কিন্তু একদিন এই মরুভূমিতে আবার হেসে ওঠে সবুজ। শুকিয়ে যাওয়া জীর্ণ নদীর দুই কূল ছাপিয়ে আবার বয়ে যায় পানি। ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া মাঠে সবুজ ধানগাছ বাতাসে দোল খায়। সেই দোল লাগে কিষান-কিষানির মনেও। মুখে ফোটে হাসি।
আর এই হাসি ফুটিয়ে তোলেন একজন রাজেন্দ্র সিং। মেজাজি প্রকৃতিকে প্রকৃতির অস্ত্র দিয়েই বশ করেছেন শেষ পর্যন্ত। শুকিয়ে যাওয়া সাতটি নদীতে পানির প্রবাহ ঘটিয়েছেন। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার প্রাচীন রীতি অনুসরণ করে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন রাজস্থানে। এ জন্য কেউ কেউ তাঁকে নদী-স্রষ্টা, আবার কেউ বৃষ্টিমানব বলে ডাকে।
গল্পটা ভারতের বৃহত্তম প্রদেশ রাজস্থানের। এর অধিকাংশ জমিই ঊষর। গোটা দেশে সুপেয় পানির মাত্র এক শতাংশ আছে রাজস্থানে। সেই বাপ-দাদার আমল থেকে খরা আর খরা দেখে আসছেন এখানকার কৃষকেরা। রাজেন্দ্র সিংয়ের প্রতিরোধ-পর্বের আগ পর্যন্ত এখানকার কৃষকদের নিয়তিই ছিল প্রকৃতির হাতে নিজেকে সমর্পণ করা।
গত ২৫ বছর ধরে এই নিয়তি বদলে দিতে শুরু করেছেন রাজেন্দ্র সিং। শুরুটা করেছিলেন ১৯৮৪ সালে, গোপালপুর নামে একটি গ্রাম থেকে। অনাবৃষ্টিতে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষেত আর মানুষের মুখ দেখে কেঁদে উঠেছিল তাঁর মন। একটা উপায়ও বের করে ফেলেছিলেন।
গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শুকনো, মরা গাঙে বাঁধ দিলেন রাজেন্দ্র। গাঁয়ের লোকজন সুধালে জবাবে বলেছিলেন, ‘বৃষ্টির পানি প্রকৃতির এক অসামান্য দান। প্রতি ফোঁটা বৃষ্টির পানির রয়েছে অমূল্য দাম। অথচ এই পানির বিন্দুমাত্র সদ্ব্যবহার করি না আমরা। মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়ে ধরার বুকে পড়ে। আবার ধরণী সেই পানি শুষে নেয়। আমরা চাইলে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে কৃষিকাজে ব্যবহার করতে পারি।’
নদীর খানিকটা অংশে দুই দিকে মাটি ও পাথরের বাঁধ দিয়েছিলেন রাজেন্দ্র। সেই বাঁধের ভেতরে বৃষ্টির পানি জমে থইথই করছে। সেই পানি চাষিরা চাষের জমিতে দিলেন। কেউ কেউ নিয়ে গেল গেরস্থালির কাজে। এবার গাঁয়ের ছেলেবুড়ো সবাই মিলে নেমে পড়ল কাজে। ওই গাঙে আরও কয়টা বাঁধ তৈরি করল তারা। এভাবে দেখতে দেখতে গোটা নদীই একসময় পানিতে ভরে গেল, ফিরে পেল প্রাণ।
২৫ বছরে বিভিন্ন নদ-নদীতে এভাবে ১০ হাজার জলাধার বানিয়েছেন রাজেন্দ্র। রাজস্থানের প্রায় এক হাজার গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেসব জলাধার। সাকল্যে সাড়ে ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় জলাধার তৈরি করতে পেরেছেন তিনি। এখন আর একা নন রাজেন্দ্র। তাঁর সঙ্গে এখন আছে দক্ষ এক কর্মীবাহিনী। নাম দিয়েছেন ‘তরুণ ভারত সংঘ’।
এই সংঘে ৪৫ জন নিয়মিত কর্মী আছে। আর অনিয়মিত কর্মী আছে ২৩০ জন। এ ছাড়া গ্রামের সাধারণ মানুষ তো আছেই। কমিউনিটি লিডারশিপে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০১ সালে রাজেন্দ্র সিং র্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কারে ভূষিত হন।
আবুল হাসনাত. ওয়েবসাইট অবলম্বনে
| তারিখ: ০৬-১১-২০০৯
No comments:
Post a Comment