Wednesday, April 20, 2011

হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে...

জীবনানন্দের সেই কবিতাটা মনে আছে? 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়/

হয়তো মানুষ নয়, হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে।' প্রকৃতির কবি যে শঙ্খচিলের বেশে বারবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে চেয়েছেন কালের বিবর্তনে সে শঙ্খচিল এখন হারাতে বসেছে।

একটা সময় ছিল নদী-নালা, জলাশয়ের আশপাশে তাকালেই চোখে পড়ত সাদা পেটওয়ালা মরচের মতো সোনালি ডানার ঝাঁকে ঝাঁকে চিল। গোলাকৃতি লেজের ডগা। দেখতে সাধারণ চিলেরই মতো। তবে এরা ঠিক চিল নয়, শঙ্খচিল। এদের মাথা, ঘাড়, বুক, পেটের তলার পালক শঙ্খের মতো সাদা। ধারণা করা হয়, এ জন্যই এদের নাম রাখা হয়েছে শঙ্খচিল। কিন্তু এর ডানা দুটি ও শরীরের অন্যান্য অংশ খয়েরী। শঙ্খচিলের গড় দৈর্ঘ্য ৪৮ সে.মি.। সাধারণ চিলের মতো শঙ্খচিলের ডাক তীক্ষ্ম নয়; বরং কিছুটা কর্কশ। জলের কাছাকাছি উঁচু গাছের ডালে বর্ষাকালে এরা কাঠি ও ডাল দিয়ে বড়সড় বাসা বানায়। এরা জলের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। জোয়ারের সময় খাঁড়িগুলো এদের বিশেষভাবে পছন্দ। এদের ডাক অনেকটা বাচ্চাদের কান্নার মতো। শঙ্খচিলের ইংরেজি নাম Brahmiy Kite, বৈজ্ঞানিক Haliastur indus। এরা অ্যাক্সিপিট্রিডি পরিবারের সদস্য। দেশে একসময় প্রায় ৮৩ প্রজাতির চিল ছিল। দিন দিন নদী-নালা জলাশয় দূষণ হয়ে বিপন্ন হতে বসেছে প্রিয় এ পাখিটি। তার উপরে শিকারিদের লোলুপ দৃষ্টি এদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। সাধারণত জলাশয়, নদীরপাড় এবং বর্ষায় ডুবে যাওয়া ধানখেতের আশপাশে এদের 'জমিদারি' হাঁটাচলা। মাছ, ব্যাঙ, ছোটখাটো সরীসৃপ, পোকামাকড় থেকে আরম্ভ করে মানুষের ফেলে দেওয়া বা পরিত্যক্ত খাবারের টুকরা পর্যন্ত এদের খাদ্য। 

  মেহেদী হাসান রাহাত
http://www.bangladesh-pratidin.com/index.php?view=details&type=gold&data=Emirates&pub_no=353&cat_id=1&menu_id=7&news_type_id=1&index=0 

Monday, April 18, 2011

মানবী না দানবী?


যুগে যুগে পৌরাণিক ইতিহাসের নানা কাহিনীতে আমরা অনেক দেবতার সন্ধান পাই। আবার এ নিয়ে রাক্ষস আর দানব-দানবীর ইতিহাসও নেহাতই কম নয়। স্ফিংস তেমনি এক পৌরাণিক দানবী। প্রাচীন মিসর এবং গ্রিক পুরাণ থেকে এর উদ্ভব। পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী স্ফিংস হচ্ছে একটি সিংহ, যার মাথা মানবীর। এর ব্যতিক্রম বর্ণনাও রয়েছে কোথাও কোথাও। তবে মূল বক্তব্য এটিই। এখনো প্রাচীন বিভিন্ন নিদর্শনে এই দানবীর অস্তিত্বের প্রমাণ মিলে। মিসরের বিখ্যাত স্ফিংসের পিরামিড যার উজ্জ্বল উদাহরণ।



মিসরের বিখ্যাত পিরামিড গ্রেট স্ফিংসের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানুষের মাথা আর সিংহের শরীরের আদলে গড়া এই পিরামিড বিশ্বের বিস্ময় জাগানিয়া স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বৃহত্তম ও বিখ্যাত স্ফিংস ভাস্কর্য মিসরের নীলনদের তীরে গিজা মালভূমিতে অবস্থিত। মনে করা হয়, সে স্ফিংসের চেহারা রাজা ফারাহ খাফরা অথবা সম্ভবত তার ছেলের। এ কথা কমবেশি সবার জানা থাকলেও অনেকেই জানে না এই স্ফিংস আসলে কি?

গ্রিক পুরাণ মতে, স্ফিংস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের থিবস নগরীর রক্ষক। নগরীতে প্রবেশকারী সব আগন্তুককে ধাঁধার জটিল জালে বন্দী করার কৌশল ছিল স্ফিংসের একচেটিয়া রণনীতি। সেসব জটিল প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না কোনো মানুষের। ধাঁধার সমাধান না করতে পারলে থিবস-এ প্রবেশ দূরে থাক উপরন্তু প্রাণও খোয়া যেত। উত্তর দিতে অপারগ সেসব হতভাগ্য মানুষকে বধ করে উদরপূর্তি হতো স্ফিংসের। আর এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ইডিপাস। স্ফিংস এই গ্রিক বীরকে প্রশ্ন করেন: কোন সেই জন্তু যে সকালে চতুষ্পদ, মধ্যাহ্নে দ্বিপদ আর সন্ধ্যায় তিন পদের সাহায্যে চলে? প্রত্যুত্তরে ইডিপাস জানান, তার নাম মানুষ। শৈশবে সে চার হাত-পায়ের সাহায্যে হামাগুঁড়ি দেয়, যৌবনে দু'পায়ের ওপর ঋজু হয়ে চলে আবার বার্ধক্যে হাতের লাঠির ওপর ভর করে হাঁটে। কথিত আছে, এই উত্তর শোনার পরই ধ্বংস হয়ে যায় স্ফিংস ও তার সঙ্গের বিভীষিকা।

কথিত আছে স্ফিংস উঁচু থেকে পাথরে আছড়ে পড়ে মারা যায়। আবার অন্য কাহিনী মতে, সে নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলে। ভয়ঙ্কর এ দানবীর নাম স্ফিংস। যার শরীরের মাথার দিকটা মানবীর মতো আর শরীরের বাকি অংশ সিংহের মতো। তবে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকে আবার একে মতভেদ না বলে প্রকারভেদ বলার পক্ষপাতী। নানা পৌরাণিক কাহিনী ঘেঁটে দানবী স্ফিংসের তিনটি নাম এবং চেহারা খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে 'অ্যান্ড্রোস্ফিংস' (Androsphinx)। এ ধরনের স্ফিংসের দেহ সিংহের, মাথা মানবীর। অধিকাংশ বর্ণনায় এ ধরনের স্ফিংসের কথাই জানা গেছে। আরেকটি হচ্ছে ক্রায়োস্ফিংস (Criosphinx)। এ ধরনের স্ফিংসের দেহ সিংহের, মাথা ভেড়ার। শেষটি হচ্ছে হেইরোকোস্ফিংস (Hierocosphinx)। যেটির দেহ সিংহের আর মাথাটি হচ্ছে বাজপাখির।

পুরাতাত্তি্বকরা অবশ্য এসব কাহিনীকে রূপক আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মতে, আসলে এর পরই অবসান হয় আদিম উপাসনা রীতির। গ্রিসে সূচনা হয় পরবর্তী যুগের অলিম্পিয়ান দেবদেবীর পূজা অর্চনার প্রথা।

খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে স্ফিংস চিত্রশিল্পী এবং ভাস্করশিল্পীদের কাছে প্রেমের প্রতীক হিসেবে ধরা দেয়। গ্রিক ও মিসরীয় পৌরাণিক কাহিনীতে ভিন্ন ভিন্ন স্ফিংসের উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রিকরা অবশ্য স্ফিংসের দেহে নারীর সৌষ্ঠব প্রয়োগ করেছিলেন। গ্রিসে স্ফিংসের পরিচয় ধ্বংস ও দুর্ভাগ্যের বাহক এক দানবী হিসেবে। পৃথিবীর বৃহত্তম স্ফিংস ভাস্কর্যটির নির্মাতা মনে করা হয় রাজা ফারাও খাফরাকে। রাজা ফারাও খাফরা তার রাজবংশের চতুর্থ রাজা ছিলেন (২৭২৩-২৫৬৩ BC)। এ স্ফিংস ভাস্কর্যকে বলা হয় Khepri-Re-Atum, আরবি নাম Abual Hoi, যা অনুবাদ করলে হয় 'ফাদার অব টেরর' (Father of terror)। তবে গ্রিক নাম স্ফিংসই প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তবে গ্রিক পুরাণের স্ফিংস এবং মিসরীয় স্ফিংসের মধ্যে পার্থক্যের কথা না বললেই নয়। মিসরে স্ফিংসকে মানব হিসেবে দেখালেও গ্রিক পুরাণে এটা মানবী। গ্রিক কবি হেসিউডের বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই স্ফিংস হচ্ছেন ইচিদনা এবং অথ্রুসের কন্যা। আর অন্য মতে তাইফুন এবং ইচিদনার কন্যা। এখানেও একে ভয়ঙ্কর দানবী হিসেবেই পরিচিত করা হয়েছে।

যত যাই হোক না কেন, কল্পনা কিংবা পুরাণের এই দানবী আজো শত শত মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। 

রণক ইকরাম
মুলসুত্র:http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&type=gold&data=News&pub_no=351&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=1 

Wednesday, April 6, 2011

কফি কাহন


কেউ কেউ দুধবিহীন কালো কফি, যা 'র‌্যান্যাক কফি' নামে পরিচিত সেটি খেতে পছন্দ করেন। তবে গরম পানিতে দুধ এবং চিনি মিশিয়ে যে কফি তৈরি করা হয় সেটিই বিশ্বব্যাপী প্রিয় পানীয়। অনেকেই পছন্দ করেন ঠাণ্ডা কফি!

আমাদের অনেকের পানীয় তালিকায় রয়েছে কফির নাম। কিন্তু এই কফি আবিষ্কারের কাহিনী অনেকেরই অজানা। বহু শতাব্দী আগে আরবের এক মেষপালক খেয়াল করলেন, তার মেষগুলো অদ্ভুত আচরণ করছে। কারণ কি? তারা আসলে সবুজ এক প্রকার উদ্ভিদের লাল ফল খেয়ে লাফাচ্ছে। ছোট শাবকদের মতোই দুষ্টুমি শুরু করেছে। এটা দেখে মেষপালক নিজে ওই ফল খেয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিল। খাওয়ার পর নিজেকে তার ওই মেষদের মতোই প্রাণবন্ত ও চাঙ্গা মনে হলো। তার এ অভিজ্ঞতা সে পার্শ্ববর্তী মঠের সন্ন্যাসীকে জানাল। ওই সন্ন্যাসীও যখন সেই ফল খেল তখন সেও একই রকম অভিজ্ঞতা লাভ করল। ওই ঘটনা তারা গ্রামবাসীকে বলল এবং যারা ওই ফল খেল তারা প্রত্যেকেই এক অদ্ভুত সতেজ অনুভূতি আস্বাদ করল। এই লাল ফলগুলো ছিল আসলে কফির ফল। এ কাহিনীর সত্যাসত্য নির্ণয় করা কঠিন। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, সর্বপ্রথম কফি পান শুরু হয়েছিল আরবে। সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে ব্রিটেনে এ প্রথা ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৬৫০ সালে অক্সফোর্ডে পৃথিবীর সর্বপ্রথম 'কফি হাউস' খোলা হয়। ধীরে ধীরে কফি পান সারা বিশ্বে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চিরহরিৎ এক প্রকার উদ্ভিদের বীজ থেকে কফি পাওয়া যায়। চারাগাছগুলোর বয়স যখন ৩-৪ মাস তখন তাতে ফুল ধরে। এর কাঁচা ফলগুলোর রং হয় সবুজ। ৫-৬ মাস পর ফল পেকে লাল রং ধারণ করে। ফলের বীজগুলো প্রথমে ঝলসে নিয়ে পরে গুঁড়া করা হয়। বাজারে যে কফি পাউডার পাওয়া যায় তা আসলে কফি ফলের বীজেরই গুঁড়া। কফির প্রস্তুতি নানা রকম হতে পারে। কেউ কেউ দুধবিহীন কালো কফি, যা 'র‌্যান্যাক কফি' নামে পরিচিত সেটি খেতে পছন্দ করেন। তবে গরম পানিতে দুধ এবং চিনি মিশিয়ে যে কফি তৈরি করা হয় সেটিই বিশ্বব্যাপী প্রিয় পানীয়। অনেকেই পছন্দ করেন ঠাণ্ডা কফি! এক কাপ কফিতে সাধারণত ১২০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। ক্যাফেইন হচ্ছে এক ধরনের সতেজকারী উত্তেজক। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে অতিরিক্ত কফি পান করলে নিদ্রাহীনতার আশঙ্কা থাকে। ব্রাজিল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কফি উৎপাদন করে। কফি উৎপাদনে কলম্বিয়ার স্থান দ্বিতীয়। এছাড়া আফ্রিকা, আমেরিকা ও এশিয়ার নানা দেশে কফি উৎপাদিত হয়।

নবাব আমিন 
মুলসুত্র: এখানে

জলে ভাসা জীবন


'রানী সালাম বারে বার/নামটি আমার গয়া বাইদ্যা বাবা থাকি পদ্মার পাড়' এটি পদ্মা, যমুনা, বড়াল, ধলেশ্বরী, ইছামতি, শীতলক্ষ্যা অথবা তুরাগের বুকে বসতি গড়ে ওঠা সম্প্রদায়ের যাযাবর জীবনের গল্প। লিখেছেন

_ সিরাজ প্রামাণিক



বেদেদের জীবনের গতিপথ তাবিজ-কবজ, জাদুটোনা আর সাপের খেলা দেখানোর নেশাতেই মিলেমিশে থাকে। সাপের খেলা দেখানো বেদে সম্প্রদায়ের আদি পেশা। যুগ যুগ ধরে জীবিকার অন্বেষণে তারা একমাত্র এ পেশাকেই আঁকড়ে ধরে আছে। সাপ খেলা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেলে এ সম্প্রদায়ের অপমান হবে, এ ভেবেই বংশ পরম্পরায় এ পেশাকে যে কোনো মূল্যে ধরে রাখতে চায় তারা। এই সাপের খেলা দেখাতে গিয়ে অনেক সময় তাদের মৃত্যুও ঘটে। সাপের বিষনালি বন্ধ করে, সিরিঞ্জ দিয়ে বিষ তুলে এনে তারা সাপের খেলা দেখায়। তবে মাঝে মাঝে এটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়। ভালোভাবে বিষ নামাতে না পারলে সাপের ছোবলে অনেকে মারাও যায়। যাযাবর বলেই তাদের জীবন বৈচিত্র্যময়। বেদেসমাজ মাতৃতান্ত্রিক। বেদে নারীরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করে। উপার্জন, বিয়ে ও সন্তান প্রতিপালনে তারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বেদে পুরুষরা অলস। কায়িক পরিশ্রমকে তারা ঘৃণা করে। ফলে সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য বেদে মেয়েদেরই ঘর থেকে বের হতে হয়। বেদেরা সাধারণত নদীর আশপাশে সমতল ভূমিতে মাচা করে বসবাস করে। তবে নৌকায় বসবাসই তাদের ঐতিহ্য। তারা এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না। নৌকা করে গ্রামগঞ্জে পরিভ্রমণ করে। বিশেষ করে ফসল ওঠার মৌসুমে ও হাটবার তারা বেশি যায়। বেদে নারীরাই দলবদ্ধভাবে এই পরিভ্রমণে যায়। এ সময় তাদের সঙ্গে সাপের ঝাঁপি ও ওষুধের ঝুলি থাকে। হাটবাজারে সাপের খেলা দেখিয়ে এবং ওষুধ বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে। তাছাড়া দাঁতের পোকা বের করা, শিঙ্গা ফুঁকা, শরীরে উল্কি এঁকেও তারা আয় করে। এ সময়ে বেদেনিরা বেশ সাজগোছ করে, কোমরে বিছা লাগায়, শরীরে ইমিটেশন গহনা পরে, খোঁপায় ফুল গুঁজে রাখে। মানুষকে আকর্ষণ করার জন্যই এমন সাজগোজ করে। অর্থ উপার্জনের পর ফেরে নিজ ডেরায় স্বামী-সন্তানের কাছে। বেদেরা সাধারণত সাপ ধরে। বনজঙ্গল, ঝোপঝাড় থেকে পুরুষ বেদেরা সাপ ধরে নিয়ে আসে। বেদেনিরাও সাপ ধরতে পারে। ডোরা সাপ, ঘর চিতি, লাউডগা ইত্যাদি বিষহীন সাপ সাবলীলভাবে ধরতে পারে। তবে সবাই সাপ ধরতে পারে না। উগ্র মেজাজের এবং ভয়ঙ্কর বিষাক্ত দাঁড়াশ, কালকেউটে, গোখরা, শক্সিখনীজাতীয় সাপ তারা অন্য বেদের কাছ থেকে কিনে নেয়। উপার্জন মৌসুম শেষ হলে বেদে পরিবারে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বিয়ে করতে হলে কনেকে অর্থ দিতে হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অন্য কোনো কারণে ছাড়াছাড়ি হলে সম্পত্তি, পুত্র, কন্যাও ভাগাভাগি হয়। সর্দাররা বিচার করে যা রায় দেয় উভয়পক্ষকে তা মেনে নিতে হয়। বিয়ের রাতে স্বামীকে সন্তান পালনের জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হয়। যতদিন স্ত্রী উপার্জনের জন্য বাইরে থাকে ততদিন স্বামী-সন্তান প্রতিপালন করে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর ঘরে যায়। স্ত্রীর ঘরই স্বামীর ঘর।

বেদেদের জীবন-জীবিকা আবর্তিত হয় পানি আর নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে মিলে। নৌকার পাটাতনেই তাদের জন্ম-মৃত্যু আর সেখানেই তাদের বসবাস। পানির সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই বেড়ে ওঠে বেদেশিশু। জীবনের অলিগলি পেরিয়ে পানিই তাদের পরম বন্ধু। ভোরের আলো ফুটে না ওঠতেই তাদের জীবন-সংগ্রাম শুরু হয়। সমাজের লৌকিক প্রথা অনুযায়ী একদিন খাদ্য অন্বেষণে না গেলে তাদের জন্য চরম অমঙ্গল। তাই তারা প্রকৃতির শত বৈরী আবহাওয়া মধ্যেও খাদ্য অন্বেষণে যায়। বেদে সম্প্রদায় গোষ্ঠীবদ্ধ যাযাবর জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এরা বহর নিয়ে সরদারের নেতৃত্বে ঘুরে বেড়ায় একস্থান থেকে অন্যস্থানে। বেদেদের প্রতিটি পরিবারের জন্যই পৃথক নৌকা রয়েছে। তাদের ব্যবহৃত নৌকা সাধারণত ১০-১২ হাত লম্বা হয়। কেউ কেউ এরচেয়ে বড় নৌকাও তৈরি করে। তবে তা নির্ভর করে আর্থিক সামর্থের ওপর। নৌকাকে তারা নাও বা ডিঙ্গি বলে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য নৌকা চালনায় দক্ষ। এক সময়ে শাল ও সুন্দরী কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করা হতো। কিন্তু এসব কাঠের দাম খুব বেশি হওয়ায় অধিকাংশ নৌকা এখন রেইনট্রি অথবা চাম্বল কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। নৌকাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে তাদের আলাদা এক রাজ্য, এক পৃথক ইতিহাস। নৌকানির্ভর জীবনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা তাদের মধ্যে খুব কম। ভিন্নতর সংস্কৃতি নিয়ে গভীর মমতায় ভাসমান জীবনব্যবস্থা আঁকড়ে থাকলেও নদীর বুকেও তাদের স্থিতি নেই। আজ এক ঘাটে তো কাল আরেক ঘাটে। বেদেদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। ধর্ম ইসলাম কিন্তু কেউ কেউ পূজা-অর্চনায়ও বিশ্বাসী। রাষ্ট্রের বিমুখতা আর স্থলভূমির মানুষের বৈরিতা, শূন্যতায় ভরে দিয়েছে বেদেদের জীবনের অমিত সম্ভাবনাকে। তবু মাটির স্পর্শজাগা পৃথিবীতে বাঁচার স্বপ্নে বিভোর থাকে তারা। নদীর অন্ধকার গর্ভে আরও ঘনীভূত অন্ধকারাচ্ছন্ন তাদের জলজীবন। এ জলযাত্রা মাটি আর আকাশকে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়ায় না। পানি, মাটি আর আকাশ এক সঙ্গে জিইয়ে রাখে তাদের সীমাহীন দুঃখ।