Wednesday, October 6, 2010

একাত্তরের পুতুলওয়ালা

সবুজ একটা ধানক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে এক কৃষকের সঙ্গে জোর তর্ক চলছে একজন রাজাকার আর খোদ ইয়াহিয়া খানের।
রাজাকার: কইয়া দাও, মুক্তি কোথায়?
ইয়াহিয়া: কিধার মুক্তি হায়?
কৃষকটি একটু এগিয়ে এসে নিজের বুক চাপড়ে বলল, ‘এইখানে, এইখানে থাকে মুক্তি। বুকের মধ্যেই মুক্তি থাকে।’

সত্যিকারের তর্ক নয়। ইয়াহিয়া, রাজাকার ও কৃষকরূপী পুতুলদের তর্ক। পুতুলদের এই কাণ্ড হাসি ফোটায় রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের মুখে, ক্যাম্পের শরণার্থীদের মুখে। আর সেই হাসি দেখে পুতুলের পেছনে দাঁড়িয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলেন একজন পুতুলওয়ালা। তিনি জয় করে ফেলেন অন্যরকম এক যুদ্ধ, হাসি জয়ের যুদ্ধ।
এই যুদ্ধজেতা মানুষটি আমাদের মুস্তাফা মনোয়ার। অনেক গৌরবময় পরিচয়ের মধ্যে বিরাট এক পরিচয়—একাত্তরের রণাঙ্গনে পাপেট শো দেখিয়ে মানুষ হাসানো মুস্তাফা মনোয়ার।

অন্যরকম যুদ্ধ
মুস্তাফা মনোয়ারের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। পাকিস্তানের ‘রিপাবলিক দিবস’। পাকিস্তান টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক হিসেবে এদিন বিশেষ কিছু আয়োজন করার কথা মুস্তাফা মনোয়ারের। কিন্তু এই দিন উদ্যাপন করতে মন সায় দিল না তাঁর।
কী করে মন সায় দেয়? বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। এমন অবস্থায় পাকিস্তানের বিশেষ দিবস পালন!
টেলিভিশন স্টেশনে ঢুকে মুস্তাফা মনোয়ার ভাবতে থাকলেন, কী করা যায়। পরিকল্পনা করলেন, অনুষ্ঠান শেষে এই বিশেষ দিনে পাকিস্তানের পতাকাই উড়ানো হবে না। যেই ভাবা, সেই কাজ। তখন ১০টার মধ্যে টেলিভিশন বন্ধ হয়ে যেত। এদিন অনুষ্ঠান আরও দুই ঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া হলো।
ওদিকে ১৫ দিন আগ থেকেই ৬০-৭০ জন পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্প করেছে স্টেশনের ভেতর। অধৈর্য মেজর সাহেব জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রোগ্রাম খতম নেহি হোতা কাহে?’ মুস্তাফা মনোয়ার বললেন, ‘আপকো মালুম নেহি আজ স্পেশাল ডে? প্রোগ্রাম অর ভি চ্যালে গা।’ ১১টার দিকে সব কলাকুশলী পেছনের গেট দিয়ে চলে গেলেন। মুস্তাফা মনোয়ার, উপস্থাপিকা মাসুমা খাতুন সব, আরও কজন আছেন শুধু। ১২টা এক-দুই মিনিটে মাসুমা বললেন, আজ ২৪ তারিখ। আমাদের অনুষ্ঠানমালা শেষ। এই বলে সবাই মিলে ভোঁ-দৌড়।
এর পর পাকিস্তান টেলিভিশন স্টেশনেও আর পা রাখা হয়নি। ঢাকায়ও বেশি দিন থাকা হয়নি। ২৬ মার্চ এসে গেল। চললেন কলকাতার পথে। পথে পথে হূদয় ভেঙে দেওয়া ছবি। হাজার হাজার মানুষ পথ চলছে। নেই কোনো মুখের ভাষা। তারা জানে না কোথায় চলছে।
কলকাতায় গিয়ে উঠলেন পার্ক সার্কাস এলাকার একটি বাসায়। নানা কাজের মধ্যেও মাঝে মাঝে বারাকপুরের শিবিরগুলোতে যেতেন। সেখানে কারও মুখে হাসি নেই। বাচ্চাগুলোও গম্ভীর। বেঁচে থাকার ইচ্ছাও যেন নেই মানুষগুলোর। তখনই হঠাত্ মনে পড়ে গেল পাপেটের কথা। পাপেট দিয়ে এই মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর পরিকল্পনা করলেন মুস্তাফা মনোয়ার।
পাপেট বা কথা বলা পুতুলের প্রতি মুস্তাফা মনোয়ারের ভালোবাসাটা তৈরি হয়েছিল কলকাতাতেই। তখন তিনি এই কলকাতায় চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সে সময় রাজস্থানসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পাপেট শো দেখে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। আর অন্তরে ছিল গ্রামবাংলায় পুতুলনাচের প্রতি টান। দুইয়ে মিলে তৈরি হলো পাপেট-প্রেম।
১৯৫৯ সালে ফাইন আর্টসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে যোগ দিলেন পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে। ঢাকায় এসে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পাপেট নিয়ে কাজ করার জন্য। কাজ শুরুও করলেন। মুস্তাফা মনোয়ারের পাপেট শো প্রথম পরিচিতি লাভ করলো ষাটের দশকে; কলিম শরাফীর একটি অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে।

পুতুলের যুদ্ধ
মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সেই পাপেটকেই অস্ত্র বানাতে চাইলেন। কিন্তু পাপেট যে বানাবেন, সঙ্গে তো কিছুই নেই। এরই মধ্যে শিললেনের সেই বাসায় হাজির হয়ে গেলেন তারেক আলী, সাইদুল আনাম টুটুলসহ অনেকে। পাপেটের কথা শুনে তাঁদের উত্তেজনার শেষ নেই। আঠা, কাঠের গুঁড়ো, সুতা, কাপড়, লেইস, রডসহ পুতুল বানানোর সব সরঞ্জামই জোগাড় হলো।
এবার বানাতে হবে পুতুল আর তার জন্য চাই জামা। তাড়াতাড়ি তৈরি করতে হবে সব। কাগজ কেটে পুতুল আর তার জামার মাপ হয়ে গেল।
পুতুলের জামা-কাপড় বানানোর জন্য শিললেনের এক ছোট দর্জির দোকানে হাজির হলেন মুস্তাফা মনোয়ার। ছয়-সাতটি ছোট ছোট জামা বানিয়ে দিতে হবে, আজই। দর্জি তো খুবই অবাক, ‘এত ছোট জামা? এ দিয়ে কী হবে। এখন পারব না।’
কিন্তু নাছোড়বান্দা মুস্তাফা মনোয়াররা, ‘কিন্তু জামাগুলো তো আমাদের ভীষণ দরকার।’ শেষমেশ কথায় কথায় বের হয়ে গেল মুস্তাফা মনোয়াররা বাংলাদেশের লোক। শরণার্থী শিবিরে পুতুলনাচ দেখানোর জন্য এই জামা-কাপড়গুলো চাই। এটুকু শুনেই দর্জি যেন আকাশের চাঁদ পেল হাতে। পারলে মাথার ওপরে তুলে ধরে পুতুলওয়ালাকে!
‘আপনারা মুক্তিযোদ্ধা’—দর্জি বলল। মুস্তাফা মনোয়ার হাসলেন। দর্জিমশাই এত অভিভূত হয়ে গেলেন যে, পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যেই সব কাজ শেষ করে দিলেন। শুধু কাজ শেষ করে দিলেন না। কিছুতেই আর মজুরি নেবেন না। বললেন, ‘লজ্জা দেবেন না, আমি সারা জীবন বলতে পারব, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করেছি।’
পুতুল তৈরি হলো, জামা-কাপড় হলো। এবার শুরু খেলা দেখানো। বারাকপুরের কাছে একটি শরণার্থী শিবিরে গিয়ে হাজির হলেন মুস্তাফা মনোয়ার ও তাঁর পাপেট শোর দল। কালো পর্দা দিয়ে কোনোরকমে মঞ্চ বানানো হলো। প্রথম দিন ওই দলের উপস্থিতিতে শরণার্থী শিবিরের লোকজন অবাক। কী হচ্ছে এখানে!
রাজাকার এসে কৃষককে ভয় দেখাল। রাজাকারের পক্ষ নিয়ে খোদ ইয়াহিয়া চলে এল। তাকে তাড়া করতে মুক্তিযোদ্ধা এল। মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে ইয়াহিয়া আর তার রাজাকার সঙ্গী ভয়ে জড়সড়। শেষে সবাই মিলে ইয়াহিয়া আর রাজাকারকে ধরে পিটুনি।
শুরু হলো হাসি। কান্নাজড়ানো হাসি, প্রাণ খুলে হাসি, মুচকি হাসি, অল্প হাসি, বেশি হাসি—চারদিকে শুধু হাসির শব্দ। মুস্তাফা মনোয়ার আর তাঁর দল অবাক হয়ে দেখলেন, হাসছে সবাই। কয়েক দিন আগে সন্তান হারানো মা হাসছেন, সর্বস্ব হারানো বাবা হাসছেন, পা হারানো মুক্তিযোদ্ধা হাসছেন।
বুক ভরে তৃপ্তির শ্বাস নিলেন মুস্তাফা মনোয়ার। এই তো চেয়েছিলেন তিনি। এমন দুঃসময়ে হাসির বড় প্রয়োজন।
মোট ছয়টি মজার চরিত্রের পাপেট বানানো হয়—কৃষক, ছোট ছেলে, ইয়াহিয়া, রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা ও বাউল। একটি দৈত্যাকৃতির রাক্ষসও ছিল, যাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করা হতো। সংলাপ লিখতে বসে দর্শকদের জন্য কিছু জায়গা রাখা হতো। এসব জায়গায় পাপেটের বিভিন্ন কথার জবাব দিত সাধারণ মানুষ।
লোকজনেরও ছিল দুর্দান্ত উত্সাহ। ইয়াহিয়া মার খাচ্ছে। ঘোষক তখন বলে উঠত, ‘আর কে কে মারতে চায়?’ উপস্থিত জনতা চিত্কার করে উঠত। শো শেষে অনেকে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ক্ষোভ ঝাড়তে সরাসরি এই পুতুল ইয়াহিয়া আর রাজাকারকেই ধরে মারতে চাইত।
শরণার্থী শিবিরের পাশাপাশি পার্ক সার্কাসের স্থানীয় ক্লাবগুলোতেও আয়োজন করা হয় পাপেট শো। কখনো মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টারগুলোতেও এই পাপেট শো সাহস জুগিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। সেসব জায়গায় কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধাও পাপেট পরিচালনায় হাত লাগিয়েছেন। কখনো মুস্তাফা মনোয়ার একাই যেতেন। কখনো দল নিয়ে সাইদুল আনাম টুটুল, তারিক আলী হাজির হয়ে যেতেন।
এভাবে শরণার্থীদের শিবিরে শিবিরে ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে গেল আমেরিকার চিত্রগ্রাহক লেয়ার লেভিনের সঙ্গে। তিনি তো মহা অবাক। এত সুন্দর অভাবনীয় একটা মাধ্যম দেখে তিনি যারপরনাই অভিভূত। চিত্রায়ন করলেন তাঁর পাপেট শো।
এরই মধ্যে মুস্তাফা মনোয়ারের ডাক পড়ে তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে। দিল্লিতে ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দল’ যাবে। সেখানে দলনায়ক হতে হবে মুস্তাফা মনোয়ারকে। পাপেট শো বিরতি দিয়ে সেই দলের সঙ্গে কেটেছে বাকি একাত্তর।
তার পর কত দিন চলে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। পাপেট, ছবি, সংস্কৃতি আর টেলিভিশন নিয়ে দিন কাটে মুস্তাফা মনোয়ারের।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে কোনো একদিনের কথা, দিনটা ঠিক মনে পড়ে না। হঠাত্ এক দিন দেখা তারেক মাসুদের সঙ্গে। তিনি জোর করে নিয়ে গেলেন তাঁর এডিটিং স্টুডিওতে। সেখানে মুক্তির গান নামের একটা চলচ্চিত্রের কাজ চলছে। তারেক মাসুদ তাঁকে কিছু দৃশ্য দেখতে বললেন।
মুস্তাফা মনোয়ার বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখলেন, ফিরে এসেছে সেই একাত্তরের কৃষক, রাজাকার আর ইয়াহিয়ার বাগ্যুদ্ধ! কৃষক ইয়াহিয়াকে বলছে, ‘তোমার হস্তরেখায় মরণরেখা স্পষ্ট দেখা যাইতেছে।’ মুক্তিযোদ্ধা পুতুলটি বলছে, ‘বাংলার ঘরে ঘরে মুক্তিযোদ্ধারা জন্ম নেয়। তাঁরা থাকেন বাঙালির বুকের মধ্যে।’
চোখের পানি মুছে তারেক মাসুদের দিকে ফিরে চাইলেন। একটা অজানা আনন্দে ভরে গেল বুকটা। ধুলোর আড়ালে হারিয়ে যায়নি তাঁর মুক্তিযোদ্ধারা। এই বাংলায় কেউ না কেউ ঠিকই মশালটা জ্বালিয়ে রাখে। 
 
শিখ্তী সানী | তারিখ: ১১-১২-২০০৯

No comments: