Wednesday, April 6, 2011

জলে ভাসা জীবন


'রানী সালাম বারে বার/নামটি আমার গয়া বাইদ্যা বাবা থাকি পদ্মার পাড়' এটি পদ্মা, যমুনা, বড়াল, ধলেশ্বরী, ইছামতি, শীতলক্ষ্যা অথবা তুরাগের বুকে বসতি গড়ে ওঠা সম্প্রদায়ের যাযাবর জীবনের গল্প। লিখেছেন

_ সিরাজ প্রামাণিক



বেদেদের জীবনের গতিপথ তাবিজ-কবজ, জাদুটোনা আর সাপের খেলা দেখানোর নেশাতেই মিলেমিশে থাকে। সাপের খেলা দেখানো বেদে সম্প্রদায়ের আদি পেশা। যুগ যুগ ধরে জীবিকার অন্বেষণে তারা একমাত্র এ পেশাকেই আঁকড়ে ধরে আছে। সাপ খেলা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেলে এ সম্প্রদায়ের অপমান হবে, এ ভেবেই বংশ পরম্পরায় এ পেশাকে যে কোনো মূল্যে ধরে রাখতে চায় তারা। এই সাপের খেলা দেখাতে গিয়ে অনেক সময় তাদের মৃত্যুও ঘটে। সাপের বিষনালি বন্ধ করে, সিরিঞ্জ দিয়ে বিষ তুলে এনে তারা সাপের খেলা দেখায়। তবে মাঝে মাঝে এটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়। ভালোভাবে বিষ নামাতে না পারলে সাপের ছোবলে অনেকে মারাও যায়। যাযাবর বলেই তাদের জীবন বৈচিত্র্যময়। বেদেসমাজ মাতৃতান্ত্রিক। বেদে নারীরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করে। উপার্জন, বিয়ে ও সন্তান প্রতিপালনে তারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বেদে পুরুষরা অলস। কায়িক পরিশ্রমকে তারা ঘৃণা করে। ফলে সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য বেদে মেয়েদেরই ঘর থেকে বের হতে হয়। বেদেরা সাধারণত নদীর আশপাশে সমতল ভূমিতে মাচা করে বসবাস করে। তবে নৌকায় বসবাসই তাদের ঐতিহ্য। তারা এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না। নৌকা করে গ্রামগঞ্জে পরিভ্রমণ করে। বিশেষ করে ফসল ওঠার মৌসুমে ও হাটবার তারা বেশি যায়। বেদে নারীরাই দলবদ্ধভাবে এই পরিভ্রমণে যায়। এ সময় তাদের সঙ্গে সাপের ঝাঁপি ও ওষুধের ঝুলি থাকে। হাটবাজারে সাপের খেলা দেখিয়ে এবং ওষুধ বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে। তাছাড়া দাঁতের পোকা বের করা, শিঙ্গা ফুঁকা, শরীরে উল্কি এঁকেও তারা আয় করে। এ সময়ে বেদেনিরা বেশ সাজগোছ করে, কোমরে বিছা লাগায়, শরীরে ইমিটেশন গহনা পরে, খোঁপায় ফুল গুঁজে রাখে। মানুষকে আকর্ষণ করার জন্যই এমন সাজগোজ করে। অর্থ উপার্জনের পর ফেরে নিজ ডেরায় স্বামী-সন্তানের কাছে। বেদেরা সাধারণত সাপ ধরে। বনজঙ্গল, ঝোপঝাড় থেকে পুরুষ বেদেরা সাপ ধরে নিয়ে আসে। বেদেনিরাও সাপ ধরতে পারে। ডোরা সাপ, ঘর চিতি, লাউডগা ইত্যাদি বিষহীন সাপ সাবলীলভাবে ধরতে পারে। তবে সবাই সাপ ধরতে পারে না। উগ্র মেজাজের এবং ভয়ঙ্কর বিষাক্ত দাঁড়াশ, কালকেউটে, গোখরা, শক্সিখনীজাতীয় সাপ তারা অন্য বেদের কাছ থেকে কিনে নেয়। উপার্জন মৌসুম শেষ হলে বেদে পরিবারে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বিয়ে করতে হলে কনেকে অর্থ দিতে হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অন্য কোনো কারণে ছাড়াছাড়ি হলে সম্পত্তি, পুত্র, কন্যাও ভাগাভাগি হয়। সর্দাররা বিচার করে যা রায় দেয় উভয়পক্ষকে তা মেনে নিতে হয়। বিয়ের রাতে স্বামীকে সন্তান পালনের জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হয়। যতদিন স্ত্রী উপার্জনের জন্য বাইরে থাকে ততদিন স্বামী-সন্তান প্রতিপালন করে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর ঘরে যায়। স্ত্রীর ঘরই স্বামীর ঘর।

বেদেদের জীবন-জীবিকা আবর্তিত হয় পানি আর নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে মিলে। নৌকার পাটাতনেই তাদের জন্ম-মৃত্যু আর সেখানেই তাদের বসবাস। পানির সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই বেড়ে ওঠে বেদেশিশু। জীবনের অলিগলি পেরিয়ে পানিই তাদের পরম বন্ধু। ভোরের আলো ফুটে না ওঠতেই তাদের জীবন-সংগ্রাম শুরু হয়। সমাজের লৌকিক প্রথা অনুযায়ী একদিন খাদ্য অন্বেষণে না গেলে তাদের জন্য চরম অমঙ্গল। তাই তারা প্রকৃতির শত বৈরী আবহাওয়া মধ্যেও খাদ্য অন্বেষণে যায়। বেদে সম্প্রদায় গোষ্ঠীবদ্ধ যাযাবর জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এরা বহর নিয়ে সরদারের নেতৃত্বে ঘুরে বেড়ায় একস্থান থেকে অন্যস্থানে। বেদেদের প্রতিটি পরিবারের জন্যই পৃথক নৌকা রয়েছে। তাদের ব্যবহৃত নৌকা সাধারণত ১০-১২ হাত লম্বা হয়। কেউ কেউ এরচেয়ে বড় নৌকাও তৈরি করে। তবে তা নির্ভর করে আর্থিক সামর্থের ওপর। নৌকাকে তারা নাও বা ডিঙ্গি বলে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য নৌকা চালনায় দক্ষ। এক সময়ে শাল ও সুন্দরী কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করা হতো। কিন্তু এসব কাঠের দাম খুব বেশি হওয়ায় অধিকাংশ নৌকা এখন রেইনট্রি অথবা চাম্বল কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। নৌকাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে তাদের আলাদা এক রাজ্য, এক পৃথক ইতিহাস। নৌকানির্ভর জীবনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা তাদের মধ্যে খুব কম। ভিন্নতর সংস্কৃতি নিয়ে গভীর মমতায় ভাসমান জীবনব্যবস্থা আঁকড়ে থাকলেও নদীর বুকেও তাদের স্থিতি নেই। আজ এক ঘাটে তো কাল আরেক ঘাটে। বেদেদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। ধর্ম ইসলাম কিন্তু কেউ কেউ পূজা-অর্চনায়ও বিশ্বাসী। রাষ্ট্রের বিমুখতা আর স্থলভূমির মানুষের বৈরিতা, শূন্যতায় ভরে দিয়েছে বেদেদের জীবনের অমিত সম্ভাবনাকে। তবু মাটির স্পর্শজাগা পৃথিবীতে বাঁচার স্বপ্নে বিভোর থাকে তারা। নদীর অন্ধকার গর্ভে আরও ঘনীভূত অন্ধকারাচ্ছন্ন তাদের জলজীবন। এ জলযাত্রা মাটি আর আকাশকে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়ায় না। পানি, মাটি আর আকাশ এক সঙ্গে জিইয়ে রাখে তাদের সীমাহীন দুঃখ।

No comments: