Tuesday, October 26, 2010

সাগরতলে উড়োজাহাজ


চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ডুবে যাওয়া জাহাজ খুঁজতে গিয়ে সন্ধান মিলল এক যুদ্ধবিমানের

পানিতে নোঙর ফেলে ইঞ্জিনচালিত নৌকার হাল ধরে আছেন আবুল কালাম আজাদ। নৌকার সঙ্গে বিনা বাধায় ছুটছে নোঙর। আবুল কালাম আজাদ ভাবেন, এই বুঝি সাগরের তলদেশে আটকে যাবে নোঙর। নোঙর আটকায়ও। অক্সিজেন-মাস্ক পরে উত্তাল সাগরে নেমে পড়েন আজাদ। আবার নিজে ওপরে থেকে কখনো নামিয়ে দেন তাঁর প্রশিক্ষিত কোনো ডুবুরিকে। উদ্দেশ্য, সাগরতলে দীর্ঘসময় ডুবে থাকা কোনো জাহাজের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা। ২০ বছর ধরে এভাবেই পানির নিচে নোঙর ফেলে ছুটে চলছেন আর সাগরের তলদেশ থেকে আস্ত জাহাজ কিংবা জাহাজের খণ্ডাংশ উদ্ধার করে আনছেন আজাদ।
সাগরের তলদেশে কোনোকিছুতে নোঙর আটকালেই আজাদের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গত ২৫ জুলাই এ রকমই একটি ঘটনা ঘটে বন্দরের বহির্নোঙরে, সি অ্যাংকরেজ এলাকায়। হঠাৎ কোনোকিছুতে নোঙর আটকে গিয়ে তীব্র টান অনুভব করেন আজাদ। বোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে ডুবুরি রহমানকে নামিয়ে দেন। আর আনা হয় বার্জ ও উদ্ধারের যন্ত্রপাতি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আজাদ নিজেও নেমে পড়েন সাগরে। সাগরের নিচে ডুবে থাকা জাহাজের কাদামাটি সরানো হয়। এরপর মোটা তারের সাহায্যে শুরু হয় উত্তোলন-পর্ব। কিন্তু জাহাজ নয়, সাগরের তলদেশ থেকে উঠে আসছে উড়োজাহাজ—উড়োজাহাজের টায়ার, আগ্নেয়াস্ত্র, গুলির বাক্স...।
প্রায় এক মাস ধরে চলা উদ্ধারকাজ শেষ না হতেই আজাদের বাহিনীকে একদিন অতর্কিতে ঘিরে ফেলে জলদস্যুরা। দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সশস্ত্র দস্যুদল ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে বাঁশখালী উপকূলের দিকে জিম্মি করে নিয়ে যায় আজাদের প্রতিষ্ঠান হিরামণি স্যালভেজের দুই কর্মী ইয়ার মোহাম্মদ ও বাদল হাওলাদারকে। নিজের দুই কর্মীকে বাঁচাতে আজাদ বাধ্য হন মুক্তিপণ দিতে। জলদস্যুদের ভয়ে বন্ধ হয়ে যায় উদ্ধারকাজ। এ পর্যন্ত উদ্ধারকৃত বিমানের বিভিন্ন অংশ, গোলাবারুদ এখন পড়ে আছে কর্ণফুলী নদীর ১৫ নম্বর ঘাটের অদূরে বিজয়নগর এলাকায়।
বন্দরের উপসংরক্ষক ক্যাপ্টেন নাজমুল আলম ধারণা করছেন, এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ।
ঘটনা জানার পর বিমানবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করা উড়োজাহাজের অংশগুলো দেখে গেছেন। তাঁরাও মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া কোনো বিমান ছিল এটি।
বহির্নোঙরের সি অ্যাংকরেজ এলাকায় সাগরতলায় ডুবে থাকা জাহাজ, লোহালক্কড় উদ্ধারের অনুমতি বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে নেওয়া ছিল আজাদের প্রতিষ্ঠানের নামে। উদ্ধার করা লোহালক্কড় বিক্রি থেকেই মূল আয় আজাদের। কিন্তু এ যাত্রায় আজাদ এখন পর্যন্ত খরচই তুলতে পারেননি; উদ্ধারকাজ শুরু না হলে সেই সম্ভাবনাও নেই।
তবে আজাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা পাশাপাশি আরেকটি উদ্ধারকাজ করছেন; অ্যাভলুস নামের একটি জাহাজ তোলার চেষ্টা করছেন সাগরের তলা থেকে। ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা মাইন দিয়ে ধ্বংস করেছিলেন এই গ্রিক জাহাজটি। বন্দরের ডলফিন জেটির অদূরে ডুবে থাকা জাহাজটি উদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন আবুল কালাম আজাদের ডুবুরি দল। চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার বুক অব ইনফরমেশন-১৯৭৩-এর তথ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা ছোট-বড় ২১টি জাহাজের ক্ষতি করেছিলেন। এই ২১টি জাহাজের একটি এই অ্যাভলুস।
তবে একটানা কাজ করা যাচ্ছে না। জেটিতে জাহাজ না থাকলে উদ্ধারকাজ চলে, আর নয়তো বন্ধ। জেটিতে জাহাজের ভিড় না থাকলে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে অ্যাভলুস জাহাজটি পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হবে মনে করছেন আজাদ।
বন্দর চ্যানেল ও বহির্নোঙরে জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে এমনিতেই অপসারণ করতে হয় ডুবে থাকা জাহাজ। নানা কারণে প্রতিবছর গড়ে চার থেকে ছয়টি জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়ে বন্দর এলাকায় ডুবে যায়। কোনো কোনো সময় ডুবে থাকা জাহাজে ধাক্কা লেগেও দুর্ঘটনা ঘটে। আজাদের প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত ছোট-বড় ১৬টি জাহাজ কর্ণফুলী নদী ও সমুদ্র থেকে উদ্ধার করেছে। এগুলোর মধ্যে এমভি কারই সেনতোসা, এমভি ওশেন ওয়েভ, এমভি শাহ বদর-১, এমভি রামগতি, এমভি স্টার আল তাইর, এমভি সাগর, এমভি মমিন, এমভি মেয়জিন, এমভি বাংলার কিরণ, এমভি মেঘনা, এমভি পেসিফিক-৩, এমভি সুমি-৩, এমভি লিতা উল্লেখ্যযোগ্য।
উপসংরক্ষক ক্যাপ্টেন নাজমুল আলম মনে করেন, ‘আজাদের প্রতিষ্ঠান কৃতিত্বের সঙ্গে বন্দর এলাকায় ডুবে যাওয়া জাহাজ অপসারণের কাজ করছে। শর্ত সাপেক্ষে এসব জাহাজ উদ্ধারের অনুমতি দিই আমরা।’
আজাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্ধারকাজ হচ্ছে, চাক্তাই খালের মুখে আড়াআড়িভাবে ডুবে থাকা বিদেশি এক জাহাজের উদ্ধার অভিযান। এই জাহাজের কারণে চট্টগ্রাম নগর থেকে আসা পানির স্রোত কর্ণফুলী নদীতে পড়তে বাধাপ্রাপ্ত হতো। আজাদ বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দায়িত্ব পেয়ে জাহাজটি অপসারণের কাজ শুরু করেন। আজাদ বলেন, ‘জাহাজটি অপসারণের পুরো খরচ আমার ওঠেনি। তবে জাহাজটি সরানোর ফলে নগরের পানির স্রোত এখন আর বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে না।’
সমুদ্রের তলদেশে কাজ করতে গিয়ে আজাদকে বিপদেও পড়তে হয়েছে অনেকবার। উত্তাল সাগরের সঙ্গে যুদ্ধ তো আছেই, আছে জলদস্যুদের খপ্পরে পড়ার আতঙ্ক। এর বাইরে ছোটখাটো দুর্ঘটনায়ও পড়তে হচ্ছে বিভিন্ন সময়। একবার সাগরের নিচে বড় এক মাছের গুঁতোয় প্রায় জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হয়েছিল আজাদের। সঙ্গীরা টের পেয়ে তাঁকে টেনে তোলেন বার্জে।
বরগুনার পায়রা নদীতে মাছ ধরে কেটেছে আবুল কালাম আজাদের ছোটবেলা। নদীর এপার থেকে ওপারে সাঁতার কাটতেই তার ছিল যত আনন্দ। পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে পড়ালেখা করা হয়নি। মাত্র ২০ বছর বয়সেই ১৯৮৪ সালের দিকে চলে আসেন চট্টগ্রামে। সীতাকুণ্ডের এক জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই ইয়ার্ডে ভাঙার জন্য আনা একটি স্ক্র্যাপ জাহাজ একবার তীরের কাছে ডুবে গেলে জরুরি ভিত্তিতে দরকার হয়ে পড়ে ডুবুরির। আজাদ সাহস করে অক্সিজেন-মাস্ক পরে নেমে যান পানির নিচে। এভাবেই হেলপার থেকে আজাদ একদিন বনে গেলেন ডুবুরি। পাঁচ বছর পর চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার স্যালভেজ প্রতিষ্ঠানের ডুবুরি হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার পর থেকেই দক্ষ ডুবুরি হিসেবে আজাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
প্রতিবছর চট্টগ্রাম এলাকায় দুর্ঘটনায় ডুবছে জাহাজ। কিন্তু এসব জাহাজ উদ্ধারের জন্য এখনো পর্যাপ্তসংখ্যক প্রতিষ্ঠান নেই। সেই সমস্যা থেকেই সমাধান এল তাঁর মাথায়, নিজে যদি একটা প্রতিষ্ঠান গড়তে পারেন তাহলে উদ্ধারকাজের জন্য কারও মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হবে না। জমানো টাকায় আজাদ গড়ে তুললেন হিরামণি স্যালভেজ। ১৫ বছর আগের ঘটনা এটা।
নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ার পর আজাদ প্রথম যে সমস্যায় পড়লেন তা হলো দক্ষ ডুবুরির অভাব। খুঁজে খুঁজে তিনি সাহসী কিছু লোক জড়ো করে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। এখন তাঁর ডুবুরি বাহিনীর সুনাম চারদিকে। এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ জন ডুবুরিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন নিজে। তাঁর তিন ভাইও এই পেশায় জড়িত।
চট্টগ্রামের এমন কোনো স্যালভেজ প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে আজাদের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া ডুবুরি কাজ করছেন না। বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়নপত্র দেখে আজাদের প্রশিক্ষিত তিনজন ডবুরিকে দুবাইভিত্তিক একটি স্যালভেজ কোম্পানি নিয়োগ দিয়েছে। আরও সাতজন ডুবুরির বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তাঁদেরই একজন ইউসুফ, ‘হেই আমাগো বড় ওস্তাদ।’ তিনি বলেন, ‘হেলপার থেকে তাঁর প্রশিক্ষণে আমি ডুবুরি হয়েছি। ওস্তাদ এখন আমাদের বিদেশে কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছেন।’ ইউসুফ আশা করছেন, এক মাসের মধ্যে দেশের বাইরে কোথাও কাজ জুটে যাবে তাঁর।
সাগরের তলদেশ থেকে ঘুমিয়ে থাকা জাহাজের ঘুম ভাঙানোই এখন তাঁর নেশা। এই নেশার টানেই প্রায় ৪৭ বছর বয়সেও তিনি চষে বেড়াচ্ছেন উত্তাল সাগর। 
 
 সুত্র: প্রথম আলো। মাসুদ মিলাদ | তারিখ: ২২-১০-২০১০

No comments: