Monday, October 18, 2010

তাঁর অস্ত্রের পাশেই ছিল কবিতা

পাবলো নেরুদা | তারিখ: ০৮-১০-২০১০

ক্রুশবিদ্ধ যিশু আর চে গুয়েভারার বিষণ্ন হাসিমাখা মুখ এখন পর্যন্ত বিশ্বের জনপ্রিয়তম ছবি। চে গুয়েভারার মৃত্যুতে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় যত শোকগাথা রচিত হয়েছে, তা সত্যিই বিরল। চিলির বিপ্লবী কবি পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথায় সেই চেকেই আমরা দেখি বিষণ্ন এক যোদ্ধার প্রতিকৃতিতে, যিনি ভালোবাসতেন বিপ্লব আর ভালোবাসতেন কবিতা।

দুর্ভাগা বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার রাষ্ট্রীয় হত্যা ছিল এক মর্মান্তিক আঘাত। তাঁর মৃত্যু ঘোষণাকারী টেলিগ্রাম দুনিয়ার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ভক্তিমাখা শীতল এক শিহরণের মতো। তাঁর বীরোচিত করুণ জীবনকে প্রণতি জানিয়ে লেখা হলো লাখ লাখ শোকগাথা। ঘটনাটি যত বিরাট, কোনো কবিতা সেই উচ্চতা ছুঁতে না পারলেও সারা দুনিয়া থেকে সেগুলো উপচে পড়তে থাকল। কিউবা থেকে একটি টেলিগ্রাম পেলাম। সেখানকার এক সাহিত্য-সম্পাদক চেকে নিয়ে লেখা আমার কবিতাটি চেয়েছেন। কিন্তু আমি তখনো কিছু লিখতে পারিনি। আমার বিশ্বাস ছিল, এ রকম একটি শোকগাথাকে কেবল তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ দিয়ে ধারণ করা চলে না, এর মধ্যে থাকতে হবে এই দুঃখভারাতুর কাহিনির প্রগাঢ় প্রতিধ্বনি। তাই সেই কবিতাটি যত দিন না আমার মনে আর রক্তে পরিণত হচ্ছে, তত দিন তার অনুরণন আমার মধ্যে বাজবে।
আমি আপ্লুত হয়ে যাই যে এই মহান গেরিলা যোদ্ধার রোজনামচায় একমাত্র যে কবির কবিতা উদ্ধৃত হয়েছে, সেই কবি আমি। মনে পড়ে, সার্জেন্ট রেটামারের সামনে একদিন চে আমাকে বলেছিলেন, সিয়েরা মায়েস্ত্রোয় প্রায়ই তিনি তাঁর অগ্রণী, গরিমাময়, গৌরবদীপ্ত দাড়িধারী গেরিলাদের আমার ‘ক্যান্টো জেনারেল’ কবিতাটি পড়ে শোনাতেন। ডায়েরিতে ভবিষ্যদ্বাণীর মতো লিখে রেখেছিলেন, আমার ‘ক্যান্টো পারা বলিভার’ (বলিভারের জন্য গীতি) কবিতার একটি চরণ: ‘সাহসী সেনানীর মতো তোমার ছোটো লাশ...’।
চে গুয়েভারার সঙ্গে আমার প্রথম দেখাটি একদম অন্য রকম ছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল হাভানায়। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যখন তাঁর দপ্তরে যাই, তখন রাত একটা। তিনি যেখানে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, সেটি অর্থ না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তা পুরো মনে নেই। ঠিক হয়েছিল, আমাদের দেখা হবে মধ্যরাতে। এর আগে এক অন্তহীন সরকারি অনুষ্ঠানে আমাকে সভাপতিমণ্ডলীর সঙ্গে বসে থাকতে হয়েছিল। তাতেই আমার পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। চে ছিলেন বুট, সামরিক পদক, পিস্তলসহ পূর্ণ সামরিক পোশাকে। তাঁর দপ্তরের পরিবেশটি ছিল ব্যাংকের মতো। সেখানে সামরিক পোশাকে তাঁকে কিছুটা বেঢপই লাগছিল। মানুষটি কিছুটা রোদে পোড়া, কথাবার্তায় ধীর এবং কণ্ঠে স্পষ্ট আর্জেন্টেনীয় টান। তাঁকে দক্ষিণ আমেরিকার রুক্ষ প্রান্তরের সেই সব মানুষের মতো লাগে, যাদের কোনো তাড়াহুড়ো নেই। কথা বলেন ছোট ছোট বাক্যে। শেষে থাকে এমন এক হাসি, যেন আর কিছু বলার নেই, এখন অন্যরা বলুক।
আমার ক্যান্টো জেনারেল বইয়ের কবিতা নিয়ে তিনি যা বললেন, তাতে মনে স্লাঘা জাগল। এর কবিতাগুলোই তিনি সিয়েরা মায়েস্ত্রোর রাতগুলোতে সহযোদ্ধাদের পড়ে শোনাতেন। এখন অনেক বছর পরও আমি শিউরে উঠে ভাবি, আমার কবিতা তাঁর মৃত্যুসঙ্গী হয়েছিল। আরেক বিপ্লবী রেজিস দেব্রের কাছ থেকে জানতে পারি, বলিভিয়ার পাহাড়ে তাঁঁর শেষ দিনগুলোতে কাঁধের ঝুলিতে যে দুটি বই তিনি রাখতেন, তার একটি ছিল গণিতের, অন্যটি আমার ক্যান্টো জেনারেল।
সেই রাতে তিনি আমাকে যা বলেছিলেন, তাতে কিছুটা চমকে গেলেও তাঁর নিয়তিটা যেন দেখতে পেলাম। কথা হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য কিউবা আগ্রাসন নিয়ে। কিউবার রাজপথের কৌশলগত জায়গায় বালুর বস্তা ফেলা যুদ্ধপ্রস্তুতি চোখে পড়েছিল। সেই রাতে চে হঠাৎ বললেন, ‘যুদ্ধ...যুদ্ধ...আমরা সব সময়ই যুদ্ধের বিরুদ্ধে। কিন্তু একবার যেহেতু লড়েছি, এখন আর লড়াই ছাড়া আমরা থাকতে পারব না। আমরাও সব সময় সেখানেই ফিরতে চাই।’
কথাগুলো যেন তাঁর চিন্তারই উচ্চারণ, যাতে আমি বুঝতে পারি। শুনে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যুদ্ধ আমার কাছে কোনো লক্ষ্য নয়, ভয়ের ব্যাপার।
আমি বিদায় নিলাম। সেটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা। এরপর বলিভিয়ার জঙ্গলে চলে তাঁর লড়াই, আসে সেই বেদনাবিধুর মৃত্যু। কল্পনায় এখনো ভাসে সেই বিষণ্ন চে গুয়েভারার ছবি, যাঁর সব বীরোচিত লড়াইয়ে অস্ত্রের পাশেই ঠাঁই পেত কবিতা।
পাবলো নেরুদার মেময়ার্স থেকে নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করেছেন ফারুক ওয়াসিফ

পাবলো নেরুদা
(১২ জুলাই ১৯০৪—২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩)
তাঁর জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে কবিতা আর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে, পরিচিতি ছিল কমিউনিস্ট লেখক হিসেবে। ১৯২৩ সালে প্রথম বই বের করার জন্য বিক্রি করে দিয়েছিলেন সব সম্পত্তি। পারিবারিক বিরোধ এড়াতে প্রথম বই ক্রেপুসকুলারিও বের করেন পাবলো নেরুদা ছদ্মনামে। কারণ, কবি পেশায় পরিবারের একদম সায় ছিল না। পরের বছর তাঁর বইয়ের প্রকাশক পেতে বেগ পেতে হয়নি, বের করেন তাঁর বিখ্যাত ২০টি প্রেমের কবিতা। ১৯২৭ সালে নেরুদা শুরু করেন তাঁর দীর্ঘ কূটনৈতিক জীবন। ১৯৪৩ চিলির সিনেটে নির্বাচিত হন এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। আরেক লাতিন লেখক গাব্রিয়েল মার্কেস বলেন: যেকোনো ভাষায়ই নেরুদা বিশ শতকের সেরা কবি। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে দুই বছর ক্যানসারে ভোগার পর চিলির গণতান্ত্রিক সরকারের পরাজয়ের ১২ দিন আগে এই মহান কবির জীবনাবসান ঘটে। 
 সংগ্রহ: দৈনিক প্রথম আলো

No comments: