহ গীতিকা'য় লিখেছেন, 'চন্দ্রাবতী সম্ভবত ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।' তিনি আরও লিখেছেন_ পিতা ও কন্যা একত্রে মনসা দেবীর ভাসান ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেছিলেন। সে হিসেবে এবং মন্দির ও চন্দ্রাবতীর লেখায় রামায়ণ সম্পর্কে অন্যান্য আলোচনা, মন্দিরের নির্মাণশৈলী ও স্থানীয় অনুসন্ধান থেকে অনুমান করা হয়, মন্দিরটি ষোড়শ শতকের শেষ দিকে নির্মিত, যদিও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মন্দিরটি অষ্ট কোণাকৃতির। এর উচ্চতা ১১ মিটার। আটটি কোণার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ ১.৭ মিটার। নিচের ধাপে একটি কক্ষ ও কক্ষে যাওয়ার জন্য একটি দরজা রয়েছে। ভেতরে হয় শিবপূজা। নিচের সরলরেখায় নির্মিত অংশটি দুটি ধাপে নির্মিত। নিচের ধাপের চারদিকে প্রায় অর্ধ বৃত্তাকার খিলানের সাহায্যে নির্মিত প্রশস্ত কুলুঙ্গি রয়েছে। নিচের ধাপে কার্নিশ পর্যন্ত উচ্চতা ২.৭০ মিটার। কক্ষের ভেতরে সাতটি জানালাসদৃশ কুলুঙ্গি রয়েছে যার প্রস্থ ৫২ সেন্টিমিটার এবং দৈর্ঘ্য ৯৯ সেন্টিমিটার। এতে কিছু কারুকাজও আছে। কক্ষের ব্যাস ২.৩৫ মিটার। দ্বিতীয় ধাপটিও সরলরেখায় নির্মিত। এ পর্যায়েও অর্ধ বৃত্তাকারের খিলানের সাহায্যে নির্মিত প্রশস্ত কুলুঙ্গি রয়েছে। কুলুঙ্গির ভেতরে একদা পোড়ামাটির অসংখ্য চিত্র ফলকের অলঙ্করণ ছিল যা আজ অবশিষ্ট নেই। মন্দিরটি প্রায় ভগ্ন অবস্থায় ছিল। কয়েক বছর আগে প্রত্নতাত্তি্বক বিভাগ মন্দিরটির সংস্কার করেছে। ১৯৯১ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে মন্দিরের অনেক ক্ষতি হয়। এবং শিবলিঙ্গটিও চুরি হয়ে যায়। বর্তমনে মন্দিরটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সম্পত্তি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এ বিষয়ে শুধু একটি সাইনবোর্ড টানিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। এর রক্ষণাবেক্ষণসহ নিরাপত্তার বিষয়টি এখন হুমকির মুখে। মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটিও কাঁচা। ফলে দূর-দূরান্তের অনেক দর্শনার্থী সহজে মন্দিরটি দেখতে যেতে পারেন না।

সাইফউদ্দিন আহমেদ, কিশোরগঞ্জ 

মুলসুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&type=gold&data=Economics&pub_no=303&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=0