আজকের দিনে ক্যাসাব্লাংকা বা আমাদের বায়েজিদ বোস্তামীর গল্প অসম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু নোয়াখালীর জয়াগ গ্রামে গিয়ে আবিষ্কার করা গেল একে একে নয়জন ক্যাসাব্লাংকার গল্প। বাবার জন্য নয়, তাদের অপেক্ষা ছিল ‘বাপু’র জন্য। বাপু, মানে মহাত্মা গান্ধীর অপেক্ষায় তাঁরা কাটিয়ে দিয়েছেন সারাটা জীবন। আর এই যুগের ক্যাসাব্লাংকাদের এই অপেক্ষার ভেতর দিয়েই গড়ে উঠেছে ‘গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট’।
সেই ক্যাসাব্লাংকারা হলেন গান্ধীর সঙ্গে শান্তির কাজে বাংলাদেশে আসা তাঁর নয়জন শিষ্য। গল্পের শুরু সেই ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি। মহাত্মা গান্ধী এলেন জয়াগের জমিদারবাড়িতে। প্রায় তিন মাস হলো নোয়াখালীতে এসে পৌঁছেছেন তিনি।
দাঙ্গার খবর পেয়ে তিনি গ্রাম পরিক্রমা করছেন। তাঁর সঙ্গী হয়েছেন গান্ধী-অন্তঃপ্রাণ লোকেরা। তাঁরা গান্ধীর কাছে দীক্ষা নিয়েছেন—ধর্মের, অহিংসার, শান্তির। যত দিন প্রাণ তত দিন তাঁদের যাত্রা।
গান্ধীজির গ্রাম পরিক্রমার ধারাটা অদ্ভুত। গাড়ি-ঘোড়া নেই। তিনি চলেন পদব্রজে। যেখানে রাত সেখানেই ঘুম। ভোরবেলা আবার যাত্রা। ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে পড়েছেন জয়াগে। লোকলস্কর নিয়ে আশ্রয় নিলেন হেমন্তকুমার ঘোষের বাড়িতে।
হেমন্ত বাবু এ গাঁয়ের জমিদার। ভদ্রলোকের কপাল মন্দ। যেদিন গান্ধী পদধূলি দিলেন সেদিন তিনি বাড়িতে নেই। পরদিন সকালেই গান্ধী অন্যত্র চললেন। হেমন্ত বাবু গান্ধীর নাগাল পেলেন না। কিন্তু বাড়িতে গান্ধীর পদধূলি পড়ায় অভিভূত হয়ে গেলেন। আবেগ উথলানো হূদয়ে তিনি গান্ধীকে চিঠি লিখতে বসলেন। গান্ধীর শান্তিমিশনের কাজে তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করবেন, সব সম্পত্তি লিখে দেবেন গান্ধীকে। কিন্তু সম্পত্তি দিয়ে গান্ধী কী করবেন! স্মিত হেসে হেমন্ত বাবুর পত্রের উত্তরে বললেন, ‘আমার সম্পত্তির প্রয়োজন নেই। পারলে ওই সম্পত্তি শান্তিরক্ষার কাজে ব্যবহার করুন।’ হেমন্ত বাবু হুকুম শিরোধার্য করলেন। স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি দিয়ে তৈরি করলেন ‘অম্বিকা-কালীগঙ্গা দাতব্য ট্রাস্ট’। আর সেই ট্রাস্টেই এসে কাজ শুরু করলেন গান্ধীর শিষ্যরা। কারণ, গান্ধীর আদেশ!
বিহারেও দাঙ্গা শুরু হওয়ার খবর পেয়ে নোয়াখালী ছেড়ে রওনা দিলেন মহাত্মা গান্ধী। ইচ্ছে ছিল আবার নোয়াখালীতে ফিরে গ্রামোন্নয়নে কাজ করার। রেলস্টেশনে এগিয়ে দিতে আসা জনাবিশেক শিষ্যকে তাই হুকুম করলেন, ‘নোয়াখালী ফিরে যাও। শান্তি আশ্রমে কাজ করতে থাকো। আমি শিগগিরই ফিরে আসব।’
গান্ধী চলে গেলেন। আর গান্ধীর আদেশ সঙ্গে নিয়ে নোয়াখালীতে ফিরলেন গান্ধীর অনুসারীরা। বিপুল উদ্যমে তাঁরা শান্তি আশ্রমের কাজে ঝাঁপ দিলেন। কাজের তো আর অভাব নেই। একটা গ্রাম্য সমাজে যত রকম অসুবিধা হতে পারে, তার সব দিকে তাঁরা হাত লাগালেন। গান্ধী ফিরে আসবেন।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধী খুন হলেন। জয়াগ গ্রাম ত্যাগের ঠিক এক বছরের মাথায়। এই মৃত্যুর খবর সারা পৃথিবীতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেল। নোয়াখালীর শান্তি মিশনেও পৌঁছাল এই খবর। গান্ধীর মৃত্যু এবং দেশভাগের প্রতিক্রিয়ায় আশ্রম ছেড়ে ভারতে পাড়িও জমালেন অনেক শিষ্য। কিন্তু এসব কিছুই বিন্দুমাত্র বিচলিত করল না নয়জন শিষ্যকে।
তাঁরা বিশ্বাসই করলেন না গান্ধীর মৃত্যুসংবাদ! সত্যসাধক গান্ধী নিজের মুখে বলেছেন, তিনি ফিরে আসবেন। তিনি নিশ্চয়ই আসবেন। সেই ফেরার পথ চেয়েই কাজ করে চললেন চারু চৌধুরী, রেড্ডি পল্লী সত্যনারায়ণেরা। কাজ করেন গ্রামের উন্নয়নে। কেউ বাচ্চাদের পড়ান, কেউ অহিংসার ব্রত শেখান। আর সত্যনারায়ণের মতো কেউ কেউ অক্লান্ত কাজ করে যান মানুষের জন্য। আজও সত্যনারায়ণের কাজের গল্প ঘুরে মানুষের মুখে। রামগঞ্জের এক বৃদ্ধ আবদুর রাজ্জাক মনে করলেন, “প্রতি রাতে এলাকার সব সাঁকোর দুই পাশে একটা করে হারিকেন ঝুলিয়ে দিতেন সত্যনারায়ণজি। কেউ যেন সাঁকো থেকে পড়ে না যায়। আমরা বলতাম, ‘এসব করে কী হবে?’ উনি হেসে বলতেন, ‘বাপু আবার আসবেন, তখন দেখবেন এসব’।” এই ‘বাপু’র পথ চেয়ে কাজ করে যাওয়ার পথটা সোজা ছিল না। পাকিস্তান সরকার তাঁদের শান্তি দিল না। ‘ভারতের এজেন্ট’ তকমা দিয়ে নানা রকম হেনস্তা শুরু হলো। এসব গান্ধীবাদী জেল খাটলেন বছরের পর বছর। তাঁরা জেলে পচে মরতে রাজি, কিন্তু গান্ধীর নির্দেশ আলগা করতে নারাজ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এঁদের মধ্যে চারজনের প্রতীক্ষা শেষ হয়ে গেল। গান্ধীর চারজন অহিংস অনুসারীকে তারা হত্যা করল। মদনমোহন চট্টোপাধ্যায় আর দেবেন্দ্রনারায়ণ সরকার ধ্যান করছিলেন। ধ্যানস্থ অবস্থায় গুলি করে মারা হলো তাঁদের।
সবচেয়ে আঁধার রাতও শেষ হয়, ভোর আসে। অবশেষে আসে স্বাধীনতা। আলো জ্বলে ওঠে। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি এক বিশেষ অধ্যাদেশবলে পুরোনো ট্রাস্ট পুনর্গঠন করে ‘গান্ধী আশ্রম বোর্ড অব ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করলেন। গান্ধীর অনুসারীরা যথারীতি আপন কাজ করতে থাকলেন। সেবাব্রত আর গান্ধীর জন্য প্রতীক্ষা। তিনি কথা দিয়েছেন, নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।
গান্ধী ফিরবেন কি না, আমরা জানি না। তবে সেই মশালবাহকেরা জেনে খুশি হবেন, মশাল আজও জ্বলছে। এখনো গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট শান্তির জন্য, অহিংসার জন্য কাজ করে চলেছে। এখনো তাঁরা মানুষকে ডেকে বলেন, ‘অহিংসাই পরম ধর্ম’। এটা কি গান্ধীর প্রত্যাবর্তন নয়!
সেই নয় গান্ধীবাদী
১. রেড্ডি পল্লী সত্যনারায়ণ
২. চারু চৌধুরী
৩. দেবেন্দ্রনারায়ণ সরকার
৪. মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়
৫. সাধনেন্দ্রনাথ মিত্র
৬. বিশ্বরঞ্জন সেন
৭. রঞ্জনকুমার দত্ত
৮. অজিত কুমার দে
৯. জীবনকৃষ্ণ সাহা
সুত্র: প্রথম আলো। তৈমুর রেজা, নোয়াখালী থেকে ফিরে | তারিখ: ০২-১০-২০০৯
No comments:
Post a Comment