লেলং শব্দের মধ্যে যেন অন্য রকম একটা ঘ্রাণ পাই, বুনো সবজির ঘ্রাণ। গাছটা ডুমুরপাতার মতো, খসখসে পাতা, কিনারা করাতের মতো অল্প অল্প খাঁজকাটা। এক টুকরো পাতা ছিঁড়ে ঘ্রাণ নিতেই সুগন্ধ উথলে উঠল। সুগন্ধ পেলাম সাবারাংপাতা আর লেবু ঘাস থেকেও। ওগুলোও তাদের সবজি সুঘ্রাণ করার পাতা। রান্নায় দেয়। আরও এক সুঘ্রাণের গাছ দেখলাম উঠোনের এক পাশে, ওরা বলে ভাতপাতা। আনারসগাছের মতো দেখতে, তবে সবুজ পাতাগুলো অত বড় আর শক্ত নয়। পাতা থেকে পোলাওয়ের ঘ্রাণ আসে। ভাতকে সুঘ্রাণযুক্ত করতে তারা এ পাতা ব্যবহার করে। লেলংয়ের সুমিষ্ট আর ঝাঁজালো গন্ধে জিভে জল আসে। বলতেই আ ক্রইং মারমা সাবধান করে দেন, শরীরে বাতের ব্যথা থাকলে লেলংশাক খাওয়ার পর সব ব্যথা উথলে উঠবে, কাজেই বুঝেশুনে খেতে হবে। ওরা পাহাড় ভাঙে, জুমে জমি চষে, কাঠ কাটে, উঁচু পাহাড় থেকে নিচের খাদে আসে জল তুলতে। ওদের বাতের ব্যথা আসবে কোত্থেকে? তাই লেলংশাক তো ওরাই খাবে।
কথায় কথায় লেলংয়ের সঙ্গে যোগ হয় মেয়াশাক, কইদা, তিদে, ফুজি, অগছা, ইয়েরিং, বাঁশকোড়ল, ঢেঁকিশাক, সাবারাং, চুকাইপাতা, খনাগোলা, ডুমুরশিম, কচি কড়ইপাতা, তিত বেগুন, জংলি বেগুন, তারা ইত্যাদি। সবজিবিশারদেরা এ পর্যন্ত দেশে মোট ৮৯টি সবজিকে চাষের সবজি হিসেবে তালিকাবদ্ধ করেছেন। পাহাড়ের এসব সবজি ওই তালিকার মধ্যে নেই। এসব সবজি আদিবাসীরাও চাষ করে না। বনে-জঙ্গলে এমনিতেই হয়। তারা যখন জুমে কাজ করতে যায়, পাহাড়ের বনে কাঠ কাটতে যায়, তখন এসব সবজি তুলে আনে পিঠের থুরং ভরে। আর সেগুলো কোনো মসলা ছাড়াই সেদ্ধ করে রান্না করে। শুধু একটু লবণ পড়ে তাতে। তেল-মরিচ কিছুই দেওয়া হয় না। মাঝেমধ্যে তাতে পড়ে একমুঠো ইঁচা বা চিংড়ির শুঁটকি। ঝুমের কাঁচা মরিচ পিষে আলাদা রাখা হয়। সেদ্ধ করা পানির মতো সেই সবজিকে ওরা বলে আফ্রাইন। আফ্রাইনে থাকে নানা রকম শাক ও সবজির সমাহার। যখন যা পাওয়া যায়, তা দিয়েই রান্না হয় আফ্রাইন। বিন্নি চালের ভাত আর গরম গরম আফ্রাইন খুবই মজা লাগে খেতে। মাফ্রু প্রুংয়ের স্বামী উমে ফ্রু বললেন, ‘এক দিন আফ্রাইন না খেলে মনে হয়, পেটটাই ভরল না। তবে এখন আফ্রাইনে আমরা জুম চাষ করা অনেক সবজি যেমন—শিম, বরবটি, ঝিঙে, কাঁকরোল, কুমড়া, মারফা, কলার থোড় ইত্যাদিও মেশাচ্ছি। কী করব, এখন আর জঙ্গলে আগের মতো সবজি পাওয়া যায় না। লোকও বাড়ছে। আগে আমাদের দিনে যতটুকু শাকসবজি লাগত, ঠিক ততটুকুই বন থেকে তুলতাম। এখন অনেকেই আর ওই নিয়ম মানছে না। তারা বেশি বেশি বুনো সবজি তুলে বাজারে বেচছে, দুটো টাকাও কামাচ্ছে। তাই বুনো সবজি আর আগের মতো মিলছে না। মনে হয়, ভবিষ্যতে আমাদের চাষ করেই শাকসবজি খেতে হবে। কিন্তু তাতে মনে হয়, আমাদের বেশি বেশি বদ্যির কাছে যেতে হবে। কেননা, খনাগোলা খেলে আমাদের জন্ডিস সেরে যেত। হলুদের ফুল আমরা সবজির মতো রেঁধে ও সেদ্ধ করে খাই। বনহলুদের ফুল তেতো বলে খাই না। কিন্তু বনহলুদের গাছ থেকে আমরা পেটের অসুখ সারানোর ওষুধ বানাই। এসব গাছ হারিয়ে গেলে আমরা সুস্থ থাকব কী করে?’ এ প্রশ্নের কোনো জবাব আমারও জানা নেই।
সুত্র: দৈনিক প্রথম আলো। মৃত্যুঞ্জয় রায় | তারিখ: ০৮-১০-২০১০
No comments:
Post a Comment