আনোয়ারা খাতুন ৩৮ বছর ধরে বস্তিতে থাকেন। সে তো অনেকেই থাকেন। এর চেয়ে বেশি দিন ধরেও বস্তিতে আছেন অনেকে। কিন্তু সেই অনেকের সঙ্গে আনোয়ারা খাতুনের একটি পার্থক্য আছে। আনোয়ারা বস্তিতে আছেন একটি বাড়ির মায়ায়।
বস্তির বাইরে এলেই চোখে পড়ে দোতলা পাকা বাড়ি। এই পাকা বাড়িতেই ১২ বছর বয়সে বউ হয়ে এসেছিলেন আনোয়ারা খাতুন।
এই বাড়িতেই হয়তো কেটে যেত বাকিটা জীবন। কিন্তু সব বদলে দিল এক একাত্তর। একাত্তরের ধাক্কায় আনোয়ারা হারালেন স্বামীকে, আর হারালেন বাড়িটি।
আনোয়ারাদের বাড়িতে ক্যাম্প বানিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। তখন স্ত্রী আনোয়ারাকে নিয়ে গ্রামে পালিয়ে যান স্বামী জলিল শাহ্। স্ত্রীকে গ্রামে রেখে জলিল চললেন মুক্তিসংগ্রামে।
সেই যে গেলেন, আর ফিরলেন না জলিল। পরে আনোয়ারা শুনেছেন, এই শহরেই কী অবর্ণনীয় অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়েছে তাঁর স্বামীকে।
জলিল মারা গেলেও একসময় মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের হাসি হাসেন। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু আনোয়ারার জীবন নতুন করে শিকলে আটকে পড়ে। ঋণের দায়ে বাড়িটি বিক্রি করে দেয় তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। শুরু হয় স্বাধীনতার সমান বয়সী আনোয়ারার বস্তি-জীবন।
রাজশাহী শহরের তালাইমারী শহীদ মিনার এলাকায় পদ্মা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসংলগ্ন একটি বস্তিতে থাকেন আনোয়ারা খাতুন। হোমিও চিকিত্সা করতেন বলে বস্তিবাসীরা তাঁকে ‘ডাক্তার’ হিসেবেই জানে।
‘ডাক্তারের ঘর’ খোঁজ করলে একবাক্যে সবাই চিনিয়ে দেয়। ছনের বেড়া দেওয়া তিনখানা টিনের একটি খুপড়ির ভেতর বসে তরকারি কাটছিলেন আনোয়ারা খাতুন।
ডাকতেই বের হয়ে এলেন। ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, কোথায় বসতে দেবেন!
একসময় বসতে দেওয়ার উপকরণের অভাব ছিল না। এখন সে প্রসঙ্গে আনোয়ারার কণ্ঠে শুধুই কান্না, ‘খান সেনারা সব শেষ করে দিয়েছে। বর্ষার সময় পানি ওঠে ঘরে। সাতবার এই ঘর ভেঙে দিয়েছে সরকার। এলাকার লোকজন আবার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।’
ঘরের ভেতর একজন মানুষের শোবার মতো ছোট্ট একটা চৌকি। আর রান্নার কিছু তৈজসপত্র।
এসব জিনিসপত্র দেখতে দেখতে পুরো স্মৃতি এসে ঘিরে ধরে আনোয়ারাকে।
শিউরে উঠে বলেন, ‘গল্প শুনেছি, আমার স্বামীকে কীভাবে পোশাক পরা অবস্থায় মাটিচাপা দিয়ে রেখেছে। দেশ স্বাধীন হলে বাড়িতে এসে দেখি, টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি কিচ্ছু নেই। সারা বাড়ি ছড়িয়ে আছে শুধু ছোপ ছোপ রক্ত।’
তার পরও সেই রক্তের দাগ মুছে বাড়িতে বসবাস করতে চেয়েছিলেন আনোয়ারা। কিন্তু কয়েকটা দিন যেতেই তাঁর বড় ভাসুর এসে বললেন, পারিবারিক ঋণ শোধ করতে বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। বাধ্য হয়ে দুই ভাসুরের সঙ্গে তিনিও দলিলে স্বাক্ষর করেন।
দেশ নিজের হলো, বাড়ি পরের হয়ে গেল! বস্তিতে উঠে গেলেন আনোয়ারা। স্বামী অবসরে হোমিওপ্যাথি চিকিত্সা করতেন। দেখে দেখে তিনিও কিছুটা আয়ত্ত করেছিলেন। শুরু করলেন বস্তিবাসীর চিকিত্সা। সঙ্গে কুমড়োর বড়ি তৈরি করে বিক্রি করতেন।
এতেও সংসার চলে না। এক প্রতিবেশীর ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার কাজ নিলেন। এতে করে মাসে ৩০০ টাকা পেতেন। ইদানীং সেই ছেলেটি বড় হলে তিনি আবার বেকার হয়ে পড়েন। এদিকে বয়সও বেড়েছে। মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন মাঝেমধ্যেই তাঁকে এক বেলা খেয়ে দিন কাটাতে হয়।
অনেকে বলেন এই বস্তি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে। তাহলে জীবনটা হয়তো আরেকটু সহজ হয়। কিন্তু আনোয়ারা এই বাড়ি ছাড়তে পারেন না। এই বাড়ি থেকে তাঁর স্বামীর বাড়িটি দেখা যায় যে! স্বামীকে ছেড়ে কোথায় যাবেন তিনি?
বস্তির বাইরে এলেই চোখে পড়ে দোতলা পাকা বাড়ি। এই পাকা বাড়িতেই ১২ বছর বয়সে বউ হয়ে এসেছিলেন আনোয়ারা খাতুন।
এই বাড়িতেই হয়তো কেটে যেত বাকিটা জীবন। কিন্তু সব বদলে দিল এক একাত্তর। একাত্তরের ধাক্কায় আনোয়ারা হারালেন স্বামীকে, আর হারালেন বাড়িটি।
আনোয়ারাদের বাড়িতে ক্যাম্প বানিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। তখন স্ত্রী আনোয়ারাকে নিয়ে গ্রামে পালিয়ে যান স্বামী জলিল শাহ্। স্ত্রীকে গ্রামে রেখে জলিল চললেন মুক্তিসংগ্রামে।
সেই যে গেলেন, আর ফিরলেন না জলিল। পরে আনোয়ারা শুনেছেন, এই শহরেই কী অবর্ণনীয় অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়েছে তাঁর স্বামীকে।
জলিল মারা গেলেও একসময় মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের হাসি হাসেন। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু আনোয়ারার জীবন নতুন করে শিকলে আটকে পড়ে। ঋণের দায়ে বাড়িটি বিক্রি করে দেয় তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। শুরু হয় স্বাধীনতার সমান বয়সী আনোয়ারার বস্তি-জীবন।
রাজশাহী শহরের তালাইমারী শহীদ মিনার এলাকায় পদ্মা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসংলগ্ন একটি বস্তিতে থাকেন আনোয়ারা খাতুন। হোমিও চিকিত্সা করতেন বলে বস্তিবাসীরা তাঁকে ‘ডাক্তার’ হিসেবেই জানে।
‘ডাক্তারের ঘর’ খোঁজ করলে একবাক্যে সবাই চিনিয়ে দেয়। ছনের বেড়া দেওয়া তিনখানা টিনের একটি খুপড়ির ভেতর বসে তরকারি কাটছিলেন আনোয়ারা খাতুন।
ডাকতেই বের হয়ে এলেন। ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, কোথায় বসতে দেবেন!
একসময় বসতে দেওয়ার উপকরণের অভাব ছিল না। এখন সে প্রসঙ্গে আনোয়ারার কণ্ঠে শুধুই কান্না, ‘খান সেনারা সব শেষ করে দিয়েছে। বর্ষার সময় পানি ওঠে ঘরে। সাতবার এই ঘর ভেঙে দিয়েছে সরকার। এলাকার লোকজন আবার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।’
ঘরের ভেতর একজন মানুষের শোবার মতো ছোট্ট একটা চৌকি। আর রান্নার কিছু তৈজসপত্র।
এসব জিনিসপত্র দেখতে দেখতে পুরো স্মৃতি এসে ঘিরে ধরে আনোয়ারাকে।
শিউরে উঠে বলেন, ‘গল্প শুনেছি, আমার স্বামীকে কীভাবে পোশাক পরা অবস্থায় মাটিচাপা দিয়ে রেখেছে। দেশ স্বাধীন হলে বাড়িতে এসে দেখি, টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি কিচ্ছু নেই। সারা বাড়ি ছড়িয়ে আছে শুধু ছোপ ছোপ রক্ত।’
তার পরও সেই রক্তের দাগ মুছে বাড়িতে বসবাস করতে চেয়েছিলেন আনোয়ারা। কিন্তু কয়েকটা দিন যেতেই তাঁর বড় ভাসুর এসে বললেন, পারিবারিক ঋণ শোধ করতে বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। বাধ্য হয়ে দুই ভাসুরের সঙ্গে তিনিও দলিলে স্বাক্ষর করেন।
দেশ নিজের হলো, বাড়ি পরের হয়ে গেল! বস্তিতে উঠে গেলেন আনোয়ারা। স্বামী অবসরে হোমিওপ্যাথি চিকিত্সা করতেন। দেখে দেখে তিনিও কিছুটা আয়ত্ত করেছিলেন। শুরু করলেন বস্তিবাসীর চিকিত্সা। সঙ্গে কুমড়োর বড়ি তৈরি করে বিক্রি করতেন।
এতেও সংসার চলে না। এক প্রতিবেশীর ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার কাজ নিলেন। এতে করে মাসে ৩০০ টাকা পেতেন। ইদানীং সেই ছেলেটি বড় হলে তিনি আবার বেকার হয়ে পড়েন। এদিকে বয়সও বেড়েছে। মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন মাঝেমধ্যেই তাঁকে এক বেলা খেয়ে দিন কাটাতে হয়।
অনেকে বলেন এই বস্তি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে। তাহলে জীবনটা হয়তো আরেকটু সহজ হয়। কিন্তু আনোয়ারা এই বাড়ি ছাড়তে পারেন না। এই বাড়ি থেকে তাঁর স্বামীর বাড়িটি দেখা যায় যে! স্বামীকে ছেড়ে কোথায় যাবেন তিনি?
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ | তারিখ: ০৪-১২-২০০৯
No comments:
Post a Comment