Tuesday, October 5, 2010

আবদুল গনির উদ্ভাবন

গুটি ইউরিয়া সার তৈরির মেশিনে কাজ করছেন আবদুল গনি গুটি ইউরিয়া সার তৈরির মেশিনে কাজ করছেন আবদুল গনি

যা দেখেন, তা-ই বানাতে পারেন তিনি। অন্যের চোখে যা জটিল কারিগরি মারপ্যাঁচ, আবদুল গনির চোখে তা জলের মতো সহজ। পড়াশোনা করেছেন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। রিকশা মেরামতির কাজ করতেন। সবদিক দেখেশুনে কাজ নেন ওয়েল্ডিং কারখানায়। সে ১৯৯৪-৯৫ সালের কথা।
এবার আবদুল গনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেন ৮০ হাজার টাকা। নিজের ওয়েল্ডিং কারখানা বানিয়ে থ্রেসার মেশিন তৈরি করা শুরু করেন। ভীষণ চাহিদা। ১০০ থ্রেসার মেশিনের ফরমায়েশ পেয়ে গেলেন। ঘটনাচক্রে এর পরপরই শুরু হয়ে যায় টানা ১৮ দিনের হরতাল। হু হু করে বেড়ে যায় লোহার দাম। যে টাকায় মেশিনগুলোর বায়না নিয়েছিলেন, সে টাকা লোহা কিনতেই শেষ। তিন লাখ টাকার ঋণে পড়ে যান আবদুল গনি। মাথার ওপর গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের কিস্তি। একেবারে জীবন-মরণ সমস্যা। বাধ্য হয়ে নিজের ভিটেবাড়ি বেচে দিয়ে সপরিবারে রাস্তায় নেমে আসেন। বড় দুই ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই দায়।
নিজের উদ্ভাবনী শক্তির গুণেই রাস্তা থেকে আবার উঠে আসেন আবদুল গনি। সে এক অসাধারণ জীবনযুদ্ধ। ১৯৯৯ সালের কথা। নাটোরের সার-ডিলার আবুল হোসেন তালুকদার গুটি ইউরিয়া বানানোর একটা মেশিন কিনে আনেন। দাম এক লাখ ২০ হাজার টাকা। ভদ্রলোক স্থানীয়ভাবে কম খরচে মেশিনটি তৈরির কথা ভাবেন। খোঁজাখুঁজি করে পেয়ে যান নাটোরেরই লালপুর উপজেলার ওয়ালিয়া পশ্চিমপাড়া গ্রামের আবদুল গনিকে। মেশিন দেখে আবদুল গনি হিসাব করে বললেন ৮০ হাজার টাকার মধ্যে এই মেশিন তৈরি করে দিতে পারবেন। সত্যিই তিন মাসের মধ্যে আবদুল গনি মেশিনটি তৈরি করে ফেললেন। সারের মান বেশ ভালো, ঘণ্টায় আট-নয় বস্তা সার বের হচ্ছে।
চারদিকে হইচই পড়ে গেল। মেশিন বিক্রি হতে লাগলো। ২০০০ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠান মেসার্স গনি ফাউন্ড্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের লাইসেন্স করেন। ২০০৪ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ নেন।
এদিকে ২০০০ সাল থেকেই আবদুল গনির কাছে ফরমায়েশ আসতে থাকে। ব্যাপক ফরমায়েশ পাওয়ায় তিনি উপজেলার গোপালপুর রেলগেটে আরও একটি ওয়ার্কসপ তৈরি করেন।
আবদুল গনির সঙ্গে কথা হলো তার রেলগেটের ওয়ার্কসপে গিয়ে। ভীষণ ব্যস্ত। তাঁর নির্দেশনা মতো মিস্ত্রিদের সঙ্গে কাজ করছে তাঁর দুই ছেলে। বললেন, ‘৪০টা মেশিনের ফরমায়েশ আছে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করতে হচ্ছে।’ তাঁর গোডাউনে দেখা গেল অনেক মেশিন তৈরি প্রক্রিয়াধীন অবস্থায়।
আবদুল গনি জানান, বগুড়ার একজন কারিগর ৪০টি মেশিন তৈরি করেছিলেন কিন্তু ফলাফল ভালো পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। এ জন্য মেশিনপ্রতি তিনি ১২ হাজার টাকা করে পারিশ্রমিক নিয়েছেন। এখন তাঁর কাছে রংপুর, বগুড়া ও দিনাজপুরের ফরমায়েশ রয়েছে। উত্তরাঞ্চলে এই মেশিন ব্যবহার করছেন—এমন অনেকেই জানিয়েছেন, সরকারিভাবে সরবরাহ করা মেশিনের চেয়ে আবদুল গনির মেশিনই ভালো কাজ করছে।
একসময়কার বাস্তুহারা আবদুল গনি নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতায় ফিরে পেয়েছেন অনেক কিছু। বাড়ি করেছেন। সাত-আট বিঘা জমি কিনেছেন। মোটরসাইকেল কিনেছেন, নিজের গুদাম আছে। তাঁর চোখে স্বপ্ন, অভাবের কারণে বড় দুই ছেলের পড়াশোনা হলো না, ছোট ছেলে দুটোর নিশ্চয়ই হবে।
গুটি ইউরিয়া মেশিনের পর এবার আবদুল গনি তৈরি করেছেন জৈব সার তৈরির স্বয়ংক্রিয় মেশিন। এখন বাজারে যেসব মেশিন আছে সেসবে বানানো জৈব সার আবার রোদে শুকাতে হয়। রোদ না থাকলে মেশিন চলে না। তার নতুন মেশিন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জৈব সার শুকিয়ে বের হবে, রোদে শুকাতে হবে না। প্রতি ঘণ্টায় তৈরি হবে ১০০ কেজি জৈব সার। দিনে ১০ ঘণ্টা মেশিন চালালে এক টন করে জৈব সার তৈরি হবে। কিন্তু তাঁর দুঃখ, তিনি এই মেশিনটি চালানোর অনুমতি পাচ্ছেন না। আবদুল গনির আবেদন, সরকার যদি তাঁর এই নতুন মেশিনটি চালানোর অনুমতি দেয়, তাহলে তাঁর চেয়ে কৃষকেরাই বেশি উপকৃত হবেন। 
 
সুত্র: প্রথম আলো। আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ | তারিখ: ২৯-০১-২০১০

No comments: