তিরতির করে জল বইছে, ঝিরিঝিরি শব্দ কানে আসছে, ঝিঁ ঝিঁ করে পোকারা ডাকছে। এ ছাড়া পাহাড়ে আর কোনো শব্দ নেই। শনশন বাতাসে দুলছে তকমাগাছের ঝোপ, আর সে ঝোপ থেকে তকমাপাতার ঘ্রাণ আসছে বাতাসে। তাই বাতাসটাও বেশ মিষ্টি ঘ্রাণে ভরে উঠছে। সুউচ্চ আলুটিলার ওপরে পাকা বেঞ্চিতে বসে জোরে জোরে সেই সুগন্ধময় বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছি প্রাণভরে। আহ্, ঢাকায় এ রকম বিশুদ্ধ সুগন্ধময় বাতাস কখনো পাই না। কিছুক্ষণ আগেই দম বন্ধ হওয়া ঘুটঘুটে অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে আলুটিলা গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছি। তাই শরতের এই ফুরফুরে বাতাসে যেন দেহমন জুড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ চলে যাচ্ছে দূরে, নিচে ওই ছোট ছোট দালান-কোঠা দিয়ে সাজানো পাহাড়ি শহর খাগড়াছড়ির দিকে। শহরটার মধ্য দিয়ে চেঙ্গি নদী এঁকেবেঁকে চলে গেছে। অপূর্ব সেই নীলাভ-সবুজ দৃশ্য!
একটু দম নিয়ে জিরিয়ে নিতেই এর চেয়েও সুন্দর দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। সবুজ শ্যামল তরুলতায় ঢাকা পাহাড়ের শরীর। কচি কচি সবুজ ফসলের মাখামাখি সবুজ পাহাড়ের বুকজুড়ে। জুম চাষ। কচি ধানগাছগুলো তার পাতা ছেড়ে ঐশ্বর্যের বিজয়বার্তা ঘোষণা করছে। ধানের মধ্যে শসার মতো গাছ, মারফা ওর নাম। আরও আছে হলুদ, তিল, তুলা, মরিচ, বরবটি—কী নেই সে জুমে? পাশের পাহাড়ে বর্শার ফলার মতো হলুদগাছ মাথা তুলছে, কদিন পরই দেখতে দেখতে ওরা আমার সমান হয়ে যাবে। হলুদগাছের ফাঁকে ফাঁকে ডুমুর-শিম (অড়হর), খনাগোলা (সোনা) গাছেরা তরুণ ডালপালা মেলে আড়মোড়া ভাঙছে। বর্ষা শেষে কী যে সবুজে তন্ময় হয় পাহাড়ের বুক! আর সেসব পাহাড়ের বুকে, জুমে কাজ করছে জুমকন্যারা।
এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে আনমনে নেমে গেছি ওসব পাহাড়ের বুকে, টের পাইনি। খাড়া সেসব পাহাড়ে কী করে যে জুমকন্যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে জুমের আগাছা পরিষ্কার করে, জুম ফসলের যত্ন নেয়—ভাবতে ঘোর লাগে। ওই উঁচু পাহাড় থেকে নিচে তাকালে পরান কাঁপে, পা ফসকে পড়ে গেলেই আলুর দম। কিন্তু ওতে ওদের কোনো ভয় নেই যেন। দিব্যি সমতল ভূমির মতো কাজ করে চলেছে। ওপর থেকে রং-বেরঙের থামি, ব্লাউজ আর খবং পরা জুমকন্যাদের দেখে সবুজ বাগানে রঙিন পাহাড়ি ফুলের মতোই লাগে। মনে হয়, ছোট ছোট কলের পুতুল কার ইশারায় যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। নির্জন সেই পাহাড়ের বুকে পাখির কলরব, ঝরনার জলপতনের শব্দ, পোকাদের ডাকাডাকি। একমনে জুমকন্যারা কাজ করে চলেছে। নামতে নামতে ঠিক ওদের কাছেই চলে গেলাম। পথে জংলি আগাছার ঝোপ, সাপের উপদ্রব, পথহীন আলগা মাটির ঢাল—কোনো কিছুই যেন আমাকে ধরে রাখতে পারল না। তরতর করে বেড়ে উঠছে ধান ও সবজি গাছেরা, মসলা ফসলও। এক জুমকন্যা জুমের মাটিতে উপুড় হয়ে বসে তাগল (পাহাড়ি দা) চালাচ্ছে। জুমের ফসল নানা রকম আগাছায় ঠেসে ধরেছে। এখনই সেগুলো সরাতে না পারলে আগাছারাই ফসল খেয়ে ফেলবে। আর পরিবারসহ জুমকন্যাদের সারা বছর হয়তো না খেয়ে কাটাতে হবে। তাই জুমিয়ারা এখন ভীষণ ব্যস্ত জুম সাফে। কাছে গিয়ে জুমকন্যার নাম জানতে চাইলাম। পাড়াটার নামও। কিন্তু সে কোনো কথাই বলল না। বয়স আন্দাজ আঠারো-কুড়ি হবে, শক্ত-সমর্থ শরীর, উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং, খাটো গাট্টাগোট্টা হাত-পা। মনে হলো, সে একজন টিপরা তরুণী। যতই তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম, কোনো জবাব পেলাম না। ভাবলাম, হয় সে বাংলা জানে না, নতুবা প্যাঁচাল পেড়ে অযথা সময় নষ্ট করতে চায় না। পাশের জুমে আর একজন জুমকন্যা কাজ করছেন। বয়স্ক। হাঁক দিলাম, দিদি একটু আসতে পারি? হাঁক শুনে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে দেখলেন। তারপর খড়ের একটা বিড়া থেকে আগুন নিয়ে ডাব্বার কলকি ধরিয়ে ঘড়াৎ ঘড়াৎ টানতে শুরু করলেন। অনুমতি দিলেন কি দিলেন না, বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আমি আর অনুমতির অপেক্ষা না করে তাঁর কাছে পৌঁছে গেলাম।
কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, ‘কেমন আছেন? কখন এসেছেন জুমে? কাজ কি শেষ? চলে যাবেন?’ কথা শুনে মাথা কাত করলেন। কথায় কথায় জানা গেল, তিনি একজন টিপরা নারী। কাছের বড়পাড়া টিপরাপল্লিতে তাঁর বাড়ি। এখান থেকে সেটা প্রায় পাঁচ মাইল দূরে। ভোরের আলো ফোটার আগেই জুমে কাজ করার জন্য চলে এসেছেন। আন্দাজ ১১টা পর্যন্ত এখানে থাকবেন। তারপর চলে যাবেন। খুব ভালো বাংলা বলতে পারেন না, তবে সব কথা বুঝতে পারেন। জুমে ধানের সঙ্গে বিনি মকাই (ভুট্টা), আদা ও হলুদ চাষ করেছেন। এবার আদা-হলুদের দাম বেশি। এ রকম দাম থাকলে এবার জুম থেকে ভালো লাভ হবে। দেখতে দেখতে তিনি একটা থুরংয়ের ভেতরে কিছু শাকপাতা ভরে নিলেন। বললেন, ‘জুমটা হলো আমাদের বাজার। বাজারে যেমন নানা রকম জিনিস পাওয়া যায়। জুমেও তেমনই। লবণ-তেল ছাড়া আর সবই এখানে পাই। ঝিরি থেকে পাই মাছ।’ থুরংটাকে পিঠে করে এবার রওনা দিলেন। এক হাতে তাগল, অন্য হাতে ডাব্বা (হুক্কা)। প্রকৃতির সঙ্গে জুমকন্যার সেই অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্যের ছবি তোলার আর সাহস হলো না, সে অনুমতিও পেলাম না।
সুত্র: প্রথম আলো। মৃত্যুঞ্জয় রায় | তারিখ: ১৯-১০-২০১০
No comments:
Post a Comment