১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ভেতরের ও শরণার্থী শিবিরের চিত্র ঘুরে ঘুরে দেখেছেন সে সময়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাংসদ ও ত্রাণকর্মীরা। তাঁদের অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীর সামনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অক্সফাম প্রকাশ করে এক ঐতিহাসিক দলিল—টেস্টিমনি অব সিক্সটি। সম্প্রতি প্রকাশনাটির প্রতিলিপি সংস্করণ প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। প্রথম আলো সেই প্রকাশনাটিরই অবিকল বাংলা সংস্করণ প্রকাশ করেছে গত ১৬ ডিসেম্বর। ষাটজনের সাক্ষ্য নামে সেই প্রকাশনা নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন
২৫ মার্চ ১৯৭১ সামরিক বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণের পর সাড়ে সাত কোটি মানুষের পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠল অত্যাচার ও নির্যাতনের প্রধান সাক্ষী। সেনাশাসক ও তাঁদের সমর্থকদের পরিকল্পিত নির্যাতনে শুরু হয় বিপুল সংখ্যায় দেশত্যাগ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মানুষের সৃষ্টি করা এ ধরনের তাণ্ডবের নজির আর কোথাও নেই; ফিলিস্তিনেও না, ভিয়েতনামেও না। প্রাণের ভয়ে এমন বিপুলসংখ্যক মানুষের স্বদেশ ত্যাগের ঘটনাও আধুনিক ইতিহাসে আর নেই। শরণার্থীর এমন অবিরাম স্রোত কেউ দেখেনি। মানুষের এমন দুঃখ, কষ্ট, দুর্দশার বর্ণনা অসম্ভব।
আমাদের সেই দুঃসময়ে ভারতসহ অনেক রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান অক্সফাম বিশেষভাবে যুক্ত ছিল শরণার্থী-ব্যবস্থাপনায়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক অক্সফামের তখনকার সদর দপ্তর অক্সফোর্ডের ২৭৪ বানবারি রোডে। অক্সফামের জনসেবা কার্যক্রম শুরু হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। অক্সফামের সঙ্গে তখন জড়িত রিচার্ড এক্সলে ও হেলেন এক্সলে।
আর সে সময় এই বিপদাপন্ন বাংলাদেশি শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস। ভদ্রলোক তাঁর বিভিন্ন লেখায় বলেছে, শরণার্থী-সমস্যা ও পূর্ব পাকিস্তানের সংকট নিয়ে গোটা পৃথিবীর নিস্পৃহতা কাটাতে উদ্যোগী হয়েছিল অক্সফাম। একটি আঘাত দিয়ে পৃথিবীর বিবেককে জাগাতেই অক্সফাম বিশেষ একটি দলিল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই দলিলটির নামই দেওয়া হয় টেস্টিমনি অব সিক্সটি—ষাটজনের সাক্ষ্য। কোন ৬০ জন?
যাঁরা সংকটের ভয়াবহতা দেখেছেন, যাঁরা এই ভয়াবহ বর্ণনাতীত পরিস্থিতিতে বসবাস করছেন, তাঁদের সাক্ষ্য। এই স্বর তাঁদেরই স্বর। সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে আছেন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও মাদার তেরেসা। বরেণ্য সাংবাদিকদের মধ্যে আছেন জন পিলজার, মাইকেল ব্রানসন, ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ, নিকোলাস টোমালিন, মার্টিন উলাকট, এলেক্স হেনড্রি, অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস, ডেভিড লোসান, অ্যালান হার্ট, ক্লদ মস প্রমুখ। সাংসদদের মধ্যে রয়েছেন রেনা প্রেনটিস, জন স্টোনহাউস, বার্নার্ড ব্রেইন, জেমস রামসডেন, ব্রুস ডগলাস মান প্রমুখ।
এসব লোকের কাছে দৌড়ে দৌড়ে যাওয়া হলো। সংগ্রহ করা হলো তাঁদের সাক্ষ্য ও বিশ্ববাসীর প্রতি তাঁদের আবেদন। সবাই লেখার হাত বাড়িয়ে দিলেন। বরেণ্য চিত্রগ্রাহকেরা তাদের দুর্লভ ছবি পাঠালেন। শিল্পী জেরার্ড স্কার্ফ লেখা না পাঠিয়ে পাঠালেন কয়েকটি স্কেচ। সব মিলিয়ে দাঁড়িয়ে গেল অসাধারণ এক প্রকাশনা।
সে সময় অক্সফামের পরিচালক ছিলেন লেসলি কার্কলে। এই দুর্লভ ও মানবিক প্রকাশনাটির মুখবন্ধ লিখেছেন তিনি। কার্কলে লিখছেন, এই গল্প তাড়া খাওয়া, গৃহহারা, মৃত্যু-উন্মুখ মানুষের। যখন এ-প্রান্তে মহাপ্রলয়, বিশ্ব সম্প্রদায় উটপাখির মতো মাথা গুঁজে রাখার খেলায় ব্যস্ত।
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হলো ইতিহাসের অসামান্য এই দলিল। তত দিনে অক্সফাম পরিচালকের ভাষায় সুইডেন ও নিউজিল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার সমসংখ্যক মানুষ স্বদেশ ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে। এই দলিল প্রকাশের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন চলাকালে বিতরণ করা। উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
এই প্রকাশনা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। নাড়া দেওয়ায় আরেকটু সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন সিনেটর কেনেডি। তিনি সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থীবিষয়ক সিনেট উপকমিটির চেয়ারম্যান। একাত্তরে ভারতের সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন, শত শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেন কেনেডি। এই সাক্ষ্য দলিলে তিনি ‘দুর্দশার মোজাইক’ নামে একটি লেখা লেখেন। সেখানে জোর দিয়ে বলেন, এই ট্র্যাজেডির ব্যাপকতা পৃথিবী বুঝে উঠতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘পূর্ব বাংলার ট্র্যাজেডি কেবল পাকিস্তানের জন্য ট্র্যাজেডি নয়, এটা কেবল ভারতের জন্য ট্র্যাজেডি নয়, এটা সমগ্র বিশ্বসম্প্রদায়ের জন্য ট্র্যাজেডি।’
এটুকু বলে কাজ শেষ মনে করেননি কেনেডি। তাঁরই প্রস্তাব অনুযায়ী এই দলিলটি বাংলার সংকটের সাক্ষ্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ৯২তম কংগ্রেসের কার্যক্রমে রেকর্ডভুক্ত হয়।
এমনি করেই একাত্তরে আমাদের এই বাংলাদেশের সংকটের সঙ্গে বিশ্বকে পরিচিত করে দিয়েছেন অসামান্য কিছু মানুষ। নিশ্চয়ই এসব উদ্যোগ কোনো না কোনোভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে আমাদের সংগ্রামে।
আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে আমরা সেই উদ্যোক্তাদের নিশ্চয়ই একটা ধন্যবাদ অন্তত পৌঁছে দিচ্ছি।
এম এ মোমেন: লেখক এবং
ষাটজনের সাক্ষ্য ম্যাগাজিনের অনুবাদক। তারিখ: ১৮-১২-২০০৯
২৫ মার্চ ১৯৭১ সামরিক বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণের পর সাড়ে সাত কোটি মানুষের পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠল অত্যাচার ও নির্যাতনের প্রধান সাক্ষী। সেনাশাসক ও তাঁদের সমর্থকদের পরিকল্পিত নির্যাতনে শুরু হয় বিপুল সংখ্যায় দেশত্যাগ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মানুষের সৃষ্টি করা এ ধরনের তাণ্ডবের নজির আর কোথাও নেই; ফিলিস্তিনেও না, ভিয়েতনামেও না। প্রাণের ভয়ে এমন বিপুলসংখ্যক মানুষের স্বদেশ ত্যাগের ঘটনাও আধুনিক ইতিহাসে আর নেই। শরণার্থীর এমন অবিরাম স্রোত কেউ দেখেনি। মানুষের এমন দুঃখ, কষ্ট, দুর্দশার বর্ণনা অসম্ভব।
আমাদের সেই দুঃসময়ে ভারতসহ অনেক রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান অক্সফাম বিশেষভাবে যুক্ত ছিল শরণার্থী-ব্যবস্থাপনায়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক অক্সফামের তখনকার সদর দপ্তর অক্সফোর্ডের ২৭৪ বানবারি রোডে। অক্সফামের জনসেবা কার্যক্রম শুরু হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। অক্সফামের সঙ্গে তখন জড়িত রিচার্ড এক্সলে ও হেলেন এক্সলে।
আর সে সময় এই বিপদাপন্ন বাংলাদেশি শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস। ভদ্রলোক তাঁর বিভিন্ন লেখায় বলেছে, শরণার্থী-সমস্যা ও পূর্ব পাকিস্তানের সংকট নিয়ে গোটা পৃথিবীর নিস্পৃহতা কাটাতে উদ্যোগী হয়েছিল অক্সফাম। একটি আঘাত দিয়ে পৃথিবীর বিবেককে জাগাতেই অক্সফাম বিশেষ একটি দলিল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই দলিলটির নামই দেওয়া হয় টেস্টিমনি অব সিক্সটি—ষাটজনের সাক্ষ্য। কোন ৬০ জন?
যাঁরা সংকটের ভয়াবহতা দেখেছেন, যাঁরা এই ভয়াবহ বর্ণনাতীত পরিস্থিতিতে বসবাস করছেন, তাঁদের সাক্ষ্য। এই স্বর তাঁদেরই স্বর। সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে আছেন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও মাদার তেরেসা। বরেণ্য সাংবাদিকদের মধ্যে আছেন জন পিলজার, মাইকেল ব্রানসন, ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ, নিকোলাস টোমালিন, মার্টিন উলাকট, এলেক্স হেনড্রি, অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস, ডেভিড লোসান, অ্যালান হার্ট, ক্লদ মস প্রমুখ। সাংসদদের মধ্যে রয়েছেন রেনা প্রেনটিস, জন স্টোনহাউস, বার্নার্ড ব্রেইন, জেমস রামসডেন, ব্রুস ডগলাস মান প্রমুখ।
এসব লোকের কাছে দৌড়ে দৌড়ে যাওয়া হলো। সংগ্রহ করা হলো তাঁদের সাক্ষ্য ও বিশ্ববাসীর প্রতি তাঁদের আবেদন। সবাই লেখার হাত বাড়িয়ে দিলেন। বরেণ্য চিত্রগ্রাহকেরা তাদের দুর্লভ ছবি পাঠালেন। শিল্পী জেরার্ড স্কার্ফ লেখা না পাঠিয়ে পাঠালেন কয়েকটি স্কেচ। সব মিলিয়ে দাঁড়িয়ে গেল অসাধারণ এক প্রকাশনা।
সে সময় অক্সফামের পরিচালক ছিলেন লেসলি কার্কলে। এই দুর্লভ ও মানবিক প্রকাশনাটির মুখবন্ধ লিখেছেন তিনি। কার্কলে লিখছেন, এই গল্প তাড়া খাওয়া, গৃহহারা, মৃত্যু-উন্মুখ মানুষের। যখন এ-প্রান্তে মহাপ্রলয়, বিশ্ব সম্প্রদায় উটপাখির মতো মাথা গুঁজে রাখার খেলায় ব্যস্ত।
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হলো ইতিহাসের অসামান্য এই দলিল। তত দিনে অক্সফাম পরিচালকের ভাষায় সুইডেন ও নিউজিল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার সমসংখ্যক মানুষ স্বদেশ ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে। এই দলিল প্রকাশের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন চলাকালে বিতরণ করা। উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
এই প্রকাশনা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। নাড়া দেওয়ায় আরেকটু সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন সিনেটর কেনেডি। তিনি সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থীবিষয়ক সিনেট উপকমিটির চেয়ারম্যান। একাত্তরে ভারতের সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন, শত শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেন কেনেডি। এই সাক্ষ্য দলিলে তিনি ‘দুর্দশার মোজাইক’ নামে একটি লেখা লেখেন। সেখানে জোর দিয়ে বলেন, এই ট্র্যাজেডির ব্যাপকতা পৃথিবী বুঝে উঠতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘পূর্ব বাংলার ট্র্যাজেডি কেবল পাকিস্তানের জন্য ট্র্যাজেডি নয়, এটা কেবল ভারতের জন্য ট্র্যাজেডি নয়, এটা সমগ্র বিশ্বসম্প্রদায়ের জন্য ট্র্যাজেডি।’
এটুকু বলে কাজ শেষ মনে করেননি কেনেডি। তাঁরই প্রস্তাব অনুযায়ী এই দলিলটি বাংলার সংকটের সাক্ষ্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ৯২তম কংগ্রেসের কার্যক্রমে রেকর্ডভুক্ত হয়।
এমনি করেই একাত্তরে আমাদের এই বাংলাদেশের সংকটের সঙ্গে বিশ্বকে পরিচিত করে দিয়েছেন অসামান্য কিছু মানুষ। নিশ্চয়ই এসব উদ্যোগ কোনো না কোনোভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে আমাদের সংগ্রামে।
আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে আমরা সেই উদ্যোক্তাদের নিশ্চয়ই একটা ধন্যবাদ অন্তত পৌঁছে দিচ্ছি।
এম এ মোমেন: লেখক এবং
ষাটজনের সাক্ষ্য ম্যাগাজিনের অনুবাদক। তারিখ: ১৮-১২-২০০৯
No comments:
Post a Comment