এক ঝাঁকে প্রায় ৮০০ পানিকাটা গাংচিল
আমাদের দেশে বসবাস করা বা পরিযায়ন করা গাঙচিলের প্রজাতি প্রায় দেড় ডজন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে অভিনব হচ্ছে ইন্ডিয়ান স্কিমার বা পানিকাটা গাঙচিল। অনেকে এদের ডাকে জলখোর, পানিচরা, গাঙমারা ও নদীচরা বলে; হাতিয়ার চরাঞ্চলে এদের বলে খোয়াজ। তবে বলে রাখা ভালো, ওখানকার লোকেরা তিন-চার প্রজাতির পাখিকেই খোয়াজ নামে ডাকে। পানিকাটা পাখির বৈজ্ঞানিক নাম Rynchops albicollis।
গাঙচিলের দলের সবচেয়ে সুন্দর প্রজাতির একটি এই পানিকাটা। পাখিটি লম্বায় ৪০ সেন্টিমিটার বা ১৬ ইঞ্চি। কপাল বাদ দিয়ে মাথার ওপর একটি কালো টুপি। ডানার ওপরের দিকে সারা পিঠের প্রায় সবটাই কালচে। কেবল মেলে ধরা ডানার পেছনমুখী অংশে একটি সাদা পট্টি। বাকি সারা দেহ ধবধবে সাদা। টকটকে লাল ঠোঁট ও পা চোখ এড়ানোর মতো নয়। প্রায় আট সেন্টিমিটার লম্বা ঠোঁটের ওপরের অংশ নিচেরটির চেয়ে বেশ ছোট। অভিনব এ লম্বা নিচের ঠোঁট পানিতে ডুবিয়ে ওপরের ছোট ঠোঁটটিকে পানির ওপরে রেখে উড়ে চলার সময় অনেক মাছ নিচের ঠোঁটে বেঁধে আসে। তখন সে ওপরের ঠোঁট বন্ধ রেখে খপ করে মাছটি ধরে ফেলে।
পানিকাটার মাছ শিকারের দৃশ্য উপভোগ করার মতো। এরা দলবদ্ধভাবে পানির ওপর ঘুরে ঘুরে গা না ভিজিয়ে মাছ শিকার করে। মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে ধারেকাছের বালুবেলায় এরা জিরিয়ে নেয়। অলসভাবে বসেও থাকতে পারে দীর্ঘ সময়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গাঙচিল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ বা জলজ প্রাণী শিকার করে।
বাংলাদেশে পানিকাটার একটি ছোট দল প্রথম দেখি ৮ জানুয়ারি ১৯৯৫ সালে। আমরা তখন নোয়াখালী জেলার দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপগুলোয় পাখিশুমারি করছি। হাতিয়ার উত্তর-পশ্চিম কোণের ছোট দ্বীপ কচ্ছপিয়ায় সে সময় গোটা তিরিশেক পানিকাটা দেখেছিলাম। ওড়ার ফাঁকে ফাঁকে চরের জোয়ার-ভাটায় ভেজা মাটিতে বসে তারা জিরিয়ে নিচ্ছিল। দেশে যাঁরা পাখি নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের অনেকেই এরপর পানিকাটার দলের দেখা পান মূলত হাতিয়া দ্বীপের পশ্চিম, নিঝুম দ্বীপের পূর্ব এবং দ্বীপ দুটির দক্ষিণের পুরোনো ও সদ্য জেগে ওঠা চরগুলোয়।
এ যাত্রায় যখন প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে দেশের নানা অঞ্চলে ঝটিকা সফর করছি, তখন নিঝুম দ্বীপের হরিণ গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণারত ছাত্র দীপু জানাল, হাতিয়া-নিঝুম দ্বীপের মাঝের মুক্তারিয়া খাঁড়িতে পানিকাটা বেশ দেখা যাচ্ছে। গেল ২০ জানুয়ারি কনকনে শীতে হাতিয়া দ্বীপের জাহাজমারা থেকে অটোরিকশায় চেপে সকাল আটটার আগে মুক্তারিয়া ঘাটে গিয়ে একটি ডিঙি নৌকায় উঠেছি। তখনো সূর্যের লেশমাত্র নেই। শিরশির করে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাসে মাঝির জীবনও ওষ্ঠাগত। মুখাবয়ব ও ক্যামেরা ধরার কারণে হাত বাদবাকি পুরো শরীরে কাপড় জড়িয়ে নিয়েছিলাম। তাই রক্ষা যে, শীতের কাঁপুনিতে ক্যামেরা হাত থেকে নদীতে পড়ে যায়নি। ঘন কুয়াশায় ঢাকা সূর্যহীন আকাশ দেখে মনে হয়েছিল মুক্তারিয়া খাঁড়িতে কোনো পাখির দেখা মিলবে না। খাঁড়ির পূর্বদিকে মূল হাতিয়া দ্বীপের অংশ হিসেবে কালামচরের প্রায় পুরো অংশ বন বিভাগের লাগানো কেওড়া, গেওয়া ও বাইন-বাগান। এর দক্ষিণ দিকে ফি বছর যুক্ত হচ্ছে নতুন চর। মুক্তারিয়া খাঁড়ি ও তার পশ্চিম পাড়ের চর নিঝুম দ্বীপের অংশ।
কারও কারও ধারণা, দেশের যেকোনো মোহনা অঞ্চলে পানিকাটা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু হাতিয়া ও মনপুরা উপজেলার মাঝখানে বিস্তীর্ণ বালুচর বা উপকূলীয় চরাঞ্চলের বাইরে এখন পর্যন্ত পারতপক্ষে এদের কোনো নমুনা চোখে পড়েনি। ধরে নেওয়া হয়, এসব চরেই এরা প্রাকবর্ষায় প্রজনন করে। শীতের সময় এদের একটি বড় দল পরিযায়ী পাখি হিসেবে আমাদের স্থানীয় পানিকাটাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ফলে সারা বিশ্বের না হলেও উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় পানিকাটা পাখির দলটির বাস হাতিয়ার আশপাশে।
এখন পানিকাটা পাখির প্রজাতি বাংলাদেশে বেঁচে থাকবে কি না, তা অনেকটাই নির্ভর করছে এখানে এদের অবস্থান কেমন তার ওপর। আন্তর্জাতিকভাবে পানিকাটা ভালনারেবল বা বিপন্ন। কিন্তু বাংলাদেশে এদের অবস্থা আরও সঙিন বলে একে এনডেঞ্জারড বা সংকটাপন্ন প্রজাতির দলে ফেলা হয়। বিপন্ন বা সংকটাপন্ন প্রাণীদের প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন দেশের বন্য প্রাণী মন্ত্রণালয় বা পরিদপ্তর সুষ্ঠু ও পরিবেশবান্ধব বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করে এবং তা বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নেয়। বাংলাদেশে সবকিছুই বিপরীত। এখানে বন্য প্রাণী আইন করা হয়েছে। পানিকাটা পাখিটি সংরক্ষিত প্রজাতির তালিকায়ও স্থান পেয়েছে। কিন্তু উপদ্রুত প্রাণীগুলো প্রকৃতিতে বেঁচে আছে কি না, এরা কোথায় থাকে, কী খায়, মানুষের পরাক্রমের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে পারছে কি না, তা দেখার টেকসই কোনো ব্যবস্থা নেই। কারণ, দেশে বন বিভাগের আওতার বাইরে নিজস্ব সত্তায় বলীয়ান কোনো বন্য প্রাণী বিভাগ বা পরিদপ্তর গড়ে ওঠেনি, যা বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা নিতে পারে।
সরকারের এখনই এমন একটি বন্য প্রাণী পরিদপ্তর গড়ে তোলা জরুরি, যা হবে বন ও পরিবেশ বিভাগের সমতুল্য। অন্য হাজারটা কর্মসূচির মধ্যে এর কাছে প্রাধান্য পাবে বিপন্ন, সংকটাপন্ন ও সমূহ সংকটাপন্ন প্রাণী প্রজাতি সংরক্ষণের সব ব্যবস্থা নেওয়া। এ পরিদপ্তরের প্রধান একটি কাজ হবে সংকটাপন্ন প্রাণী প্রজাতি সংরক্ষণ সেল গঠন করা। সারা দেশের মোহনা অঞ্চলে পানিকাটা প্রজাতির সংখ্যার একটি শুমারি করার জন্য এই সেলকে অবিলম্বে মাঠে নামতে হবে। প্রয়োজনে এ কাজে তারা বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার বা ছোট ও হালকা প্রশিক্ষণ বিমানের সহায়তা নিতে পারে। কারণ আকাশ থেকে যত সহজে চরাঞ্চলের পাখিশুমারি করা যায়, ডাঙায় হেঁটে বা নৌকা থেকে তেমনটি সম্ভব নয়। এমনকি বিমান থেকে ছবি তুলেও সহজে পাখি গণনা করা সম্ভব। এরপর পানিকাটার সবচেয়ে বড় দলটি যে অঞ্চলে পাওয়া যাবে, সেটিকে এ পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেবে এ পরিদপ্তর।
ভূমি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ও পাখিবিশারদদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে তদারকির জন্য কমিটি গঠন করলে এলাকার লোক সম্পৃক্ত বোধ করবে। পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে এ প্রজাতিটি সংরক্ষণ করতে পারলে সে অঞ্চলে ইকোট্যুরিজম প্রকল্প গড়ে তোলারও একটি সম্ভাবনা তৈরি হবে। এতে পানিকাটা পাখি যেমন বাঁচবে, তেমনি তৃণমূল মানুষদেরও উপার্জনের উত্স সৃষ্টি হবে। দেশবাসী পাবে অনুপম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ।
ড. রেজা খান: দুবাই চিড়িয়াখানার প্রধান
ড. রেজা খান | তারিখ: ০৫-০২-২০১০
No comments:
Post a Comment