Tuesday, October 5, 2010

কোপেনহেগেন কাঁপানো ছবির গল্প

কোপেনহেগেন কাঁপানো ছবির গল্প কোপেনহেগেন কাঁপানো ছবির গল্প

প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি মানুষের লড়াইয়ের ছবি তুলেছিলেন জোনাথন বিজার্গ মোলার। তাঁর ছবি ও লেখা নিয়ে জলবায়ু সম্মেলন চলাকালীন ডেনমার্কের পলিটিক্যান পত্রিকায় প্রকাশিত সেই বিশেষ আয়োজন নিয়ে লেখা

৯ ডিসেম্বর ২০০৯। সেদিন বাংলাদেশ ছিল কোপেনহেগেনের ‘টক অব দ্য টাউন’। বাসে, ট্রেনে, কফি শপে, পাবে—আলোচনায় ঘুরেফিরে আসছিল বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল, যেন একটু আগেই বাংলাদেশে ঘুরে গেছে তারা। বাংলাদেশের বিপন্ন উপকূল চোখে ভাসছে সবার। ব্যাপারটা কী!
রহস্যের উদ্ঘাটন হলো ডেনমার্কের অন্যতম প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় দৈনিক পলিটিক্যান পত্রিকাটা হাতে নিতেই। দেশের শীর্ষ দৈনিকটি চার পৃষ্ঠাজুড়ে বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষ আয়োজন করেছে। সাদাকালো অসামান্য কিছু ছবি আর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম শিকার বাংলাদেশের করুণ এক চিত্র। আর এসব কিছুর পেছনের মানুষটি হলেন জোনাথন বিজার্গ মোলার।
বাংলাদেশ নিয়ে চার পৃষ্ঠার এই আয়োজন প্রকাশের জন্য প্রায় এক বছর আগে থেকে কাজ শুরু করে পলিটিক্যান। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত একটি দেশের ওপর আলোকচিত্রসহ প্রতিবেদন ছাপবে। ‘কোপ-১৫’ সম্মেলন চলাকালে সেটি প্রকাশ করাই ছিল তাদের ইচ্ছা। 
কোপেনহেগেনের তরুণ আলোকচিত্রী জোনাথন মোলার পত্রিকাটির এ পরিকল্পনা জানতে পেরে এর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশের ওপর প্রতিবেদন তৈরির ব্যাপারে তিনি তাঁর আগ্রহের কথা জানান।
এরপর বাংলাদেশে এসে শুরু হয় জোনাথনের আরেক লড়াই। শুধুপলিটিক্যান-এর জন্য কিছু ছবি তোলা, প্রতিবেদন লেখায় নিজেকে আটকে রাখেননি জোনাথন। হাজারো ছবি দিয়ে তুলে আনতে চেয়েছেন জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের বিপন্নতাকে।
১২ ডিসেম্বর কোপেনহেগেনের সিটি সেন্টারে ছিল উপচে পড়া ভিড়। জলবায়ু-বিপন্ন দেশগুলোর ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলছিল সেখানে। প্রদর্শনীতে জোনাথনের তোলা বাংলাদেশের ১৫টি ছবি স্থান পেয়েছিল। বিস্ময়ের সঙ্গে খেয়াল করা গেল, এ ছবিগুলোর সামনেই ভিড় লেগে রইল সবচেয়ে বেশি। নেচার ল্যাবরেটরি, এ টাউন দ্যাট ডিসেপেয়ার্ড, ঘোস্ট টাউন, আইলা ভিকটিম, দ্য ভিলেজ উইদাউট ম্যান শীর্ষক ছবিগুলো দর্শকেরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। সঙ্গে জোনাথনের কাছে তারা জানতে চেয়েছে বাংলাদেশের উপকূলের লড়াকু মানুষের কথা।
এই ছবিগুলো শুধু সাধারণ দর্শকের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেনি, ‘কোপ-১৫’ সম্মেলনে হাজির হওয়া বিশ্বনেতারাও আলোড়িত হয়েছেন এসব ছবি দেখে। সম্মেলনকেন্দ্রে বারবার আলোচনায় আসছিল বাংলাদেশ। আর রেফারেন্স হিসেবে বারবার এসেছে সেই পলিটিক্যান-এর রিপোর্ট। ‘কোপ-১৫’ সম্মেলনের সভাপতি কোনি হেডগার্ড তাঁর একাধিক বক্তৃতায় পলিটিক্যান-এর ওই প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে কথা বলেছেন। হেডগার্ড বলেন, ‘বাংলাদেশের যেসব নারী আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখনো বেড়িবাঁধে রাত যাপন করছে, তাদের কথা মনে রেখেও বিশ্বসম্প্রদায়ের উচিত একটি চুক্তিতে অবতীর্ণ হওয়া।’
মনে রাখার মতো ব্যাপার হলো, একদিকে সম্মেলনের পক্ষের লোকদের কাছে পলিটিক্যান-এর এই আয়োজন যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি এটি হাতিয়ার হয়েছে সম্মেলনবিরোধীদের কাছেও। এ সম্মেলনকে ‘ধনী দেশগুলোর ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে প্রচণ্ড তুষারপাত উপেক্ষা করে সম্মেলনকেন্দ্রের বাইরে মিছিল-সমাবেশ করছিল বিরোধীরা।
এই বিরোধীদের মুখেও ছিল বাংলাদেশকে বাঁচানোর আকুতি। তাদের বক্তৃতাতেও উদ্ধৃত হয়েছে পলিটিক্যান। কয়েকজন বিরোধীকে দেখা গেল, পলিটিক্যান পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশ-বিষয়ক প্রতিবেদন ও আলোকচিত্রকে ফেস্টুনে সাঁটিয়ে মিছিল করতে। স্লোগান উঠছিল ‘সেভ বাংলাদেশ, সেভ বাংলাদেশ’।
কথা হচ্ছিল কিমা ফোরাম নামের সম্মেলনবিরোধী একটি পরিবেশবাদী সংস্থার কর্মী ইয়াসপার মোলেরের সঙ্গে। পলিটিক্যান পত্রিকায় বাংলাদেশ-বিষয়ক আলোকচিত্রের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘আমাদের সুখ, আনন্দ আর ভোগের কারণে যে কার্বন নিঃসরিত হচ্ছে, তার জন্য ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশের মানুষ। এই দেশটির যে এত ক্ষতি হচ্ছে, তা এত দিন বুঝতে পারা তো দূরের কথা, জানতেও পারিনি। আমরা আমাদের ভোগবিলাসী জীবনের জন্য এখন অনুতাপ বোধ করছি। আমাদের সরকারের উচিত, কার্বনশূন্য প্রযুক্তির জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা।’ বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে প্রয়োজন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে অতিরিক্ত কর দিতেও তিনি রাজি আছেন বলে জানান।
ফ্রান্স থেকে আসা গ্রিনপিসের কর্মী আন্দ্রে রুইসন কিছুটা আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করে বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশের যে আলোকচিত্র আমরা দেখলাম, জলবায়ু পরিবর্তন না থামাতে পারলে ভবিষ্যতে পুরো পৃথিবীর পরিণতি বাংলাদেশের মতো হবে। আজ থেকে ৫০ বছর পর ইউরোপ নিয়ে একই ধরনের আলোকচিত্র তোলা সম্ভব হবে। সেই দিন যাতে না আসে, সে জন্যই আমরা আন্দোলন করছি। আমাদের সন্তান ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মের পরিণতি কী হতে পারে, পলিটিক্যানে বাংলাদেশের আলোকচিত্র দেখে তা আমরা আন্দাজ করতে পারছি। আমাদের লড়াই এখন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে বাঁচানোর, পৃথিবীকে বাঁচানোর।’
এই লড়াইয়ে রুইসনরা জিতবেন কি না, সেটা সময়ই বলবে। তবে আপাতত জোনাথনদের হাত ধরে বাংলাদেশের একটা বিজয় হলো বৈকি! 
 প্রথম আলো।।
ইফতেখার মাহমুদ | তারিখ: ২২-০১-২০১০

No comments: