Tuesday, October 12, 2010

সু চির জন্য সাঁতার

মার্কিন নাগরিক জন উইলিয়াম ইয়েত্তো বিনা অনুমতিতে অং সান সু চির সঙ্গে দেখা করেছেন রীতিমতো লেক সাঁতরে। এই ‘অপরাধে’ আবার গৃহবন্দী সু চি! কে এই জন ইয়েত্তো? লিখেছেন তৈমুর রেজা

আর মোটে দুই সপ্তাহ। এর পরই মুক্তি পাবেন অং সান সু চি। দিন গোনেন তিনি। যে বাড়িতে তিনি বন্দী, তার জানালায় দাঁড়ান বারবার। চেয়ে থাকেন খোলা আকাশে আর প্রার্থনা করেন দেশের প্রতিটি ধূলিকণার জন্য। অপেক্ষা সেই ভোরের। কিন্তু সেই ভোর আর আসে না। আরেকটা দমকা হাওয়া এসে বন্ধ করে দেয় জানালা।
আচমকা এবার যে জালে তিনি আটকে গেলেন, তা হয়তো কারও কল্পনায়ও আসত না। সেটা এমনই অদ্ভুত যে হঠাত্ শুনলে ঠাওর করা মুশকিল—এটা একটা গাঁজাখুরি গল্প, নাকি সত্য! জন ইয়েত্তো বলে এক মার্কিন নাগরিক বিনা অনুমতিতে সু চির বাড়িতে ঢুকে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। ভদ্রলোকের এই পাগলামির দোষ গিয়ে পড়ল সু চির ওপর!
জন ইয়েত্তোর খামখেয়ালিতে শাস্তির মেয়াদ বাড়ে সু চির। তাঁকে আরও ১৮ মাস গৃহবন্দী থাকতে হবে। প্রশ্ন হলো, কে এই ইয়েত্তো? জন উইলিয়াম ইয়েত্তো যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। কোনো এক অদ্ভুত কারণে তাঁর প্রায়ই সু চিকে দেখার খায়েশ হয়। ভিসার জন্য তিনি ছোটাছুটি করেন, কিন্তু ভিসা পান না। এখানে-সেখানে তিনি ঘুরে বেড়ান। সু চির মুক্তির জন্য তিনি প্রাণ দেবেন—এমন ধারা কথাও বলে বেড়ান। মুখে বলে চুপ করে থাকেন না, ২০০৮ সালে লেক সাঁতরে তিনি একবার সত্যি সু চির বাড়িতে ঢুকে পড়েন। ২০০৯ সালে আবার।
সমাজের চোখে এলোমেলো লোকটির জন্ম হয়েছিল ১৯৫৫ সালে, মিশিগান শহরে। ইয়েত্তোর বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক ছিল না। তাঁর আগের তিন ভাইবোন শৈশবেই মারা যান। ইয়েত্তোর বয়স যখন দুই, তাঁর বাবা তাঁদের ছেড়ে যান। বয়স পাঁচ বছর হতেই অ্যালকোহলে আসক্তির কারণে তাঁর মা হারিয়েছেন সন্তানদের অভিভাবকত্ব।
পর্যুদস্ত ইয়েত্তোরা চলে আসেন ক্যালিফোর্নিয়ায় এক স্বজনের বাড়িতে। কিন্তু সেখানে তাঁর পোষাল না। ১৯৭১ সালে তিনি বাড়ি থেকে পালালেন। এরপর দুই বছর কাটিয়েছেন গাড়িতে। গাড়িতেই চিত, গাড়িতেই নিদ। এরপর তিনি যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে। কিন্তু এক বছরের মাথায় সে চাকরিও খোয়া গেল!
১৯৭৫ সালে বিচিত্র এই মানুষটি বিয়ে ‘শুরু’ করেন! শুরুই বলতে হবে। কারণ, এরপর আরও তিনটি বিয়ে করেছেন ইয়েত্তো।
গ্র্যাজুয়েট হতে ইয়েত্তোর বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে তিনটি আলাদা বিষয়ে ডিগ্রি পান তিনি—মনোবিজ্ঞান, জীববিদ্যা আর অপরাধবিদ্যায়। এত দিনে ইয়েত্তোর শরীর ভাঙতে শুরু করেছে। নানা রকম অসুখ বাসা বেঁধেছে তাঁর শরীরে। শ্বাসকষ্ট আর ডায়াবেটিস আছে। শৈশবে পাওয়া আঘাত থেকে মানসিক অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়েছে। ২০০৭ সালে তিনি শতভাগ প্রতিবন্ধী হিসেবে যুদ্ধসংস্থা থেকে টাকা পান।
২০০৮ সালে ছেলেকে সঙ্গে করে ইয়েত্তো এশিয়ায় আসেন। এর আগে সু চির ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না তাঁর। থাইল্যান্ডে পৌঁছে একটু একটু করে তিনি জানতে থাকেন মিয়ানমারের ‘আন্টি’র ব্যাপারে। শুনতে থাকেন বর্মি এই নারীর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই ও ত্যাগের কথা। কিছুদিনের মধ্যে সু চির ভক্ত বনে যান ইয়েত্তো।
শুধু ভক্ত হওয়া নয়, সু চিকে মুক্ত করার ব্যাপারে কিছু একটা করার কথাও ভাবতে থাকেন। সবাইকে বলতে শুরু করেন, সু চির মুক্তির জন্য তাঁকেই তো ভাবতে হবে। তাঁর কি আর বসে থাকাটা ভালো দেখায়! বিশ্ববাসীর মনোযোগ কাড়তে তিনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন বলে ঠিক করেন। এরপর একদিন হঠাত্ মে সট শহর থেকে উধাও হয়ে যান ইয়েত্তো। কী করে যেন মিয়ানমারের ভিসাও জোগাড় করে ফেলেন। ৭ নভেম্বর তিনি ইয়াঙ্গুনের পথে উড়াল দেন।
ইয়েত্তোর এই ইয়াঙ্গুন যাত্রার পেছনে আরেকটা পুরোনো গল্প আছে। গল্পটা তাঁর ছেলেকে নিয়ে। খুব দুষ্টু ছিল ইয়েত্তোর ছেলে ক্লিন্ট। বাবার কিনে দেওয়া মোটরসাইকেল হাঁকাতে গিয়ে একদিন ছেলেটা মারা যায়।
এই দুর্ঘটনার ভেতর দিয়ে ইয়েত্তো তাঁর একটা ‘শক্তি’ আবিষ্কার করে ফেলেন। ছেলে মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকে তাঁর মনে হতো, ছেলেটার অশুভ কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু ছেলেকে সাবধান করেননি তিনি। এরপর সত্যি সত্যি ছেলে মারা গেলে এই মৃত্যুর জন্য তাঁর নিজেকেই দোষী মনে হয়। এরপর ইয়েত্তো মনে করতে শুরু করেন, তাঁর অশুভ আশঙ্কা সত্যে পরিণত হবে।
এমনই একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল তাঁর সু চিকে নিয়ে—সু চিকে মেরে ফেলা হতে পারে। আশঙ্কাটা সত্য হওয়ার আগেই বন্দী নেত্রীকে সতর্ক করাটা নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেছেন ইয়েত্তো। ছেলের ব্যাপারে যে ভুল করেছেন, সু চির ব্যাপারে সেটা করতে চান না। তাই চললেন কারাগারে পরিণত হওয়া সু চির সেই বাড়িতে।
কিন্তু যেতে চাইলেই কি আর যাওয়া যায়? সু চি যে বাড়িতে বন্দী, সেটাকে প্রায় দুর্গ বানিয়ে ফেলেছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। বাড়িটির চারদিকে পরিখা হিসেবে ইনা লেককে ব্যবহার করা হচ্ছে। দিনরাত ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেই বাড়ি পাহারা দেয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। আর লেকের মধ্যে সারাক্ষণ চক্কর দিয়ে বেড়ায় পুলিশের সশস্ত্র নৌযান।
এরই মধ্যে পথ বের করে নেন ইয়েত্তো। সিদ্ধান্ত নেন সাঁতরে লেক পার হবেন। সিদ্ধান্তটাকে কী করে যেন বাস্তবও করে তোলেন। উপস্থিত হন সু চির বাড়িতে। লেক পার হয়ে পথ হিসেবে তিনি বাড়ির পেছন দিকের কালভার্টের তলাটা ব্যবহার করলেন। তারপর বাড়ির পেছন দিকের ছোট্ট বেড়া গলে ঢুকে পড়লেন। কিন্তু মূল বাড়িতে ঢোকার পথে বাধা পেলেন সু চির পরিচারিকার কাছে।
এই বাধায় সেবার সু চির সঙ্গে দেখা করতে পারলেন না ইয়েত্তো। কিন্তু চটপটে ইয়েত্তো সবাইকে কথায় মন্ত্রমুগ্ধ করে দুই দিন কাটিয়ে দিলেন এই বাড়িতে। গণতন্ত্রের প্রতীক সু চির এখন বই পড়া দরকার—এ কথা ভেবে তিনি ছয়টা বই রেখে গেলেন, আর রেখে গেলেন ইয়েত্তোর মেয়ের লেখা একটা চিঠি। মেয়ের খুব শখ—তার লেখা চিঠি পড়বেন সু চি।
এসব কীর্তি করে তিনি যে পথে এসেছিলেন, সেই পথেই পালিয়ে যান। অবশ্য ফেরার পথে তিনি ধরাও পড়েছিলেন পুলিশের হাতে। কিন্তু পুলিশ কী ভেবে যেন তাঁকে ছেড়ে দেয়।
সু চি কিন্তু ঘটনাটা চেপে রাখেননি। ২০০৮ সালের এই ঘটনা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন তিনি। তারা বলেছিল, বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। অথচ এক বছরের মাথায় একই ঘটনায় মহা বিচলিত হয়ে পড়ল মিয়ানমার সরকার!
২০০৮ সালের অভিযান শেষ করে এসেও শান্ত হতে পারেন না ইয়েত্তো। কিছুদিনের মধ্যে আবার বিচলিত হয়ে পড়েন—সু চি বন্দী হয়ে আছেন, তাঁকে উদ্ধার করতে হবে। রূপকথার রাজপুত্রের মতো নিজে উদ্ধার করতে না পারলেও অন্তত একটা শোরগোল বাধিয়ে ফেলতে তিনি নিশ্চয়ই পারবেন। তাই আবার যাওয়া চাই সু চির বাড়িতে। সেই সঙ্গে সু চি সম্পর্কে আশঙ্কাটা জোরালো হতে থাকে তাঁর।
তিনি আবার সু চির বাড়িতে হানা দেওয়ার বুদ্ধি আঁটতে থাকেন। এবার ‘গুগল আর্থ’-এর সাহায্যে তিনি লেক সাঁতরে সু চির বাড়ি পৌঁছানোর নিখুঁত ম্যাপিং করে ফেলেন। ৩ মের এক বিকেলে তিনি সুদীর্ঘ সাঁতার আরম্ভ করেন। দুই কিলোমিটার সাঁতরে তিনি সু চির বাড়ি পৌঁছান।
মজার ব্যাপার হলো, ইয়েত্তো লেকে সাঁতরাচ্ছেন—এই দৃশ্য কিছু পুলিশের চোখে পড়ে। কিন্তু তারা খুব জোরের সঙ্গে ইয়েত্তোকে আটকানোর চেষ্টাও করেনি। স্রেফ কিছু পাথর ছুড়ে মেরেছে লোকটির দিকে!
ইয়েত্তো যখন সু চির বাড়ি পৌঁছালেন, তখন ভোর। নর্দমা ব্যবহার করে তিনি বাড়িতে ঢোকেন। এবারও পাকড়াও হলেন সু চির দুই মহিলা সহকারীর কাছে। কিন্তু কথার জাদু দিয়ে তাঁদের বশীভূত করে ফেলেন। তিনি দুর্বল মানুষ, ডায়াবেটিসের রোগী, অতটা পথ সাঁতরেছেন, ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে—এত কষ্টের কথা বললেন, দুটো খেতে না দিয়ে কেউ পারে!
খেয়েদেয়ে, একটু বিশ্রাম নিয়ে শুরু হলো তাঁর বড় আবদার—সু চির সঙ্গে দেখা করতে দিতে হবে। এবং দেখা হয়েও গেল। সু চির সঙ্গে সাক্ষাত্ হতেই প্রথম নিবেদন, এখানে কয়টা দিন থাকতে দিতে হবে। সু চি রাজি হলেন না। মন যতই বলুক, আশঙ্কা হয়, একে প্রশ্রয় দিলে সামরিক সরকার আবার কুযুক্তি দিতে শুরু করবে। কিন্তু ইয়েত্তো তো জানেন, মাতৃমূর্তি সু চিকে কীভাবে বশ করতে হবে। বললেন, পায়ে প্রবল ব্যথা, এ অবস্থায় তাঁর পক্ষে ফিরে যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব। সু চি আর কী করবেন! নিচতলায় একটা ব্যবস্থা করে দিতে বললেন ইয়েত্তোর জন্য।
ইয়েত্তো বাড়ি ছাড়লেন মধ্যরাতে। তারপর আবার সাঁতার। বিপদটা টের পাচ্ছিলেন ইয়েত্তো। তাই ঠিক করলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে যাবেন। যাওয়ার সময় সু চির বাড়িতে তিনি রেখে যান চাদর, ওড়না, স্কার্ট, টর্চলাইট, রং-পেনসিল—এ রকম অদ্ভুত কিছু জিনিস।
এবার খেলা সাঙ্গ হলো। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে পৌঁছানোর কয়েক মুহূর্ত আগে দূতাবাস থেকে ১০০ ফুট দূরত্বে ধরা পড়ে গেলেন ইয়েত্তো। ইনসেন কারাগারে পাঠানো হলো তাঁকে। ১৪ মে তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কড়া কিছু অভিযোগ আনা হলো—ইমিগ্রেশন আইন অমান্য, সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ, বিনা অনুমতিতে সাঁতার এবং বিনা অনুমতিতে স্থানীয় বাসিন্দার বাড়িতে রাত কাটানো।
পুরো ব্যাপারটা মিয়ানমারের সামরিক সরকারের জন্য বিরাট একটা আশীর্বাদ হয়েই এল। জন ইয়েত্তোর এই অভিযানের পেছনে তারা বেশুমার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র খুঁজে পেল। সরকারের হাত আরও শক্তিশালী করল আদালতে ইয়েত্তোর ভাষ্য। আদালতে ইয়েত্তো বললেন, তিনি গায়েবি সংবাদ পেয়েছেন, সন্ত্রাসীরা সু চিকে মেরে ফেলবে। স্বয়ং ঈশ্বরের আদেশে তিনি সু চির বাড়িতে গেছেন, তাঁকে সাবধান করার জন্য। এসব অতিপ্রাকৃত যুক্তিতে মন গলল না আদালতের।
সু চির কাছে অবশ্য যথেষ্ট বাস্তব যুক্তি ছিল। তিনি আদালতে বললেন, এই অতিথি তো নিমন্ত্রিত ছিলেন না। তাঁর বাড়িতে ইয়েত্তোর অনুপ্রবেশের দায় যদি কারও থেকে থাকে, সেটা নিরাপত্তাকর্মীদের। কিন্তু কে কার যুক্তি শোনে! একটা ছুতো তো পাওয়া গেছে!
আগস্টের ১১ তারিখ রায় হলো। ইয়েত্তোর সাত বছরের জেল। সু চির আরও তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড; যদিও মিনিট পাঁচেক পর রায় পাল্টে সু চির ১৮ মাসের বিনাশ্রম দণ্ড হলো। হতাশা, ক্ষোভ আর অবুঝ ভক্তের প্রতি হয়তো মমতা নিয়েই আবার সেই বাড়ি ফিরে গেলেন সু চি।
আর ইয়েত্তো? তিনি জেলে ঢুকেই খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলেন। কারণ হিসেবে বললেন, ‘ধর্মীয় ব্যাপার। তোমরা বুঝবে না।’ স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হলো। তারপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিনেটর এসে তাঁকে মুক্ত করে নিয়ে গেলেন।
দেশে ফিরলেন ইয়েত্তো। নাম হয়ে গেল। কেউ তাঁর ওপর বিরক্ত, কেউ তাঁর সদিচ্ছার কারণে তাঁকে ‘নায়ক’ ভাবছে। আর ইয়েত্তো নতুন কোনো পরিকল্পনা আঁটছেন।
ইয়েত্তোর জন্য সু চিকে ২০১০ সালের নির্বাচনের সময়ও বন্দী থাকতে হবে, তাঁর জন্য সু চিকে পোহাতে হবে আরও কষ্ট, হয়তো তাঁরই জন্য আরও পিছিয়ে যাবে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সূর্যোদয়। কিন্তু এই ভক্তর তাতে কোনো বিকারই নেই যেন।
এত কিছুর পর আবার বলেন, ‘আমি আরও একবার, দশবার, একশবার যাব। আমাকে যেতেই হবে।’
তথ্যসূত্র: এএফপি, ওয়েবসাইট। | তারিখ: ০৪-০৯-২০০৯

No comments: