Monday, October 11, 2010

বিষনগর (বিচিত্রিতা...)

ছোটবেলায় শোনা গল্পে এমন ব্যাপার থাকত। কোনো শহরে হয়তো আগুন ধরে গেল, জ্বলছে তো জ্বলছেই। এক সকালে উঠে দেখা গেল, একফোঁটা পানি নেই কোথাও, পুরো শহর শুকিয়ে মরুভূমি। মানুষ তো দূরের কথা, তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে মশা-মাছিও মরছে। রূপকথার বইতে এমন শহরের নাম থাকে ‘মৃতপুরী’ বা ‘প্রেতপুরী’।
এই যুগটা ঠিক মৃতপুরীর নয়, এখন ‘গিজগিজপুরী’র যুগ। শহরগুলো আরও ঘনবসতিতে অস্থির হয়ে উঠছে। এখন শহরের মরার উপায় কই?
কিন্তু এই যুগেও যদি শোনা যায়, একটা গোটা শহর ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে? মানুষ পিলপিল করে ছুটছে, একবার শহর থেকে বেরোতে পারলেই ব্যস্—হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আর কি। দিনে দিনে উজাড় হয়ে যাচ্ছে সেই শহর। কী বলবেন তাকে? মৃতপুরী নয়?
যুক্তরাষ্ট্রের পিচার শহরে ঠিক এই ঘটনাই ঘটছে এখন। রিফিউজিদের মতো লাইন দিয়ে নাগরজনেরা লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছেন। শহরের ত্রিসীমানা পার হলেই তুমুল আনন্দ। সাকল্যে ১৪০ জন মানুষ এখন এই মৃতপ্রায় নগরে রাত্রিযাপন করছে। এদের চেহারা দেখলে মনে হবে, কালাপানি দ্বীপে এদের কয়েদবাস হয়েছে। তারাও তক্কে তক্কে আছে, সুযোগ পেলেই শহর ছেড়ে পালানোর। কেন?
কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে এই শহরে তাকানো যাক। রমরমা ফুর্তির শহর। ধনে ধনবতী, রসে রসময়। প্রাচুর্যে ঢলঢল শহরের ঘরদোর, রাস্তাঘাট। প্রাচুর্যের পেছনের গল্পটাও রূপকথার মতো। পিচার খনির শহর। সিসার খনি, দস্তার খনি, আকরিক লোহার খনি—খনিতে খনিময়। খনিগুলোতে দিন-রাত কাজ চলছে। ‘যে করে খনিতে শ্রম, যেন তারে ডরে যম’—এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে পাশাপাশি দুই শহরে উত্তোলন চলছে। পিচার আর ট্রিস। তখন এই দুই শহরে খনিজ দ্রব্যের স্বর্ণযুগ চলছে। সে সময় ২০ বিলিয়ন ডলারের আকরিক উত্তোলন করা হয়েছিল এখানে।
বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে গেল। শানাও হাতিয়ার। নতুন হাতিয়ার গড়ে শত্রুকে ঘায়েল করতে হবে। তাই আরও লোহা চাই, সিসা-দস্তা চাই। খনি খালি হতে শুরু হলো এবার।
১৯৭০ সালে এসে দেখা গেল, গ্রাম্য প্রবাদ সত্যি বটে। বেহিসাবি খরচে রাজার গোলাও একদিন ফুরায়। খনি উপুড় করে এত দিন যুদ্ধ হয়েছে। হঠাত্ একদিন দেখা গেল, ডালা খালি। শেষ খনিতেও উত্তোলন বন্ধ হয়ে গেল।
খনি উজাড় হয়ে গেছে।
বাকি থাকল কী? যা থাকল তার বর্ণনা ভয়াবহ। খনিজ পদার্থের বর্জ্যে ঢাকা পড়ল পুরো শহর। রাস্তার ধুলোর মধ্যে সিসা জমে আছে। পাথরের গুঁড়োর সঙ্গে লেগে আছে সিসা আর লোহা। শহরের আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে খনির গুঁড়ো হয়ে পড়ে থাকা বর্জ্য। আর এসব ক্ষতিকর আবর্জনাতেই এক ভয়ংকর ট্রাজেডি ঘটে গেল শহরে।
এখন শহরে প্রতিবার নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য দাম গুনতে হয়। বর্জ্যদ্রব্যে শরীরে নানা গণ্ডগোল দেখা দিচ্ছে। রক্তে সিসার মাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ভয়াবহ মাত্রায়। স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। শহরে এখনো যারা বসবাস করছে তারা যেন মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে।
শহর ছেড়ে যাওয়া কঠিন। স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করার কোনো প্রশ্ন নেই, কিনবে কে? ব্যাংক থেকে লোন পাওয়ার উপায় নেই। সরকার ক্ষতিপূরণ দিয়ে এদের সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সেই সুবাদেই শহর খালি হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত উদ্যম নিয়ে লোকে পালিয়ে যাচ্ছে শহর ছেড়ে। যেন নাক জাগিয়ে একটু সুস্থ বায়ু প্রাণ ভরে ফুসফুসে নিতে অধীর হয়ে আছে সবাই।
আর খনিশ্রমিকেরা? গ্লিন্ডা পাওয়েল, যিনি সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা করে বসে আছেন, তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমার বাবা ছিলেন খনিশ্রমিক। ক্যান্সারে মারা গেছেন তিনি। মার অবস্থাও তাই—ফুসফুসের অবস্থা খুব খারাপ।’
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পাওয়েল অপেক্ষা করছেন শহর ছেড়ে যাওয়ার।
বিদেশি সূত্র অবলম্বনে শাহজাদা তৈমুর | তারিখ: ২৫-০৯-২০০৯

No comments: