তোরাব ক্যাম্পের কমান্ডার ডা. আমজাদ হোসেনের সামনে ঘুর ঘুর করতে থাকেন। কমান্ডার বুঝে যান তোরাবের মনোভাব। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় অপারেশনের।
চিরিরবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের অদূরে জগদীশপুর রেলসেতুটি উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে তোরাবের ওপর। মাত্র ছয় সদস্যের মুক্তিবাহিনী নিয়ে অপারেশনে বেরিয়ে পড়েন তোরাব।
ভারতের বরাহার ক্যাম্প থেকে মেশিনগান, কয়েকটি রাইফেল নিয়ে বের হয় তোরাবের বাহিনী। আরও নেওয়া হয় স্থলমাইন। যে মাইনটি পোঁতা হবে ব্রিজের পাটাতনের (স্লিপার) নিচে। দীর্ঘ ৪০ মাইল পথ হেঁটে ছুটলেন তাঁরা।
২৯ সেপ্টেম্বর রাত তিনটার দিকে পৌঁছে যান সেতুর খুব কাছাকাছি। এর আগে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার পথ চলার ক্লান্তিতে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু যেন ছিল না তাঁদের।
ক্লান্ত তোরাবের চোখে স্বপ্ন উঁকি দেয়, দেশটা স্বাধীন হয়েছে। আকাশের বুকে মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকাটি উড়ছে পতপত করে।
দূরে ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। সংবিত ফেরে তোরাবের। আর দেরি করা যায় না। তড়িঘড়ি কাপড়ের পুঁটলি থেকে বের করেন মাইনটি। এরপর ছয় যোদ্ধা ক্রলিং করে এগিয়ে যান সেতুর কাছে। তোরাবের হাতে মাইনটি। সব ঠিক, কেবল সেতুর পাটাতনের নিচে মাটি আলগা করে পোঁতা হবে সেই মাইন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বিকট শব্দে একটা বিস্ফোরণ ঘটে। আর কিছু মনে নেই তোরাবের! যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে আবিষ্কার করলেন শিলিগুড়ির বাগডোকরা হাসপাতালে। সহযোদ্ধারা আহত তোরাবকে কাঁধে করে প্রথমে নিয়ে আসেন ক্যাম্পে। পরে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হয় হাসপাতালে। ডান হাতের কবজি পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়েছে, ডান চোখটিও নেই তাঁর। চিকিৎসকেরা আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। তোরাবকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় বোম্বের সামরিক হাসপাতাল ও পুনাতে। সেখানে কৃত্রিম চোখ লাগানো হয় তাঁর।
বাংলাদেশ স্বাধীন। তবু তোরাব ঘরে ফিরছেন না। তোরাবের বাবা গহির উদ্দিন ছেলের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। সুস্থ হয়ে তোরাব ১৯৭২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঘরে ফেরেন। মুক্তিযোদ্ধার সেই রেলসেতু অপারেশন কিন্তু বৃথা যায়নি। পরে জেনেছিলেন, মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনী ভড়কে যায়। আর সামনে এগোয়নি তারা। বিশেষ ট্রেনটি পুনরায় পাকিস্তানি বাহিনীর তিন শতাধিক সদস্যকে ফিরিয়ে নেয় পার্বতীপুর হয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাসে। যে বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখেছিলেন দিনাজপুরবাসীকে রক্ষার জন্য, তিনি নিজেই আজ অসহায়-পরাধীন!
মুক্তিযোদ্ধা তোরাবের সঙ্গে কথা বললে কেঁদেই ফেলেন তিনি। জানান, ভিটেমাটির ১২ শতক জমির ওপর নজর পড়েছে তাঁর বিমাতা ভাইদের। গ্রামের একটি দুষ্কৃতকারী চক্রের ষড়যন্ত্রে ভাইয়েরা এখন তাঁকে উচ্ছেদ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। চক্রটি একাত্তরের পরাজিত শক্তি। যাদের দোর্দণ্ড দাপট এখনো বড় হাশিমপুরে। বারবার হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে, যেন এখনই চলে যাই সহায়-সম্পত্তি সবকিছু ছেড়ে। রাতে দুষ্কৃতকারীরা বাড়ির সদর দরজার সামনে অস্ত্র হাতে ওত পেতে থাকে। গোটা পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে ভয় পায়।
এসএসসি পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা তোরাব প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মেধাবী ওই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা কি শিক্ষার সুযোগ পাবে না? বড় আতঙ্কে আছে ওরা। স্বাধীনতার জন্য জীবনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন তোরাব, অথচ তাঁর পরিবার আজ স্বাধীন দেশে বড্ড অসহায়। স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে তোরাবের পরিবার আজ নিরাপত্তাহীন।
যাঁর বীরত্বের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে লেখা চিঠি দিয়েছিলেন। সেই তোরাব কি স্বাধীন বাংলাদেশেও এতটা অসহায়ই হয়ে রইবেন?
চিরিরবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের অদূরে জগদীশপুর রেলসেতুটি উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে তোরাবের ওপর। মাত্র ছয় সদস্যের মুক্তিবাহিনী নিয়ে অপারেশনে বেরিয়ে পড়েন তোরাব।
ভারতের বরাহার ক্যাম্প থেকে মেশিনগান, কয়েকটি রাইফেল নিয়ে বের হয় তোরাবের বাহিনী। আরও নেওয়া হয় স্থলমাইন। যে মাইনটি পোঁতা হবে ব্রিজের পাটাতনের (স্লিপার) নিচে। দীর্ঘ ৪০ মাইল পথ হেঁটে ছুটলেন তাঁরা।
২৯ সেপ্টেম্বর রাত তিনটার দিকে পৌঁছে যান সেতুর খুব কাছাকাছি। এর আগে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার পথ চলার ক্লান্তিতে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু যেন ছিল না তাঁদের।
ক্লান্ত তোরাবের চোখে স্বপ্ন উঁকি দেয়, দেশটা স্বাধীন হয়েছে। আকাশের বুকে মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকাটি উড়ছে পতপত করে।
দূরে ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। সংবিত ফেরে তোরাবের। আর দেরি করা যায় না। তড়িঘড়ি কাপড়ের পুঁটলি থেকে বের করেন মাইনটি। এরপর ছয় যোদ্ধা ক্রলিং করে এগিয়ে যান সেতুর কাছে। তোরাবের হাতে মাইনটি। সব ঠিক, কেবল সেতুর পাটাতনের নিচে মাটি আলগা করে পোঁতা হবে সেই মাইন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বিকট শব্দে একটা বিস্ফোরণ ঘটে। আর কিছু মনে নেই তোরাবের! যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে আবিষ্কার করলেন শিলিগুড়ির বাগডোকরা হাসপাতালে। সহযোদ্ধারা আহত তোরাবকে কাঁধে করে প্রথমে নিয়ে আসেন ক্যাম্পে। পরে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হয় হাসপাতালে। ডান হাতের কবজি পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়েছে, ডান চোখটিও নেই তাঁর। চিকিৎসকেরা আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। তোরাবকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় বোম্বের সামরিক হাসপাতাল ও পুনাতে। সেখানে কৃত্রিম চোখ লাগানো হয় তাঁর।
বাংলাদেশ স্বাধীন। তবু তোরাব ঘরে ফিরছেন না। তোরাবের বাবা গহির উদ্দিন ছেলের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। সুস্থ হয়ে তোরাব ১৯৭২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঘরে ফেরেন। মুক্তিযোদ্ধার সেই রেলসেতু অপারেশন কিন্তু বৃথা যায়নি। পরে জেনেছিলেন, মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনী ভড়কে যায়। আর সামনে এগোয়নি তারা। বিশেষ ট্রেনটি পুনরায় পাকিস্তানি বাহিনীর তিন শতাধিক সদস্যকে ফিরিয়ে নেয় পার্বতীপুর হয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাসে। যে বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখেছিলেন দিনাজপুরবাসীকে রক্ষার জন্য, তিনি নিজেই আজ অসহায়-পরাধীন!
মুক্তিযোদ্ধা তোরাবের সঙ্গে কথা বললে কেঁদেই ফেলেন তিনি। জানান, ভিটেমাটির ১২ শতক জমির ওপর নজর পড়েছে তাঁর বিমাতা ভাইদের। গ্রামের একটি দুষ্কৃতকারী চক্রের ষড়যন্ত্রে ভাইয়েরা এখন তাঁকে উচ্ছেদ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। চক্রটি একাত্তরের পরাজিত শক্তি। যাদের দোর্দণ্ড দাপট এখনো বড় হাশিমপুরে। বারবার হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে, যেন এখনই চলে যাই সহায়-সম্পত্তি সবকিছু ছেড়ে। রাতে দুষ্কৃতকারীরা বাড়ির সদর দরজার সামনে অস্ত্র হাতে ওত পেতে থাকে। গোটা পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে ভয় পায়।
এসএসসি পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা তোরাব প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মেধাবী ওই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা কি শিক্ষার সুযোগ পাবে না? বড় আতঙ্কে আছে ওরা। স্বাধীনতার জন্য জীবনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন তোরাব, অথচ তাঁর পরিবার আজ স্বাধীন দেশে বড্ড অসহায়। স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে তোরাবের পরিবার আজ নিরাপত্তাহীন।
যাঁর বীরত্বের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে লেখা চিঠি দিয়েছিলেন। সেই তোরাব কি স্বাধীন বাংলাদেশেও এতটা অসহায়ই হয়ে রইবেন?
এম আর আলম | তারিখ: ১৩-১২-২০১০
মুলসুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-12-13/news/115411
No comments:
Post a Comment