নিজের দেশটা বাংলাদেশ, এ কথা বলার সময় গর্বে বুকটা ভরে ওঠে মূলত এই কারণে যে এ এমন এক দেশ, যে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং তার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম, কঠোর-কঠিন সময় ধৈর্যের সঙ্গে পার করার ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিশ্বজনকে মোহিত করে। বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ পেয়ে যে বিদেশিরা এখানে আসতে হলে রীতিমতো সন্ত্রস্তবোধ করেন তাঁরাও একবার বাংলাদেশ ঘুরে গেলে ভাবতে থাকেন কী ভুল ধারণা নিয়েই না তাঁরা এতদিন বসেছিলেন। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, অত্যন্ত নিষ্ঠাবান রাজনীতিকেরা এবং সমাজকর্মী, নাগরিক সমাজের সদস্যরা—অবশ্যই যাঁরা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এ দেশের নানা প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন—কীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন এবং ১৯৭১ সালে সেই অত্যাশ্চর্য চমকপ্রদ ঘটনাটি ঘটালেন। তাই এ দেশ নিয়ে আমাদের তো স্বপ্নের শেষ নেই!
কিন্তু বাস্তবতা বারবার সেই স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশের স্থপতি, প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি নিহত হন কিছু দুষ্কৃতী ও দুষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন সেনাসদস্যের হাতে। তিনি একাই তাঁদের আক্রোশ ও আক্রমণের শিকার হননি, তাঁকে হত্যা করা হলো তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয় এবং রাজনৈতিকভাবে নিকটজনসহ। আমরা যারা একুশকে বুকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধ পার হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে নিজের জীবন-সংগ্রামের অঙ্গ হিসেবেই বিশ্বাস করি, তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়াকে মেনে নিতে পারি না। তাই দীর্ঘ সময়ের সামরিক শাসন অথবা গণতন্ত্রের নাম করে সামরিক শাসকদের শাসন, বা যেকোনো অপশাসনের লক্ষণ দেখলে বিচলিত না হয়ে পারি না। সেই উদ্বেগ থেকেই আজকে কলম ধরা।
১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশের যে পেছন ফিরে হাঁটা, তার গতিবেগ এমনই ছিল যে সব মানুষের দেশ হওয়ার পথ ছেড়ে সংকীর্ণ হতে হতে মৌলবাদীদের দাপট, সামরিক শক্তির চোখরাঙানি, এমনকি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তির গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে বাংলাদেশের মাটির ওপর দিয়ে চলেফিরে বেড়ানোর ধৃষ্টতাও সহ্য করতে হয়েছে। নব্বইয়ে যদিও গণতন্ত্রে ফিরে আসার অভিযাত্রার সূচনা ঘটেছিল, কিন্তু বহু বছরের জঞ্জাল সরিয়ে পরিষ্কার পথের নিশানা নির্ণয় করা সহজসাধ্য ছিল না। গণতান্ত্রিক জীবনের স্বাদ পেতে শুরু অবশ্য জনগণ করেছিল, কিন্তু ১০ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই রাজনীতির ধরন অদ্ভুত এক রূপ নিল। তত দিনে যাঁরা রাজনীতিকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটা সাধনা বলে বিশ্বাস করতেন তাঁদের অনেকেই ঝরে গেছেন এবং তাঁদের জায়গা দখল করে নিয়েছেন যাঁরা রাজনীতিকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করেন। সোজা কথায়, আখের গোছানোর কাজকেই মূলনীতি বলে চিনেছেন তেমন ব্যক্তিরা।
স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এ কথা সব রাজনীতিকের জন্য কোনোমতেই প্রযোজ্য নয় এবং অনেক সম্মানিত ব্যতিক্রম এখনো রাজনীতির হালটুকু ধরে সুস্থতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁরা ক্রমশই সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছেন। ফলে যাঁরা রাজনীতিকদের এই দুর্বলতা থেকে সুযোগ নিতে পারেন তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে তাঁদের লভ্যাংশ ঠিকই বুঝে নিচ্ছেন। ফাঁকিতে পড়ছে গণতন্ত্রকামী মানুষ—যাদের রক্তে, ঘামে, শ্রমে তৈরি এই বাংলাদেশ। তার পরও তারা আশা ছাড়েনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল ইঙ্গিত দেয় কী উৎসাহ আর উদ্দীপনায় জনগণ গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে। তিন দশকেরও বেশি সময়ের মিথ্যা ইতিহাস চর্চা, বাংলাদেশের মূল ভিত্তি থেকে মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার হীন প্রচেষ্টা, সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদের প্রশ্রয়, দুর্নীতিকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেওয়া, সন্ত্রাসকে প্রগতি আর উন্নয়নের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা দেওয়া—এই সমস্ত প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বড় হওয়া নতুন প্রজন্ম কী বিপুলভাবে ভোট দিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার পক্ষে। যে যুদ্ধাপরাধের বিচার না করে সহিংসতাকে এক ধরনের বৈধতা দিয়ে মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল তার বিচার দাবি করল। সবার সম-অধিকার ও সমান মর্যাদার নীতিকে সমর্থন জানাল। একটা সময়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর করা গেল—এ সমস্ত অভিজ্ঞতায় বিরাট আশায় মানুষ বুক বেঁধে বসে ছিল যে সত্যিকার অর্থে এবার বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে এগোবে। জনগণের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার সদিচ্ছার প্রকাশে কোনো ঘাটতি দেখা যায় না। দেড় বছরের সরকারের জীবনে যেসব ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটেছে জনগণ তাকে স্বাভাবিক কিংবা কঠিন-সাধ্য বলে মেনে নিয়ে নিজেদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে দেয়নি শত উসকানি সত্ত্বেও। জনগণের বিভিন্ন অংশ চেষ্টা করেছে যার যার মতো নিজের দায়িত্ব পালন করে যেতে। এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সরকারের ওপর নজরদারি বজায় রাখা। কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে গণতন্ত্রে মূল ভূমিকায় থাকবে জনগণ এবং জনগণের প্রতিনিধি হয়েই সরকার দেশ পরিচালনা করবে এবং মাননীয় সাংসদেরাও জনগণের হয়েই দেশের আইন-কানুন প্রণয়ন করবেন। যে অঙ্গীকারের ভিত্তিতে তাঁরা সংসদের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, সেই অঙ্গীকারগুলো যৌক্তিক সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবেন। বিচারব্যবস্থা সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। গণতন্ত্র বলতে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সেটাই তো বুঝি। যাঁরা জনগণের হয়ে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবেন তাঁরা দেশের সম্পদের সুরক্ষারও পবিত্র দায়িত্ব পালন করবেন। জনগণের অবদানে যে সম্পদ আহরিত হয়, তাদের অজির্ত আয়ের ওপর থেকে যে কর আদায় করা হয় তার সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে মতামত দেওয়া শুধু জনগণের কর্তব্যই নয়, নৈতিক দায়িত্বও বটে। এবং একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জনগণ তা করে থাকে নানা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। তাই গণতন্ত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, স্বচ্ছ নিয়োগব্যবস্থা, সৎ ও যোগ্য আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বাড়িয়ে বলা যায় না। এ সরকার যে তা অনুধাবন করেছে তারও প্রমাণ আমরা পেয়েছি। অনেক ক্ষেত্রেই অর্জনকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। আজকে আমরা সংবিধান সংশোধনের সুযোগ পেয়েছি যার মাধ্যমে অর্বাচীন কিছু পরিবর্তন রদ করে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সন্নিবেশিত করতে পারব। সামরিক শাসনের ওপর আইনি নিষেধাজ্ঞা এসেছে। একই সঙ্গে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায় তথ্য অধিকারের সুযোগ। আর তথ্যের অবাধ প্রবাহের জন্য প্রয়োজন স্বাধীন গণমাধ্যম। গণমাধ্যমও এক অর্থে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। সাংসদেরা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য, আর সংবাদমাধ্যম জনগণের নির্বাচন মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে প্রতিদিন। যে মুহূর্তে একজন নাগরিক তাঁর পকেটের পয়সা দিয়ে একটি পত্রিকা কিনে নেন, কিংবা বোতাম টিপে রেডিও অথবা টেলিভিশনের একটি চ্যানেল বেছে নেন, সেই মুহূর্তেই তিনি সেই পত্রিকা অথবা চ্যানেলের প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করছেন এবং সেই পত্রিকা অথবা চ্যানেলের মাধ্যমে তাঁর তথ্য পাওয়া এবং নজরদারির দায়িত্বটি পালন করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশে যেকোনো সংকটে এবং আন্দোলনে গণমাধ্যম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। গণমাধ্যমের কোনো ভুল বা অন্যায় থাকতে পারে না সে কথা কেউ বলবে না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি বা বিব্রত করার জন্যও গণমাধ্যমের ব্যবহার হয়ে থাকে, সেটা চিহ্নিত করা এবং তার প্রতিবাদ করারও নিয়মতান্ত্রিক উপায় আছে এবং তা করাও উচিত। কিন্তু কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি তাঁকে অর্পিত কোনো অবস্থানের সুযোগ গ্রহণ করে এমন কোনো কাজ যদি করেন যা জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করতে পারে, তার জন্য তাঁকে তো জবাবদিহি করতেই হবে—গণতন্ত্রের সেটাই নিয়ম বলে জানি। সেই বোধ থেকেই সৎ নাগরিক হিসেবে অবশ্যই তার কার্যকারণ জানতে চাওয়ার অধিকার আমাদের রয়েছে। এবং জনগণের কাছে উত্তর দেওয়ার দায়বদ্ধতা থেকে জনগণের প্রতিনিধিরা বাইরে থাকতে পারেন না। কিছু প্রশ্ন তুললেই যদি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অবস্থান টলিয়ে দেওয়ার, অথবা গণতন্ত্র বানচাল করার অভিযোগ শুনতে হয়, তাহলে সেই গণতন্ত্রের ভিত্তি সম্পর্কেই সন্দিহান হয়ে উঠতে হয়। আর একটা অভিযোগ তোলা হয় কথায় কথায় যে রাজনীতিকদের হেয় করার জন্য এসব প্রশ্ন তোলা। ওই কাজটি করতে তাঁদের তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন পড়ে বলে তো মনে হয় না! কথায় কথায় এক-এগারোর দায়দায়িত্ব দেশি-বিদেশি নানাজনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ১৫ কোটি মানুষের এই দেশে এক-আধজন ইচ্ছা করলেই কি এক-এগারোর সৃষ্টি করতে পারেন! তাহলে আর আমাদের এত দিনের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মূল্য কোথায়? আর যত্রতত্র যার-তার নামে দোষ চাপাতে গিয়ে একেকটি ভয়ংকর ঘটনার জন্য যাঁরা প্রকৃত দায়ী, তাঁদের কি আড়াল করে ফেলা হচ্ছে না? এভাবেই খন্দকার মোশতাকেরা রাষ্ট্রপতি বনে যান আর শুধু শুধু গ্রেপ্তার হন জজ মিয়া আর পার্থ সাহারা।
আমরা যারা বুকে হাত দিয়ে জাতীয় সংগীত গাই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, যারা সেই বায়ান্ন সাল থেকে খালি পায়ে ফুল হাতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গাইতে গাইতে আজিমপুর ঘুরে শহীদ মিনারে এসে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি, উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে দিন-রাত ভুলে আইয়ুবশাহি-মোনেমশাহির পতনের আন্দোলনে সারা শহর মিছিলে মিছিলে ছেয়ে দিয়েছি, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’—এই ডাক শুনে শূন্য হাতে নিরস্ত্র অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যখন যেভাবে পেরেছি দেশটাকে গণতন্ত্রের পথে চলতে সাহায্য করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছি—কতিপয় সংসদ সদস্যেদের নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিচয় ধরে অগণতান্ত্রিক আচরণে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। কোনো সন্দেহ নেই যে নির্বাচনে জেতার সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্রের পোশাকি পরিচয় ধারণ করে বিরোধী দলের ওপর নগ্ন আক্রমণ ও দমন-পীড়ন চালাতে লজ্জিত হয়নি অনেক শক্তিই, একথাও ঠিক দলীয়করণকেই নিরপেক্ষতার পরিবর্তে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে দেশ পরিচালনায়। মিথ্যা ইতিহাস আর ভ্রান্ত তথ্যকে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে সত্য বলে। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে সম্পদ আহরণ আর সিন্দবাদের দৈত্যের মতো জনগণের কাঁধে চেপে আর না নামার নীতি গ্রহণ করাকেই রাজনীতি নামে চালিয়ে দেওয়ার কৌশলও গ্রহণ করেছে তারা—কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে তো তারই বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল জনগণ বিপুলভাবে। যারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারার সঙ্গে কোনো দিন যুক্ত ছিল না, মুক্তিযুদ্ধেও এদের অনেকের অংশগ্রহণ ঘটনাচক্রেই সংঘটিত হয়েছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অভিষিক্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ পাওয়া যায় না বরং তার বিপরীতেই অবস্থান নিয়েছিল, তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা আউড়ে গেলেও তাদের আচরণ ভিন্ন হতে পারে—ক্ষুব্ধ হলেও আমাদের অবাক বা শঙ্কিত হওয়ার কারণ ঘটে না। কিন্তু যারা এই দেশটাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্যের অংশীদার, তাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে তোয়াক্কা না করার প্রবণতা দেখলে মনে শঙ্কা জাগে বৈকি! তাই এমন আচরণ দেখে যখন পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার করা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সচেতন করে দিতে চায় জনগণ, তার প্রতি-উত্তরে কি তাদের অগণতান্ত্রিক আচরণ করা সাজে? কষ্ট হয় যখন দেখি জনগণের সেবা করার সুযোগের আবেদন জানিয়ে জানিয়ে সংসদে পৌঁছে নিজেদের ব্যক্তিগত কিংবা দলগত স্বার্থে দিনের পর দিন সংসদ বর্জন চলে, সাংসদেরা সময়মতো উপস্থিত না হওয়ার কারণে কোরাম হয় না, এমন সব আলোচনা সংসদে চলে যার কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। যে নির্বাচনের জন্য তাঁরা প্রাণপাত করেন, কখনো কখনো আক্ষরিক অর্থে, সেই নির্বাচনকেই অর্থবহ করার তাগিদ তাঁদের মধ্যে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। সাধারণ জনগণ তো এসব নিয়ে সমালোচনা করবেই। দিনবদলের রাজনীতি তো দেশটাকে দুর্বৃত্তায়নের হাত থেকে রক্ষা করারই অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
মাননীয় সাংসদদের কাছে তাই অনুরোধ, দোহাই আপনাদের, যে পবিত্র দায়িত্ব নিয়ে একটি অত্যন্ত উঁচু শ্রদ্ধার আসনে আসীন হয়েছেন তার মর্যাদাটা ভুলে যাবেন না—অনুগ্রহ করে দেশটাকে আর দুর্বৃত্তায়নের চাকায় ঘুরপাক খেতে দেবেন না। আমরা যেন ভুলে না যাই এ দেশটি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণে ভিজে আছে। নূর হোসেন, ডাক্তার মিলনেরা প্রাণ দিয়েছেন গণতন্ত্রের জন্য, নিহত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে, চার জাতীয় নেতাকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছে জেলখানার ভেতরে। তাঁদের অপরাধ ছিল তাঁরা গণতন্ত্র চেয়েছিলেন। তাঁদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এমন আচরণ মেনে নিতে হবে কেন আমাদের?
সুলতানা কামাল: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১০
কিন্তু বাস্তবতা বারবার সেই স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশের স্থপতি, প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি নিহত হন কিছু দুষ্কৃতী ও দুষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন সেনাসদস্যের হাতে। তিনি একাই তাঁদের আক্রোশ ও আক্রমণের শিকার হননি, তাঁকে হত্যা করা হলো তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয় এবং রাজনৈতিকভাবে নিকটজনসহ। আমরা যারা একুশকে বুকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধ পার হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে নিজের জীবন-সংগ্রামের অঙ্গ হিসেবেই বিশ্বাস করি, তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়াকে মেনে নিতে পারি না। তাই দীর্ঘ সময়ের সামরিক শাসন অথবা গণতন্ত্রের নাম করে সামরিক শাসকদের শাসন, বা যেকোনো অপশাসনের লক্ষণ দেখলে বিচলিত না হয়ে পারি না। সেই উদ্বেগ থেকেই আজকে কলম ধরা।
১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশের যে পেছন ফিরে হাঁটা, তার গতিবেগ এমনই ছিল যে সব মানুষের দেশ হওয়ার পথ ছেড়ে সংকীর্ণ হতে হতে মৌলবাদীদের দাপট, সামরিক শক্তির চোখরাঙানি, এমনকি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তির গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে বাংলাদেশের মাটির ওপর দিয়ে চলেফিরে বেড়ানোর ধৃষ্টতাও সহ্য করতে হয়েছে। নব্বইয়ে যদিও গণতন্ত্রে ফিরে আসার অভিযাত্রার সূচনা ঘটেছিল, কিন্তু বহু বছরের জঞ্জাল সরিয়ে পরিষ্কার পথের নিশানা নির্ণয় করা সহজসাধ্য ছিল না। গণতান্ত্রিক জীবনের স্বাদ পেতে শুরু অবশ্য জনগণ করেছিল, কিন্তু ১০ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই রাজনীতির ধরন অদ্ভুত এক রূপ নিল। তত দিনে যাঁরা রাজনীতিকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটা সাধনা বলে বিশ্বাস করতেন তাঁদের অনেকেই ঝরে গেছেন এবং তাঁদের জায়গা দখল করে নিয়েছেন যাঁরা রাজনীতিকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করেন। সোজা কথায়, আখের গোছানোর কাজকেই মূলনীতি বলে চিনেছেন তেমন ব্যক্তিরা।
স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এ কথা সব রাজনীতিকের জন্য কোনোমতেই প্রযোজ্য নয় এবং অনেক সম্মানিত ব্যতিক্রম এখনো রাজনীতির হালটুকু ধরে সুস্থতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁরা ক্রমশই সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছেন। ফলে যাঁরা রাজনীতিকদের এই দুর্বলতা থেকে সুযোগ নিতে পারেন তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে তাঁদের লভ্যাংশ ঠিকই বুঝে নিচ্ছেন। ফাঁকিতে পড়ছে গণতন্ত্রকামী মানুষ—যাদের রক্তে, ঘামে, শ্রমে তৈরি এই বাংলাদেশ। তার পরও তারা আশা ছাড়েনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল ইঙ্গিত দেয় কী উৎসাহ আর উদ্দীপনায় জনগণ গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে। তিন দশকেরও বেশি সময়ের মিথ্যা ইতিহাস চর্চা, বাংলাদেশের মূল ভিত্তি থেকে মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার হীন প্রচেষ্টা, সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদের প্রশ্রয়, দুর্নীতিকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেওয়া, সন্ত্রাসকে প্রগতি আর উন্নয়নের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা দেওয়া—এই সমস্ত প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বড় হওয়া নতুন প্রজন্ম কী বিপুলভাবে ভোট দিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার পক্ষে। যে যুদ্ধাপরাধের বিচার না করে সহিংসতাকে এক ধরনের বৈধতা দিয়ে মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল তার বিচার দাবি করল। সবার সম-অধিকার ও সমান মর্যাদার নীতিকে সমর্থন জানাল। একটা সময়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর করা গেল—এ সমস্ত অভিজ্ঞতায় বিরাট আশায় মানুষ বুক বেঁধে বসে ছিল যে সত্যিকার অর্থে এবার বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে এগোবে। জনগণের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার সদিচ্ছার প্রকাশে কোনো ঘাটতি দেখা যায় না। দেড় বছরের সরকারের জীবনে যেসব ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটেছে জনগণ তাকে স্বাভাবিক কিংবা কঠিন-সাধ্য বলে মেনে নিয়ে নিজেদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে দেয়নি শত উসকানি সত্ত্বেও। জনগণের বিভিন্ন অংশ চেষ্টা করেছে যার যার মতো নিজের দায়িত্ব পালন করে যেতে। এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সরকারের ওপর নজরদারি বজায় রাখা। কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে গণতন্ত্রে মূল ভূমিকায় থাকবে জনগণ এবং জনগণের প্রতিনিধি হয়েই সরকার দেশ পরিচালনা করবে এবং মাননীয় সাংসদেরাও জনগণের হয়েই দেশের আইন-কানুন প্রণয়ন করবেন। যে অঙ্গীকারের ভিত্তিতে তাঁরা সংসদের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, সেই অঙ্গীকারগুলো যৌক্তিক সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবেন। বিচারব্যবস্থা সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। গণতন্ত্র বলতে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সেটাই তো বুঝি। যাঁরা জনগণের হয়ে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবেন তাঁরা দেশের সম্পদের সুরক্ষারও পবিত্র দায়িত্ব পালন করবেন। জনগণের অবদানে যে সম্পদ আহরিত হয়, তাদের অজির্ত আয়ের ওপর থেকে যে কর আদায় করা হয় তার সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে মতামত দেওয়া শুধু জনগণের কর্তব্যই নয়, নৈতিক দায়িত্বও বটে। এবং একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জনগণ তা করে থাকে নানা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। তাই গণতন্ত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, স্বচ্ছ নিয়োগব্যবস্থা, সৎ ও যোগ্য আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বাড়িয়ে বলা যায় না। এ সরকার যে তা অনুধাবন করেছে তারও প্রমাণ আমরা পেয়েছি। অনেক ক্ষেত্রেই অর্জনকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। আজকে আমরা সংবিধান সংশোধনের সুযোগ পেয়েছি যার মাধ্যমে অর্বাচীন কিছু পরিবর্তন রদ করে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সন্নিবেশিত করতে পারব। সামরিক শাসনের ওপর আইনি নিষেধাজ্ঞা এসেছে। একই সঙ্গে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায় তথ্য অধিকারের সুযোগ। আর তথ্যের অবাধ প্রবাহের জন্য প্রয়োজন স্বাধীন গণমাধ্যম। গণমাধ্যমও এক অর্থে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। সাংসদেরা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য, আর সংবাদমাধ্যম জনগণের নির্বাচন মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে প্রতিদিন। যে মুহূর্তে একজন নাগরিক তাঁর পকেটের পয়সা দিয়ে একটি পত্রিকা কিনে নেন, কিংবা বোতাম টিপে রেডিও অথবা টেলিভিশনের একটি চ্যানেল বেছে নেন, সেই মুহূর্তেই তিনি সেই পত্রিকা অথবা চ্যানেলের প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করছেন এবং সেই পত্রিকা অথবা চ্যানেলের মাধ্যমে তাঁর তথ্য পাওয়া এবং নজরদারির দায়িত্বটি পালন করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশে যেকোনো সংকটে এবং আন্দোলনে গণমাধ্যম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। গণমাধ্যমের কোনো ভুল বা অন্যায় থাকতে পারে না সে কথা কেউ বলবে না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি বা বিব্রত করার জন্যও গণমাধ্যমের ব্যবহার হয়ে থাকে, সেটা চিহ্নিত করা এবং তার প্রতিবাদ করারও নিয়মতান্ত্রিক উপায় আছে এবং তা করাও উচিত। কিন্তু কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি তাঁকে অর্পিত কোনো অবস্থানের সুযোগ গ্রহণ করে এমন কোনো কাজ যদি করেন যা জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করতে পারে, তার জন্য তাঁকে তো জবাবদিহি করতেই হবে—গণতন্ত্রের সেটাই নিয়ম বলে জানি। সেই বোধ থেকেই সৎ নাগরিক হিসেবে অবশ্যই তার কার্যকারণ জানতে চাওয়ার অধিকার আমাদের রয়েছে। এবং জনগণের কাছে উত্তর দেওয়ার দায়বদ্ধতা থেকে জনগণের প্রতিনিধিরা বাইরে থাকতে পারেন না। কিছু প্রশ্ন তুললেই যদি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অবস্থান টলিয়ে দেওয়ার, অথবা গণতন্ত্র বানচাল করার অভিযোগ শুনতে হয়, তাহলে সেই গণতন্ত্রের ভিত্তি সম্পর্কেই সন্দিহান হয়ে উঠতে হয়। আর একটা অভিযোগ তোলা হয় কথায় কথায় যে রাজনীতিকদের হেয় করার জন্য এসব প্রশ্ন তোলা। ওই কাজটি করতে তাঁদের তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন পড়ে বলে তো মনে হয় না! কথায় কথায় এক-এগারোর দায়দায়িত্ব দেশি-বিদেশি নানাজনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ১৫ কোটি মানুষের এই দেশে এক-আধজন ইচ্ছা করলেই কি এক-এগারোর সৃষ্টি করতে পারেন! তাহলে আর আমাদের এত দিনের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মূল্য কোথায়? আর যত্রতত্র যার-তার নামে দোষ চাপাতে গিয়ে একেকটি ভয়ংকর ঘটনার জন্য যাঁরা প্রকৃত দায়ী, তাঁদের কি আড়াল করে ফেলা হচ্ছে না? এভাবেই খন্দকার মোশতাকেরা রাষ্ট্রপতি বনে যান আর শুধু শুধু গ্রেপ্তার হন জজ মিয়া আর পার্থ সাহারা।
আমরা যারা বুকে হাত দিয়ে জাতীয় সংগীত গাই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, যারা সেই বায়ান্ন সাল থেকে খালি পায়ে ফুল হাতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গাইতে গাইতে আজিমপুর ঘুরে শহীদ মিনারে এসে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি, উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে দিন-রাত ভুলে আইয়ুবশাহি-মোনেমশাহির পতনের আন্দোলনে সারা শহর মিছিলে মিছিলে ছেয়ে দিয়েছি, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’—এই ডাক শুনে শূন্য হাতে নিরস্ত্র অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যখন যেভাবে পেরেছি দেশটাকে গণতন্ত্রের পথে চলতে সাহায্য করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছি—কতিপয় সংসদ সদস্যেদের নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিচয় ধরে অগণতান্ত্রিক আচরণে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। কোনো সন্দেহ নেই যে নির্বাচনে জেতার সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্রের পোশাকি পরিচয় ধারণ করে বিরোধী দলের ওপর নগ্ন আক্রমণ ও দমন-পীড়ন চালাতে লজ্জিত হয়নি অনেক শক্তিই, একথাও ঠিক দলীয়করণকেই নিরপেক্ষতার পরিবর্তে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে দেশ পরিচালনায়। মিথ্যা ইতিহাস আর ভ্রান্ত তথ্যকে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে সত্য বলে। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে সম্পদ আহরণ আর সিন্দবাদের দৈত্যের মতো জনগণের কাঁধে চেপে আর না নামার নীতি গ্রহণ করাকেই রাজনীতি নামে চালিয়ে দেওয়ার কৌশলও গ্রহণ করেছে তারা—কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে তো তারই বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল জনগণ বিপুলভাবে। যারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারার সঙ্গে কোনো দিন যুক্ত ছিল না, মুক্তিযুদ্ধেও এদের অনেকের অংশগ্রহণ ঘটনাচক্রেই সংঘটিত হয়েছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অভিষিক্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ পাওয়া যায় না বরং তার বিপরীতেই অবস্থান নিয়েছিল, তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা আউড়ে গেলেও তাদের আচরণ ভিন্ন হতে পারে—ক্ষুব্ধ হলেও আমাদের অবাক বা শঙ্কিত হওয়ার কারণ ঘটে না। কিন্তু যারা এই দেশটাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্যের অংশীদার, তাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে তোয়াক্কা না করার প্রবণতা দেখলে মনে শঙ্কা জাগে বৈকি! তাই এমন আচরণ দেখে যখন পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার করা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সচেতন করে দিতে চায় জনগণ, তার প্রতি-উত্তরে কি তাদের অগণতান্ত্রিক আচরণ করা সাজে? কষ্ট হয় যখন দেখি জনগণের সেবা করার সুযোগের আবেদন জানিয়ে জানিয়ে সংসদে পৌঁছে নিজেদের ব্যক্তিগত কিংবা দলগত স্বার্থে দিনের পর দিন সংসদ বর্জন চলে, সাংসদেরা সময়মতো উপস্থিত না হওয়ার কারণে কোরাম হয় না, এমন সব আলোচনা সংসদে চলে যার কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। যে নির্বাচনের জন্য তাঁরা প্রাণপাত করেন, কখনো কখনো আক্ষরিক অর্থে, সেই নির্বাচনকেই অর্থবহ করার তাগিদ তাঁদের মধ্যে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। সাধারণ জনগণ তো এসব নিয়ে সমালোচনা করবেই। দিনবদলের রাজনীতি তো দেশটাকে দুর্বৃত্তায়নের হাত থেকে রক্ষা করারই অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
মাননীয় সাংসদদের কাছে তাই অনুরোধ, দোহাই আপনাদের, যে পবিত্র দায়িত্ব নিয়ে একটি অত্যন্ত উঁচু শ্রদ্ধার আসনে আসীন হয়েছেন তার মর্যাদাটা ভুলে যাবেন না—অনুগ্রহ করে দেশটাকে আর দুর্বৃত্তায়নের চাকায় ঘুরপাক খেতে দেবেন না। আমরা যেন ভুলে না যাই এ দেশটি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণে ভিজে আছে। নূর হোসেন, ডাক্তার মিলনেরা প্রাণ দিয়েছেন গণতন্ত্রের জন্য, নিহত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে, চার জাতীয় নেতাকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছে জেলখানার ভেতরে। তাঁদের অপরাধ ছিল তাঁরা গণতন্ত্র চেয়েছিলেন। তাঁদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এমন আচরণ মেনে নিতে হবে কেন আমাদের?
সুলতানা কামাল: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১০
No comments:
Post a Comment