Monday, October 11, 2010

বিচিত্রিতা কালো মানুষ, সাদা মুখোশ

বর্ণবাদের প্রকাশ ঘটে দু’ভাবে। প্রথমত, শুধুমাত্র শরীরের রঙের কারণে একজন মানুষ সম্মানিত অথবা ঘৃণিত হয়। যেমন, এই আমেরিকায় কিছুদিন আগ পর্যন্ত এ দেশের কালো মানুষ একজন সম্পূর্ণ মানুষ বলে স্বীকৃত হতো না। তার অধিকার ছিল সীমিত, সমাজে তার সম্মান ছিল নামমাত্র। এ দেশে কালো মানুষ এখনও দৈনন্দিন বৈষম্যের শিকার। একই রকম বর্ণবাদ প্রচলিত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। কালো মানুষের দেশ, অথচ শাসক সাদা বলে তাদের কোনো অধিকারই ছিল না।
এটি বর্ণবাদের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রকাশ। কিন্তু বর্ণবাদের এটি দৃষ্টিভঙ্গিজাত প্রকাশও রয়েছে। দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসন বা অন্য যে কারণেই হোক, অনেক সময় কালো মানুষও নিজের গাত্রবর্ণ ঘৃণা করা শুরু। মনে মনে সে শ্বেতপ্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেয়, আপ্রাণ চেষ্টা করে তারই মতো হতে। আমেরিকার কালোদের মধ্যে এই মনোভাব দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে। সে মনোভাব বদলাতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কালোরা নিজেরাই এক সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করে। সে আন্দোলনের স্লোগান ছিল, ‘ব্লাক ইজ বিউটিফুল।’
রং নিয়ে বিভ্রম আমাদের দেশেও রয়েছে। এমনিতে আমরা সবাই-ই কালো মানুষ, অথচ অনেকেরই আপ্রাণ চেষ্টা সাদা হওয়ার। গায়ের রং ফর্সা করার যত সাজ-সরঞ্জাম আমাদের উপমহাদেশে পাওয়া যায়, পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
মাইকেল জ্যাকসন একজন কালো মানুষ। যে গান গেয়ে তিনি জগত্ জোড়া নাম করেন, তা মূলত কালো মানুষের নিজস্ব গান। অথচ মানুষটা তাঁর পরিণত জীবনের প্রায় সারাটা সময় একটা সাদা ‘মুখোশ’ পরে কাটালেন। গায়ের রং সাদা। হাতের যে দস্তানা, সেটি সাদা। যে তিনটি ছেলেমেয়ের পিতা বলে তিনি নিজেকে দাবি করেন, তারাও সাদা। যে দুটি বিয়ে তিনি করেছিলেন বলে বলা হয়, তারাও সাদা মানুষ।
তাহলে কি এটাও ঠিক যে, জ্যাকসন নিজেকে, নিজের গায়ের রংকে, কালো মানুষ হিসেবে নিজের সকল ঐতিহ্য ও অর্জনকে ঘৃণা করতেন?
এক কথায় জবাব দেওয়া মুশকিল। জ্যাকসন নিজে মুখে বলেছেন কালো মানুষ হিসেবে তিনি গর্বিত। ‘ব্লাক অ্যান্ড হোয়াইট’ তার একমাত্র রাজনৈতিক গান, সেখানে অবশ্য নিজেকে বর্ণ-ভিত্তিক সকল বিভক্তির ঊর্ধ্বে উপস্থিত করেছেন।
তাহলে তাঁর গায়ের রং সাদা কেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘ভিটিলিগো’ নামের একটি অসুখের কারণে তাঁর শরীরের স্বাভাবিক রং নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ফলে শরীরে সাদা সাদা ছোপের সৃষ্টি হয়েছিল। রঙের এই বৈশাদৃশ্য কাটাতেই তিনি তার গায়ের চামড়া ‘ব্লিচ’ করে নিয়েছিলেন। কথাটা যদি সত্যিও হয়, তারপরেও আমরা কিছুতেই বুঝে উঠি না শুধু শরীরের রং নয়, তাঁর চেহারাও কীভাবে ক্রমশ একজন সাদা মানুষের মতো হয়ে উঠল।
তাঁর মৃত্যুর আগের বিশ বছরের ছবি পাশাপাশি দেখুন। স্পষ্ট বোঝা যাবে, লোকটি প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে নিজের চেহারা বদলে নিয়েছেন। এমনকি এক সময় কালো মানুষের যে স্বাভাবিক নাক তাঁর ছিল, সেটিও বার কয়েক অস্ত্রপচার করা হয়। শেষমেষ অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে জ্যাকসনের নাকই উধাও হয়ে যায়।
কালো মানুষের সংগীতের তিনি যুবরাজ, কিন্তু কখনো কোনো কালো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করেছেন, তা আমরা জানি না। অন্তত যে দুটি বিয়ের কথা আমরা জানি, দুটিই ক্ষণস্থায়ী, সে দুটি স্ত্রী-ই শ্বেতকায়া। তাদের একজন এলভিস প্রিসলির মেয়ে, অন্যজন তাঁর নার্স। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, যে তিনটি শিশুকে জ্যাকসনের সন্তান বলে আমরা জানি, তাদের সবার গায়ের রং সাদা, মাথার চুল স্বর্ণ বর্ণের।
একথা মোটামুটি প্রচলিত যে জ্যাকসন তাঁর সন্তানের জন্য এক বা একাধিক শ্বেতকায় বন্ধুর কাছ থেকে শুক্রানু সংগ্রহ করেন। জ্যাকসনের দ্বিতীয় স্ত্রী ও দুই সন্তানের জননী ডেবি স্মিথ স্বীকার করেছেন, মাইকেলের এক বন্ধুর শুক্রানু থেকে তিনি দুটি সন্তানের জননী হয়েছেন। শুধু মা হওয়ার জন্য মাইকেল তাকে মোটা অংকের অর্থ দেন বলে ডেবি স্বীকার করেছেন। গোড়া থেকেই মাইকেলের শর্ত ছিল একটা: যে সন্তান হবে, সে যেন ধবধবে ফর্সা হয়।
দুই সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর তাদের ওপর থেকে সকল অধিকার ত্যাগ করার জন্য মাইকেল ডেবি স্মিথকে কম করে হলেও নয় মিলিয়ন ডলার দিয়েছেন বলে মহিলা স্বীকার করেছেন।
আমি জানি এসব পুরনো কাসুন্দি এখন ঘাটার কোনো অর্থ হয় না। তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত ট্রাজেডি, অথবা মানুষ হিসেবে তাঁর সীমাবদ্ধতা কোনো কিছুই শিল্পী ও গায়ক হিসেবে মাইকেলের অর্জনকে খাটো করবে না। কিন্তু তবুও প্রশ্ন ওঠে, কারণ কোনো শিল্পী—তা আমেরিকার মতো পুঁজি ও মুনাফা-সর্বস্ব অসুস্থ সমাজেও—তাঁর সময়, সমাজ ও নাগরিক গোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে টিকে থাকে না। শিল্পী নিজের জন্য গান করেন না, তার লক্ষ্য শ্রোতা। তাঁর শ্রোতাদের কাছে জ্যাকসনের মতো সুপারস্টার প্রায় আরাধ্য দেবতা। শুধু তাঁর গান নয়, মাইকেলের জীবনও এসব শ্রোতা গভীরভাবে অনুসরণ করেছে। এদের ওপর মাইকেলের ব্যক্তিগত প্রভাব অপরিসীম, তা অস্বীকার যায় না।
মনে পড়ছে, প্রেসিডেন্ট বুশ একসময় জ্যাকসনকে এই বলে সম্মানিত করেছিলেন যে তিনি তাঁর সময়ের তরুণদের চোখে একজন ‘রোল মডেল।’
তাহলে এ কেমন রোল মডেল যে নিজেকে নিজেই ঘৃণা করে? নিজের মতো নয়, অন্য কারো মতো হতে যে আজীবন চেষ্টা করে?
 
৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯, নিউইয়র্ক

হাসান ফেরদৌস

No comments: