Sunday, October 3, 2010

 কবুতরের উড়াল প্রতিযোগিতা (বাংলাবান্ধা টু ঢাকা)

গিরিবাজ কবুতর আকাশপথে উড়তে পারে প্রায় ৫০ কিলোমিটার। কিন্তু হোমার কবুতর উড়তে পারে কত দূর? হাজার কিমি নাকি তারও বেশি? বিলি নামের এক হোমার কবুতর পাড়ি দিয়েছিল আটলান্টিক। ফ্রান্স থেকে ছাড়া হয়েছিল এই কবুতরটি, যাওয়ার কথা ছিল ইংল্যান্ডের লিভারপুল। কিন্তু সেই বিলি প্রায় তিন হাজার ৩২১ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হয়েছিল নিউইয়র্কে। কেন? সেই রহস্য আজও অজানা। এই বিলিকে ছাড়া হয়েছিল আরও প্রায় ১০০ কবুতরের সঙ্গে; কবুতরের উড়াল প্রতিযোগিতায়। সারা বিশ্বেই কবুতরের ওড়ার প্রতিযোগিতা বা সোজা কথায় যাকে বলে কবুতরের রেস জনপ্রিয় একটি খেলা হিসেবে চালু আছে ২০০ বছর আগে থেকেই। ধারণা করা হয়, ২২০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম কোনো কবুতরের রেসের আয়োজন করা হয়। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে প্রথম বেলজিয়ামে কবুতর রেসের আনুষ্ঠানিক আয়োজন করা হয়। বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস কবুতর ও কবুতর রেসের জন্য বিশ্বময় সুপ্রসিদ্ধ। সাধারণত এক হাজার কিমি আকাশপথের এই রেসের আয়োজন করা হয়। সর্বশেষ বার্সেলোনা থেকে বেলজিয়াম পর্যন্ত এক হাজারের বেশি কিমি দূরত্বের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ এক হাজার ৮০০ কিমি রেসের আয়োজন করা হয়। আমাদের দেশেও এই কবুতরের রেস চালু আছে। প্রতিবছর শীতপূর্ব ও গ্রীষ্মকালে এই রেসের আয়োজন করা হয়। নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও দেখভালের পর কবুতর এই রেসের জন্য উপযুক্ত হয়। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি কবুতর উড়তে পারে ঘণ্টায় ১৩০ কিমি থেকে ২৬০ কিমি পর্যন্ত। দিনে একটি কবুতর প্রায় ৬০০ মাইল পথ পাড়ি দিতে পারে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় রেসটি হয়েছে তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রায় ৩৭০ কিমি। আকাশপথের এই রেসে অংশগ্রহণকারী কবুতরের সংখ্যা ছিল শতাধিক।
কবুতর পাঁচালি
সাধারণত ছয় মাস বয়স থেকে কোনো কবুতর ওড়ার জন্য উপযুক্ত হয়। এই ছয় মাস বয়স থেকে শুরু হয় তার প্রশিক্ষণ। তার আগে দুই থেকে তিন মাস বয়স হলেই কবুতরটিকে তার পরিবার থেকে আলাদা করে অন্য কোনো খাঁচায় রাখা হয়। চার মাস বয়স হলে আবারও তার খাঁচা পরিবর্তিত হয়। এবারের খাঁচা থাকে ঘরের বাইরে। এ সময় কবুতরটি তার বাসস্থান ও প্রতিবেশ সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। ছয় মাস পরে তাকে তার বাসস্থানের আশপাশে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ওড়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ সময় কবুতর উড়তে শেখে এবং ধীরে ধীরে তার ওড়ার বেগ ও দূরত্ব বাড়তে থাকে। কবুতরের ব্রিডিংয়ের ক্ষেত্রেও বেশ যত্ন নিতে হয়। এ জন্য কবুতরের জীবনবৃত্তান্ত অনুসরণ করা হয়। সাধারণত তার পূর্ববর্তী কোনো রেসে ভালো ফল করা পুরুষ কবুতর ও স্ত্রী কবুতরের ব্রিডিং করা হয়। জন্মের এক সপ্তাহ পরেই যেকোনো কবুতরের পায়ে একটি রিং পরিয়ে দেওয়া হয়। সেই রিংয়ে দেশের কোড, একটি কোড নম্বর ও জন্মসাল অঙ্কিত থাকে। এই রিংয়ের তথ্যাদি প্রামাণ্য হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া প্রতিটি কবুতরের জন্য আলাদা জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করা হয়। সেই জীবনবৃত্তান্তে কোনো কবুতরের বাবা-মায়ের পরিচয় উল্লেখ থাকে। এভাবে পাঁচ থেকে সাতটি পর্বপরম্পরায় কবুতরের জন্মবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ থাকে। প্রশিক্ষণবিহীন কোনো কবুতর খুব বেশি দূর উড়তে পারে না বা তার গতিবেগও রেসের জন্য সন্তোষজনক হয় না। যেসব কবুতর চিঠি আদান-প্রদানের কাজ করত তারা ১০০ কিমির বেশি উড়তে পারত না। এসব কবুতরের গতি ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিমি।
রেসের কবুতর হোমার রেসার হিসেবে পরিচিত। দুই ধরনের হোমার রেসার আছে—কম বয়সী হোমার রেসার এবং প্রাপ্তবয়স্ক হোমার রেসার। ছয় মাস থেকে এক বা দেড় বছর পর্যন্ত কবুতরকে কম বয়সী রেসারদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একটি কবুতর ছয় থেকে আট বছর পর্যন্ত সন্তোষজনকভাবে উড়তে পারে। গিরিবাজ কবুতর পরিচিত রোলার রেসার হিসেবে। রোলার কবুতর সর্বোচ্চ ছয় কিমি পর্যন্ত উচ্চতায় উঠতে পারে। হোমার রেসার উঠতে পারে তারও বেশি, বিমান চলাচলের বায়ুস্তর পর্যন্ত।
রেসে অংশগ্রহণকারী কবুতরের ৯০ শতাংশেরও বেশি ফিরে আসে। সাধারণত বজ্রপাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বাজপাখির আক্রমণে না পড়লে যেকোনো কবুতরই ঘরে ফিরে আসে। তবে কোনো কোনোটি পথ ভুল করে ফিরে আসতে দেরি করে। এই দেরি মাস পেরিয়ে বছরও হতে পারে।

বাংলাদেশের কবুতর রেস
আমাদের দেশে বাংলাদেশ রেসিং পিজিওন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে প্রতিবছর কবুতরের রেসের আয়োজন করা হয়। ২০০৩ সালের মার্চ থেকে এই সংগঠনটি কাজ শুরু করে। সিকান্দার আলী, মাকসুদ আহমেদ সনেট, রেজা-উর-রাহমান সিনহা, আলা উদ্দিন স্বপন এই কয়েকজনের উদ্যোগে কবুতর নিয়ে বাংলাদেশে প্রথম কোনো সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে সংগঠনটির ১৮০ জন সদস্য রয়েছেন। সর্বপ্রথম তাঁরা ২০০৪ সালের মে মাসে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে ৮০ কিমি দূরত্বের রেসের আয়োজন করেন। এই প্রতিযোগিতায় প্রায় ৩৫টি কবুতর অংশ নেয়। এর পর থেকে প্রতিবছরই তাঁরা কবুতরের রেসের আয়োজন করেন। সংগঠনের সদস্যরা নিজেরাই কবুতর উৎপাদন এবং সংগ্রহ করে থাকেন। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়াম থেকেও তাঁরা কবুতর সংগ্রহ করেন। গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত রেস দেখতে নেদারল্যান্ডস থেকে এসেছিলেন মার্সেল স্যাঞ্জার্স। এ ছাড়া কবুতরের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা-পরামর্শও তাঁরা সংগ্রহ করেন এই দুটি দেশ থেকে। এ বছরের পরবর্তী রেসের আয়োজনও শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। আগামী আক্টোবর-নভেম্বরে আয়োজিত হবে পরবর্তী রেস।

রেসের ফলাফল
প্রথমেই কোনো স্থান নির্বাচন করা হয় রেসের জন্য। সেই স্থানে কবুতর নিয়ে যাওয়ার জন্য ভ্যান থাকে। তার আগে অংশগ্রহণকারী কবুতরের পরিচয় লিপিবদ্ধ করা হয়। এবং আরেকটি রিং কবুতরের পায়ে পরানো হয়, যেখানে একটি গোপন নম্বর ও ফোন নম্বর থাকে। রেসের দিন একই সময় কবুতরগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সংখ্যার কবুতর রেসের জন্য নির্বাচন করতে পারেন। প্রতিযোগিতার সময় হচ্ছে কবুতর ছাড়ার সময় থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কোনো কবুতর তার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছালে পায়ের রিংটি খোলা হয় এবং নম্বরটি সংগ্রহ করা হয়। দূরত্ব আর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে রেসে অংশগ্রহণকারী কবুতরের গতিবেগ নির্ধারণ এবং সেই বিবেচনায় ফলাফল ঘোষণা করা হয়। সাধারণত এই কাজে একটি বিশেষভাবে তৈরি ঘড়ি বিজয়ী নির্বাচনের কাজ করে। ঘড়িটি রেস শুরুর সময় চালু করা হয়। যে নম্বরটি কবুতরের পায়ে লুকানো থাকে, রেস শেষে সেই নম্বরটি ঘড়ির বিশেষ স্বয়ংক্রিয় স্থানে রাখা হয়। তখনকার সময়কে রেস শেষ হওয়ার সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নতুন প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে ইলেকট্রনিক টাইমিং মেশিন। এ ক্ষেত্রে কবুতরের পায়ে একটি ছোট চিপ সংযুক্ত করা হয়। এই মেশিনে কোনো কবুতরের গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সংগৃহীত হয়। আগের তুলনায় ইলেকট্রনিক টাইমিং মেশিন অনেক নিখুঁত ফলাফল প্রকাশ করতে পারে।

 সুত্র: প্রথম আলো। সালাহ্ উদ্দিন | তারিখ: ০৯-০৭-২০১০

No comments: