Wednesday, October 6, 2010

একটি প্রত্নকীর্তির হারিয়ে যাওয়া (বাংলার মুখ)

চট্টগ্রাম শহরের পোস্তারপাড় জামে মসজিদের সামনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। এসে যা দেখলাম, তাতে হতাশ হলাম। আশা ছিল, সুলতানি যুগের পুরোনো একটি মসজিদের কিছুটা অংশের হলেও দেখা পাব। কিন্তু পুরোনো সে মসজিদ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন। তার কোনো দেখাই নেই।
নতুন মসজিদে ঢুকতেই দেয়ালের উপরাংশে সাঁটা আছে পাথরখণ্ড। রংচং করে তাকে পুরোদস্তুর আধুনিক আদল দেওয়া হয়েছে। এর উপরাংশে বাংলায় লেখা আছে, মসজিদটি বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে নির্মিত হয়েছিল। নির্মাতার নাম মজলিশ খুরশিদ। নির্মাণ সন ৯২১ হিজরি, মানে ১৫১৭-১৫১৮ সাল। পুনর্নির্মাণের তারিখ ১৪২২ হিজরি মোতাবেক ২০০১ সালের ২৩ মার্চ।
এর নিচে যে শিলালেখাটি আছে, তা হোসেন শাহের আমলের মূল মসজিদের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পুরোনো ও নিশ্চিহ্ন মসজিদটির নিদর্শন বলতে এখন শুধু এই শিলালেখাটিই অবশিষ্ট আছে।
এ বিষয়ে আলাপ হলো কক্সবাজারের ৪৩ বছর বয়স্ক আলি আহমেদের সঙ্গে। তিনি ১৯৯৯ সাল থেকে এ মসজিদে আছেন। আলাপ হলো মসজিদটির ভারপ্রাপ্ত ইমামের সঙ্গেও। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া নিবাসী ৪৮ বছর বয়স্ক এই ইমাম সাহেবের নাম হাফেজ মোহাম্মদ আলি। তিনি ২০০৪ সাল থেকে এখানে আছেন বলে জানালেন।
বর্তমান মসজিদের ভেতরে ঢুকে দেখলাম, মোজাইক করা আর টাইলস বসানো পুরোদস্তুর এক আধুনিক মসজিদ এটি। প্রাচীন মসজিদের সামান্যতম নিদর্শনের সন্ধানও এতে না পেয়ে আরও হতাশ হলাম। এ হতাশার ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরেই একটু আশার বাণী শোনালেন ইমাম সাহেব। তিনি জানালেন, পুরোনো মসজিদের রঙিন ছবি তাঁরা তুলে রেখেছেন। সেই ছবিটি আমাকে দেখাতে পারেন।
শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ফ্রেমে বাঁধানো কয়েকটি ছবি হাজির করলেন। তাতে দেখা গেল, সেই মসজিদটি ছিল এক গম্বুজবিশিষ্ট এবং তার চার কোনায় ছিল চারটি মিনার। আলি আহমদ এবং আবদুল খালেকের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, পূর্ব দেয়ালে ছিল তিনটি প্রবেশপথ। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে ছিল একটি করে আরও দুটি প্রবেশপথ। অর্থাত্ প্রবেশপথের মোট সংখ্যা ছিল পাঁচ। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে তাঁরা একটি মেহ্রাব দেখেছেন বলে জানালেন। সেই মেহ্রাবের তিন দিকে ছিল লতা-পাতার কারুকাজ। মসজিদের প্রবেশপথের ওপর মূল শিলালেখাটি লাগানো ছিল। পুরো মসজিদটি চুন-সুরকিতে গাঁথা হয়েছিল। মসজিদের ইটের মাপ ছিল লম্বায় ১২ ইঞ্চি, চওড়ায় পাঁচ ইঞ্চি ও পুরুত্বে তিন ইঞ্চি। গম্বুজের ভেতরের অংশের শীর্ষ ভাগে ছিল তারার মতো নকশা করা। মসজিদটির সামনে ছিল খোলা মাঠ। মূল মসজিদের প্রবেশপথের ওপর ছোট ছোট চারটি গম্বুজ ছিল। সেই মসজিদটিকে অধ্যাপক আবদুল করিম মোগল যুগের বলে অনুমান করেছেন। তবে শিলালেখাটি যে সুলতানি যুগের তাতে তাঁরও কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর অনুমান অনুযায়ী, মূল সেই মসজিদটি হয় এখানেই অথবা এর কাছাকাছি কোথাও ছিল। ধ্বংসপ্রাপ্ত সুলতানি যুগের মসজিদে পুরোনো শিলালেখাটি লাগানো হয়েছিল। মসজিদের দক্ষিণের জলাশয়টি সম্পর্কেও এলাকাবাসী তথ্য দিলেন। সে অনুযায়ী, জলাশয়ের উত্তর প্রান্তের পুরোনো ঘাটটি এখনো টিকে আছে। সঙ্গে সঙ্গেই ছুটলাম সেই ঘাট দেখতে। রাতের আঁধারে জ্বলে উঠল ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। পরে কম্পিউটারে ছবিটিকে স্পষ্ট করে দেখেছি চুন-সুরকিতে বাঁধানো লম্বা লম্বা সিঁড়ি নেমে গেছে এই পোস্তারপাড় দিঘির জলে। কিন্তু এই ঘাটই যে সুলতানি যুগে নির্মিত হয়েছিল, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার মতো আর কোনো প্রমাণ সেই ২০০৯ সালের ২৮ মের রাতে জোগাড় করা সম্ভব হলো না। পরেও না।
দুজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য ১৭-১৮ বছর আগে উত্তর ছাড়া বাকি তিন দিকের পাড় কেটে ভরাট করা হয়েছে। উত্তর-পূর্ব কোণের ঘটনা হোসেন শাহের আমলের। দিঘির বর্তমান আয়তন এক একর ২.৫ কানি। এর উত্তর পাড়ে মসজিদ, পূর্ব ও দক্ষিণে রাস্তা এবং দোকান, পশ্চিমে অস্থায়ী ভাড়া ঘর। এখন চারপাশের জমি ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। মূল মসজিদটির দেখা না মিললেও শিলালেখাটির দেখা পাওয়ায় দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হলো। তবে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীতে প্রকাশ্যে কীভাবে একটা বিরল প্রত্ননিদর্শনকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা সম্ভব হলো, তা ভেবে কূলকিনারা পেলাম না। 
 
খন্দকার মাহমুদুল হাসান | তারিখ: ০৮-০১-২০১০

No comments: