Saturday, December 18, 2010

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন


আলফ্রেড হিচককের বিখ্যাত নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট ছবির অনুকরণে
উত্তর আটলান্টিকের তীরে রেকইয়াভিক শহরের গ্রেটিসগাটা স্ট্রিটের ছোট্ট সাদা বাড়িটি শতবর্ষের পুরোনো। আইসল্যান্ডের আবহাওয়া এমন, উত্তরে বাতাস যেকোনো সময় বয়ে আনতে পারে তুষার ও বরফ, এমনকি বসন্তকালেও। যখন সে রকম ঘটে, রেকইয়াভিক শহরজুড়ে নেমে আসে প্রগাঢ় নৈঃশব্দ। এ বছরের মার্চের ৩০ তারিখ সকালে ঠিক এ রকম আবহাওয়ার মধ্যে এলেন এক দীর্ঘদেহী যুবক। তাঁর চোখের মণি দুটো ধূসর, চুলগুলো রুপালি-সাদা, পরনে আগাপাশতলা ধূসর স্নো স্যুট; সঙ্গে কয়েকজনের ছোট্ট এক দল। আইজাফজাল্লাইকুল আগ্নেয়গিরিতে সম্প্রতি অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছে।
‘আমরা সাংবাদিক, আগ্নেয়গিরি নিয়ে লিখতে এসেছি। আপনার বাড়িটি ভাড়া নিতে চাই।’ বললেন রুপালি-সাদা চুলের যুবক।
বাড়ির মালিক সম্মত হয়ে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই যুবক ও তাঁর সঙ্গীরা বাড়িটির সব জানালার খিড়কিগুলো বন্ধ করে দিলেন; নিশ্চিত করলেন, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা যেন সব বন্ধই থাকে। বাড়িটি এখন এক যুদ্ধকক্ষ, যাকে বলে বাংকার। আধা ডজন কম্পিউটার বসানো হলো লিভিংস্পেসে। এসে যোগ দিল স্থানীয় কয়েকজন: শুরু হয়ে গেল কাজ: প্রজেক্ট বি, ৩৮ মিনিট দৈর্ঘ্যের র ভিডিও ফুটেজ; ২০০৭ সালে বাগদাদে একটি মার্কিন অ্যাপাচে মিলিটারি হেলিকপ্টারের ককপিট থেকে তোলা। মার্কিন সেনাদের হাতে ১৮ জন বেসামরিক মানুষ হত্যার দৃশ্য, রয়টারের দুজন সাংবাদিকসুদ্ধ। ফুটেজগুলো বিশ্লেষণ ও সম্পাদনা করে তৈরি হবে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র: কোল্যাটারাল মার্ডার (আনুষঙ্গিক হত্যাযজ্ঞ); সেটি ছাড়া হবে অনলাইনে, এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে যে অনলাইনে যাওয়ার পর প্রামাণ্যচিত্রটি আর কেউ সরিয়ে ফেলতে পারবে না। সব কাজ শেষ করতে হবে এক সপ্তাহের মধ্যে।
তার ৩৯ বছর আগে, ১৯৭১ সালের জুলাই, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা যখন স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন একটি বর্বর সামরিক সরকার ও তার নৃশংস বাহিনীর বিরুদ্ধে, তখন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ছোট্ট এক দ্বীপে জন্ম হলো আরেক যোদ্ধার, যিনি প্রায় চার দশক পর আঘাত হানবেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর, সবচেয়ে অমানবিক ও প্রতারক রাষ্ট্রশক্তির নিরাপত্তাব্যবস্থার মর্মমূলে: শুরু করবেন ফার্স্ট সাইবার ওয়ার্ল্ড ওয়ার।
নাম তাঁর জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ; তাঁর সাইবার বাহিনীর নাম ‘উইকিলিকস’। ১৯৮৭ সালে যখন তাঁর বয়স ১৬, তখন তিনি হাতে পেলেন একটি মডেম, সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কম্পিউটারটিকে পরিণত করলেন একটি পোর্টালে; ওয়েবসাইটের চল তখনো শুরু হয়নি, কিন্তু কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও টেলিকম সিস্টেমগুলো পরস্পর সংযুক্ত হয়েছিল এবং এক গোপন ইলেকট্রনিক ভুবন ছিল, যেখানে জুলিয়ানের মতো ক্ষিপ্র বুদ্ধিসম্পন্ন কিশোরেরা ঢুকে পড়তে পারত। তিনি তত দিনে মেলবোর্নে চলে এসেছেন, সেখানকার ‘কম্পিউটার গিক’দের মধ্যে অচিরেই তাঁর এমন খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি ইউরোপ-আমেরিকার সবচেয়ে সুরক্ষিত কম্পিউটার নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যেও ঢুকে পড়তে পারেন। এ সময় তিনি দুজন হ্যাকারকে সঙ্গে নিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল সাবভারসিভস’ নামে একটি গ্রুপ গঠন করেন। কানাডার টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি নরটেলসহ ২৪টি প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষিত কম্পিউটার নেটওয়ার্কে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে একদিন অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পুলিশ হানা দিল তাঁর মেলবোর্নের বাসায়। ধরে নিয়ে গেল তাঁকে। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে ১০ বছরের কারাবাস নিশ্চিত। তিনি অভিযোগ মেনে নিয়ে ভুল স্বীকার করলেন, আর কখনো এমন কাজ করবেন না বলে অঙ্গীকার করে কয়েক হাজার ডলার জরিমানা দিয়ে মুক্তি পেলেন। শুরু করলেন সবার জন্য বিনা খরচে ব্যবহারযোগ্য সফটওয়্যার তৈরির কাজ। তিনি বিশ্বাস করেন, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ মানবসভ্যতার অভিন্ন অর্জন, বাণিজ্যিক স্বার্থে তা কুক্ষিগত করে রাখা অনৈতিক। মানবাধিকারকর্মীদের ব্যবহারের জন্য তিনি বিনা খরচে তৈরি করে দিলেন কিছু মূল্যবান সফটওয়্যার।
অ্যাসাঞ্জ মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও পদার্থবিদ্যা পড়েছেন, কিন্তু কোর্স শেষ করেননি। বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকদের কারবার দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। ইরাকের মরুভূমিতে মার্কিন বাহিনীর ট্যাংক বালুর মধ্যে কী করে আরও দ্রুত চলতে পারে, সেই গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন তাঁরা। অ্যাসাঞ্জ প্রচুর পড়াশোনা করেন, দর্শন থেকে শুরু করে নিউরোসায়েন্স পর্যন্ত, অনেক বিষয়ে তাঁর আগ্রহ। তাঁর মা ১৭ বছর বয়সে ক্লাসের বইপত্রে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মোটরসাইকেল নিয়ে। কিশোর অ্যাসাঞ্জকে তিনি পড়ে শোনাতেন চিরায়ত গ্রিক সাহিত্য: এস্কাইলাস, ইউরিপিডিস, সফোক্লিসের নাটক। জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস পড়ে অ্যাসাঞ্জ টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রের স্বরূপ চিনতে পেরেছেন প্রথম, অরওয়েলের ভক্ত তিনি। কুর্ট ভোনেগাটও তাঁর খুব প্রিয়। বুখারিনের গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদণ্ডের কাহিনি অবলম্বনে লেখা আর্থার কোয়েসলারের ডার্কনেস অ্যাট নুন তাঁর অন্যতম প্রিয় উপন্যাস। আলেকসান্দর সোলঝেনিৎসিনের ফার্স্ট সার্কেল পড়ে অ্যাসাঞ্জ ২০০৬ সালে মন্তব্য লিখেছেন: ‘ঠিক আমার নিজের জীবনের অ্যাডভেঞ্চারগুলোর মতো!’
ব্যাপক পড়াশোনার মাধ্যমে ইতিহাস জানা ও সমসাময়িক বৈশ্বিক পরিস্থিতির দিকে রাজনীতিসচেতন দৃষ্টিতে নজর রাখার মধ্য দিয়ে অ্যাসাঞ্জ পরিণত বয়সে এমন এক ধারণায় পৌঁছান যে সব সরকার ও ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান মিথ্যা বলে, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে। সরকারমাত্রই ষড়যন্ত্রপ্রবণ। অ্যাসাঞ্জ মনে করেন, ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে গোপনীয়তা। গোপনীয়তা ভেঙে দিতে পারলেই ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল করা সম্ভব। এ রকম ভাবনা বা দর্শন থেকে তিনি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে চালু করেন উইকিলিকস নামের এক নতুন ধরনের ওয়েবসাইট, যার কাজই হবে জনগুরুত্বপূর্ণ গোপন নথিপত্র বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ করা। ওই সময় তিনি ‘কন্সপিরেসি অ্যাজ গভর্নেন্স’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেটাকে বলা হয় উইকিলিকসের ইশতেহার। সেখানে তিনি লেখেন, ‘আমরা যদি নিষ্ক্রিয়ভাবে অন্যায়-অবিচার দেখে যাই, কিছুই না করি, তবে আমাদের অবস্থা দাঁড়ায় সে অন্যায়ের পক্ষে। নিষ্ক্রিয়ভাবে অন্যায়-অবিচার দেখতে দেখতে আমরা দাসে পরিণত হই। অধিকাংশ অন্যায়-অবিচার ঘটে খারাপ শাসনব্যবস্থার কারণে; শাসনব্যবস্থা ভালো হলে অন্যায়-অবিচার কমে যায়।...আমাদের এমন কিছু করতে হবে, যেন খারাপ শাসনব্যবস্থার জায়গায় ভালো কিছু আসে।’
সর্বশেষ গত ২৮ নভেম্বর উইকিলিকস মার্কিন কূটনীতিকদের তারবার্তা প্রকাশের পর অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকসের প্রতি এসেছে প্রচণ্ড আঘাত। যুক্তরাষ্ট্র উইকিলিকস বন্ধ করার এবং অ্যাসাঞ্জকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে, বড় বড় দেশের সরকারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, এমনকি তাঁর স্বদেশ অস্ট্রেলিয়ার সরকারও। খুব স্থূল অভিযোগে অ্যাসাঞ্জকে লন্ডনের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ডিসেম্বরের ৬ তারিখে। তাঁর জামিনের আবেদন প্রথমে খারিজ হয়েছে, দ্বিতীয় দফায় তিনি জামিন পেয়েছেন, কিন্তু এখনো কারাগার থেকে মুক্তি পাননি, সুইডিশ কর্তৃপক্ষ আপিল করবে বলে।
অ্যাসাঞ্জ ও তাঁর সহযোগীরা অনেক আগে থেকেই জানতেন, তাঁদের ওপর আঘাত আসবে। সে কারণে উইকিলিকসের কোনো স্থায়ী অফিস নেই, কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকেরা সবাই মোটের ওপর গুপ্ত জীবন যাপন করেন বাধ্য হয়ে। অ্যাসাঞ্জ নিজে তাই এক রহস্যময় চরিত্রের খ্যাতি পেয়েছেন।
২০০৮ সালে মার্কিন আর্মি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স সেন্টার এক গোপন সামরিক প্রতিবেদন তৈরি করে, যেখানে বলা হয়, উইকিলিকস হচ্ছে মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য এক মারাত্মক হুমকি। গোপন সূত্রে অ্যাসাঞ্জ প্রতিবেদনটি হাতে পেয়ে যান এবং তখনই বুঝে নেন, প্রতিবেদনটি উইকিলিকসের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধের ঘোষণাপত্র। এ বছরের মার্চে তিনি ওই প্রতিবেদনটি উইকিলিকসে প্রকাশ করেন এই শিরোনাম দিয়ে: মার্কিন গোয়েন্দারা উইকিলিকসকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি সব সময় সন্দেহ করেন যে তাঁকে গোপনে অনুসরণ করা হচ্ছে। বাগদাদের ভিডিও ফুটেজটি নিয়ে কাজ করার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন রেকইয়াভিক শহর। কারণ আইসল্যান্ডে তাঁর কিছু বন্ধু আছেন, যাঁরা নানা ধরনের বিপ্লবী চিন্তাভাবনা করেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পার্লামেন্টের সদস্যও। আগের কয়েক বছর অ্যাসাঞ্জ কয়েকজন রাজনীতিক ও অধিকারকর্মীর সঙ্গে মিলে তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে দারুণ শক্তিশালী একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছিলেন। তাঁদেরই কয়েকজন তাঁকে ভিডিওচিত্রটি নিয়ে অত্যন্ত গোপনে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর এমন আরও অনেক বন্ধুবান্ধব আছেন কেনিয়ায়, সুইডেনে, ইংল্যান্ডে এমনকি খোদ আমেরিকায়ও। কিন্তু অ্যাসাঞ্জকে লুকিয়ে চলতে হয়। আইসল্যান্ড থেকে কেনিয়া—কখন কোথায় থাকেন তার ঠিক-ঠিকানা নেই। কখনো হোটেলে ওঠেন না, থাকেন বন্ধুবান্ধবের বাসায়। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন শুধু নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে। মুঠোফোন ব্যবহার করেন একাধিক; শুধু কাউকে কল করার সময়, বাকি সময় মুঠোফোন বন্ধ থাকে, এমনকি ব্যাটারিও খুলে রাখেন, যাতে তাঁর অবস্থান ও চলাফেরার ওপর কেউ কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রের সাহায্যে নজর রাখতে না পারে। লন্ডনে বিচারক তাঁকে জামিন দেননি এই যুক্তি দেখিয়ে যে তাঁর কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। সুইজারল্যান্ডের সুইসপোস্ট তাঁর অ্যাকাউন্ট বাতিল করেছে, যখন তারা আবিষ্কার করেছে যে সুইজারল্যান্ডে অ্যাসাঞ্জ যে ঠিকানায় থাকেন বলে অ্যাকাউন্টটি খোলার সময় লিখেছেন, সেটি ভুল। উইকিলিকসের অন্য সদস্যরাও এই সন্দেহের শিকার যে শত্রুরা তাঁদের। অ্যাসাঞ্জসহ সবাই কমবেশি ‘প্যারানোয়েড’। তিনি একজনকে বলেছেন, ‘আমি সুইডেনে এক মেয়ের বাসায় উঠেছিলাম। সে একটি সংবাদপত্রের ফরেন এডিটর। তার ভয়, সিআইএ আমাকে ফলো করছে। এই ভয়ে সে ওই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। আমি তাকে আর খুঁজেই পাইনি।’
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের এই গুপ্ত জীবন এক মহান মিশনের অংশ: ষড়যন্ত্রমূলক গোপনীয়তার বিরুদ্ধে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতার মিশন। অ্যাসাঞ্জ গোটা বিশ্বকে এক অভিন্ন জাতিরাষ্ট্র বলে মনে করেন এবং সেই ন্যায়পরায়ণ মুক্ত সমাজ বা ‘ওপেন সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেমেছেন, যুগে যুগে মানুষ যার স্বপ্ন দেখে এসেছে। এ লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গে আছে গোটা বিশ্বের জনগণ; দেশে দেশে তাঁর মুক্তির দাবিতে মিছিল হচ্ছে। তিনি জানেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ধ্বংস করতে উদ্যত। তার সহযোগী আরেক রাষ্ট্রের পুলিশের হাতে তিনি আটকও হয়েছেন, কিন্তু ঘাবড়াননি একটুও। লন্ডনের ওয়ার্ডসওয়ার্থ কারাগারের নিভৃত প্রকোষ্ঠে থেকে তিনি মায়ের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে এই বাণী পাঠিয়েছেন: ‘আমার সব বিশ্বাস ও আদর্শ অপরিবর্তিত আছে। আমি এযাবৎ যেসব আদর্শ-মূল্যবোধের কথা বলে এসেছি, সেসবের প্রতি আমার আস্থা অটুট রয়েছে। এসব পরিস্থিতির (প্রেপ্তার, কারাবাস, সুইডেনে পাঠানোর উদোগ্য, বিচার) কারণে সেগুলোর কোনো নড়চড় হবে না। এসবের ফলে যদি কোনো পরিবর্তন ঘটে থাকে, তবে তা হলো এই যে আমার আদর্শগুলো যে সত্য ও সঠিক, আমার এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে।...এসব অবৈধ ও অনৈতিক তৎপরতা থেকে আমার কাজ ও আমার লোকজনকে রক্ষা করার জন্য আমি বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ, পৃথিবীর নিপীড়িত, প্রতারিত, প্রতিবাদী সব মানুষ আপনার সঙ্গে আছে।


উইকিলিকস
২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত উইকিলিকস যে পরিমাণ গোপন নথিপত্র, ভিডিও ফুটেজ, ই-মেইল ইত্যাদি প্রকাশ করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তেমনটি আর কখনোই ঘটেনি। কারিগরিভাবে অবিশ্বাস্য রকমের নিখুঁত ওয়েবসাইট উইকিলিকস। শত শত ডোমেইন নামে বিশ্বজুড়ে ২০টিরও বেশি সার্ভারে তাঁরা তাঁদের ম্যাটেরিয়ালগুলো সংরক্ষণ করেন। এটি একটি ‘আনসেন্সরেবল সিস্টেম ফর আনট্রেসেবল মাস ডকুমেন্ট লিকিং অ্যান্ড পাবলিক অ্যানালাইসিস।’ এটাকে ধ্বংস করতে হলে সারা বিশ্বের ইন্টারনেট-ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করতে হবে।

জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ
জন্ম কুইন্সল্যান্ডের টাউন্সভিলে, কিন্তু তাঁর কোনো ঘরবাড়ি নেই। মা-বাবা এক ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার গ্রুপ চালাতেন, তাই শৈশব থেকেই যাযাবরের জীবন। তাঁর বয়স যখন আট, তখন মা-বাবার ছাড়াছাড়ি; মা বিয়ে করলেন এক সংগীতশিল্পীকে, যিনি আবার এক গুপ্ত কাল্ট পরিবারের সদস্য, যারা শিশুদের চুরি করে এনে কাল্টভুক্ত করে। সেখানে এক ছোট ভাইয়ের জন্ম হলো, কিন্তু সৎ-বাবা হয়ে উঠলেন নিপীড়ক। দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে পালালেন মা ক্রিস্টিন ক্লেয়ার। জুলিয়ানের বয়স তখন ১১। সৎ-বাবা পিছু নিলেন; ছোট ভাইটিকে কেড়ে নিতে চান তিনি। পাঁচ বছর ধরে চলল আইনি লড়াই, সেই সঙ্গে মা ক্রিস্টিনকে ধাওয়া করে চলল অপহরণের আতঙ্ক। পাঁচ বছরে মোট ৩৭ বার তাঁকে থাকার জায়গা বদল করতে হয়েছে। এমনই এক জায়গায় তাঁরা একটি বাসায় থাকতেন, যার বিপরীত দিকে ছিল একটি ইলেকট্রনিকসের দোকান। কিশোর জুলিয়ান সেখানে গিয়ে কমোডর ৬৪ কম্পিউটারের বোতাম চাপাচাপি করতেন। তারপর একটা সময় মা তাঁকে একটি কম্পিউটার কিনে দিলেন; জুলিয়ান অচিরেই এমন দক্ষ হয়ে উঠলেন, বিভিন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রামের গোপন পাসওয়ার্ড ভেঙে লুকানো সব তথ্য পড়ে ফেলতে পারতেন। 
মশিউল আলম | তারিখ: ১৭-১২-২০১০
মুল সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-12-17/news/116319 

No comments: