মেয়েটির বয়স মাত্র ১১, ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। এরই মধ্যে সে চারটি ফিল্ম বানিয়েছে, তার একটি আবার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও ছিনিয়ে এনেছে। মেয়েটির নাম শিরোপা পূর্ণ। ২৬তম শিকাগো আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উত্সবে শিরোপার স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র আওয়ার বোট ইজ আওয়ার অ্যাড্রেস পেয়েছে শিশুদের প্রযোজিত শ্রেষ্ঠ ফিল্ম/ভিডিও পুরস্কার। এই পুরস্কারের মূল্যমান আড়াই হাজার ডলার।
শিকাগো যাওয়ার পথে শিরোপা নিউইয়র্কে এসেছিল ছবিটির একটি কপি নিয়ে। বাঙালিপাড়া জ্যাকসন হাইটসে একঘর-ভর্তি লোক আমরা সে ছবি দেখলাম গভীর আগ্রহ নিয়ে। বাংলাদেশের যাযাবর সাপুড়েদের নিয়ে ছবিটি। নৌকায় তাদের জীবন, এই নৌকাই তাদের মরণ। জিপসিদের নিয়ে এক ধরনের রোমান্টিক আগ্রহ আমাদের আছে। বাংলা ফিল্মে ও নাটকে তাদের জীবনের খণ্ডাংশ আমাদের দেখা আছে। কিন্তু তার কোথাও এই কঠিন, কঠোর ও নির্মম জীবনাভিজ্ঞতার নির্মোহ প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। এই সাপুড়েদের জীবনে কী এক নিষিদ্ধ দিক আছে, নাটুকে বাঙালি কেবল সে নিষিদ্ধ গল্পই শুনতে চায়। অথচ তাদের বাস্তব জীবন যে গল্পের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, শিরোপার মাত্র ১৩ মিনিটের এই তথ্যচিত্রে তা বেশ স্পষ্ট ধরা পড়ে।
শিশুর চোখে, প্রধানত শিশুদের দিয়েই শিরোপা এই যাযাবর জীবনের গল্পটি বলেছে। যে নদীতে ওর সাপুড়েরা দলবল নিয়ে তাদের নৌকা নোঙর করে, তা নোংরা, ভয়াবহ পরিবেশদূষণের শিকার। আশপাশের কলকারখানা থেকে অনবরত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, নানা রকম বর্জ্য, দৈনন্দিন আবর্জনা সেখানে জমা হয়। সেই নোংরা পানিতেই এদের গোসল ও আহার। রোগশোক এদের লেগেই থাকে। শিশুরা প্রায় সবাই নানা রকম অপুষ্টিতে ভোগে। এটা মোটেই অবাক কোনো ব্যাপার নয় যে নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসরত সাপুড়েদের আয়ু খুব বেশি হয় না।
পাকা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টারের মতো শিরোপা আমাদের একাধিক সাপুড়ে পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। শিরোপার ক্যামেরা অনুসরণ করে আমরা পৌঁছে যাই একটি বেদে-নৌকার ভেতর। একরত্তি পাটাতন, তার ওপর কেমন যত্নে পরিপাটি সব সাজানো। চটের মাদুর, চাদর, ফুলতোলা বালিশ, রন্ধন ও আহারের সরঞ্জাম। খোলা আকাশের নিচে আহারের আয়োজন চলে, ক্ষুধার্ত শিশু বড় বড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে অপেক্ষায়। ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই একদম শিশু বয়স থেকে নানা রকম মাটির জিনিস বানাতে শেখে, সেসব বিক্রি করে বাবা-মায়ের দু-চার পয়সা আয় হয়। আবার একদম নিরানন্দ জীবন নয় এসব শিশুর। নিজেদের মতো করে এরা খেলাধুলা করে, প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, এমনকি স্বাভাবিক ভবিষ্যতের স্বপ্নও দেখে। যেসব ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, তাদের কাছে শিরোপার প্রশ্ন: বড় হয়ে কী হবে? কেউ হতে চায় চিকিত্সক, কেউ বা অন্য কোনো পেশাজীবী। একটি শিশু, সে শিরোপার মতোই ১০-১১ বছর বয়সী হবে, ক্যামেরার দিকে চোখ তুলে বলে, মানুষ। সে বড় হয়ে মানুষ হতে চায়।
শুধু যাযাবর সাপুড়েদের জীবনের গল্প নয় এই ছবি। এর আসল বক্তব্য: নদীর ওপর এই যে ভাসমান মানুষ, এরা আসলে আমাদেরই প্রতিবেশী। অথচ এদের আমরা চিনি না, তাদের চিনতে কোনো আগ্রহও আমাদের নেই। কোনো সরকার বাহাদুর নেই যে এদের এই মানবেতর জীবন থেকে টেনে তুলে আনে। কোনো রাজনৈতিক দল নেই অথবা কোনো এনজিও-নেতা নেই, যাঁর এজেন্ডায় এদের কথা অন্তর্ভুক্ত হয়। এই যে মানবেতর জীবন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, তা আসলে আমাদের নিজেদের মানতের চৈতন্যেরই প্রতিভাষ।
এই ছবির অন্য সাব-টেক্সট: পরিবেশের ক্রমাগত দূষণ ও তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া। শিরোপার ক্যামেরা বারবার ফিরে স্থির হয় থকথকে কাদার মতো ঘন ময়লা পানির ওপর। এই পানির অপর নাম জীবন নয়, মরণ। ক্লাসের বড় আপার মতো সোজাসাপ্টা গলায়, স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে শিরোপা আমাদের প্রশ্ন করে: এ নিয়ে কী আমাদের কারও কিছু করার নেই? এভাবেই কি আমাদের নদীগুলো মরে যাবে, আর তার সঙ্গে নিশ্চিত মৃত্যু ঘটবে এই অসহায়, অভাবী যাযাবরদের?
বিশ্বের ১০০টির বেশি ছবি এ বছর শিকাগো শিশু চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সেসব ছবির অন্য আর কোনোটি আমি দেখিনি। পত্রিকায় দেখেছি সেরা পুরস্কার যারা ছিনিয়ে নেয়, তাদের অধিকাংশই এসেছে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে। এক ব্যতিক্রম শিরোপা। মেয়েটির মা খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা, বাবা চলচ্চিত্র পরিচালক মিঠু। শিরোপা জানাল, বাবাই তাকে হাতে-কলমে ছবি নির্মাণের কলাকৌশল শিখিয়েছেন। একদিন ঢাকার বাইরে বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে প্রথম বেদে-নৌকা দেখে শিরোপা। এই এতটুকু নৌকায় একটা পুরো পরিবার বাস করে? জেনে বিস্মিত হয়েছিল। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তারা ঘুরে বেড়ায়, কী মজার জীবন! সেই বেদেদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে গিয়ে শিরোপা আবিষ্কার করে, মজার নয়, বড় কঠিন, বড় নির্দয় সে জীবন। শিশুর বিস্ময়ে কিন্তু অভিজ্ঞতায় পরিণত একজন শিল্পীর আন্তরিকতায় এই ছবিটি সে বানিয়েছে। বিজয়ের শিরোপা যে তার জুটেছে, এতে বিস্ময়ের কী আছে!
টাইম ম্যাগাজিন শিশু-কিশোরদের জন্য ‘টাইম ফর কিডস’ নামে যে বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করে থাকে, তার একটি সাম্প্রতিক সংখ্যায় শিরোপা খবরের শিরোনাম হয়েছে। এখানে ওই ম্যাগাজিনে মুদ্রিত ছবিটিই ছাপা হলো। তার সঙ্গে পত্রিকার খুদে রিপোর্টার মেগান পফাউ এবং উত্সবের পরিচালক নিকোল ড্রিসকা।
শিকাগো যাওয়ার পথে শিরোপা নিউইয়র্কে এসেছিল ছবিটির একটি কপি নিয়ে। বাঙালিপাড়া জ্যাকসন হাইটসে একঘর-ভর্তি লোক আমরা সে ছবি দেখলাম গভীর আগ্রহ নিয়ে। বাংলাদেশের যাযাবর সাপুড়েদের নিয়ে ছবিটি। নৌকায় তাদের জীবন, এই নৌকাই তাদের মরণ। জিপসিদের নিয়ে এক ধরনের রোমান্টিক আগ্রহ আমাদের আছে। বাংলা ফিল্মে ও নাটকে তাদের জীবনের খণ্ডাংশ আমাদের দেখা আছে। কিন্তু তার কোথাও এই কঠিন, কঠোর ও নির্মম জীবনাভিজ্ঞতার নির্মোহ প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। এই সাপুড়েদের জীবনে কী এক নিষিদ্ধ দিক আছে, নাটুকে বাঙালি কেবল সে নিষিদ্ধ গল্পই শুনতে চায়। অথচ তাদের বাস্তব জীবন যে গল্পের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, শিরোপার মাত্র ১৩ মিনিটের এই তথ্যচিত্রে তা বেশ স্পষ্ট ধরা পড়ে।
শিশুর চোখে, প্রধানত শিশুদের দিয়েই শিরোপা এই যাযাবর জীবনের গল্পটি বলেছে। যে নদীতে ওর সাপুড়েরা দলবল নিয়ে তাদের নৌকা নোঙর করে, তা নোংরা, ভয়াবহ পরিবেশদূষণের শিকার। আশপাশের কলকারখানা থেকে অনবরত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, নানা রকম বর্জ্য, দৈনন্দিন আবর্জনা সেখানে জমা হয়। সেই নোংরা পানিতেই এদের গোসল ও আহার। রোগশোক এদের লেগেই থাকে। শিশুরা প্রায় সবাই নানা রকম অপুষ্টিতে ভোগে। এটা মোটেই অবাক কোনো ব্যাপার নয় যে নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসরত সাপুড়েদের আয়ু খুব বেশি হয় না।
পাকা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টারের মতো শিরোপা আমাদের একাধিক সাপুড়ে পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। শিরোপার ক্যামেরা অনুসরণ করে আমরা পৌঁছে যাই একটি বেদে-নৌকার ভেতর। একরত্তি পাটাতন, তার ওপর কেমন যত্নে পরিপাটি সব সাজানো। চটের মাদুর, চাদর, ফুলতোলা বালিশ, রন্ধন ও আহারের সরঞ্জাম। খোলা আকাশের নিচে আহারের আয়োজন চলে, ক্ষুধার্ত শিশু বড় বড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে অপেক্ষায়। ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই একদম শিশু বয়স থেকে নানা রকম মাটির জিনিস বানাতে শেখে, সেসব বিক্রি করে বাবা-মায়ের দু-চার পয়সা আয় হয়। আবার একদম নিরানন্দ জীবন নয় এসব শিশুর। নিজেদের মতো করে এরা খেলাধুলা করে, প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, এমনকি স্বাভাবিক ভবিষ্যতের স্বপ্নও দেখে। যেসব ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, তাদের কাছে শিরোপার প্রশ্ন: বড় হয়ে কী হবে? কেউ হতে চায় চিকিত্সক, কেউ বা অন্য কোনো পেশাজীবী। একটি শিশু, সে শিরোপার মতোই ১০-১১ বছর বয়সী হবে, ক্যামেরার দিকে চোখ তুলে বলে, মানুষ। সে বড় হয়ে মানুষ হতে চায়।
শুধু যাযাবর সাপুড়েদের জীবনের গল্প নয় এই ছবি। এর আসল বক্তব্য: নদীর ওপর এই যে ভাসমান মানুষ, এরা আসলে আমাদেরই প্রতিবেশী। অথচ এদের আমরা চিনি না, তাদের চিনতে কোনো আগ্রহও আমাদের নেই। কোনো সরকার বাহাদুর নেই যে এদের এই মানবেতর জীবন থেকে টেনে তুলে আনে। কোনো রাজনৈতিক দল নেই অথবা কোনো এনজিও-নেতা নেই, যাঁর এজেন্ডায় এদের কথা অন্তর্ভুক্ত হয়। এই যে মানবেতর জীবন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, তা আসলে আমাদের নিজেদের মানতের চৈতন্যেরই প্রতিভাষ।
এই ছবির অন্য সাব-টেক্সট: পরিবেশের ক্রমাগত দূষণ ও তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া। শিরোপার ক্যামেরা বারবার ফিরে স্থির হয় থকথকে কাদার মতো ঘন ময়লা পানির ওপর। এই পানির অপর নাম জীবন নয়, মরণ। ক্লাসের বড় আপার মতো সোজাসাপ্টা গলায়, স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে শিরোপা আমাদের প্রশ্ন করে: এ নিয়ে কী আমাদের কারও কিছু করার নেই? এভাবেই কি আমাদের নদীগুলো মরে যাবে, আর তার সঙ্গে নিশ্চিত মৃত্যু ঘটবে এই অসহায়, অভাবী যাযাবরদের?
বিশ্বের ১০০টির বেশি ছবি এ বছর শিকাগো শিশু চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সেসব ছবির অন্য আর কোনোটি আমি দেখিনি। পত্রিকায় দেখেছি সেরা পুরস্কার যারা ছিনিয়ে নেয়, তাদের অধিকাংশই এসেছে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে। এক ব্যতিক্রম শিরোপা। মেয়েটির মা খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা, বাবা চলচ্চিত্র পরিচালক মিঠু। শিরোপা জানাল, বাবাই তাকে হাতে-কলমে ছবি নির্মাণের কলাকৌশল শিখিয়েছেন। একদিন ঢাকার বাইরে বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে প্রথম বেদে-নৌকা দেখে শিরোপা। এই এতটুকু নৌকায় একটা পুরো পরিবার বাস করে? জেনে বিস্মিত হয়েছিল। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তারা ঘুরে বেড়ায়, কী মজার জীবন! সেই বেদেদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে গিয়ে শিরোপা আবিষ্কার করে, মজার নয়, বড় কঠিন, বড় নির্দয় সে জীবন। শিশুর বিস্ময়ে কিন্তু অভিজ্ঞতায় পরিণত একজন শিল্পীর আন্তরিকতায় এই ছবিটি সে বানিয়েছে। বিজয়ের শিরোপা যে তার জুটেছে, এতে বিস্ময়ের কী আছে!
টাইম ম্যাগাজিন শিশু-কিশোরদের জন্য ‘টাইম ফর কিডস’ নামে যে বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করে থাকে, তার একটি সাম্প্রতিক সংখ্যায় শিরোপা খবরের শিরোনাম হয়েছে। এখানে ওই ম্যাগাজিনে মুদ্রিত ছবিটিই ছাপা হলো। তার সঙ্গে পত্রিকার খুদে রিপোর্টার মেগান পফাউ এবং উত্সবের পরিচালক নিকোল ড্রিসকা।
হাসান ফেরদৌস | তারিখ: ২০-১১-২০০৯
No comments:
Post a Comment