Monday, December 27, 2010

ঘুড়ির দুনিয়া

ঘুড়ি ওড়ানোর মধ্যে রয়েছে এক অন্যরকম আনন্দ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ঘুড়ি ওড়ানো একটি জনপ্রিয় খেলা। তবে ঘুড়ি শুধুই যে ছোটরা ওড়ায় তা কিন্তু নয়, বড়রাও ঘুড়ি উড়িয়ে থাকেন।

ঘুড়ির আবিষ্কার হয়েছিল কোথায়? কে এই সুন্দর খেলার বস্তুটি আবিষ্কার করেছিলেন? তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে শোনা যায় ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের ট্যারাস্টাস শহরের আর্কিটাস নামে এক ভদ্রলোক প্রথম ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হান সিন নামে চীন দেশের এক সেনাপতিই প্রথম ঘুড়ি তৈরি করেন। আগে সিল্ক কাপড় দিয়ে ঘুড়ি তৈরি হতো। কাগজ আবিষ্কারের পর কাগজের ঘুড়ি তৈরি শুরু হয়।

ইউরোপ বা আমেরিকায় ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ থাকলেও চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেই এই খেলার জনপ্রিয়তা বেশি। যদিও আকাশ পরিষ্কার থাকলে ও অনুকূল বাতাস পেলেই ঘুড়ি ওড়ানো যায়, তবুও পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই একটি বিশেষ দিনকেই ঘুড়ি দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এদিন সবচেয়ে বেশি ঘুড়ি আকাশে উড়তে দেখা যায়। সবাই এই বিশেষ দিনটির কথা ভেবেই যেন নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকেন।

চীন দেশে ঘুড়ি দিবসের দিন সব বয়সের নারী ও পুরুষ ঘুড়ি উড়িয়ে থাকেন। বিচিত্র বর্ণের, বিচিত্র আকারের অসংখ্য ঘুড়ি সারা আকাশ রাঙিয়ে তোলে। ওদেশের ঘুড়িগুলোর রং ও আকার আমাদের দেশের ঘুড়ির চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। রংবেরংয়ের সুন্দর মাছ, প্রজাপতি, ড্রাগন, পাখি, মানুষ, পরী, জাহাজ ইত্যাদি প্রায় তিনশ রকমের ঘুড়ি আকাশে উড়তে দেখা যায়। আর সবচেয়ে মজার ঘুড়ি হলো লণ্ঠন ঘুড়ি। রাতেরবেলায় এই ঘুড়ির মধ্যে লণ্ঠন বসিয়ে ওড়ানো হয়। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এরকমই বিভিন্ন ঘুড়ি দিবসে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। প্রতিবছর পুরান ঢাকায় সাকরাইন উৎসবে ঘুড়ি ওড়ানো অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। বিচ্ছিন্নভাবে সারা দেশে নিয়মিতই চলে ঘুড়ির উৎসব। ঢাকায় কিছু সংস্কৃতিসেবী প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করে আসছে।

আমাদের দেশের ঘুড়ি এবং ভারতীয় ঘুড়ির মধ্যে খানিকটা মিল রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে ভারতের একাধিক প্রদেশে অভিনব রকমের ঘুড়ির দেখা মেলে। এসব ঘুড়ির সঙ্গে মালয়েশিয়ার ঘুড়ির কিছু মিল দেখতে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে দুইটি কাঠি দিয়ে তৈরি বর্গাকৃতির ঘুড়ি যার আকারগত কোনো বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় না। কেবল নানা রংয়ের কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনে তৈরি করা হয়ে থাকে। ডিজাইন মতো তাদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয়, যেমন চাঁদিয়াল, ঢুপিয়াল, ঘয়লা, চৌরঙ্গি ইত্যাদি। ভারতবর্ষের অন্যত্র বিভিন্ন দেশের নেতা বা সিনেমার নায়কদের ছবি ঘুড়িতে লাগিয়ে ওড়ানো হয়ে থাকে।

উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে নানা রকমের ঘুড়ি দেখা গেছে। যেমন কানকাওয়া, চংগ, তুলকল, পতংগ, গুড্ডি প্রভৃতি। এসব ঘুড়ি তৈরি করা ছিল যেমন শ্রমসাধ্য তেমনি খরচ সাপেক্ষ। দিলি্লর রাজা শাহ আলমের আমল থেকেই ঘুড়ি ওড়ানোটা ভারতবর্ষে খেলা হিসেবে মনে করা হয়। নবাবী আমল ছিল পেশাদার ঘুড়ি উড়িয়েদের সুবর্ণ যুগ। তখন ঘুড়ি ওড়ানোর ওপর বাজি ধরা হতো যা হতো উড়িয়েদের প্রাপ্য।

ঘুড়ির প্যাঁচ বা কাইট ফাইটিং প্রায় সব দেশেই খেলা হয়ে থাকে। তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে মাতামাতি হয় থাইল্যান্ডে। ওখানে ঘুড়ির লীগ প্রতিযোগিতা হয়। শীতকালে এ ধরনের প্রতিযোগিতা দেখা যায়।

ঘুড়ি ওড়ে কিভাবে? ঘুড়িতে সুতো দিয়ে মাটি থেকে নিচের দিকে টান দেওয়া হয়। আর ঘুড়ির ওপর উর্ধ্বমুখী কাজ করে বাতাসের আকর্ষণ শক্তি। এই দুটি টান যতক্ষণ সমান থাকে ততক্ষণ ঘুড়ি আকাশে উড়তে পারে। শুধু খেলার সামগ্রী হিসেবে পরিচিত হলেও অনেক সময়ে এই ঘুড়িই বিজ্ঞানের নানা গবেষণায় সাহায্য করেছে। যেমন ১৭৪৯ সালে আলেকজান্ডার উইলসন ঘুড়িতে থার্মোমিটার লাগিয়ে ঊর্ধ্বাকাশের তাপমাত্রা নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন। ১৯০১ সালের ১২ ডিসেম্বর ঘুড়ির মধ্যে অ্যান্টেনা লাগিয়ে নিউফাউন্ডল্যান্ডের বৈজ্ঞানিক মার্কনি আকাশের ইলেকট্রোম্যাগনেটিভ ওয়েভ ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭৫২ সালে বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন আকাশে একটি সিল্কের ঘুড়ি উড়িয়ে তার সাহায্যে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত বিদ্যুৎ ও আকাশের বিদ্যুৎ যে এক তা প্রমাণ করেছিলেন। যুদ্ধের নানা কাজেও ঘুড়ি ব্যবহার করা হয়েছে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে। 
আমিন রহমান নবাব
মুলসুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&type=gold&data=Football&pub_no=239&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=0 

Tuesday, December 21, 2010

হাছন রাজা বৃত্তান্ত


  ২১ ডিসেম্বর ২০১০ [৭ পৌষ ১৪১৭ বঙ্গাব্দ] মরমী কবি দেওয়ান হাছন রাজার  জন্মদিন। ১২৬১ বাংলা সনের (১৮৫৪ খ্রি.) এই তারিখে সুনামগঞ্জের লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়নের তেঘরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলার বিশ্বনাথের রামপাশায়। পিতা জমিদার দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী, মাতা মোসাম্মৎ হুরমত জাহান বেগম। হাছন রাজা ছিলেন জমিদার বংশের সন্তান। তার পূর্বপুরুষ ছিল হিন্দু রাজবংশের উত্তরাধিকারী। সিলেটের রামপাশা ও ভাটি অঞ্চল নামে খ্যাত সুনামগঞ্জের লক্ষ্মণশ্রী বিস্তৃত ছিল তাদের রাজত্বকাল। কিন্তু হাছন রাজা রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেও সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন চলনে-বলনে। রাজকীয় আড়ম্বরে চলাফেরা ছিল তার খুবই অপছন্দনীয় বিষয়। তিনি প্রাচীন ঋষিদের মতো শব্দ নিয়ে খেলা করতেন। সে কারণে তাকে 'রাজর্ষি' বলা হতো। ঋষিদের শব্দব্রহ্ম ছিল মূলত ঈশ্বর ও অতীন্দ্রিয় জগৎ নিয়ে তেমনিইভাবে হাছন রাজাও সেরকম ভাবনায় থাকতেন। হাছন রাজার ভাবনা ছিল মূলত মানুষ, জীবন ও জগৎ নিয়ে। তার গান বা কবিতার ছত্রে ছত্রে এ দর্শনই ফুটে উঠে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দর্শনকে উপলব্ধি করে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিভিন্ন বক্তৃতায় হাছন রাজার কথা তুলে ধরতেন। হাছন রাজার দর্শন সুফিবাদ প্রভাবিত ছিল। তিনি যখন বলেন, 'মম আঁখি হইতে পয়দা হইলো আসমান জমিন।' সেটা স্মরণ করিয়ে দেয় সুফি দার্শনিকের 'আইনাল হক'কে।

কথিত আছে, তিনি চিশতিয়া তরিকার এক আধ্যাত্মিক গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যকে প্রেম-ধর্মের বন্যায় ভাসিয়ে নিয়েছিলেন। হাছন রাজার প্রেমসত্তার অনুভূতি ছিল প্রবল। এছাড়া তিনি আকৃষ্ট ছিলেন বাংলার বাউল ধারায়। নিজেই নিজের গানে বলেছেন, 'বাউলা কে বানাইল রে,

হাছন রাজারে বাউলা কে বানাইল রে...।'

হাছন রাজা বাউলদের মতো জীবনযাপন করেননি। তিনি সংসারী ছিলেন। বৈষয়িক জ্ঞানও যে তার খুব কম ছিল, তাও বলা যাবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই বাউলসত্তাকে লালন করতেন। সহজ-সরল অনাড়ম্বর চলাফেরায় বাউলদের নৈকট্য অনুভব করতেন। সামন্তবাদী পারিবারিক কাঠামোয় বাউলদের জীবনপদ্ধতি অনুসরণ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। হাছন রাজার দৌহিত্র দার্শনিক জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেন, বাউল-ভাবনা থাকলেও হাছন রাজা বাউল ছিলেন না। বাউল দর্শন যে তাকে প্রভাবিত করেছিল, সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। একবার এক অতিথি হাছন রাজাকে ঘর কোথায় জিজ্ঞাসা করলে তিনি কবরস্থান দেখিয়ে বলেন, এটাই আমার ঘর। তিনি এলাকার বাইরে সফরে থাকা অবস্থায় তার ইংরেজ কর্মচারী পাকাঘর বানানোর চেষ্টা চালায়। ফিরে এসে এটা দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ ভেঙে ফেলার হুকুম দেন এবং ইংরেজ কর্মচারিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। এগুলো পর্যালোচনা করলে হাছন রাজার পাকা ঘরে নিরাসক্তির কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। হাছন রাজার জীবনদর্শন আলোচনা করলে একই সঙ্গে একজন রাজা এবং একজন ঋষিকে খুঁজে পাওয়া যায়। হাছন রাজা ২২ অগ্রহায়ণ ১৩২৯ বাংলায় (১৯২২ সাল) মৃত্যুবরণ করেন। 

 শাহ্ মো. আখলাকুর রহমান
মুলসুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&type=gold&data=Download&pub_no=234&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=0

Monday, December 20, 2010

বছরশেষে প্রজন্মের আলোচিত মুখ (উইকিলিকস ও এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ)

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত মুখ_উইকিলিকস ও এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। ২০০৬ সালে জন্ম নেওয়া উইকিলিকস নামের নব্য এ প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎ করেই আলোচনার শীর্ষে আসে দুনিয়া কাঁপানো সব গোপন তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে। বিভিন্ন দেশের গোপন তথ্য প্রকাশের এ কার্যক্রম শুরু করা হয় চলতি বছরের ২৮ নভেম্বর থেকে। প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দেশগুলোতে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়ে যায়, দেখা দেয় নিরাপত্তা হুমকি। তবে আইনি সব জটিলতার ফাঁক খুঁজে অবশেষে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয় ৩৯ বছর বয়সী উইকিলিকস-এর এ প্রতিষ্ঠাতাকে। যিনি একাধারে সাংবাদিক, প্রকাশক, প্রোগ্রামার, একজন হ্যাকার এবং সর্বশেষ এই প্রজন্মের এক ভিন্ন প্রত্যয়ী মুখ। তাকে নিয়ে লিখেছেন প্রাঞ্জল সেলিম

অল্পবয়সেই এমন সাহসিকতার পরিচয় দেওয়া লোকটির জন্ম অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের টাউনভ্যালিতে। তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে ম্যাগনেটিক আইল্যান্ড নামক জায়গায়। জুলিয়ান তার শৈশবকালে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেই সুবাদে অনেক স্কুলেই তার পড়া হয়েছে। কখনও আবার তাকে ঘরে বসে মাস্টার দিয়ে পড়ালেখা চালাতে হয়েছে। শৈশবটা কেটেছে তার সংগ্রাম করে। ইউনিভার্সিটি পরিবর্তনের ব্যাপারেও তার যথেষ্ট খ্যাতি আছে। তিনি মোটামুটি ৬টির মতো ইউনিভার্সিটি বদল করেন। সেগুলোতে ২০০৩ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পদার্থ ও গণিত নিয়ে পড়ালেখা করেন। এবং শেষ পর্যন্ত ঠিকানা হয় মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি। তার নিজের যে ওয়েবসাইট, তাতে তিনি তার ২০০৫ সালের পদার্থ বিষয়ের প্রতিযোগিতার কথা উলেস্নখ করেন। সেই সাথে তার পড়াশোনার ব্যাখ্যাও সেখানে রাখেন। আরো জানা যায়, তিনি ফিলোসফি ও নিউরোসাইন্স নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। ১৩ বছর বয়সে মায়ের কাছ থেকে উপহার পাওয়া কম্পিউটারটি দিয়েই তার মূলত হাতেখড়ি। এরপর একটু বড় হলে শুরু করেন হ্যাকিং।

অ্যাসাঞ্জের পরিবার ভাগ্য

পরিবার বলতে তার প্রেমিকা ও একটি ছেলে। ছেলের নাম ড্যানিয়েল। ১৯৮৯ সালে তিনি তার প্রেমিকা ও ছেলে নিয়ে আবাসন শুরু করেন। কিন্তুু ১৯৯১ সালের হ্যাকিং বিষয়ক এক ঘটনার কারণে তাদের মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়। পরের কয়েক বছর সেই সম্পর্কচ্ছেদের জের ধরে ছেলের কাস্টাডি নিয়ে মামলা চলতে থাকে।

ক্যারিয়ারের শুরুতে অ্যাসাঞ্জ

তার ক্যারিয়ার জীবনের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে হ্যাকিং প্রসঙ্গ। ১৯৮৭ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি তার জীবনের প্রথম হ্যাকিং করেন ম্যানড্যাস্ক পরিচয়ে। তার মতো আরো দুজন হ্যাকারের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি ইন্টারন্যাশনাল সারভারসিভস নামে একটা গ্রুপ তৈরি করেন। ১৯৯১ সালে তার হ্যাকিং কার্যক্রম ধরা পরে অস্ট্রেলিয়ান পুলিশের কাছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি তার ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার ব্যবহার করে ক্যানাডিয়ান টেলিকমিউনিকেশান কোম্পানি ও সেই সাথে ছোট কিছু কোম্পানির ওয়েবসাইট হ্যাক করেন। পরবর্তীতে 'আমি আর কখনোই হ্যাকিং করবো না' এমন শর্তে মুক্তি পান। এ ঘটনার পরে তার তেমন কোনো উলেস্নখযোগ্য খবর ছিলো না। ১৯৯৩ সাল নাগাদ তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রথম আইএসপি কোম্পানিতে যোগদান করেন। এরপর প্রায় এক বছর পর ১৯৯৪ থেকে শুরু করে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি মেলবোর্নের এক প্রোগ্রামিং কোম্পানিতে ওপেন সোর্স সফটওয়্যারের কাজ করেন। তিনি কয়েকটি নতুন ফাইল পঁ্যাচ তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। সেই সাথে তিনি 'আন্ডারগ্রাউন্ড :টেলস অব হ্যাকিং' ও 'ম্যাডনেস অ্যান্ড অবসেশন অন দ্য ইলেক্ট্রনিক ফ্রন্টিয়ার' নামের দুটি বই লেখেন। ১৯৯৭ সালে তিনি লিনাক্সের জন্য নতুন কনসেপ্ট নিয়ে আসেন। তিনি আসলে চেয়েছিলেন এমন এটা সফটওয়্যা টুল বানাতে, যা হিউম্যান রাইটসের কাজে ব্যবহার হতে পারে। এরপর তিনি ওয়েব বেইজড সার্চ ইঞ্জিনের কাজে হাত দেন। সেই কাজ করতে গিয়ে তিনি ১৯৯৯ সালে রিকস ডট ওআরজি নামের একটা ডোমেইন কিনে রাখেন। কিন্তুু তিনি তখনও সেই ডোমেইন নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেন নি।

উইকিলিকসের জন্মের কথা

২০০৬, এক ইতিহাস গড়ার কারখানার সৃষ্টির বছর। উইকিপিডিয়া আমাদের সবার পরিচিত একটি নাম। এক বাক্যে বিশাল তথ্যের ভাণ্ডার। তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে দেশে জবাবদিহিতাকে শক্তিশালী ও সরকারের কাজে স্বচ্ছতা আনার জন্য একই পথে হাঁটা শুরু করা আরো একটি তথ্যভাণ্ডারের নাম উইকিলিকস। তবে তা শুধু গোপন তথ্য প্রকাশের ভাণ্ডার। এই ওয়েবসাইটটিও উইকিপিডিয়ার আদলে তৈরি। এর জন্মলগ্নেও ঘোষণা দেওয়া হয় যে, তা উইকিপিডিয়ারই গোপন এক ভার্সন। উইকিলিকসে কাজ করেন মোট ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবী ও প্রায় ৮ শত কমর্ী। উইকিলিকস নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলা যায়, এটা একটা সাধারণ সংস্থা, যা দিয়ে কোনো আয় হয় না। তাদের মূল লক্ষ্য জনসাধারণের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য ও খবর পেঁৗছে দেওয়া, যা সাধারণত সবার কাছে লুকিয়ে রাখা হয়। তাদের কাজের মূল অংশ হলো প্রমাণসহ সত্য প্রকাশ করা। প্রতিষ্ঠানটি নতুন হলেও খুব দ্রুতই এর বিস্তার ঘটেছে। ২০০৭-এ প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই তা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খবর প্রকাশ শুরু করে দেয়। সাথে প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে করা হয় এ খবরগুলো বিস্তরভাবে প্রচারের জন্য। আর এই কারণে উইকিলিকসকে প্রায়ই মুখোমুখি হতে হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যায়। খবরগুলো মুক্তভাবে প্রকাশে বাধা দেওয়া হয়েছে প্রতিটা পদক্ষেপেই। কিন্তুু তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি নির্ভীকভাবে তথ্যগুলো প্রকাশ করেছে এবং এখন পর্যন্ত করেই চলেছে। হিউম্যান রাইটসের শর্ত ধরেই এত কিছু_এমনটাই মনে করেন উইকিলিকসের সদস্যরা। সাইটে একটি আর্টিকেলের কথা বলা হয়েছে, যা সাংবাদিক ও স্বেচ্ছাসেবীদের উৎসাহিত করে। সকলেরই জানার অধিকার আছে এবং বলার অথর্াৎ মতামত জানাবার অধিকার আছে। আর এই খবর সকলের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে উইকিলিকস।

উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতাকে গ্রেপ্তার করে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। কারণ, সম্প্রতি উইকিলিকস কিছু অধিক গুরুত্বপূর্ণ নথি প্রকাশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ সম্পর্কে রয়েছে এমন গোপন কিছু তথ্য, যা দেশগুলোকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে। জানা গেছে, এই ঘটনায় হিলারি ক্লিনটন বাধ্য হয়েছেন সকলকে ফোন করে ক্ষমা চাইতে। ৫ ডিসেম্বর রোববার সর্বশেষ তথ্য ফাঁসের পর অবশ্য প্রতিষ্ঠাতা অ্যাসাজ নিজেই আত্মসমর্পণ করেন। খবর সংগ্রহের বড় উৎস হিসেবে ধরা হয়েছে হ্যাকিং। এছাড়াও খবরের উৎস হিসেবে মার্কিন কিছু সিনিয়র কর্মকর্তারও জড়িত থাকার কথা বলা হচ্ছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, সাবেক মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা ব্র্যাডলি ম্যানিং রয়েছেন এর পেছনে। ধারণা করা হচ্ছে, বিখ্যাত গায়িকা লেডি গাগার গানের সিডি থেকে গান সরিয়ে তাতে গোপন বার্তাগুলো তুলে নেওয়া হয় এবং পেঁৗছে দেওয়া হয় উইকিলিকসের তথ্যভাণ্ডারে। উলেস্নখ্য, শেষ পর্যন্ত জামিনে মুক্তি পেয়েছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ।

উইকিলিকসের সত্যিকারের ডোমেইন নিয়ে অনিশ্চয়তা

মজার এক তথ্যে জানা গেছে যে, এ সত্য প্রকাশে নিভর্ীক প্রতিষ্ঠানটির অনলাইনে যে সংস্করণ আছে, তার ডোমেইনের (উইকিলিকস ডট ওআরজি) মালিক কে, তা এখনও অজানা। প্রতিসমানটির মূল ঠিকানাটি গত ৩ ডিসেম্বর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরে তা নতুন এক ঠিকানায় চলে গেছে, কিন্তু তথ্য প্রচার কাজ এখনও চলছে। ডট ওআরজি ঠিকানাটি একটা থার্ড পার্টির ঠিকানা দিয়ে রেজিস্টার করা হয়েছিল, যার আইডেনটিটি জানা নেই কারও। তবে এই সাইটের অসংখ্য ঠিকানা রয়েছে, এমনকি এতে যারা কাজ করে, তাদের নিজেদেরও নিজস্ব সাইট ঠিকানা রয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে অর্জিত কিছু পুরস্কারের কথা

অ্যাসাজ পল, দুনিয়ার বুকে সাড়া জাগানো এ মানুষটি বিভিন্ন সময়ে পুরস্কারও পেয়েছেন।

২০০৮ সালে ইকোনোমিস্ট পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তাকে।

২০০৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া পুরস্কারটিও তার ভাগ্যে আসে।

২০১০ সালে স্যাম অ্যাডাম অ্যাসোসিয়েশন থেকে স্যাম অ্যাডাম অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় তাকে, অ্যাকাডেমিতে তার দক্ষতা ও কাজের জন্য। সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পৃথিবীর ৫০ জন প্রভাবশালী মানুষের মধ্যে ২৩তম অবস্থানে আসেন। বিভিন্ন ম্যাগাজিনেও তাকে নিয়ে লেখালেখি করা হয়। এমনকি রাশিয়া থেকে অফিসিয়ালি তাকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু হোয়াইট হাউস সে প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। তারা অভিমত দেয় যে, অ্যাসাজ এর আচরণ বেপরোয়া। নভেম্বরের শুরুর দিকে তার আলোচনা স্থান পায় উটনি রিডার নামক ম্যাগাজিনে, যাতে তার নাম আসে সেই সব ২৫ জন মানুষের মাঝে, যাদের কাজ পৃথিবীতে পরিবর্তন এনেছে। সবশেষে ৭ ডিসেম্বর নিউইয়র্কের টাইমস ম্যাগাজিনে তাকে 'পারসন অব দ্য ইয়ার' আখ্যা দেওয়া হয়।

অ্যাসাঞ্জের সমালোচনা

শুধু যে সমর্থন ও স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন অ্যাসাঞ্জ, তা নয়। তাকে বিভিন্ন দেশের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে অসংখ্যবার। সেই সাথে শিকার হয়েছেন সমালোচনারও। তার সাংবাদিক পরিচয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞগণ। উইকিলিকস ওয়েবসাইটে যে নথিপত্র প্রকাশ করা হয়, তা সব সময় পুরোপুরি প্রকাশ করা হয় না। যেমন, ২০০৭ সালে বাগদাদে মার্কিন হেলিকপ্টার হামলায় প্রাণহানির যে ভিডিওচিত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল, তা ছিল কিছুটা সম্পাদিত। হেলিকপ্টার থেকে যাদের উপর হামলা চালানো হয়, তাদের একজনের হাতে ছিল রকেটচালিত গ্রেনেট লঞ্চার। কিন্তুু উইকিলিকসের প্রকাশিত চিত্রে ওই লোকের ছবি বাদ দেওয়া হয়। সেই অর্থে অনেকেই অ্যাসাঞ্জের কাজের পদ্ধতি নিয়ে সন্ধিহান। ফ্রিডম অব দ্য প্রেসের নির্বাহী পরিচালক লুসি ডালগ্রিস বলেছেন, 'ইহা সাংবাদিকতা নয়, তথ্যের বিতরণ মাত্র।' তবে অ্যাসাঞ্জও শক্ত ভাষায় এর জবাব দিয়েছেন, 'আমি সাংবাদিক কি না, তাতে কার কী যায় আসে। তথ্য প্রকাশই আমার মূল লক্ষ্য।'

বাংলাদেশও বাদ গেল না অ্যাসাঞ্জের তালিকা থেকে

জানা গেছে, ওয়েবভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্রনীতিসহ গোটা বিশ্বের যে আড়াই লাখ নথি ফাঁস করার উদ্যোগ নিয়েছে, তার মধ্যে ২,১৮২টি ফাইল বাংলাদেশের। আরো বলা হয়, ১৯৬৬ সাল থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দেশটির ২৭৪টি দেশের দূতাবাসের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া নথি প্রকাশ পেতে যাচ্ছে। সেই সম্পর্কিত লেখচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। মোট ৪৫টি দূতাবাস সেখানে স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে ৩৭ নম্বর স্থানে আছে ঢাকায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস।

সার্বিক বর্তমান পরিস্থিতি

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে আটক করা হলেও তার প্রতিষ্ঠানটির তথ্য প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়নি। তার সমর্থকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিনটি সার্ভারের মাধ্যমে ক্রমাগত তথ্য প্রকাশ করেই চলেছে। সম্প্রতি জানা গেছে, তারা সুইডেনের মাস্টারকার্ড ব্যাংকিং ওয়েবসাইটগুলোতে সাইবার হামলা চালিয়েছে। এক অর্থে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে অ্যাসেঞ্জকে আটকের প্রতিবাদ হিসেবে, এমনটাই জানা গেছে বিভিন্ন সূত্র থেকে।

সর্বশেষ খবর জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়া তাকে কূটনৈতিক সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে। সেই সাথে পল ঘোষণা দিয়েছেন, তাকে গুপ্তহত্যা করা হলে আরো স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশ করা হবে। গোপনীয়তা ও সত্যের এ লড়াইয়ে কে জয়ী হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে যাই ঘটুক, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি শুধু ২০১০ নন; বরং এক শতকের সব থেকে আলোচিত ব্যক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছেন।
 
মুলসুত্র: http://ittefaq.com.bd/content/2010/12/20/news0132.htm

Sunday, December 19, 2010

মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ে কেন


কোনো খারাপ খবর শুনে, খুব বেশি ভয় পেলে বা নানা কারণে মানুষকে প্রায়শ অজ্ঞান হয়ে পড়তে দেখা যায়। অজ্ঞান অবস্থায় শরীর ঘামে ভিজে যায়, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে, দৈহিক বোধশক্তি কমে যায়। অজ্ঞান হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন : আলো-বাতাসহীন ঘর, অভুক্ত অবস্থা, প্রচণ্ড ক্লান্তি, দারুণ যন্ত্রণা, কোনো মর্মান্তিক মানসিক আঘাত। প্রশ্ন হলো মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ে কেন? অজ্ঞান কেন হয় জানার আগে জানতে হবে জ্ঞান বা চেতনা কাকে বলে। চেতনাকে পুরোপুরি বজায় রাখতে হলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল অব্যাহত রাখা দরকার। মস্তিষ্ক তার দরকার মতো রক্তের জোগান পেলেই শরীরের সব অঙ্গ-প্রতঙ্গ স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে পারে। মস্তিষ্কের পুরোদমে কাজ করার মানেই হলো জ্ঞান থাকা। তাই মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে কোনো রকম অসুবিধা দেখা দিলেই শরীরের অন্যান্য কাজ ব্যাহত হয়। তা হলে দেখা যাচ্ছে, যেকোনো কারণেই হোক মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে কোনো গোলমাল ঘটলেই সে গোলমালের ফল হলো অজ্ঞান হয়ে পড়া। কেননা রক্তের জোগানে কমবেশি হওয়া মস্তিষ্ক সহ্য করতে নারাজ। আর তাই মাথার সঙ্গে শরীরটাও বিকল হয়ে পড়ে। কয়েকটি কাজ করলে অজ্ঞান হওয়ার হাত থেকে কিছুটা বাঁচা সম্ভব। কাউকে সেরকম অবসন্ন হওয়ার মতো দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে শুইয়ে দেওয়া উচিত। তাহলে সামনে ঝুঁকে পড়ে মাথাটাকে হাঁটু পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এরকম করলে মস্তিষ্ক তার রক্তের জোগান ফিরে পেতে পারে আর তার ফলে জ্ঞান হারানোর ভয় কম থাকে। হঠাৎ যদি কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে তাহলে তাকে শুইয়ে দিয়ে জামা-কাপড় একটু আলগা করে দেওয়া উচিত। শোয়ানোর সময় মাথাটা একটু নিচু দিকে রেখে পায়ের দিকটা উঁচুতে রাখতে হবে। এতে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। জ্ঞান ফিরে আসার পর রোগীকে একটু গরম চা বা কফি খাওয়ালে ভালো হয়। আর মাথায় কোনো আঘাত বা সর্দি-কাশির ফলে কেউ অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা উচিত।

Saturday, December 18, 2010

আত্মসমর্পণের সেই বিকেল

স্বতঃসিদ্ধ নিয়মেই রাত নামে পৃথিবীতে। সকাল হয়। পশ্চিমাকাশে সূর্যের হেলে পড়ার সুবাদে অবসান হয় দুপুরের। প্রতিবেশে জন্ম নেয় বিকেল। কিন্তু সব বিকেলই তো এক রকম নয়! আবহাওয়ার ভিন্নতা ছাড়াও কিছু কিছু বিকেল তো অবশ্যই সমুজ্জ্বল অনন্য মহিমায়, উদ্ভাসিত ব্যতিক্রমী দ্যোতনায়! হিমেল হাওয়া-মাখা শীতের বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের কথা মনে হয় আমাদের। কেমন ছিল বিজয় দিনের অসাধারণ সেই বিকেলটি?
বিকেলটি নিশ্চিতভাবেই স্বর্গীয় মত্ততায় পূর্ণ ছিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে যে স্থানটি আজ প্রতিষ্ঠিত ঢাকায়, সেই স্থানটি তখন ছিল রমনা রেসকোর্স ময়দানের অবিভক্ত অংশ। ঢাকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত সেই ময়দান লোকে লোকারণ্য ছিল সে বিকেলে। মুক্তিকামী জনতার মুহুর্মুহু চিৎকারে মুখর ছিল ময়দানের চারপাশ। ঐতিহাসিক এক অনুষ্ঠানের অংশ হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় উৎকণ্ঠার প্রহর গুনছিল উপস্থিত বাঙালিরা। ঘড়ির কাঁটা চারটা অতিক্রম করল। অতিক্রান্ত হলো আরও কিছু সময়। ময়দানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষের উল্লাস প্রবল হলো হঠাৎ! কেন? তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে একটা গাড়িবহর এসে থামল ময়দানের প্রবেশপথে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক কমান্ডের অধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরাকে নিয়ে সেই গাড়িবহর থেকে নেমে এলেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তাঁদের দুজনকে অনুসরণ করে ময়দানের মাটিতে পা রাখলেন ভান্তি অরোরা, এয়ার মার্শাল দেওয়ান, ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগত সিং, উইং কমান্ডার এ কে খন্দকারসহ আরও অনেকে। হ্যাঁ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নিদারুণভাবে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সামরিক রীতি অনুযায়ী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল গার্ড অব অনার প্রদান করল বিজয়ী দলের অধিনায়ককে। অন্যদিকে বিজয়ী সেনাদলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়োজিত হলো বিজিত দলের সদস্যদের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে। গার্ড অব অনার গ্রহণ করে ছোট্ট একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন অরোরা ও নিয়াজি। পাশাপাশি বসলেন তাঁরা। টেবিলের ওপর রাখা হলো একটি মুদ্রিত কাগজ। ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব সারেন্ডার’ বা ‘আত্মসমর্পণের দলিল’ শিরোনামে মাত্র তিনটি অনুচ্ছেদে যে বাক্যগুলো সন্নিবেশিত সেই কাগজটিতে, বঙ্গানুবাদে তার রূপ দাঁড়ায় অনেকটা এমন:
‘পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সব সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণে স্বীকৃত হচ্ছেন। এই আত্মসমর্পণ পাকিস্তানের সব সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী এবং আধাসামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এসব বাহিনীর সবাই—যারা যেখানে আছে, সেখানকার নিকটস্থ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ ও সব অস্ত্র সমর্পণ করবে।
‘এই দলিল স্বাক্ষরের সময় থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীনস্থ হবে। নির্দেশের অবাধ্যতা আত্মসমর্পণের শর্ত ভঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং যুদ্ধের স্বীকৃত ও প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গৃহীত হবে। যদি আত্মসমর্পণের কোনো শর্তের অর্থ বা ব্যাখ্যা সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এই আশ্বাস প্রদান করছেন যে আত্মসমর্পণকারী প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি জেনেভা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী একজন সৈনিকের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করা হবে এবং তিনি আত্মসমর্পণকারী সব সামরিক ও আধাসামরিক ব্যক্তির নিরাপত্তা ও সুব্যবস্থার অঙ্গীকার প্রদান করছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীনস্থ সেনাবাহিনী সব বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের নিরাপত্তা প্রদান করবে।’
আত্মসমপর্ণের দলিলে সন্নিবেশিত বাক্যগুলো সুলিখিত হলেও নিয়াজির মতো একজন সেনা অধিনায়কের জন্য ভীষণ অপমানজনক। কিন্তু কিছুই করার নেই তাঁর! কলম তুলে নিলেন। স্বাক্ষর করলেন দলিলের নিচের অংশের ডান দিকের নির্ধারিত স্থানে। বাঁ দিকে স্বাক্ষর করলেন অরোরা। তারপর নিয়াজি তাঁর কাঁধ থেকে এপালেট (সেনা অধিনায়কের সম্মানসূচক ব্যাজ) খুলে দিলেন; ল্যানিয়ার্ডসহ (ছোট্ট দড়িবিশেষ) পয়েন্ট থ্রি এইট ক্যালিবারের রিভলবারটি তুলে দিলেন জগজিৎ সিং অরোরার হাতে। অস্ত্রসমর্পণের এই দৃশ্য অবলোকন করে অগণিত বাঙালি আনন্দে আত্মহারা হলো। আজ থেকে ৩৯ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সেই ব্যতিক্রমধর্মী বিকেলে শতাধিক দেশি-বিদেশি সংবাদকর্মীর উপস্থিতিতে সুসম্পন্ন হলো পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ।
দীপংকর চন্দ | তারিখ: ১৬-১২-২০১০
মুলসুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-12-16/news/116146

আজব সব নৌকা

| তারিখ: ১৭-১২-২০১০
ঢাকায় স্থানীয়ভাবে পাটের নৌকা তৈরির একটি দৃশ্য

চকলেটের নৌকা
এক চকলেট-বাবুর কীর্তি। এই গ্রীষ্মেই তিনি প্রায় সোয়া এক টন চিনি আর চকলেট মিলিয়ে একটা গোটা নৌকা বানিয়ে ফেলেছেন। প্রথম নৌকাটার কপালে খারাবি ছিল। জলে নামতেই সেটা আহ্লাদে আটখানা হয়ে ডুবে মরে। দ্বিতীয়বার বানানো নৌকাটা শুরুতে টালমাটাল করলেও ধকল সামলে নেয়। টানা এক ঘণ্টা পানিতে সগৌরবে ভেসে থেকে ‘চকলেট নাও ২’ উপাধি লাভ করে। চকলেট-বাবু এখন চকলেটের প্রমোদতরী বানানোর ফন্দি আঁটছেন। ছয় থেকে আট টন লোভনীয় চকলেট খরচ করে তিনি এই নৌকা ভাসাবেন ২০১২ সালে।

কুমড়া-তরী
যাঁরা নৌকাবাইচ খুব ভালোবাসেন, এ খবরটা তাঁদের জন্য। জার্মানিতে এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো ‘আন্তর্জাতিক কুমড়া-বাইচ প্রতিযোগিতা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে! কুমড়া দিয়ে বানানো নৌকায় পাল্লা দেওয়ার চল শুরু হয়েছে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে। আমেরিকার মেইনে এটা কোনো বিরল দৃশ্য নয়। পানির মধ্যে হঠাৎ দেখা যায়, দৈত্য সাইজের বিরাট কুমড়া দিয়ে বানানো নৌকা ভাসছে।

বরফ আর ভাঙের নৌকা
বিবিসি সায়েন্সের জনপ্রিয় শো ‘ব্যাং গোজ দ্য থিওরি’ একটা মহৎ পরিকল্পনা করেছে। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটা পরিকল্পনা পরীক্ষা করে দেখবে। বরফ দিয়ে জাহাজ তৈরির পরীক্ষা। খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে আয়োজন শুরু করল তারা। তিন সপ্তাহ ধরে এক হাজার ৩০০ গ্যালন পানি আর প্রচুর ভাং জমিয়ে ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটা নৌকা তৈরি করল। কিন্তু হায় ঈশ্বর! নৌকা ছাড়ার মোটে এক ঘণ্টার মধ্যেই বেরসিক গণেশের মতো সেটা উল্টে গেল। পরীক্ষা শেষে সিদ্ধান্ত টানছেন এই শোয়ের ডিরেক্টর: ‘থিওরি কাজ করেছে, কিন্তু নির্ভরযোগ্য নয়।’ হুম, অন্তত সূর্যালোকে এই নৌকার ওপর ভরসা রাখা চলে না।

বোতল-জাহাজ
এলাহী কারবার! মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে যেতে বাধ্য। বাতিল হয়ে যাওয়া সাড়ে ১২ হাজার প্লাস্টিকের বোতল জড়ো করে বানানো পেল্লাই এক জাহাজ। এই জলযানের সমুদ্রযাত্রার যে বয়স, তার তুলনায় অন্যান্য অদ্ভুত নৌকাগুলোর বয়স হাঁটুসমান। টানা ১৩০ দিন ধরে পানির ওপর ভাসছে এই বোতল-যান। এই বোট বানানোর পেছনের উদ্দেশ্যটি মহৎ। প্লাস্টিকের বাতিল আবর্জনা জমিয়ে টেক্সাস শহরের সমান সাইজের বিরাট এক ভাসমান আস্তাকুঁড়ের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই এই অভিযান শুরু হয়েছে। এই দুঃসাহসী অভিযান শেষ হয়েছে আট হাজার নটিক্যাল মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার পর সিডনি শহরে গিয়ে।

মদের ছিপি পানিতে ভাসে
জন পোলক ছিলেন ওয়াশিংটনের এক সামান্য চাকুরে। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি হিজরত করে ক্যাপিটাল হিলে চলে আসেন। এখানে এসেই তাঁর উপলব্ধি হয়, তাঁর জীবনের স্বপ্ন কী হওয়া উচিত, সেটা তিনি বুঝে ফেলেছেন। তাঁকে মদের ছিপি দিয়ে নৌকা বানাতে হবে। তিনি শ্রমের আনন্দে অভিভূত হয়ে জোগাড় করে ফেলেন এক লাখ ৬৫ হাজার ৩২১টি মদের বোতলের ছিপি। এসব কাজে লাগিয়ে তিনি নয়ন ভরে দেখার মতো ২৭ ফুট দীর্ঘ এক নৌকা তৈরি করেন। ২০০২ সালে এই নৌকায় চেপেই তিনি ইউলিসিসের সলিলযাত্রা শুরু করে দেন। ১৭ দিনের এক মহাকাব্যিক অভিযান শেষে তিনি পর্তুগালের দৌর নদীতে নোঙর করেন।

মালাই-লাঠির নৌকা
দেড় কোটি মালাইয়ের বাতিল লাঠি দিয়ে একটি ৫০ ফুট লম্বা জাহাজ বানানো হয়েছে। ২০০৮ সালে এই মালাই নৌকা চালিয়েই নেদারল্যান্ড থেকে লন্ডন পর্যন্ত পৌঁছানো হয়েছে। বিশেষত অত্যন্ত ভাগ্যবান পাঁচ হাজার শিশুর খাওয়া আইসক্রিম থেকে জোগাড় হওয়া লাঠি এই নৌকা তৈরির কাজে ব্যবহূত হয়েছে।

কার্টনের নৌকা
লেক কেলুনে প্রতিবছর একটা জম্পেশ মেলা বসে। টানা ১০ দিনের এই মেলার একটি প্রধান আকর্ষণ হলো ঐতিহ্যবাহী কার্টনের নৌকাবাইচ। স্থানীয় নৌকাওলারা নিজেরাই নকশা করে দুধের কার্টনের নৌকা তৈরি করে এবং বাইচ করে। এই নৌকা বানানোর শর্ত হলো, কাঠের চিকন কাঠামো থাকবে, কিন্তু কার্টন দিয়েই নৌকা ভাসাতে হবে।

সোনালি আঁশের নাও
ছোটবেলায় পড়েছি, পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। পাট আমাদের অনেক উপকারে লাগে। তবে সব উপকার আমরা ভেবে বের করতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে ফরাসিরা আমাদের মিত্রপক্ষ। তারা বাংলার গৌরব সোনালি আঁশ কাজে লাগিয়ে যে নৌকা বানিয়েছে, একমুখে তার সুখ্যাতি করা অসম্ভব। এই নৌকা ডুবে মরতে অক্ষম এবং পরিবেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে যাত্রা করে এক দীর্ঘ সফর শেষে এই নৌকাযোগে এক ফরাসি পৌঁছে গেছেন প্যারিসে। 
 
মুলসুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-12-17/news/116325

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন


আলফ্রেড হিচককের বিখ্যাত নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট ছবির অনুকরণে
উত্তর আটলান্টিকের তীরে রেকইয়াভিক শহরের গ্রেটিসগাটা স্ট্রিটের ছোট্ট সাদা বাড়িটি শতবর্ষের পুরোনো। আইসল্যান্ডের আবহাওয়া এমন, উত্তরে বাতাস যেকোনো সময় বয়ে আনতে পারে তুষার ও বরফ, এমনকি বসন্তকালেও। যখন সে রকম ঘটে, রেকইয়াভিক শহরজুড়ে নেমে আসে প্রগাঢ় নৈঃশব্দ। এ বছরের মার্চের ৩০ তারিখ সকালে ঠিক এ রকম আবহাওয়ার মধ্যে এলেন এক দীর্ঘদেহী যুবক। তাঁর চোখের মণি দুটো ধূসর, চুলগুলো রুপালি-সাদা, পরনে আগাপাশতলা ধূসর স্নো স্যুট; সঙ্গে কয়েকজনের ছোট্ট এক দল। আইজাফজাল্লাইকুল আগ্নেয়গিরিতে সম্প্রতি অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছে।
‘আমরা সাংবাদিক, আগ্নেয়গিরি নিয়ে লিখতে এসেছি। আপনার বাড়িটি ভাড়া নিতে চাই।’ বললেন রুপালি-সাদা চুলের যুবক।
বাড়ির মালিক সম্মত হয়ে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই যুবক ও তাঁর সঙ্গীরা বাড়িটির সব জানালার খিড়কিগুলো বন্ধ করে দিলেন; নিশ্চিত করলেন, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা যেন সব বন্ধই থাকে। বাড়িটি এখন এক যুদ্ধকক্ষ, যাকে বলে বাংকার। আধা ডজন কম্পিউটার বসানো হলো লিভিংস্পেসে। এসে যোগ দিল স্থানীয় কয়েকজন: শুরু হয়ে গেল কাজ: প্রজেক্ট বি, ৩৮ মিনিট দৈর্ঘ্যের র ভিডিও ফুটেজ; ২০০৭ সালে বাগদাদে একটি মার্কিন অ্যাপাচে মিলিটারি হেলিকপ্টারের ককপিট থেকে তোলা। মার্কিন সেনাদের হাতে ১৮ জন বেসামরিক মানুষ হত্যার দৃশ্য, রয়টারের দুজন সাংবাদিকসুদ্ধ। ফুটেজগুলো বিশ্লেষণ ও সম্পাদনা করে তৈরি হবে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র: কোল্যাটারাল মার্ডার (আনুষঙ্গিক হত্যাযজ্ঞ); সেটি ছাড়া হবে অনলাইনে, এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে যে অনলাইনে যাওয়ার পর প্রামাণ্যচিত্রটি আর কেউ সরিয়ে ফেলতে পারবে না। সব কাজ শেষ করতে হবে এক সপ্তাহের মধ্যে।
তার ৩৯ বছর আগে, ১৯৭১ সালের জুলাই, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা যখন স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন একটি বর্বর সামরিক সরকার ও তার নৃশংস বাহিনীর বিরুদ্ধে, তখন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ছোট্ট এক দ্বীপে জন্ম হলো আরেক যোদ্ধার, যিনি প্রায় চার দশক পর আঘাত হানবেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর, সবচেয়ে অমানবিক ও প্রতারক রাষ্ট্রশক্তির নিরাপত্তাব্যবস্থার মর্মমূলে: শুরু করবেন ফার্স্ট সাইবার ওয়ার্ল্ড ওয়ার।
নাম তাঁর জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ; তাঁর সাইবার বাহিনীর নাম ‘উইকিলিকস’। ১৯৮৭ সালে যখন তাঁর বয়স ১৬, তখন তিনি হাতে পেলেন একটি মডেম, সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কম্পিউটারটিকে পরিণত করলেন একটি পোর্টালে; ওয়েবসাইটের চল তখনো শুরু হয়নি, কিন্তু কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও টেলিকম সিস্টেমগুলো পরস্পর সংযুক্ত হয়েছিল এবং এক গোপন ইলেকট্রনিক ভুবন ছিল, যেখানে জুলিয়ানের মতো ক্ষিপ্র বুদ্ধিসম্পন্ন কিশোরেরা ঢুকে পড়তে পারত। তিনি তত দিনে মেলবোর্নে চলে এসেছেন, সেখানকার ‘কম্পিউটার গিক’দের মধ্যে অচিরেই তাঁর এমন খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি ইউরোপ-আমেরিকার সবচেয়ে সুরক্ষিত কম্পিউটার নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যেও ঢুকে পড়তে পারেন। এ সময় তিনি দুজন হ্যাকারকে সঙ্গে নিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল সাবভারসিভস’ নামে একটি গ্রুপ গঠন করেন। কানাডার টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি নরটেলসহ ২৪টি প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষিত কম্পিউটার নেটওয়ার্কে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে একদিন অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পুলিশ হানা দিল তাঁর মেলবোর্নের বাসায়। ধরে নিয়ে গেল তাঁকে। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে ১০ বছরের কারাবাস নিশ্চিত। তিনি অভিযোগ মেনে নিয়ে ভুল স্বীকার করলেন, আর কখনো এমন কাজ করবেন না বলে অঙ্গীকার করে কয়েক হাজার ডলার জরিমানা দিয়ে মুক্তি পেলেন। শুরু করলেন সবার জন্য বিনা খরচে ব্যবহারযোগ্য সফটওয়্যার তৈরির কাজ। তিনি বিশ্বাস করেন, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ মানবসভ্যতার অভিন্ন অর্জন, বাণিজ্যিক স্বার্থে তা কুক্ষিগত করে রাখা অনৈতিক। মানবাধিকারকর্মীদের ব্যবহারের জন্য তিনি বিনা খরচে তৈরি করে দিলেন কিছু মূল্যবান সফটওয়্যার।
অ্যাসাঞ্জ মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও পদার্থবিদ্যা পড়েছেন, কিন্তু কোর্স শেষ করেননি। বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকদের কারবার দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। ইরাকের মরুভূমিতে মার্কিন বাহিনীর ট্যাংক বালুর মধ্যে কী করে আরও দ্রুত চলতে পারে, সেই গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন তাঁরা। অ্যাসাঞ্জ প্রচুর পড়াশোনা করেন, দর্শন থেকে শুরু করে নিউরোসায়েন্স পর্যন্ত, অনেক বিষয়ে তাঁর আগ্রহ। তাঁর মা ১৭ বছর বয়সে ক্লাসের বইপত্রে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মোটরসাইকেল নিয়ে। কিশোর অ্যাসাঞ্জকে তিনি পড়ে শোনাতেন চিরায়ত গ্রিক সাহিত্য: এস্কাইলাস, ইউরিপিডিস, সফোক্লিসের নাটক। জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস পড়ে অ্যাসাঞ্জ টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রের স্বরূপ চিনতে পেরেছেন প্রথম, অরওয়েলের ভক্ত তিনি। কুর্ট ভোনেগাটও তাঁর খুব প্রিয়। বুখারিনের গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদণ্ডের কাহিনি অবলম্বনে লেখা আর্থার কোয়েসলারের ডার্কনেস অ্যাট নুন তাঁর অন্যতম প্রিয় উপন্যাস। আলেকসান্দর সোলঝেনিৎসিনের ফার্স্ট সার্কেল পড়ে অ্যাসাঞ্জ ২০০৬ সালে মন্তব্য লিখেছেন: ‘ঠিক আমার নিজের জীবনের অ্যাডভেঞ্চারগুলোর মতো!’
ব্যাপক পড়াশোনার মাধ্যমে ইতিহাস জানা ও সমসাময়িক বৈশ্বিক পরিস্থিতির দিকে রাজনীতিসচেতন দৃষ্টিতে নজর রাখার মধ্য দিয়ে অ্যাসাঞ্জ পরিণত বয়সে এমন এক ধারণায় পৌঁছান যে সব সরকার ও ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান মিথ্যা বলে, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে। সরকারমাত্রই ষড়যন্ত্রপ্রবণ। অ্যাসাঞ্জ মনে করেন, ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে গোপনীয়তা। গোপনীয়তা ভেঙে দিতে পারলেই ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল করা সম্ভব। এ রকম ভাবনা বা দর্শন থেকে তিনি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে চালু করেন উইকিলিকস নামের এক নতুন ধরনের ওয়েবসাইট, যার কাজই হবে জনগুরুত্বপূর্ণ গোপন নথিপত্র বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ করা। ওই সময় তিনি ‘কন্সপিরেসি অ্যাজ গভর্নেন্স’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেটাকে বলা হয় উইকিলিকসের ইশতেহার। সেখানে তিনি লেখেন, ‘আমরা যদি নিষ্ক্রিয়ভাবে অন্যায়-অবিচার দেখে যাই, কিছুই না করি, তবে আমাদের অবস্থা দাঁড়ায় সে অন্যায়ের পক্ষে। নিষ্ক্রিয়ভাবে অন্যায়-অবিচার দেখতে দেখতে আমরা দাসে পরিণত হই। অধিকাংশ অন্যায়-অবিচার ঘটে খারাপ শাসনব্যবস্থার কারণে; শাসনব্যবস্থা ভালো হলে অন্যায়-অবিচার কমে যায়।...আমাদের এমন কিছু করতে হবে, যেন খারাপ শাসনব্যবস্থার জায়গায় ভালো কিছু আসে।’
সর্বশেষ গত ২৮ নভেম্বর উইকিলিকস মার্কিন কূটনীতিকদের তারবার্তা প্রকাশের পর অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকসের প্রতি এসেছে প্রচণ্ড আঘাত। যুক্তরাষ্ট্র উইকিলিকস বন্ধ করার এবং অ্যাসাঞ্জকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে, বড় বড় দেশের সরকারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, এমনকি তাঁর স্বদেশ অস্ট্রেলিয়ার সরকারও। খুব স্থূল অভিযোগে অ্যাসাঞ্জকে লন্ডনের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ডিসেম্বরের ৬ তারিখে। তাঁর জামিনের আবেদন প্রথমে খারিজ হয়েছে, দ্বিতীয় দফায় তিনি জামিন পেয়েছেন, কিন্তু এখনো কারাগার থেকে মুক্তি পাননি, সুইডিশ কর্তৃপক্ষ আপিল করবে বলে।
অ্যাসাঞ্জ ও তাঁর সহযোগীরা অনেক আগে থেকেই জানতেন, তাঁদের ওপর আঘাত আসবে। সে কারণে উইকিলিকসের কোনো স্থায়ী অফিস নেই, কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকেরা সবাই মোটের ওপর গুপ্ত জীবন যাপন করেন বাধ্য হয়ে। অ্যাসাঞ্জ নিজে তাই এক রহস্যময় চরিত্রের খ্যাতি পেয়েছেন।
২০০৮ সালে মার্কিন আর্মি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স সেন্টার এক গোপন সামরিক প্রতিবেদন তৈরি করে, যেখানে বলা হয়, উইকিলিকস হচ্ছে মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য এক মারাত্মক হুমকি। গোপন সূত্রে অ্যাসাঞ্জ প্রতিবেদনটি হাতে পেয়ে যান এবং তখনই বুঝে নেন, প্রতিবেদনটি উইকিলিকসের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধের ঘোষণাপত্র। এ বছরের মার্চে তিনি ওই প্রতিবেদনটি উইকিলিকসে প্রকাশ করেন এই শিরোনাম দিয়ে: মার্কিন গোয়েন্দারা উইকিলিকসকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি সব সময় সন্দেহ করেন যে তাঁকে গোপনে অনুসরণ করা হচ্ছে। বাগদাদের ভিডিও ফুটেজটি নিয়ে কাজ করার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন রেকইয়াভিক শহর। কারণ আইসল্যান্ডে তাঁর কিছু বন্ধু আছেন, যাঁরা নানা ধরনের বিপ্লবী চিন্তাভাবনা করেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পার্লামেন্টের সদস্যও। আগের কয়েক বছর অ্যাসাঞ্জ কয়েকজন রাজনীতিক ও অধিকারকর্মীর সঙ্গে মিলে তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে দারুণ শক্তিশালী একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছিলেন। তাঁদেরই কয়েকজন তাঁকে ভিডিওচিত্রটি নিয়ে অত্যন্ত গোপনে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর এমন আরও অনেক বন্ধুবান্ধব আছেন কেনিয়ায়, সুইডেনে, ইংল্যান্ডে এমনকি খোদ আমেরিকায়ও। কিন্তু অ্যাসাঞ্জকে লুকিয়ে চলতে হয়। আইসল্যান্ড থেকে কেনিয়া—কখন কোথায় থাকেন তার ঠিক-ঠিকানা নেই। কখনো হোটেলে ওঠেন না, থাকেন বন্ধুবান্ধবের বাসায়। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন শুধু নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে। মুঠোফোন ব্যবহার করেন একাধিক; শুধু কাউকে কল করার সময়, বাকি সময় মুঠোফোন বন্ধ থাকে, এমনকি ব্যাটারিও খুলে রাখেন, যাতে তাঁর অবস্থান ও চলাফেরার ওপর কেউ কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রের সাহায্যে নজর রাখতে না পারে। লন্ডনে বিচারক তাঁকে জামিন দেননি এই যুক্তি দেখিয়ে যে তাঁর কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। সুইজারল্যান্ডের সুইসপোস্ট তাঁর অ্যাকাউন্ট বাতিল করেছে, যখন তারা আবিষ্কার করেছে যে সুইজারল্যান্ডে অ্যাসাঞ্জ যে ঠিকানায় থাকেন বলে অ্যাকাউন্টটি খোলার সময় লিখেছেন, সেটি ভুল। উইকিলিকসের অন্য সদস্যরাও এই সন্দেহের শিকার যে শত্রুরা তাঁদের। অ্যাসাঞ্জসহ সবাই কমবেশি ‘প্যারানোয়েড’। তিনি একজনকে বলেছেন, ‘আমি সুইডেনে এক মেয়ের বাসায় উঠেছিলাম। সে একটি সংবাদপত্রের ফরেন এডিটর। তার ভয়, সিআইএ আমাকে ফলো করছে। এই ভয়ে সে ওই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। আমি তাকে আর খুঁজেই পাইনি।’
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের এই গুপ্ত জীবন এক মহান মিশনের অংশ: ষড়যন্ত্রমূলক গোপনীয়তার বিরুদ্ধে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতার মিশন। অ্যাসাঞ্জ গোটা বিশ্বকে এক অভিন্ন জাতিরাষ্ট্র বলে মনে করেন এবং সেই ন্যায়পরায়ণ মুক্ত সমাজ বা ‘ওপেন সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেমেছেন, যুগে যুগে মানুষ যার স্বপ্ন দেখে এসেছে। এ লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গে আছে গোটা বিশ্বের জনগণ; দেশে দেশে তাঁর মুক্তির দাবিতে মিছিল হচ্ছে। তিনি জানেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ধ্বংস করতে উদ্যত। তার সহযোগী আরেক রাষ্ট্রের পুলিশের হাতে তিনি আটকও হয়েছেন, কিন্তু ঘাবড়াননি একটুও। লন্ডনের ওয়ার্ডসওয়ার্থ কারাগারের নিভৃত প্রকোষ্ঠে থেকে তিনি মায়ের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে এই বাণী পাঠিয়েছেন: ‘আমার সব বিশ্বাস ও আদর্শ অপরিবর্তিত আছে। আমি এযাবৎ যেসব আদর্শ-মূল্যবোধের কথা বলে এসেছি, সেসবের প্রতি আমার আস্থা অটুট রয়েছে। এসব পরিস্থিতির (প্রেপ্তার, কারাবাস, সুইডেনে পাঠানোর উদোগ্য, বিচার) কারণে সেগুলোর কোনো নড়চড় হবে না। এসবের ফলে যদি কোনো পরিবর্তন ঘটে থাকে, তবে তা হলো এই যে আমার আদর্শগুলো যে সত্য ও সঠিক, আমার এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে।...এসব অবৈধ ও অনৈতিক তৎপরতা থেকে আমার কাজ ও আমার লোকজনকে রক্ষা করার জন্য আমি বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ, পৃথিবীর নিপীড়িত, প্রতারিত, প্রতিবাদী সব মানুষ আপনার সঙ্গে আছে।


উইকিলিকস
২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত উইকিলিকস যে পরিমাণ গোপন নথিপত্র, ভিডিও ফুটেজ, ই-মেইল ইত্যাদি প্রকাশ করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তেমনটি আর কখনোই ঘটেনি। কারিগরিভাবে অবিশ্বাস্য রকমের নিখুঁত ওয়েবসাইট উইকিলিকস। শত শত ডোমেইন নামে বিশ্বজুড়ে ২০টিরও বেশি সার্ভারে তাঁরা তাঁদের ম্যাটেরিয়ালগুলো সংরক্ষণ করেন। এটি একটি ‘আনসেন্সরেবল সিস্টেম ফর আনট্রেসেবল মাস ডকুমেন্ট লিকিং অ্যান্ড পাবলিক অ্যানালাইসিস।’ এটাকে ধ্বংস করতে হলে সারা বিশ্বের ইন্টারনেট-ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করতে হবে।

জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ
জন্ম কুইন্সল্যান্ডের টাউন্সভিলে, কিন্তু তাঁর কোনো ঘরবাড়ি নেই। মা-বাবা এক ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার গ্রুপ চালাতেন, তাই শৈশব থেকেই যাযাবরের জীবন। তাঁর বয়স যখন আট, তখন মা-বাবার ছাড়াছাড়ি; মা বিয়ে করলেন এক সংগীতশিল্পীকে, যিনি আবার এক গুপ্ত কাল্ট পরিবারের সদস্য, যারা শিশুদের চুরি করে এনে কাল্টভুক্ত করে। সেখানে এক ছোট ভাইয়ের জন্ম হলো, কিন্তু সৎ-বাবা হয়ে উঠলেন নিপীড়ক। দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে পালালেন মা ক্রিস্টিন ক্লেয়ার। জুলিয়ানের বয়স তখন ১১। সৎ-বাবা পিছু নিলেন; ছোট ভাইটিকে কেড়ে নিতে চান তিনি। পাঁচ বছর ধরে চলল আইনি লড়াই, সেই সঙ্গে মা ক্রিস্টিনকে ধাওয়া করে চলল অপহরণের আতঙ্ক। পাঁচ বছরে মোট ৩৭ বার তাঁকে থাকার জায়গা বদল করতে হয়েছে। এমনই এক জায়গায় তাঁরা একটি বাসায় থাকতেন, যার বিপরীত দিকে ছিল একটি ইলেকট্রনিকসের দোকান। কিশোর জুলিয়ান সেখানে গিয়ে কমোডর ৬৪ কম্পিউটারের বোতাম চাপাচাপি করতেন। তারপর একটা সময় মা তাঁকে একটি কম্পিউটার কিনে দিলেন; জুলিয়ান অচিরেই এমন দক্ষ হয়ে উঠলেন, বিভিন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রামের গোপন পাসওয়ার্ড ভেঙে লুকানো সব তথ্য পড়ে ফেলতে পারতেন। 
মশিউল আলম | তারিখ: ১৭-১২-২০১০
মুল সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-12-17/news/116319 

Wednesday, December 15, 2010

ইতিহাসের আশ্চর্য সময় গোল্ডরাশ

সোনা [স্বর্ণ] নামক ধাতুটির প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। মানুষের ব্যবহার্য ধাতুর মধ্যে স্বর্ণ সবার উপরে। কিন্তু কেন সোনার এত আদর? এর ঔজ্জ্বল্য, দ্যুতি কিংবা চমৎকার রং? না শুধু তাই নয়_ সোনা এমন এক ধাতু যার কোনো ক্ষয় নেই। লোহায় মরিচা ধরে, তামা বা পিতলে তাম্রমল জমা হয়। কিন্তু সোনা রাসায়নিকভাবে একবারে নিষ্ক্রিয়। তাই অন্যান্য অপদ্রব্যের সঙ্গে মিশে থাকলেও সোনার ঔজ্জ্বল্য কখনই নষ্ট হয় না। যেনতেন অ্যাসিডেও সোনাকে গলানো যায় না। সোনা গলানোর জন্য চাই অ্যাকোয়া রেজিয়া। সোনা সবচেয়ে সহনীয় (গধষষবধনষব) ধাতু। অতি ক্ষুদ্র স্বর্ণখণ্ডকেও পিটিয়ে ধাতু পাত তৈরি করা যায়। এক আউন্স সোনা পিটিয়ে দীর্ঘ তার তৈরি করা সম্ভব। স্বর্ণের এই গুণের জন্য অলঙ্কারের উপাদান হিসেবে এর জুড়ি নেই। শুধু কি অলঙ্কার, মুদ্রার উপকরণ হিসেবে সোনা আজও অদ্বিতীয়। একসময় তো ছিল স্বর্ণমুদ্রার যুগ। আজও কাগুজে মুদ্রা যা দেখছি তা এক ধরনের ঋণপত্র, পর্যাপ্ত সোনার মজুদ রেখেই তবে সরকারকে সে মূল্যমানের নোট বাজারে ছাড়তে হয়। তাই সোনার প্রতি মানুষের আকর্ষণ দুর্নিবার।

যুগে যুগে সোনার প্রতি লোভে পড়েছে রাজা-রানীসহ নয়, সাধারণ মানুষ। সোনার খোঁজে মানুষ হানা দিয়েছে নতুন নতুন ভূখণ্ডে। এক সময় ইউরোপের অভিযাত্রীরা কল্পনার স্বর্ণনগরী এল ডোরেডোর সন্ধানে চষে বেড়িয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার অরণ্য পর্বত। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ইউরোপ-আমেরিকায় বেশ ক'বার স্বর্ণাভিযান সংঘটিত হয়েছে। একজন দু'জন নয়, বিপুলসংখ্যক মানুষ যখন সোনার খোঁজে বেরিয়ে পড়েন তখন সেটা হুলুস্থূল কাণ্ডই বটে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এরকম গোল্ডরাশ দেখা গিয়েছে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। সাধারণত সোনার খনির আশপাশে নদীর তলদেশে দু'এক টুকরা সোনা পড়ে থাকতে দেখা যায়। এটা পাথুরে গুহা থেকে ঝরনাধারার বয়ে আনা সোনা। এ ধরনের সোনাকে বলা হয় প্লেসার গোল্ড। দু'একজন লোক হয়তো এভাবে সোনার খোঁজ পেল। তারপর লোক মুখে রটে যায় সোনার কথা। এক সময় পুরো লোকালয় ভেঙে পড়ে সোনার সন্ধানে। আসলে চটজলদি ধনী হতে কে না চায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকায় বেশ ক'বার গোল্ডরাশের ঘটনা ঘটেছে। ১৮৪০, ৫০, ৬০, ও '৮০-এর দশকে ঘটে যাওয়া গোল্ডরাশ আজও মানুষকে ভাবাবেগে আপ্লুত করে। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে ১৮৪৮ সালের গোল্ডরাশের ঘটনা। ১৮৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে জেমস মার্শাল নামের এক ছুতার তার বন্ধু জন সাটারকে নিয়ে নতুন একটি করাত কল খুলবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। মাটি খোঁড়ার সময় তারা কিছু সোনার সন্ধান পান সাক্রামেন্টো নদীর তীরে। জন সাটার অন্য শ্রমিকদের ঘটনাটি গোপন রাখার জন্য কঠোর নির্দেশ দেন। কিন্তু যে করেই হোক সোনার ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়। আশপাশ থেকে মানুষ ছুটে আসতে থাকে সোনার সন্ধানে। স্যামুয়েল ব্রানান নামে সানফ্রান্সিসকোর এক বণিক জানতে পারেন ঘটনাটা। কারণ সাটারের বাড়ির কাছে তার একটি দোকান ছিল। তিনি সানফ্রান্সিসকো শহরে এসে সোনার খবর প্রকাশ করে দেন। কয়েক মাসের মধ্যে সানফ্রান্সিসকো ভুতুড়ে শহরে পরিণত হলো। শহরে পুরুষ মানুষ আর কেউ থাকল না। দলে দলে লোক হাজির হলো সাক্রামেন্টো নদীর তীরে। উদ্দেশ্য একটাই সোনা চাই, সোনা। ১৮৪৮ সালের গ্রীষ্মে পুরো পশ্চিম উপকূলে সোনার খবর রটে গেল, মেক্সিকো সীমান্ত থেকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত। সেখান থেকে লোক আসতে শুরু করল। এদিকে মিসিসিপি নদী পার হয়ে পূর্ব উপকূলে খবর পেঁৗছতে সময় লাগল না। পত্রিকার লোকজনও কম জান না। তারাও খবর ছেপে দিল সেসব মানুষের যারা সোনা পেয়ে এক রাতের মধ্যে বড় লোক হয়ে গেছে। এদিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জেমস পোক এক বাণীতে স্বীকার করলেন-ক্যালিফোর্নিয়ায় সোনার খনি রয়েছে। সে বছর শীতের মধ্যেই জমে উঠল সোনার মেলা। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সবদিক থেকেই সোনার জোগান স্বাভাবিকভাবে কমে আসছিল। অন্যদিকে পেশাদার খনি মালিকরা আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে অল্প সময়ে অধিক সোনা উত্তোলন করছিল। ফলে সোনার দাম কমে গেল। শৌখিন স্বর্ণশিকারিরা একসময় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ল। অনেকেই আশানুরূপ সোনা না পেয়ে ফিরে গেল দেশে। এভাবে আস্তে আস্তে সোনার হুজুগ মিলিয়ে গেল। স্বর্ণাভিযানের ফল সবার জন্য সমান হয়নি। কেউ সোনা পেয়ে ধনকুবের হয়েছে। কেউ আবার স্বর্ণশিকারিদের সঙ্গে ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ যা পেয়েছে তা খুবই সামান্য। কেউ একেবারে রিক্ত হস্তে বাড়ি ফিরেছে, কারও কারও বাড়ি ফেরার সৌভাগ্য হয়নি, পথেই মারা পড়েছে।

এতকিছুর পরও গোল্ডরাশের আরও ঘটনা ঘটেছে। ১৮৫৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এরকম সোনার হুজুগ শুরু হয় যা ভিক্টোরিয়া গোল্ডেনরাশ নামে পরিচিত। এছাড়াও আমেরিকার পূর্ব প্রান্তে ও মধ্য আমেরিকার কলোরাডোতে বেশ ক'বার স্বর্ণাভিযান সংঘটিত হয়েছে। গোল্ডরাশের ঘটনাগুলোকে হয়তো হুজুগ কিংবা গণউন্মাদনা বলে আখ্যায়িত করা যায়, কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেছে এক নীরব বিপ্লব। বহুলোকের আগমন ও যাতায়াতের ফলে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন জনপদ, রাস্তাঘাট। ফ্যাশনের একটি ছোট্ট আবিষ্কার গোল্ডরাশের সঙ্গে জড়িত। আজকের তরুণদের অন্যতম জনপ্রিয় পরিধেয় জিন্স। প্রথম জিন্সটি যিনি তৈরি করেন তিনি হচ্ছেন লেডিস্ট্রাউস, সোনার সন্ধানে এই জার্মান ভদ্রলোকটিও ক্যালিফোর্নিয়ায় এসেছিলেন। বারবার প্যান্ট ছিঁড়ে যাওয়ায় তিনি দর্জিকে বললেন, তাঁবুর কাপড় দিয়েই প্যান্ট বানিয়ে দিতে। খানিকটা ইতস্তত করে দর্জি তাতেই রাজি হলেন। তবে বোতামের বদলে নাট-বল্টু দিয়েই হলো প্যান্ট। তার এই প্যান্ট বর্তমানে জিন্সের আকৃতি পেয়েছে। লেডিস্ট্রাউস স্বপ্নেও ভাবেননি তার প্রয়োজনের পোশাক এতটা জনপ্রিয়তা পাবে। লিভাইস ব্যান্ড আজও বাজারে সচল। প্রতিটি লিভাইস জিন্সের লোগোতে লেখা থাকে '১৮৫০ সাল থেকে' (ঝরহপব-১৮৫০), সময়টা গোল্ডরাশের। সত্যি বহু ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্ম দেওয়া গোল্ডরাশের ইতিহাসের এক আশ্চর্য সময়। 

মুল সুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=08-12-2010&type=gold&data=Career&pub_no=222&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=0

Tuesday, December 14, 2010

তিন কালের সাক্ষী

দিনের শুরুটা ভালোই ছিল, সূর্যস্নাত সকাল। তাই দেখে ভেবেছিলাম, প্রবাদবাক্যের কথাটাই হয়তো ঠিক—সকালই বলে দেয়, দিনটা কেমন যাবে। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না-যেতেই সে হিসাব বদলে যেতে শুরু করল। বান্দরবানের বালাঘাটা থেকে যখন হাঁটা শুরু করি, তখন ছিল রোদ। হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট্ট ছড়ার ওপর সেতু পেরিয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। আর আকাশেও মেঘ জমতে শুরু করল। পাহাড়ের সবুজ রং বদলে কালচে হতে শুরু করল। উঁচু সে পাহাড়ের চূড়ায় স্বর্ণমন্দিরের সোনালি শিখর ক্রমেই ঘোলাটে হয়ে এল। বৃষ্টির আশঙ্কা, তবুও কুহালংয়ের পথ ধরলাম। পাশেই একটা টিনের ছাপরা মতো চায়ের দোকান। এর পেছনেই ঘোনাপাড়া গ্রাম।
ওখানে পৌঁছাতেই একজন বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হলো। হাতে একটা ফুলের সাজি নিয়ে ফুল তুলছেন। কুশল জানিয়ে নাম জানতে চাইলে বললেন, নাম গুরুপদ দে, বয়স নব্বইয়ের ওপর। কথায় কথায় সেই প্রায় শতবর্ষী দাদুর সঙ্গেই আলাপ জমে ওঠে। এত বয়স, তবুও সোজা হয়ে হাঁটছেন, চোখে কোনো চশমা নেই, হাতে কোনো লাঠিও নেই। যা যা জিজ্ঞেস করছি, ঠিক ঠিক উত্তর দিচ্ছেন। তার মানে, কানেও কম শোনেন না। দাঁতও আছে। সামর্থ্যের রহস্যটা কী? জানতে চাইলে হেসে ফেলেন, বলেন, ‘বাপু রে, আমাদের জোয়ান বয়সে যা খেয়ে ফেলে দিয়েছি, তা এখন তোমরা চোখেও দেখো না। জোয়ান বয়সে সপ্তাহে এক পোয়া ঘি-মাখন আর দিনে এক সের দুধ খাওয়া ছিল বাঁধা। কাঁসার বাটিতে দুধে হাতের পাঞ্জা না ডুবলে খেতাম না। ফল যে কত খেতাম, তার কোনো হিসাব নেই। এখন কেউ একটা আম কেটে দুই ফালি আম খেতে দিলে রাগ হয়। আম খেতাম গামলা ভরে। নদীতে জাল ফেললেই মাছ উঠত জাল ভরে। কত আর খাব? এখন কি আর তোমরা এসব চোখে দেখো? তোমাদের শক্তিটা আসবে কোথা থেকে? আর যা খেতাম, তাতে ছিল না সাইত (বিষ)। সবকিছু টাটকা। এখন তো বাসি-পচা আর বিষ দেওয়া, ভেজাল দেওয়া খাবার খেয়ে তোমরা অম্বলের ব্যথায় মরচো। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলা—তিন কালই তো দেখলাম। কালে কালে কত যে ফারাক!’
গুরুপদ দাদুর কথায় চমক লাগে। এ রকম তিন কালের সাক্ষী এ দেশে নিশ্চয়ই আরও অনেকে আছেন। আলাপে আলাপে জানা গেল, দাদুর বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের চন্দনাইশে। নদীভাঙনে সর্বহারা হয়ে চলে আসেন বান্দরবানের ঘোনাপাড়ায়। এখানেই চাষবাস করে বেশ আছেন। টুকিটাকি ব্যবসাও করছেন। আসার পর তাঁর অসিলায় আরও আত্মীয়স্বজনও এখানে চলে এসেছে। তবে এখনো মায়ের কথা ভুলতে পারেননি। মাকে তিনি পাহাড়ে আনতে পারেননি। রাত যতই হোক, মা ঠিকই জেগে থাকতেন, না খেয়ে বসে থাকতেন। বাড়ি ফিরলে যুবক বয়সেও মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিতেন। পড়শিরা যে যা কথা দিত, সবাই সে কথা রাখত; সবাই খুব কম মিথ্যা কথা বলত। প্রতিবেশীদের মধ্যে যে সদ্ভাব ছিল, তা যেন এখন আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। কারও জামাই বাড়িতে এলে, সে হয়ে উঠত পাড়ার জামাই। আসল শাশুড়ি আর জামাইকে খাওয়ানোর সুযোগই পেত না। আর এখন কেউ জানেই না, কার মেয়ের কোথায় বিয়ে হলো। সেই মায়ের মমতা আর কুটুম-কুটুম পাড়া এখন নেই। সেসব দিন কোথায় যে হারিয়ে গেল!
ব্রিটিশ আমলে দাদুর স্মৃতিতে আমিও যেন হারিয়ে যাই। তারপর আবার ফিরে আসি পাকিস্তান আমলের কথায়। দাদু বলতে থাকেন, ‘চার আনা সের দুধ খেয়েছি, ১৬০ টাকা ছিল সোনার ভরি। দিন গেলে ১৮-২০ টাকা কামাই হতো। তার মানে আট দিনের কামাইয়ে এক ভরি সোনা কিনতে পারতাম। আর এখনকার কথা ভাবো! সারা দিন ছেলেরা খেটে কামাই করে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এক ভরি সোনা কিনতে ওদের না খেয়ে ছয় মাস টাকা জমাতে হবে।’
মেঘ আরও এঁটে আসছে। দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁর মুখটাও মেঘের মতো ভারী। ছেলেদের কথা জানতে চাইলে মুখটা আরও ভারী হয়ে ওঠে। তিন ছেলের এক ছেলেকে তিনি পাহাড়ে এসে হারিয়েছেন। তার মৃত্যু নিয়ে কোনো দিন কিছু বলতে পারেননি, বলবেনও না। বাংলা আমলের কথা জানতে চাইলেই তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলে কেউ যে সাহস করেনি, এখন বাংলা আমলে এসে তা-ই দেখতে হচ্ছে। এখন অনেক কিছুই উন্নত হয়েছে, নাতি-নাতনিরা স্কুলে যাচ্ছে, চাকরি করছে। কিন্তু এ কোন কালে এলাম রে বাপু। এ কালে ডাকাতকে ডাকাত বলা যায় না। মানুষগুলো যেন আর আগের মতো সুন্দর নেই। দুর্নীতি ও প্রতারণা বেড়েছে বহুগুণ। মানুষ যেন বেশি রাগী হয়ে যাচ্ছে; মানুষের কেবল সম্পদ গড়ার নেশা। এসব করতে গিয়ে আমরা আসল অনেক সম্পদ হারিয়ে ফেলছি।’ এ কথা বলে দাদু চলে যান একটা টগর ফুলের কাছে। ফুলে শিশির জমেছে। ঠিক সে সময়ে নামল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল টগরের শিশির। দাদুর কষ্টের শিশির ধুয়ে গেল কি না বোঝা গেল না। তবে ভাবতে ভালো লাগে, এ রকম কোনো বৃষ্টিতে যদি দেশের সব কষ্টের অশ্রুবিন্দু ধুয়ে যায়, দেশটা হয়তো একদিন টগরের শুভ্রতা নিয়ে শুদ্ধ হবে। 
 
মুলসুত্র্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-12-11/news/114911

মাছের পিতৃত্ব!


আমাদের এ সমাজ পুরুষপ্রধান হলেও মায়ের কদরই বেশি। কিছু হলেই বলি মা গো। মা ও সন্তানকে স্নেহে, আদরে, যত্নে, বিপদে আগলে রাখেন। মনে কষ্ট পেলে বলে থাকেন আমি কত কষ্টে পেটে ধরেছি তুই আমাকে কষ্ট দিলি? কিন্তু কিছুক্ষণ পরই কষ্ট ভুলে যান। এই তো মাতৃত্ব। কিন্তু পিতৃত্ব একটি শব্দ বাংলা ভাষায় থাকলেও প্রচলন মাতৃত্বের তুলনায় অনেক কম। মাঝে মাঝে পত্রিকায় দেখি পিতৃত্বের দাবিতে অনশন করেছে, মামলা করছে ইত্যাদি। অর্থাৎ বাবা যেন মায়ের তুলনায় সন্তানের প্রতি কম দায়িত্বশীল। যদিও বিষয়টি মোটেও তা নয়। পুরুষপ্রধান সমাজে পিতাকে বাইরের দায়িত্ব বেশি নিতে হওয়ায় তিনি সন্তানদের কম লালন-পালন করতে পারেন। কিন্তু মাছের বেলায় মনে হয় বিষয়টি আলাদা। মা মাছ বাচ্চা জন্ম দিয়েই খালাস, সুযোগ পেলে দু'একটা ধরেও খায়। অন্য প্রাণীদের মতো সন্তান লালন-পালন করে না। এ কারণেই বোধহয় বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে_ মাছের মায়ের পুত্রশোক। অর্থাৎ লোক দেখানো অভিনয়। অপরদিকে মাছের বাবারা সন্তানদের প্রতি ভীষণ দায়িত্বশীল। তাদের ক্ষেত্রে পিতৃত্বের বোঝা অনেক ভারী।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তেলাপোকা, কেট ফিস মাছের কথা। এ জাতের মাছের মায়েরা একটি নির্দিষ্ট সময় ডিম পাড়ে। সেই সময় বাবা মাছটি মায়ের কাছাকাছি থাকে। মা ডিম পাড়ে আর বাবা দ্রুত একটার পর একটা ডিম মুখে পুরে ফেলে। দৃশ্যটি দেখলে মনে হবে পুরুষ মাছ ডিম খেয়ে ফেলছে। আসলে তা নয়। বাবা মাছ একে একে সব ডিম মুখে পুরে নেয়। তারপর শুরু হয় ডিমে তা দেওয়ার পালা। মুখের ভেতরেই ডিম থেকে বিভিন্ন পর্যায় পাড়ি দিয়ে পোনা মাছ বের হয়। এ পুরো সময়টাতে পুরুষ মাছ অভুক্ত থাকে। আস্তে আস্তে পোনা বড় হতে থাকে, মুখের ভেতর থেকে সুযোগ পেলেই দু'একটা বাইরে আসে। বাবা মাছ খুবই সতর্কতার সঙ্গে দুষ্টু সন্তানকে আবার মুখের ভেতর পুরে নেয়। যখন পোনা আরও বড় হয়ে যায় তখন এদের আর মুখের ভেতর আবদ্ধ করে রাখা যায় না। এরা বাইরের জগৎকে দেখতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। সুযোগ পেলেই দলবেঁধে বেরিয়ে পড়ে। বাবা তখন আর বাধা দেয় না। পোনা বাবার কাছে ঘুর ঘুর করতে থাকে। যখনই কোনো শত্রু দেখে তখন সুবোধ বালকের মতো বাবার মুখের ভেতর ঢুকে পড়ে। আর বাবাও পোনাকে মুখের ভেতর গপ করে পুরে নেয়। কি নিরাপদ আশ্রয়। যতদিন পোনা বড় হয়ে দায়িত্বশীল না হয় ততদিন এ অবস্থা চলতে থাকে।

পাইপ ফিশ-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও মজার। প্রজননের সময় বাবা মাছের শরীরের নিচের অংশে দুটো ঢাকনার মতো বস্তু তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে দু'টি একসঙ্গে মিলে একটি থলে তৈরি হয়। প্রজননকালে বাবা মাছ মা মাছকে মুখ দিয়ে পেটে ধাক্কা দিতে থাকে আর অমনি কিছু ডিম মাছের লম্বা প্রজনন নল দিয়ে বেরিয়ে বাবার থলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। মাছের তো আর কোনো হাত নেই যে, সে ডিমগুলো হাতে ধরে ধরে থলেতে পুরবে। তাই কয়েকটা ডিম যখনই নলের মুখে আসে তখনই সে নাচের মুদ্রায় দ্রুত সামনে ছুটে আর ডিমগুলো থলের তলদেশে চলে যায়। বারবার এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাবা মাছ সব ডিম তার থলের মধ্যে পুরে নেয়। এবার ডিমগুলোকে তা দেওয়ার পালা। দুই সপ্তাহ পর ডিম পোনা মাছে পরিণত হয়। পিতার পেটের মধ্যে থাকা থলেতে পোনা মাছগুলো কিলবিল করতে থাকে। এক সময় থলে থেকে পোনাগুলো বেরিয়ে আসে আর বাবার কাছে ঘুর ঘুর করতে থাকে। আর বড় কিছু দেখে ভয় পেলে দৌড়ে আবার বাবার নিরাপদ থলেতে আশ্রয় নেয়। বাবাও এর জন্য তৈরি থাকে। মা মাছটিকে ডিম পাড়ার পর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ব্যবস্থা দ্বীপ মহাদেশ অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারুর কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা নিশ্চয়ই জানি বাচ্চা লালন-পালনের জন্য ক্যাঙারুর পেটের অংশেও একটি থলে থাকে। যেখানে মুখ বের করে বাচ্চা-ক্যাঙ্গারু বসে আছে, এমন ছবি আমরা প্রায়ই দেখতে পাই।

মো. আসাদুজ্জামান 
মুলসুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=11-12-2010&type=gold&data=Hotel&pub_no=225&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=3

জুলিয়ান চে গুয়েভারা!

অস্ট্রেলিয়ার ব্রিজবেন শহরে মিছিল। মিছিলকারীদের হাতে হাতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ছবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড। কণ্ঠে উচ্চকিত স্লোগান ‘আমরা সবাই জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ’। মিছিল থেকে পড়ে শোনানো হলো ব্রিটেনে বসবাসরত অস্ট্রেলীয় লেখক-সাংবাদিক জন পিলজারের একটি চিরকুট: ‘জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে দাঁড়ানো আমার সারা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর অন্যতম।’ মিছিলের নেত্রী জেসিকা পেইনি বললেন, ‘আমরা এখানে জড়ো হয়েছি উইকিলিকসকে রক্ষা করতে, তথ্যপ্রবাহের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে; আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমাদের জানার অধিকারকে রক্ষা করতে।’
কিন্তু জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের স্বদেশ অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচিত সরকার নিয়েছে অন্য পক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক নথিপত্র প্রকাশের পরপর দেশটির প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড বললেন, উইকিলিকস বেআইনি কাজ করেছে। কয়েক দিন আগে তিনি যখন এমন কথা বলেছিলেন, তখন সাংবাদিকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, উইকিলিকস অস্ট্রেলিয়ার কোন আইন ভঙ্গ করেছে। গিলার্ড কোনো উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু বৃহস্পতিবার দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল জানালেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া গোপনীয় সরকারি নথিপত্র সংগ্রহ বা গ্রহণ ও বিতরণ করা অস্ট্রেলীয় আইন অনুযায়ী অপরাধ। কিন্তু সে অপরাধের বিচার করতে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে কোন আইনে মামলা করা যায়, সে সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশের কাছ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো পরামর্শ পায়নি। তারা অ্যাসাঞ্জকে ফাঁসানোর একটা আইনি হাতিয়ার খুঁজে পেতে দিন-রাত গলদঘর্ম হচ্ছে।
অস্ট্রেলীয় সরকারের এই অবস্থানের বিরুদ্ধে এবং অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকসের পক্ষে জনসমর্থন ক্রমেই বাড়ছে। অ্যাসাঞ্জ লন্ডনে গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত মানবাধিকার আইনজীবী ও প্রত্যর্পণ-সংক্রান্ত আইনের বিশেষজ্ঞ জিওফ্রে রবার্টসন কিউসি সিডনি থেকে লন্ডনে ছুটে গেছেন অ্যাসাঞ্জকে আইনি সহায়তা দিতে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, অ্যাসাঞ্জকে প্রথমে সুইডেনে ও চূড়ান্তভাবে আমেরিকায় প্রত্যর্পণের চেষ্টা চলবে। একই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় আইনজীবী, সিনেটর, মানবাধিকারকর্মী, লেখক, সাংবাদিক, অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীরা অ্যাসাঞ্জের সমর্থনে খোলা চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী গিলার্ডের উদ্দেশে, সেই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সরকার এসবের কিছুই ভ্রুক্ষেপ না করে আমেরিকার মন জুগিয়ে উইকিলিকসের বিরুদ্ধে মামলা করার পন্থা খুঁজছে দেখে দেশটির স্বতন্ত্র সাংসদ অ্যান্ড্রু উইলকি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী গিলার্ড অস্ট্রেলিয়ার জনগণের স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন আমেরিকার সরকারের স্বার্থকে; তিনি ক্ষুণ্ন করছেন অস্ট্রেলিয়ার সার্বভৌমত্ব। ‘গেটআপ’ নামের এক রাজনৈতিক লবি গ্রুপ ঘোষণা করেছে, আগামী সপ্তাহে তারা আমেরিকার পত্রপত্রিকায় অস্ট্রেলীয় নাগরিকদের স্বাক্ষর করা একটি চিঠি প্রকাশ করবে, যেখানে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে: অ্যাসাঞ্জের হয়রানি বন্ধ করুন। গ্রুপটির পরিচালক স্যাম ম্যাকক্লিন দি অস্ট্রেলিয়ান পত্রিকার কাছে মন্তব্য করেছেন, ‘আমাদের সরকারের দায়িত্ব এ দেশের নাগরিকদের অধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া। কিন্তু সরকার সে দায়িত্ব পালন করছে না। তাই আমরা অস্ট্রেলিয়ার জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন, আমরা নিজেরাই তা করতে ঐক্যবদ্ধ হই।’
ছেলের জন্য বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অ্যাসাঞ্জের মা ক্রিস্টিন। অস্ট্রেলিয়ার দ্য সানশাইন কোস্ট ডেইলি পত্রিকাকে তিনি বলেছেন, ‘আমি তো কোনো ন্যায়বিচার দেখতে পাচ্ছি না। আমার ছেলে নিজের ইচ্ছায় পুলিশের কাছে গেল, আর তারা তাকে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে গারদে ঢোকাল!’
অ্যাসাঞ্জের ২০ বছরের ছেলে ড্যানিয়েল বাবার মতোই বুদ্ধিমান। তাঁরও মনে হচ্ছে, তাঁর বাবাকে আসলে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তিনি তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘আমি আশা করব, এটা যেন তাকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার একটা মধ্যবর্তী পদক্ষেপ না হয়।’ যৌন অপরাধসংক্রান্ত সুইডিশ আইন সম্পর্কেও তিনি খোঁজখবর করেছেন এবং লিখেছেন, নিরপেক্ষ বিচার হলে তাঁর বাবার শাস্তি হওয়ার মতো কিছু তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু দাদির মতো তিনিও শঙ্কিত, তাঁর বাবা হয়তো ন্যায়বিচার পাবেন না।
বাস্তবেও শঙ্কা ঘনিয়ে উঠছে অ্যাসাঞ্জের পরিণতি নিয়ে। যেকোনো প্রকারেই হোক, আমেরিকা তাঁকে হাতের মুঠোয় পেতে চায়। সুইডেনে দুই মহিলা তাঁর বিরুদ্ধে যৌন অপরাধের যে অভিযোগ তুলেছেন, তা এতই সামান্য যে সে জন্য অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার প্রয়োজন ছিল না। লন্ডনের একটি থানায় হাজিরা দিতে গেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং জন পিলজার, জেমাইমা খানের মতো ব্যক্তিদের জামিনদার পেয়েও ব্রিটিশ আদালত তাঁকে জামিন দেননি। কারাগারে নেওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আইনজীবীদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি, একবার মাত্র তিন মিনিটের জন্য টেলিফোনে আলাপ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাঁর আইনজীবীরা বলছেন, মক্কেলের সঙ্গে আলাপের সুযোগ না পেলে মামলা লড়তে তাঁদের খুব অসুবিধা হবে।
যে অভিযোগে সুইডিশ প্রসিকিউটররা অ্যাসাঞ্জকে সে দেশে নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন, সেটি গত আগস্ট মাসের। স্টকহোমে দুই মহিলা অ্যাসাঞ্জের ব্যাপারে কিছু অভিযোগ করেছিলেন (যৌন আচরণসংক্রান্ত, কিন্তু মোটেও ধর্ষণ নয়)। সেপ্টেম্বরে সুইডেনের প্রধান প্রসিকিউটর অ্যাসাঞ্জকে বলেছিলেন, বিষয়টি তাঁরা খতিয়ে দেখেছেন, এ নিয়ে আর তদন্ত-জিজ্ঞাসাবাদের কিছু নেই। কিন্তু নভেম্বর মাসে একজন সুইডিশ রাজনীতিক এর মধ্যে নাক গলিয়ে দেন। অ্যাসাঞ্জের ব্রিটিশ আইনজীবী মার্ক স্টিফেন্স বিবিসি ওয়ান টিভির ‘অ্যান্ড্র মার শো’তে বলেন, ‘এটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার, কারণ সুইডেন সেপ্টেম্বর মাসে পুরো মামলাটা খারিজ করে দিয়েছিল, কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরই একজন রাজনীতিকের হস্তক্ষেপে নতুন একজন প্রসিকিউটরের মাধ্যমে মামলাটি আবার তোলা হলো। আর ঘটনাটি ছিল স্টকহোমের, কিন্তু নতুন প্রসিকিউটরকে আনা হলো গটেনবার্গ থেকে, মামলা সাজানো হলো নতুন করে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করানো হলো।’
বিষয়টি যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, তা বুঝতে কারোরই কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। লন্ডনের পুলিশ অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তারের পর বলেছে, এই গ্রেপ্তারের সঙ্গে উইকিলিকসের কূটনৈতিক নথি প্রকাশের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু লন্ডন পুলিশের এই ব্যাখ্যা কেউই বিশ্বাস করে না। প্রায় সবাই বুঝতে পারছে: এক গভীর আইনি কারসাজি চলছে তাঁকে শেষ পর্যন্ত আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার মতলবে। এরই মধ্যে খবর মিলেছে, অ্যাসাঞ্জকে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের পরই যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে মার্কিন ও সুইডিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক সলাপরামর্শ চলছে। মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট ১৯১৭ সালের স্পাইয়োনেজ অ্যাক্টের অধীনে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আইনটিকে বলা হয় প্রাচীন, মরচেপড়া আইন, যেটির প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে। ওটি এখন আর কোনো কাজেই লাগে না। কিন্তু মার্কিন সিনেটের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির প্রধান জো লিব্যারম্যান বলেছেন, অ্যাসাঞ্জ যা করেছেন, তা তাঁদের পুরো ইতিহাসে স্পাইয়োনেজ অ্যাক্টের সবচেয়ে গুরুতর লঙ্ঘন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়াশিংটন মুখপাত্র ফিলিপ ক্রাউলিও বলেছেন, ‘উইকিলিকস যা করেছে, তা মার্কিন আইনে একটা বড় অপরাধ।’ স্পাইয়োনেজ অ্যাক্ট যদি অ্যাসাঞ্জের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব না হয়, তাহলে আরও অনেক আইন আছে বলে দাবি করেছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার। উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, চুরি যাওয়া সম্পদ হস্তগত করার অভিযোগে মামলা করা হবে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ মার্কিন গোপন কূটনৈতিক নথিপত্রগুলো অ্যাসাঞ্জ নিজে চুরি করেননি, বরং ব্র্যাডলি ম্যানিং নামের এক মার্কিন যুবক ইন্টেলিজেন্স অ্যানালিস্ট তাঁর কাছে পাচার করেছেন, এমন যুক্তি তোলা হলে তাঁরা দেখাবেন যে ওই পাচার করা মাল হস্তগত করাটাই হয়েছে অ্যাসাঞ্জের অপরাধ।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী হতে পারে অ্যাসাঞ্জের সেরা রক্ষাকবচ। এতে সংবাদমাধ্যমের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। মার্কিন কূটনৈতিক নথি প্রকাশের দায়ে যদি অ্যাসাঞ্জের বিচার করতে হয়, তাহলে নিউইয়র্ক টাইমসসহ যেসব বড় সংবাদপত্র ওই নথিগুলো নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাদের সম্পাদকদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে, কেউ কেউ এমন কথাও বলেছেন। কিন্তু সেটা করা সম্ভব নয়। অ্যাসাঞ্জকে শাস্তি দেওয়ার পথে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী একটা বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে, এটা ভেবেই সম্ভবত হোয়াইট হাউস মুখপাত্র রবার্ট গিভসসহ মার্কিন কর্তারা জোর দিয়ে বলছেন, অ্যাসাঞ্জ সাংবাদিক নন, উইকিলিকস কোনো সংবাদমাধ্যম নয়। আইনিভাবে এটা তাঁরা প্রমাণ করার জোর চেষ্টা চালাবেন। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির হলেও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যে সাংবাদিক, এই দাবি উড়িয়ে দেওয়া খুবই কঠিন। কেউ খুব জোর করে বলতে পারেন, এযাবৎকালের সাংবাদিকতায় যে এথিকস বা আচরণবিধি মেনে চলার কথা বলা হয়ে আসছে, যে দায়িত্বশীলতার প্রশ্নগুলোকে বড় করে দেখা হচ্ছে, অ্যাসাঞ্জ সেগুলো মানেন না, মানবেন না। কারণ, তিনি একজন বিপ্লবী অথবা নৈতিক নৈরাজ্যবাদী। এসেছেন গোপনীয়তার সমস্ত আগল ভেঙে চুরমার করতে, সবকিছু উল্টেপাল্টে দিয়ে সত্যকে মানবজাতির চোখের সামনে তুলে ধরতে। তাঁর মিশন টোটাল ট্রান্সপারেন্সি বা পরিপূর্ণ স্বচ্ছতার মিশন।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এ বড় বিপজ্জনক এক অভিযান। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর সরকারকে তিনি বেকায়দায় ফেললেন এই নিয়ে তৃতীয়বার। আল-কায়েদা আমেরিকার যে ক্ষতি করতে পারেনি (আসলে করেছে উল্টোটা), অ্যাসাঞ্জ করেছেন তার চেয়ে শতগুণ বেশি। তিনি আমেরিকান জনগণের সামনে উলঙ্গ করেছেন তাদের নির্বাচিত সরকারকে, যাদের করের টাকায় সরকার ও তার যুদ্ধযন্ত্র চলে এবং দেশে দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন ইত্যাদি রপ্তানি করার কথা বলে উল্টো কাজ করে। আমেরিকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকেরা তাই বলছেন, উইকিলিকস আমাদের গণতন্ত্রকে স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করতে সাহায্য করছে।
কিন্তু এ এক ভয়ংকর লড়াই। যাঁদের অ্যাসাঞ্জ নিজের জনগণের সামনেই উলঙ্গ করেছেন, তাঁরা যে তাঁর শির চাইবেন, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক পাঠকের প্রতিক্রিয়া দেখলাম, ‘অ্যাসাঞ্জ ইজ অর উইল বি কনসিডারড অ্যাজ চে গুয়েভারা অব দি ইনফরমেশন এইজ।’ এ প্রসঙ্গে ওই পত্রিকায়ই পড়লাম মার্টিন ফ্ল্যানাগান নামের এক লেখকের লেখা। তিনি চের ভক্ত নন, বরং তাঁকে অপছন্দ করেন বলেই মনে হলো, লিখেছেন, ‘১৯৬৭ সালে চে গুয়েভারা খুন হয়েছিলেন আমেরিকা-সমর্থিত বলিভীয় সরকারের এজেন্টদের হাতে। চে ওই দেশে একটা বিপ্লব উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, যে বিপ্লব নিয়ে সেখানকার জনগণের কোনো আগ্রহ ছিল না। তবুও চে গুয়েভারাকে স্মরণ করা হয় তাঁর সময়ের একজন স্মারক হিসেবে, সেই সময়ের প্রধান কতকগুলো উত্তেজনাময় ঘটনা জড়িয়ে আছে তাঁর জীবনের সঙ্গে। আমার মনে হচ্ছে, অ্যাসাঞ্জও শেষ পর্যন্ত ওই রকম একজন ব্যক্তিত্বের পরিণতি লাভ করবেন।’
তাই কি?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com 
 
মুলসুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=11-12-2010&type=gold&data=University&pub_no=225&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=2

নওগাঁর ঐতিহাসিক প্রত্নস্থল মাহিসন্তোষ



মাহিসন্তোষ নওগাঁ জেলায় অবস্থিত পুরাকীর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী ধামইরহাট উপজেলায় এই ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিটির অবস্থান। ঐতিহাসিক প্রত্নস্থল মাহিসন্তোষ ধামইরহাট উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের ভারত সীমান্তঘেঁষা চৌঘাট মৌজায় অবস্থিত। ধামইরহাট সদরের ফারসিপাড়া নামক স্থান থেকে পশ্চিমমুখী একটি কাঁচা সড়ক ধরে ৬ কিলোমিটার চলার পর প্রত্নস্থলটিতে পেঁৗছানো যায়। প্রত্নস্থলটিতে বর্তমানে একটি মাঝারি আকারের পাঁচিল ঘেরা চতুষ্কোনাকার দুর্গ রয়েছে। কয়েকটি দিঘি, পুকুর, রাজবাড়ি ও বারোদুয়ারী নামের একটি ঢিবি এবং একটি মাজার রয়েছে। দুর্গের উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তঘেঁষা একটি প্রশস্ত খাল রয়েছে।

প্রত্নস্থলটির উত্তর প্রান্তে চারটি অসম বাহুর সমন্বয়ে এ দুর্গটি গঠিত। চতুষ্কোণ দুর্গটির পূর্ব বাহু ২৩২ মিটার, দক্ষিণ বাহু ১৯২ মিটার লম্বা। মাটির পাঁচিলগুলো আজও ৩.৫ মিটার উঁচু এবং ১৬.৭৬ মিটার চওড়া। দুর্গের বাইরে পূর্ব দিকে পুরোপুরি এবং উত্তর দিকে কয়েক মিটার ঘিরে যে সংলগ্ন খাল রয়েছে সেটি গড়ে ২৫ মিটার চওড়া এবং ২.৭৫ মিটার গভীর। দুর্গের ভেতরের অংশের জমিপিঠ এবড়ো-থেবড়ো। বিভিন্ন স্থানে পাটকেল ও খোলামকুচির ঘন সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়।

দুর্গের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ঘেঁষে বাইরের দিকে মাজার নামে একটি স্থান রয়েছে। এর ভেতরে পাশাপাশি দুটি কবর রয়েছে। লোকে বলে এ দুটি কবর মাহিসন্তোষ ও তার কন্যার কবর। এছাড়া মাজারের বাইরে আরও একটি কবর রয়েছে। কবরটি হলো এক উজিরের। কবরটি ১৪ হাত লম্বা। যা কোথাও কোনোদিন দেখা যায়নি। এ মাজারের সামান্য পশ্চিমে আরও কয়েকটি পুরনো কবরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। লোকে বলে এগুলোও উজিরের কবর। উজিরের কবরের দক্ষিণ-পূর্বে রাজবাড়ি। সম্প্রতি এগুলোকে ঘিরে নতুন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। তবে এ মাহিসন্তোষের ইতিহাস জানার মতো কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি। অতীতে এ স্থান থেকে খ্রিস্টাব্দ ১৫ শতকের চারটি আরবি লিপি পাথরে উৎকীর্ণ অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। এ স্থানে সম্প্রতি কাঁচা মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। তবে পশ্চিম দিকে একটি অবতল মেহরাবসহ উত্তর-দক্ষিণে লম্বা একটি ভাঙা ইটের দেয়ালের চিহ্ন দেখা যায়। দেয়ালটির কয়েকটি স্থানে পাথরের বহিরাবণের চিহ্নও রয়েছে। পশ্চিম দেয়ালের সমান্তরালে কিছুদূর পূর্বে এক সারি (বর্তমানে দুইটি) পাথরের থামও দাঁড়ানো রয়েছে। এ প্রত্নস্থলে ১৯১৮ সালে তদানীন্তন বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি সীমিত আকারের একটি খননও পরিচালনা করেছিল। ওই সময় এ ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি পাথরের উৎকীর্ণ অবতল মেহরাব সংগ্রহ করে ওই সমিতির রাজশাহীস্থ সংগ্রহশালায় (বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘর) নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওই সময় প্রথম ধ্বংসস্তূপটি থেকে ১৫০৬-১৫০৭ সালের জনৈক সুহাইলের পুত্রের নিমির্ত একটি মসজিদ সম্পর্কিত আরবি ভাষ্য উৎকীর্ণ একটি পাথরের ফলক আবিষ্কৃত হয়েছিল। সেটি বর্তমানে রাজশাহী শহরের বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

বারোদুয়ারী রাজবাড়ি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উত্তর-পূর্বে মিঠাপুকুর এবং দক্ষিণ-পূর্বে সরকপুকুর নামে দুটি পুকুর রয়েছে। এছাড়া গোটা এলাকায় আরও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ইট-পাটকেলসহ অজস্র খোলামকুচি ও পাথর খণ্ড।

মাহিসন্তোষের সঠিক ইতিহাস জানার মতো কোনো কিছুই বর্তমানে সেখানে নেই। তবে চৌঘাট বা এর আশপাশে প্রাক-ইসলামী আমল থেকেই কোনো না কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কেন্দ্রের অস্তিত্ব ছিল। সেই কেন্দ্রের ধ্বংসাবশেষের উপরই খ্রিস্টাব্দ ১৩ শতকের মুসলিম বিজেতারা কোনো একটি সেনাশিবির গড়ে তুলেছিলেন। সেই সেনাশিবির অন্তত খ্রিস্টাব্দ ১৬ শতক পর্যন্ত টিকে ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত এটি প্রশাসনিক কেন্দ্রের পাশাপাশি একটি ধর্মীয় কেন্দ্রেও পরিণত হয়েছিল। আবার অনেকের বিশ্বাস, বখতিয়ার খিলজি আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর তার স্থলাভিষিক্ত ইজউদ্দীন মোহাম্মদ শিরান খিলজি (খ্রিস্টাব্দ ১২০৭ থেকে ১২০৮ সাল) এখানেই একইভাবে নিহত ও কবরস্থ হয়েছিলেন। তাছাড়া এটি ছিল সুলতানী আমলের বারবকাবাদ প্রশাসনিক এলাকার টাকশাল। এ ঐতিহাসিক প্রত্নস্থলটি জেলার মধ্যে অন্যতম। 
*বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ 
মুলসুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=11-12-2010&type=gold&data=University&pub_no=225&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=2

রাজশাহীর কসবা অপারেশন এবং একজন বীরপ্রতীক


মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্তবর্তী লালগোলার পাহাড়পুর আমবাগান ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা ছিল প্রায় ৭০ জন। সীমান্তের এপার রাজশাহীর গোদাগাড়ীর চাপাল মসজিদে ছিল রাজাকারদের ক্যাম্প। সেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অবস্থান করত। টহল জিপ নিয়ে রাত ১০টার দিকে তারা অপারেশনে নামতো। ফলে ভারত থেকে নদীপথে পদ্মা পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। ওই যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে মুক্তিযোদ্ধা নূর হামিম রিজভী বলেন, কোনো হতাহত ছাড়াই আমরা কসবা অপারেশনে সফল হই। আজও স্পষ্ট মনে রয়েছে, একদিন ৭ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী আমাকে ডেকে পাঠান। আমি মেজর গিয়াসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাকে কসবা অপারেশন সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে বলেন, হানাদার বাহিনীর টহল জিপকে অ্যাম্বুসে ফেলে খতম করতে পারলে ওরা ভয় পেয়ে যাবে। ওদের নিয়মিত নির্বিঘ্ন চলাচল বন্ধ করতে হবে। তার নির্দেশ পেয়ে আমরা অপারেশন করি। পদ্মাপাড়ের প্রাইমারি স্কুলে আমাদের সাহায্যের জন্য একজন গাইড বসে থাকতেন। ধারে কাছে হানাদার বাহিনী থাকলে তার হাতের হারিকেন উল্টিয়ে নিভিয়ে দিতেন। আমরা সতর্ক হয়ে যেতাম।

সেদিন ছিল ৭ নভেম্বর। রাত ৯টায় কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে পূর্ব-নির্ধারিত কসবা আখ সেন্টারে পজিশন নেন রিজভী। সঙ্গে ২টি এলএমজি, ১টি টু ইঞ্চি মর্টার, ৫টি ফায়ার ও থার্টিসিক্স গ্রেনেড, ১টা এসএমজি, ১০টা এসএলআর ও প্রয়োজনীয় অ্যামুনেশন্স। রাস্তার মোড়ে একটা ঝোঁপ দেখে সেখানে বেঁধে দেয়া হলো সাদা কাপড়। জিপ বা লরির লাইটের আলো সাদা কাপড়ের ওপর পড়লে হানাদার বাহিনীর আগমন নিশ্চিত করা যাবে। কিন্তু নিজেরা হানাদারদের নজরে আসবে না। ফিরে এসে অ্যাম্বুস সম্পর্কে সহযোদ্ধাদের ব্রিফ করেন, ঝটপট লাইন ফরমেশনে অ্যাম্বুস পার্টিকে সাজিয়ে নেন। পূর্ব-পশ্চিম প্রান্তে দু'টি এলএমজি, মাঝে ১০টি এসএলআর, দেড়শ' গজ পেছনে একটি বাবলা গাছের গোড়ায় বসানো হলো টু ইঞ্চি মর্টার। রাত ১১টা দিকে হানাদার বাহিনীর একটি খোলা জিপ আসে। ওপরে বসানো মেশিনগান। সতর্ক দাঁড়িয়ে আছে হানাদার সেনা। জিপ নির্ধারিত স্পটে পেঁৗছলে গর্জে ওঠে নূর হামিম রিজভীর এসএমজি। থেমে থাকেনি সহযোদ্ধাদের হাতিয়ার। গুলিতে পাকিস্তানি বাহিনীর জিপটি মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। অপারেশন শেষে পাকিস্তান সেনাদের অস্ত্র, বিধ্বস্ত ওয়ারলেস সেট ও মেশিন গানের নল খুলে নেন অপারেশনে অংশ নেয়া সহযোদ্ধারা। অপারেশন শেষে তারা যান নিজেদের ক্যাম্পে। এভাবেই শেষ হয় কসবা অপারেশন। নূর হামিম রিজভী জানান, রাজশাহী কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী থাকা অবস্থায় শুরু হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমাকে আলোড়িত করে ব্যাপকভাবে। যুদ্ধে অংশ নিতে আমি ট্রেনিংয়ে যাওয়ার মনস্থির করলাম আপনজনদের বারণ সত্ত্বেও; কিন্তু আমার মা বললেন, 'যারা নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন ও গণহত্যা চালাতে কুণ্ঠাবোধ করে না, তাদের শায়েস্তা-বিতাড়িত না করে, অপকর্ম নীরবে সহ্য করতে আমার ছেলে ঘরে বসে থাকতে পারে না।' মায়ের এ কথা ও নির্দেশনাই আমাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সাহস জুগিয়েছে। তিনি বললেন, ব্যক্তিগতভাবে কিছু পাওয়ার আশায় মুক্তিযুদ্ধ করিনি। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ পেয়েছি, মানচিত্র পেয়েছি। জাতি আমাকে বীরপ্রতীক উপাধি দিয়েছে, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছি, বাংলায় কথা বলতে পারছি। এর চেয়ে বড় পাওয়ার আর কি আছে। তবে আমার এখন একটাই চাওয়া_ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তাদের শাস্তি।

দুই ছেলে বাঁধন, প্রত্যয় ও স্ত্রী ইলাকে নিয়ে রাজশাহী নগরীর ফুদকীপাড়ার পৈতৃক নিবাসে বসবাস করেন নূর হামিম রিজভী।

শ. ম সাজু, রাজশাহী 
মুলসুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=12-12-2010&type=gold&data=Mobile&pub_no=226&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=5

লালপুরের মৃৎশিল্প


প্রয়োজনীয় উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, পুঁজির অভাব, প্লাস্টিক-এলুমিনিয়াম ও স্টিলের তৈজসপত্রের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে লালপুরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। ফলে মৃৎশিল্পী পরিবারে নেমে এসেছে দুর্দিন।

উপজেলার মাধবপুর, বিলমাড়ীয়া, ওয়ালিয়া, পালিদহ ও গৌরীপুর পালপাড়ায় শতাধিক পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত। ১০ বছর আগেও এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার। উপকরণের অভাব ও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মৃৎশিল্পীরা পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। কারখানায় তৈরি কাচ, প্লাস্টিক, স্টিল, মেলামাইন, সিরামিক, টিন, এলুমিনিয়ামের জিনিসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না মৃৎশিল্প। কমে যাচ্ছে মাটির তৈরি দ্রব্য সামগ্রীর চাহিদা।

প্রবীণ মৃৎশিল্পীদের মতে, ব্রিটিশ আমল থেকে লালপুরের মৃৎশিল্প ছিল সমৃদ্ধ ও সমাদৃত। এসব এলাকার কুমারদের তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, বদনা, কলস, গামলা, ঝাঁজর ও রকমারি পিঠা তৈরির ছাঁচের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালি সামগ্রীর কদর ছিল সর্বত্র। এছাড়া কারুকার্যখচিত শো-পিস, পুতুল, খেলনা, দেব-দেবীর মূর্তিসহ বিভিন্ন মৃৎদ্রব্য ছিল মেলা ও প্রদর্শনীর প্রধান আকর্ষণ। মৃৎশিল্পে ব্যবহার্য সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্যতা ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বাজারমূল্য কুমাররা পাচ্ছে না। মৃৎসামগ্রী তৈরিতে প্রয়োজন হয় উপযুক্ত মাটি, বালি এবং পোড়ানোর জন্য তুষ ও খড়জাতীয় জ্বালানি। আগে এঁটেল মাটি ও বালি বিনামূল্যে সংগ্রহ করা যেত। আর জ্বালানির জন্য খড়, কাঠের গুঁড়া, ধানের তুষ, আখের শুকনা পাতা বিনামূল্যে পাওয়া যেত। এসব অপরিহার্য উৎপাদন সামগ্রী ও কাঁচামাল উচ্চমূল্য দিয়েও এখন পাওয়া যায়। এছাড়া ব্যবহার্য রং ও অন্যান্য সামগ্রীর দামও বেড়েছে। মৃৎশিল্পী পরিবারের পুরুষ-মহিলা ও শিশুরা সারাদিন তৈরি করে মাটির জিনিস। বিশেষভাবে তৈরি চুলার সাহায্যে তা পোড়ানো হয়। মাধবপুর পালপাড়ার অঞ্জলি রানী বলেন, আমরা আজ অসহায় হয়ে পড়েছি। আমাদের বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখতে মৌসুম অনুযায়ী কিছু জিনিস তৈরি করে কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছি। ঐতিহ্যমণ্ডিত লালপুরের কুটিরশিল্পটির অস্তিত্ব রক্ষা করা প্রয়োজন। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও সহযোগিতা দরকার। অভিজ্ঞমহল মনে করেন, এখনই পদক্ষেপ না নিলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে লালপুরের মৃৎশিল্প।

আবদুল বারী, লালপুর (নাটোর)
মুলসুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=12-12-2010&type=gold&data=Income&pub_no=226&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=4

অমর বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলাই

অমর বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলাই এর জন্ম-১৫ ফেব্রুয়ারি ১৫৬৪ খ্রি.। আর মৃত্যু-৮ জানুয়ারি ১৬৪২ খ্রি। এই তারিখের উল্লেখ রয়েছে 'দি নিউ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা' থেকে। তবে এই তারিখ নিয়ে বিভেদ রয়েছে। জন্ম তারিখ বিভিন্ন বইয়ে বিভিন্ন রকম থাকলেও মৃত্যু তারিখ নিয়ে তেমন মতভেদ নেই। আর তার বাসস্থান ছিল- ইতালির তুসকানের গ্র্যান্ডডাচিতে।

আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের জন্য যে কোনো একক ব্যক্তির চেয়ে গ্যালিলিওর অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি চিরায়ত পদার্থবিদ্যার প্রধান প্রতিষ্ঠাতা। গ্যালিলিও প্রথম বিপ্লব আনেন বল বিদ্যায়। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের (খ্রি.পূ.৩৮৪-খ্রি.পূ.৩২২০ শিক্ষা ছিল, হালকা বস্তুর চেয়ে ভারী বস্তু দ্রুতগতিতে নিপতিত হয়। পরবর্তী প্রজন্মসমূহের পণ্ডিতরা এই মতবাদকে মেনে নিয়েছিলেন। গ্যালিলিও এ মতবাদকে যাচাই করতে মনস্থ করেন। তিনি পর পর অনেকগুলো পরীক্ষণকাজ পরিচালনা করেন। তিনি দেখতে পান, অ্যারিস্টটলের মতবাদ সঠিক নয়। আসল ঘটনা হল, ভারী ও হালকা বস্তু একই বেগে পতিত হয়। বেগ মাত্রার তারতম্য সৃষ্টি হয় বায়ুর সঙ্গে সংঘর্ষণের কারণে। টোলেমি (খ্রিস্টিয় ২য় শতাব্দী) বলেছিলেন, পৃথিবী স্থির রয়েছে। সূর্যসহ সব গ্রহসমূহ তাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। অ্যারিস্টটলও তা-ই বলে গেছেন। এই মতবাদ চলে আসছে দুই হাজার বছর ধরে। কিন্তু গ্যালিলিও এই মতবাদে বিশ্বাসী নন। তিনি নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) এর মতে বিশ্বাসী। অর্থাৎ পৃথিবীসহ সব সূর্যকেই প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু এ চিন্তাধারার সমর্থনে প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়ার পরই তিনি জনসাধারণের সম্মুখে এ চিন্তাধারা সমর্থন করা শুরু করেন। এর ফলে অ্যারিস্টটলবাদী পণ্ডিতরা বিরক্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হন এবং কোপারনিকাসবাদ নিষিদ্ধ করার জন্য ক্যাথলিক চার্চকে প্ররোচিত করতে থাকেন। গ্যালিলিও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে রোমের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। তার যুক্তি ছিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কে কিছু বলার উদ্দেশ্য বাইবেলের ছিল না। যেখানে বাইবেলের সঙ্গে সাধারণ বুদ্ধির দ্বন্দ্ব বাইবেল সেখানে রূপক। কিন্তু চার্চের ভয় ছিল এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে প্রোটেস্টেন্টদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ক্ষতি হবে। সুতরাং তারা দমননীতি গ্রহণ করেন। তারা আদেশ জারি করেন যে, গ্যালিলিও কখনো এ মতবাদ মেনে চলতে কিম্বা এর স্বপক্ষে প্রচার করতে পারবে না। বৃদ্ধ বয়সেও গ্যালিলিওকে দিয়ে ঘোষণা করতে বাধ্য করান যে, 'আমি ফ্লোরেন্সের পরলোকগত ভিনসেনজিও গ্যালিলির পুত্র ৭০ বছর বয়স্ক গ্যালিলিও গ্যালিলাই আদালতের কাঠগড়ায় হাজির... সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ স্থল এবং গতিহীন স্থির ...এই ভ্রান্ত ধারণা আমি ত্যাগ করছি, আমি কোনো প্রকারেই আর উক্ত ভ্রান্ত তথ্য সমর্থন, প্রচার বা ঘোষণা করব না।' ১৬৩২ সালে প্রকাশিত তার গ্রন্থ 'জগতের দুটি প্রধান পদ্ধতি সম্বন্ধে মতবিনিময় টোলেমিয় ও কোপারনিকাসিয়' থেকে নমুনা স্বরূপ কয়েকটি লাইন উল্লেখ করছি। উল্লেখ্য, এ গ্রন্থটিই চার্চের সঙ্গে তার সংঘাতের কারণ ছিল। এরপর সালভিয়াতি বলেন 'এখন এটা যদি সত্যি হয় যে, সেই বিন্দুটাই বিশ্বের কেন্দ্র যার চতুর্দিকে সমুদয় বর্তুল এবং বিশ্ব বস্তুরা অর্থাৎ গ্রহরা ঘোরে তাহলে এটা সুনিশ্চিত যে, পৃথিবী নয় সূর্যকেই বিশ্বের কেন্দ্রে দেখা যাবে। অতএব, এই প্রথম সাধারণ ধারণা অনুসারে প্রধান আসন সূর্যেরই এবং পৃথিবী কেন্দ্র থেকে ঠিক তত দূরে যতখানি সে সূর্য থেকে দূরে।'

যাহোক, ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ শিক্ষকতা এবং গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাপারে ও গ্যালিলিওর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কিন্তু তার চিন্তা করার ক্ষমতা এবং গ্রন্থ রচনা করার কাজ বন্ধ করতে পারেননি। অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বন্দীদশাকালে তিনি গতির নিয়ামক সম্পর্কিত সূত্রাবলী শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেন। নানা দুঃখ কষ্ট আর অভাব অনটনে এই মহান বিজ্ঞানী ও মহামানব জ্বরে ধুকে ধুকে গৃহবন্দীর নয় বছরের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর ৩২৬ বছর পর ১৯৬৮ সালে ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ গ্যালিলিওকে বিনাশর্তে ক্ষমা প্রদর্শন এবং তার দণ্ডের আদেশ নাকচ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

ষমোবারক আলী 
মুলসুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=12-12-2010&type=gold&data=Hotel&pub_no=226&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=2

সাপের জুস আর মাংস



সাপের মাংস বা সাপের জুস খাবার কথা শুনলে অনেকের গা ঘিন ঘিন করে উঠবে। ভাববেন এটা একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। অবিশ্বাস্য হলেও এটা কিন্তু একেবারে সত্যি। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্রীড়াবিদরা প্রতিদিন হাজার হাজার সাপের মাংস আর সাপের জুস খেয়ে শিউল অলিম্পিকে পদকের জন্য লড়ে গেছেন। তাদের ধারণা এটা নাকি বলবর্ধক টনিকের মতো কাজ করে, এর চেয়ে ভালো শক্তিবর্ধক টনিক নাকি আর নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্রীড়াবিদদের দেখাদেখি অন্য কয়েকটি দেশের ক্রীড়াবিদরাও শিউল অলিম্পিকে গিয়ে এই উপাদেয় খাবার খেয়ে রসনা করেছেন আর শরীরে নাকি অসাধারণ বল ফিরে পেয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার কুস্তিগীর হ্যান মিয়াং একাই প্রতিদিন ২০০টি সাপ খেয়েছেন। এর মধ্যে কিছু সাপ কেটে মাংস রান্না করে খাওয়ানো হয়েছে, আর কিছু সাপের জুস করা হয়েছে। মেয়ে হকি খেলোয়াড় কিয়েং শুকের বক্তব্য, সাপের মাংস আর সাপের জুস সবচেয়ে বেশি শক্তি জোগাতে পারে। তিনি প্রতিদিন এই খাবার খেয়ে গেছেন অন্যান্য খাবারের সঙ্গে। এটা নাকি একটা তোফা খাবার। আগে তার এই সাপের মাংস বা জুস খাওয়ার অভ্যাস ছিল না। এবারই তিনি প্রথম খেলেন। খেয়ে অবশ্য তিনি বমি করেননি বা তার গা-ও গুলিয়ে উঠেনি। বেশ মজা করে খেয়েছেন, রসনাতৃপ্ত করেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য প্রতিদিন ৫০০ করে সাপ লেগেছে গত অলিম্পিকের সময়। এবারই প্রথম নয়, আসলে শিউলে কয়েক বছর আগে এই তথাকথিত উপাদেয় খাদ্যটি চালু হয়েছিল। সাপের মাংস আর জুস সে দেশের হোটেলগুলোতে দৈনিক খাদ্য তালিকায় রাখা হয়েছে। হোটেলগুলোর এতে রমরমা ব্যবসাও চলছে। অনেকে হয়তো জানতে চেয়েছেন, এই সাপের জুস কিভাবে তৈরি করতে হবে? পদ্ধতিটা বাতলে দিচ্ছি। তবে ব্যাপারটা গোপন রাখবেন কিন্তু। হ্যাঁ, সাপের পেটটা চিড়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলুন। মুণ্ডুটাকেও কেটে বাদ দিন। এরপর সস প্যানে পানি দিয়ে উনুনে চাপিয়ে দিন। তাতে সাপগুলো ছেড়ে দিন। ভালোমতো সেদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে নিয়ে একটা লম্বা কাপড়ের মধ্যে জড়িয়ে এক জায়গায় করে চাপ দিন। তা থেকে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়বে জুস।

মো. আসাদুজ্জামান 

মুলসুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=12-12-2010&type=gold&data=University&pub_no=226&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=1

আইন পেশায় সাদা-কালো পোশাক রহস্য


বিজ্ঞ বিচারক এবং আইনজীবীদের কোট বা গাউন কেন কালো, কেন তাদের সার্ট সাদা, কালো টুপি পরে বিজ্ঞ বিচারক কেন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন_ এসব নিয়ে অনেক মতামত রয়েছে। স্বীকৃত বিষয় হলো, রোমান আইনের কার্যক্রমে কালো কোটের উল্লেখ রয়েছে, যা ইংরেজদের মাধ্যমে মনস্তাত্তি্বক রহস্যের সারথী ধরে উপকথা হিসেবে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। বেঞ্চ ও বারের পোশাকের বিষয়ে বিশেষ করে কালো কোট, কালো গাউন, সাদা বো বা ব্যান্ড ইত্যাদি প্রাচীনপন্থিদের মতাদর্শের আলোকে প্রচলিত দুটি পদ্ধতি আছে। এটি আইন-বিজ্ঞানে আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ না থাকলেও আইনপাড়ায় বিশেষ রেওয়াজ ও আচারভিত্তিক রীতি হিসেবে প্রচলিত। রাজা তার পোশাকবিহীন সিংহাসনে বসলে যে অবস্থা হবে, এজলাসে কালো কোট বা গাউন ছাড়া একই অবস্থার সৃষ্টি হবে। সেখানে কোনো বার ও বেঞ্চের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে পোশাক-আশাকের ব্যাপারে আসামি ও ফরিয়াদির ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী যে বিষয়টি প্রবহমান, তা হলো কালো কোট বা গাউন, যা আইনপাড়ায় হাজার বছর ধরে চলে আসছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, আইন অন্ধ। অর্থাৎ একজন অন্ধের কাছে সবকিছুই সমান। সাদা ও কালোর কোনো ভেদাভেদ নেই। এ ছাড়া সাবুদ ও আলামতসহ (ঈষঁব) বাদী ও বিবাদী পক্ষের সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে বস্তুনিষ্ঠ জেরাকরণ Crossing) এবং সর্বোপরি যে রায় দেওয়া হয়, তার বাইরে কোনো আইনজীবী ও বিচারকের যাওয়ার ক্ষমতা নেই। এক্ষেত্রে বিশাল ক্ষমতা ও জ্ঞানের অধিকারী হলেও কোনো ব্যক্তিগত মতামত প্রয়োগ বা চাপিয়ে দেওয়ার এতটুকু অবকাশ নেই। আইনের দর্শনের আওতায় সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যেই সাদা লাঠি নিয়ে ভেবেচিন্তে এগোতে হয়। এর গুরুত্ব এত বেশি যে, সে ব্যাপারে কথিত আছে তৎকালীন কাজির এজলাসে অন্য সাধারণ প্রজার মতো স্বয়ং বাদশাহ নামদার ফরিয়াদি বা আসামি হিসেবে বিবেচিত, এর বাইরে নয়। সংক্ষেপে এই কথাই দাঁড়ায়_ আইনজীবী মামলার মেরিটের ওপর ভিত্তি করে সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্য যুক্তিতর্ক সংবলিত বক্তব্য রাখবেন। এর মধ্যে আইনের ধারা, উপধারা, বিধি, প্রবিধি, নজির ইত্যাদি টেনে আনতে পারেন। তেমনি বিজ্ঞ বিচারকও সব দিক বিবেচনা করে অন্যদিকে না তাকিয়ে বা আইনের স্বচ্ছতার রূপ পরিগ্রহ করে অন্ধত্বের প্রেক্ষাপটে সুবিবেচক ও বস্তুনিষ্ঠ রায় দেবেন।

এদিকে বিকল্প তত্ত্বে মনে করা হয়, কালো কোট বা গাউনের অর্থ নিজের পরিচয় গোপন রাখা। এ ছাড়া কালো কোট বা গাউনের মধ্যে গলায় সাদা বো বা ব্যান্ড ব্যবহারের প্রধান হেতু হলো তিমিরাচ্ছন্ন থেকে সাদা তথা আসল সত্যকে খুঁজে বের করা। (As the Bow & Band being the symbol of keying or searching out hidden real truth of incidence.) ইতিপূর্বে বাংলাদেশসহ ব্রিটিশ কলোনিগুলোতে বেঞ্চে পরিধানকৃত কালো কোট বা গাউনের হাতা তার হাতের চেয়ে লম্বা রাখার রেওয়াজ ছিল। অবশ্য এখন আর সে রীতির প্রচলন নেই। তবে যুক্তরাজ্যে এই বিধি এখনো মেনে চলা হচ্ছে। লম্বা হাতার ব্যাখ্যা হলো, আইনের হাত এত দীর্ঘ যে আসামি যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, এ হাত তাকে খুঁজে বের করবেই। অন্যভাবে বলা হয়ে থাকে, অপরাধী যত জ্ঞান বা ক্ষমতার অধিকারী হোক না কেন, আইনের হাত লম্বা বিধায় সংশ্লিষ্ট সাজাপ্রাপ্ত আসামি বেঞ্চের রায় মানতে বাধ্য। এদিকে বিচারকের সাদা লম্বা পরচুলা পরার রেওয়াজ আমাদের দেশে এরই মধ্যে উঠে গেছে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি এখনো পরচুলা পরে থাকেন। বিচারকের পরচুলা পরিধান ছাড়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে এখনো কোনো বিচারকাজ সম্পন্ন হয় না। তারা এখনো এর গুরুত্ব এবং নিগূঢ় দর্শন আঁকড়ে আছেন। সাদা পরচুলার পেছনের রহস্য হলো, বৃদ্ধ মা-জননী সন্তানের প্রতি যেমন স্নেহপরায়ণ, তার কাছে সব সন্তান একই এবং সমান। কারও প্রতি অবিচার করার মানসিকতা থাকে না। সে আলোকেই দুই পক্ষই (বাদী ও বিবাদী) তার সন্তান বলে বিবেচ্য। তাই সঠিক বিচারের পথ সমুন্নত থাকে, কোনো পক্ষপাতিত্বের অবকাশ থাকে না। এজলাসে দুই পক্ষের কথা ও আবেদন আন্তরিকভাবে শুনে ঠাণ্ডা মাথায় রায় দিয়ে থাকেন। যাতে বিবাদী আত্মপক্ষ সমর্থন, মৌলিক অধিকার ও ন্যায়পরায়ণতার বরখেলাপের এতটুকু সুযোগ না থাকে। 

মুলসুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=12-12-2010&type=gold&data=Soccer&pub_no=226&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=0

স্বাধীন বাংলাদেশ পরাধীন মুক্তিযোদ্ধা

আগের দিনই খবরটা পৌঁছে যায় দিনাজপুর শহরে। সর্বত্র আতঙ্ক। ২৯ সেপ্টেম্বর দুপুরের মধ্যেই দিনাজপুর আক্রমণ। পাকিস্তানি বাহিনী একটা বিশেষ ট্রেনে চেপে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা দিয়েছে। এ খবর ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দাদের মাধ্যমে পৌঁছে যায় পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বরাহার মুক্তিযোদ্ধা অপারেশন ক্যাম্পে। খবরটা শুনে ছটফট করতে থাকেন মাসুম হাসান তোরাব আলী। তাঁর বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানার বড় হাশিমপুর গ্রামে। পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় দিনাজপুরের হাজার হাজার নিরীহ বাঙালি মারা যাবে, এ উৎকণ্ঠা তোরাবের মনে ভর করে। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে যান। যে করেই হোক বাঁচাতে হবে নিজ এলাকার মানুষকে, স্বজন-বন্ধুদের।
তোরাব ক্যাম্পের কমান্ডার ডা. আমজাদ হোসেনের সামনে ঘুর ঘুর করতে থাকেন। কমান্ডার বুঝে যান তোরাবের মনোভাব। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় অপারেশনের।
চিরিরবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের অদূরে জগদীশপুর রেলসেতুটি উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে তোরাবের ওপর। মাত্র ছয় সদস্যের মুক্তিবাহিনী নিয়ে অপারেশনে বেরিয়ে পড়েন তোরাব।
ভারতের বরাহার ক্যাম্প থেকে মেশিনগান, কয়েকটি রাইফেল নিয়ে বের হয় তোরাবের বাহিনী। আরও নেওয়া হয় স্থলমাইন। যে মাইনটি পোঁতা হবে ব্রিজের পাটাতনের (স্লিপার) নিচে। দীর্ঘ ৪০ মাইল পথ হেঁটে ছুটলেন তাঁরা।
২৯ সেপ্টেম্বর রাত তিনটার দিকে পৌঁছে যান সেতুর খুব কাছাকাছি। এর আগে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার পথ চলার ক্লান্তিতে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু যেন ছিল না তাঁদের।
ক্লান্ত তোরাবের চোখে স্বপ্ন উঁকি দেয়, দেশটা স্বাধীন হয়েছে। আকাশের বুকে মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকাটি উড়ছে পতপত করে।
দূরে ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। সংবিত ফেরে তোরাবের। আর দেরি করা যায় না। তড়িঘড়ি কাপড়ের পুঁটলি থেকে বের করেন মাইনটি। এরপর ছয় যোদ্ধা ক্রলিং করে এগিয়ে যান সেতুর কাছে। তোরাবের হাতে মাইনটি। সব ঠিক, কেবল সেতুর পাটাতনের নিচে মাটি আলগা করে পোঁতা হবে সেই মাইন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বিকট শব্দে একটা বিস্ফোরণ ঘটে। আর কিছু মনে নেই তোরাবের! যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে আবিষ্কার করলেন শিলিগুড়ির বাগডোকরা হাসপাতালে। সহযোদ্ধারা আহত তোরাবকে কাঁধে করে প্রথমে নিয়ে আসেন ক্যাম্পে। পরে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হয় হাসপাতালে। ডান হাতের কবজি পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়েছে, ডান চোখটিও নেই তাঁর। চিকিৎসকেরা আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। তোরাবকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় বোম্বের সামরিক হাসপাতাল ও পুনাতে। সেখানে কৃত্রিম চোখ লাগানো হয় তাঁর।
বাংলাদেশ স্বাধীন। তবু তোরাব ঘরে ফিরছেন না। তোরাবের বাবা গহির উদ্দিন ছেলের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। সুস্থ হয়ে তোরাব ১৯৭২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঘরে ফেরেন। মুক্তিযোদ্ধার সেই রেলসেতু অপারেশন কিন্তু বৃথা যায়নি। পরে জেনেছিলেন, মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনী ভড়কে যায়। আর সামনে এগোয়নি তারা। বিশেষ ট্রেনটি পুনরায় পাকিস্তানি বাহিনীর তিন শতাধিক সদস্যকে ফিরিয়ে নেয় পার্বতীপুর হয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাসে। যে বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখেছিলেন দিনাজপুরবাসীকে রক্ষার জন্য, তিনি নিজেই আজ অসহায়-পরাধীন!
মুক্তিযোদ্ধা তোরাবের সঙ্গে কথা বললে কেঁদেই ফেলেন তিনি। জানান, ভিটেমাটির ১২ শতক জমির ওপর নজর পড়েছে তাঁর বিমাতা ভাইদের। গ্রামের একটি দুষ্কৃতকারী চক্রের ষড়যন্ত্রে ভাইয়েরা এখন তাঁকে উচ্ছেদ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। চক্রটি একাত্তরের পরাজিত শক্তি। যাদের দোর্দণ্ড দাপট এখনো বড় হাশিমপুরে। বারবার হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে, যেন এখনই চলে যাই সহায়-সম্পত্তি সবকিছু ছেড়ে। রাতে দুষ্কৃতকারীরা বাড়ির সদর দরজার সামনে অস্ত্র হাতে ওত পেতে থাকে। গোটা পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে ভয় পায়।
এসএসসি পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা তোরাব প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মেধাবী ওই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা কি শিক্ষার সুযোগ পাবে না? বড় আতঙ্কে আছে ওরা। স্বাধীনতার জন্য জীবনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন তোরাব, অথচ তাঁর পরিবার আজ স্বাধীন দেশে বড্ড অসহায়। স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে তোরাবের পরিবার আজ নিরাপত্তাহীন।
যাঁর বীরত্বের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে লেখা চিঠি দিয়েছিলেন। সেই তোরাব কি স্বাধীন বাংলাদেশেও এতটা অসহায়ই হয়ে রইবেন? 
 
এম আর আলম | তারিখ: ১৩-১২-২০১০
 
মুলসুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-12-13/news/115411 

Wednesday, December 1, 2010

স্মৃতিশক্তি লোপ পায় কি করে?

বড় কোনো দুর্ঘটনার কবলে পড়লে বা খুব খারাপ কোনো খবর শুনলে অনেক সময় মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। এ রকম অবস্থায় পড়লে মানুষ তার অতীতের সবকিছু ভুলে যায়, এমনকি বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কাউকেই চিনতে পারে না। নিজের নামও বেমালুম ভুলে যায়। মনোবিজ্ঞানে একে বলা হয়, অস্মার বা স্মৃতিভ্রংশ (amnesia)। বিভিন্ন কারণেই স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে। যেমন_ মাথায় চোট লাগা, মনে কোনো বড় কষ্ট পাওয়া, অস্বাভাবিক ক্লান্তি, ওষুধপত্তরের কুফল, মাথার সার্জারি, মনের মধ্যে দারুণ টানাপড়েন, খুব বুড়ো হয়ে পড়া, বেশিরকম নেশা করা। এ রকম অনেক কারণেই স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে। কারণ যাই হোক, স্মৃতিভ্রংশ ঘটলে তার ফলাফল সব ক্ষেত্রেই এক রকম। মাথার মধ্যে নিউরন (neuron) হলো সব ধরনের স্মৃতির এক হিসেবে ভাঁড়ার ঘর। যেভাবেই হোক, এই নিউরনরা যদি আক্রান্ত হয় তাহলে স্মৃতি লোপ পায়। মাথার মধ্যে এ নিউরনের কাজ হলো বিভিন্ন সময় যা কিছু ঘটে চলেছে তার হিসাব রাখা। তাই যদি কখনো নিউরনরা কোনো ঝামেলায় পড়ে তাহলে তাদের জমার হিসাব ভণ্ডুল হয়ে স্মৃতিভ্রংশ ঘটায়।

স্মৃতি লোপ পেলে ঘটনাটি ঘটার আগে বা পরের সবকিছুই একদম মুছে যায়। এরকম অবস্থা, এক-আধ সপ্তাহ, মাস বা বছর ধরে থাকতে পারে, আবার কখনোবা সারা জীবন। মজার কথা হলো পুরনো স্মৃতি যদি ফিরে আসে, তাহলে আবার স্মৃতিবিভ্রংশ অবস্থায় যা যা ঘটেছে তা আর কিছুই মনে পড়বে না। তবে এটাও ঠিক, স্মৃতিভ্রংশ একবার ঘটলে কিছু কিছু ফল থেকেই যায়, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই এ রকম স্মৃতিভ্রংশ অবস্থা যদি কখনো ঘটে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখানো উচিত। বুড়ো হলে অবশ্য স্মৃতিশক্তি একটু লোপ পায়। তবুও পেটে ঘা, হাই ব্লাডপ্রেসার, হাঁপানি, এরকম রোগের কারণেও গোলমাল দেখা দিতে পারে।

আমিন রহমান নবাব
মুল সুত্র:
http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=29-11-2010&type=pratidin&pub_no=213&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=4

বগুড়ার নবাববাড়ি

 
নবাব আমলের পাইক-পেয়াদা আর বরকন্দাজের রূপকথা, মডেল করে দেখানো হয়েছে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাববাড়িতে। নবাবী জীবন প্রণালি এবং নবাবী আমলের সভ্যতা, কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্য কয়েকজন গুণী শিল্পীর অক্লান্ত শ্রম ও মেধায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মোহাম্মাদ আলী প্যালেস মিউজিয়াম অ্যান্ড অ্যামাউজমেন্ট পার্ক। দেশের উত্তর জনপদের কেন্দ্রস্থল বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র করতোয়া নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে নবাব প্যালেসের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে এই মিউজিয়াম অ্যান্ড পার্ক।

নবাব প্যালেসে প্রবেশ করলে দেখা যাবে তরুণী-কৃষাণী বধূরা অপেক্ষা করছে তার প্রেমিক কৃষাণের জন্য। নবাববাড়ির চারদিকে পাতাঝরা গাছে পাখি বসে আছে। কোনো কোনো গাছে পাখিরা ঠোকাঠুকি করছে। পুরনো প্যালেসটি বিশাল এক জাদুঘর। বিনোদন কেন্দ্র, জোড়া ঘোড়ার গাড়ি, কোচওয়ানদের হাতে চাবুক। ইতিহাসভিত্তিক কাহিনী অবলম্বনে যদি চলচ্চিত্র নির্মাণ হতে পারে, আবার তা যদি বাণিজ্যিক সফলতা পায় তবে ইতিহাসের বিষয়বস্তুর প্রতিচ্ছবি-প্রতিমূর্তি দাঁড় করিয়ে কেনইবা দর্শকনন্দিত করা যাবে না। এ বিশ্বাসকে ভিত্তি করে বগুড়ার নবাববাড়ির অতীত দিনের নেপালি দারোয়ান, মালী, পালকি, বেহারা, কোচওয়ান, টমটম, সিংহ, বাঘ, কুমির, ময়ূর, রাজহাঁস, বিভিন্ন পাখির প্রতিমূর্তি সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। নবাববাড়ি বিরাট হলরুমের দেয়ালে নবাব আবদুস সোবাহান চৌধুরী, নবাবজাদা আলতাফ আলী চৌধুরী, তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ আলী, সৈয়দ তহুরুন নেছা চৌধুরানী, সৈয়দ আলতাফুন নেছা চৌধুরানী। নবাব আমলের এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে শিল্পী আমিনুল করিম দুলাল এগিয়ে আসেন। সৈয়দ ওমর আলী চৌধুরীর উদ্যোগে শিল্পী আমিনুল ইসলাম দুলাল তার সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে ইতিহাসের সূতিকাগার নবাববাড়িকে রক্ষা করেন এবং একে দর্শনীয় স্থানে রূপদানের চেষ্টা করেন। শিল্পী দুলালের সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে সৈয়দ ওমর মশগুল, অতিথি আপ্যায়ন, বিলিয়ার্ড খেলা, পড়ার ঘরে বই সাজানো, জলসা ঘরে জলসার দৃশ্য, নায়েবের খাজনা আদায়_ এমন অনেক দৃশ্য জীবন্ত করে তোলার জন্য ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়।

১৯৯৮ সালের মে মাসে বগুড়ার নবাব মোহাম্মাদ আলী প্যালেস মিউজিয়াম অ্যান্ড অ্যামাউজমেন্ট পার্ক বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু করে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। ১০ টাকার টিকিট কিনে মূল গেট পার হতে হয়। এরপর ট্রেন, দোলনা, বিমানে চড়া এবং নবাববাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে টিকিট প্রয়োজন হয়। বর্তমানে এই মিউজিয়াম দেখাশোনা করেন মোহাম্মাদ আলীর ছেলে সৈয়দ হামদে আলী চৌধুরী। তিনি দীর্ঘদিন কানাডায় অবস্থানের পর কয়েক বছর আগে দেশে ফিরে পিতৃবাড়িতে অবস্থান করছেন। 
*আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া ।
মুলসুত্র:
http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&type=pratidin&pub_no=215&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=5