কিন্তু তিনি সাধারণ মানুষ নন। তিনি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সুভাষ মল্লিক। না, ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রাম করেননি সুভাষ। কিন্তু সেই থেকে এক স্মৃতিসৌধ নিয়ে এতগুলো বছর ধরে সংগ্রাম করে চলেছেন। তিনি অন্য রকম এক মুক্তিযোদ্ধা। যে মুক্তিযোদ্ধা ধরে রেখেছেন ১৭ এপ্রিলের স্মৃতি।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজন হলো এই আম্রকুঞ্জে। বাঁশ, চৌকি, চেয়ার, টেবিল দিয়ে তৈরি হলো মঞ্চ আর তোরণ। তৈরি হলো ইতিহাস। ইতিহাসের সাক্ষী সেই তোরণ বা মঞ্চ আজ আর নেই।
আছে একটা স্মৃতিসৌধ। আর আছেন সুভাষ মল্লিক। একেবারেই নিজের আগ্রহে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা পরিষ্কার করে রাখছেন স্মৃতিসৌধটি। আর হয়ে গেছেন দর্শনার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী ‘গাইড’!
যেকোনো পর্যটক-দর্শনার্থী গেলে তাকে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের খুঁটিনাটি তথ্য জানিয়ে দেন।
এতে খুশি হয়ে কেউ কিছু দিলে তা নেন। এভাবেই প্রতিদিন যা পান, তা দিয়েই তাঁর জীবন-সংসার চলে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি এই কাজ করে ঘরে ফেরেন। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাঁর এই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে স্মৃতিসৌধ পরিষ্কার করতে তিনি নিজের বউ বা তাঁর একমাত্র মেয়েকে পাঠিয়ে দেন।
খুলনার সেন্ট যোসেফ স্কুল থেকে ’৬৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ফেল করার পর আর্থিক অনটনের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেন সুভাষ। পরে স্থানীয় মিশনে কাজ নিয়ে একপর্যায়ে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ২৫ বছরের যুবক—যুদ্ধে যাওয়ার বয়স সুভাষের। কিন্তু যুদ্ধে যেতে পারলেন না শ্বাসকষ্টের কারণে। এর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করে অংশনিলেন স্বাধীনতাসংগ্রামে।
কিন্তু এই অংশ নেওয়া সান্ত্বনা দিতে পারল না সুভাষকে। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ না নিতে পারার দুঃখবোধ থেকে তিনি পুরোহিতের কাজের ফাঁকে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতেন। এই করতে করতে কখন যেন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল স্মৃতিসৌধটির সঙ্গে। এর মধ্যে নির্মিত হলো কংক্রিটের সৌধ। ১৯৯০ সালে পুরোহিতের কাজ থেকে অবসর নিয়ে দেহ-মন সব দিয়ে লেগে পড়লেন এই সৌধের সংরক্ষণকাজে। এখন এ-ই তাঁর জীবন।
সারা দিনে ছোটাছুটি। ক্ষণিক বিশ্রাম নেই। কারও সঙ্গে বাজে সময় কাটানোর ফুরসত নেই। যেকোনো পর্যটক-দর্শনার্থী গেলে ছুটে যাচ্ছেন। তাদের কাছে গিয়ে বলছেন, ‘এই দেখেন, ২৩টা স্তম্ভ। প্রথম স্তম্ভটি নয় ফুট উঁচু। স্বাধীনতাযুদ্ধ নয় মাসের হওয়ায় প্রতিটা স্তম্ভ নয় ইঞ্চি করে বেড়েছে। এই দেখেন লাল মঞ্চ। এখানেই দাঁড়িয়ে জাতীয় নেতারা প্রথম সরকার গঠন করে শপথ নেন। এখানে দাঁড়িয়েই অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।’
নতুন প্রজন্মের কাউকে পেলে তাঁকে আরও নিবিড়ভাবে স্বাধীনতার ইতিহাস বোঝানোর চেষ্টা করছেন। এরই ফাঁকে সৌধ চত্বরে গরু, ছাগল ঢুকলে তা তাড়ানো, গাছ থেকে পাতা পড়লে কিংবা কেউ কিছু ফেলে নোংরা করলে তা ছুটে গিয়ে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কারের কাজটি করতেও বিলম্ব করছেন না তিনি।
এই কাজ করতে গিয়ে যেমন দেশ-বিদেশের বড় বড় ব্যক্তিকে কাছ থেকে দেখেছেন, তেমনি অনেক বিচিত্র মানুষও তাঁর চোখে পড়েছে। নাম না জানা কত বিদেশি তাঁর এই কাজকে প্রশংসিত করেছে। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী খুশি হয়ে তাঁকে দুই শ টাকা দিয়েছিলেন।
এত কিছু করেন, কিন্তু সুভাষের এই কাজ থেকে নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। স্থানীয় অনেকে মনে করেন, গণপূর্তের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সুভাষকে মাস্টার রোলে অন্তত চাকরি দিতে পারে। অবশ্য এসব নিয়ে সুভাষের কোনো ক্ষোভ নেই। সুভাষের দুঃখ-কষ্ট—সবকিছু ওই সৌধ নিয়ে।
একটু মুখ কালো করে বলেন, ‘সবাই এই সৌধের মর্ম বোঝে না। অনেকে জুতা পায়ে উঠে পড়ে। আবার অনেকে ময়লা ফেলে। এসব দেখলে খুব খারাপ লাগে। বুঝিয়ে বলি লোকজনকে। কবে যে সবাই বুঝবে!’
আমরা সুভাষ হয়তো হতে পারি না। কিন্তু তাঁর এই ভালোবাসাটা কি অন্তত উপলব্ধি করতে পারি না?
তুহিন আরণ্য | তারিখ: ৩০-১০-২০০৯
No comments:
Post a Comment