Monday, October 11, 2010

ওলমেক সভ্যতা (যে রহস্যের শেষ নেই)

শিখতী সানী | তারিখ: ১১-০৯-২০০৯
১৮৬২ সাল। মেক্সিকোর এক স্যাঁতস্যাঁতে জঙ্গলঘেরা জলাভূমিতে চাষাবাদের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছিলো। হঠাত্ বেরিয়ে এলো বিরাট একটা বস্তু; পাথরের বা ধাতুর। বস্তুটা দেখে চাষীদের মনে হল, জিনিসটা একটা লোহার কেটলি। চাষীদের লোভ হল, এখানে হয়তো গুপ্তধন মিলতে পারে। জোরেশোরে খোঁড়াখুঁড়ি চলতে লাগলো।
কিন্তু জায়গাটা খুঁড়ে শেষ অবধি পাওয়া গেলো পাথরের একটি ভাস্কর্যের ভাঙা মাথা। চাষীরা হতাশ হলো। কিন্তু হাসি ফুটলো প্রত্নতাত্ত্বিকদের মুখে। কারণ, প্রাচীন ওলমেক সভ্যতার প্রথম নিদর্শন এই ভাঙা-মূর্তি।
সেই শুরু। তারপর এক দীর্ঘ বিতর্কের শুরু হলো, ওলমেক সভ্যতা আদৌ কখনো ছিলো কিনা। ১৯৪২ সালে মেক্সিকোতে এক আন্তর্জাতিক প্রত্নতাত্ত্বিক সম্মেলনে অজস্র নমুনা ও প্রমাণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ওলমেক সভ্যতার অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হলেন সবাই।
নতুন সন্ধান পাওয়া এই সভ্যতার প্রাচুর্য দেখে হতবাক হয়ে গেলেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। প্রাচীন ওলমেক সভ্যতার শুরু হয়েছিলো খ্রিস্টের জন্মের প্রায় বারোশো বছর আগে। তারপর হঠাত্ করেই সেটা ধ্বংস হয়ে যায় খ্রিস্টপূর্ব চারশো সালের আগে।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, মেক্সিকোতে ওলমেক সভ্যতার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতার কথা খুব শোনা যায়, কিন্তু ওলমেক সভ্যতা এদের থেকেও বুড়ো। ওলমেক সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন থেকে পণ্ডিতরা অনুমান করছেন, অ্যাজটেক ও মায়ার বিখ্যাত সভ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই ওলমেক সভ্যতার দান গ্রহণ করেছে। ‘ওলমেক’ শব্দটি এসেছে অ্যাজটেক সভ্যতার ‘নাহুতল’ ভাষা থেকে। শব্দটির মানে ‘রাবার পিপল’। পনেরো-ষোল শতকে যারা উপসাগরীয় এলাকার নাব্যদেশে বসবাস করত তাদের এই নাম ছিল। ওলমেকদের আদিনিবাস বলা হয় আফ্রিকাকে। সেখান থেকে বহুদূরের পথ পেরিয়ে ওলমেকরা এসেছিলো আমেরিকায়।
ওলমেকদের অনেকে বলে থাকেন ‘নওবান’—এটাই নাকি ওদের আসল নাম। তাদের সুক্ষ খোদাইয়ের কাজ, বিরাট ভাস্কর্য, ভাষার ব্যবহার, শূন্য আবিষ্কার, গণিতশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য এবং বর্ষপঞ্জী প্রত্নতাত্ত্বিকদের চমক লাগিয়ে দিয়েছে। পরবর্তী বিখ্যাত সভ্যতাগুলোর মতোই তারা পুরো ৩৬৫ দিনের এক দিনপঞ্জিকা মেনে চলতো। ওলমেকদের ছিলো পিরামিড বানানোর দক্ষতা। পশ্চিমা দুনিয়ায় ওলমেকরাই সম্ভবত প্রথম জাতি, যারা নিজেদের একটি লিখন-পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলো। মায়া সভ্যতার বর্ণমালা ওলমেক সভ্যতার প্রভাবেই গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়।
ওলমেকদের চারটি শহরকে চিহ্নিত করা গেছে—লাগুনা দো লোজ সেরম, সান লোরেনজো, তে জাপাও আর লা তোনও। এগুলো প্রতিটিই উন্নত স্থাপনায় ও শৈলীতে সমৃদ্দ। প্রথমদিকে তারা অন্যান্য কৃষিনির্ভর সভ্যতার মতোই শস্য উত্পাদন করতো। পরবর্তীতে হঠাত্ করেই তারা বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বাণিজ্যের প্রয়োজনে যাতায়াতের বিভিন্ন পথ তারা খুঁজে বার করে।
ওলমেক সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি ঘিরে কিছু অদ্ভুত রহস্য আছে। ওলমেকরা মনে করতো জাগুয়ার বা আমেরিকার এক ধরনের হিংস্র বাঘ সকল শক্তির আধার। জাগুয়ারের মৃত্যু হলে সেই আত্মা বেরিয়ে আসে পৃথিবীতে। ভাস্কর্যসহ এ সভ্যতার বহুমূল্য সব নিদর্শন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরে ১৯৯৬ সালে এক বিরাট প্রদর্শনী হয়।
সব হল। কিন্তু অনেক প্রশ্নের উত্তর যে এখনো মিলল না। আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় তারা এলো কিভাবে? ওলমেকরা কীভাবে এতো তাড়াতাড়ি সব কিছু শিখে ফেললো? তাদের এই বিচিত্র ভাস্কর্যবিদ্যার উত্স কী? রাতারাতি এ সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেলো কেমন করে! আর এই সভ্যতার প্রানরস কীভাবে পৌঁছে গেলো মায়া আর অ্যাজটেক সভ্যতার ধমনিতে?
এসব প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। আদৌ কোনোদিন মিলবে তো?

No comments: