- সৈকত সাদিক | তারিখ: ২৫-০৯-২০০৯
বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, শান্ত এই গ্রামটির বাড়িগুলোর ভেতরে কী কাজ হচ্ছে। কাজের কোনো শব্দও বাইরে আসছে না। শব্দ, হইচই নেই বটে; কিন্তু এই মধুপুর গ্রামেই আছেন বাশ-বেত দিয়ে শৌখিন পণ্য তৈরির অসামান্য কারিগরেরা।
গ্রামবাসী তাদের ঋষি সম্প্রদায় হিসেবে চেনে। বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দেখা গেল বাড়ির উঠানে বাঁশ ও বেতের সংমিশ্রনে তৈরি ‘ক্যান রাউন্ড বাল্ব’ সারিবদ্ধভাবে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। কাজ করার ঘরে বসে অনেকে এসব পণ্যে বার্ণিশ দিচ্ছে। এই গ্রামেরই এক পরিবারের দুই ভাই নিরঞ্জন দাস ও সুভাষ দাস। নিরঞ্জন দাস বললেন,‘বহু দূর-দূরান্ত থেকে বাঁশ-বেত কিনে এনে সেগুলো দিয়ে নানা রকম জিনিস বানাই। সেগুলো ঢাকায় নিয়ে পাইকারদের কাছে বিক্রি করি। তারা এগুলো শোরুমে তুলে বিক্রি করে। কেউ আবার বিদেশে পাঠায়।’
একসময় নিরঞ্জন-সুভাষদের বাপ-দাদারা বেত দিয়ে ধান মাপার পালা, ধামা, সের, ঢোল বানাতেন। দিন গড়াতে থাকে। আধুনিক মানুষের পালা, আগৈল, ধামার ব্যবহার কমতে থাকে। চলে আসে প্লাস্টিক, ধাতব জিনিসের ব্যবহার। বাধ্য হয়েই মধুপুরের ঋষি সম্প্রদায়ের লোকেরা ঝোঁকে শৌখিন পণ্য নির্মাণে।
সুভাষ দাস বলছিলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়ের লোকদের তেমন ধানের জমি নাই বা বাপ-দাদার অর্থনৈতিক অবস্থাও সচ্ছল ছিল না। কিন্তু জীবন তো বাঁচানো লাগব। তাই মাথার বুদ্ধিটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। যখন দেখলাম মানুষ আর আগৈল, ধামাকেনে না তখন চিন্তা করলাম বাঁশ-বেত দিয়া কী বানানো যায়। পণ্যের ধরন পরিবর্তন করে বিভিন্ন স্থানে দেখাতে লাগলাম। আমার পণ্য দেখে আড়ং পছন্দ করল। সেই থেকে আমি আড়ংয়ের সঙ্গে কাজ করছি।’
এখন তারা বাঁশের ও বেতের তৈরি ‘ক্যান রাউন্ড বাল্ব’, ঢোলসহ বিভিন্ন জিনিস নিয়মিত সরবরাহ করেন বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠানে। তাদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই চলে সুভাষদের কারখানা। এ ছাড়া বিভিন্ন পণ্যের ‘স্যাম্পল’ বানিয়ে রেখেছেন তাঁরা। এগুলো দেখে কেউ যদি অর্ডার দেয় সে অনুযায়ী সরবরাহ করেন।
সুভাষ-নিরঞ্জন দাসের থেকে বেশি সময় ধরে বাঁশ-বেত নিয়ে কাজ করছেন পণ্ডিতচন্দ্র দাস। নিজের বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন ‘মধুপুর কুটিরশিল্প’। কারখানাতেই পাওয়া গেল পণ্ডিত দাসকে।
তাঁর কারখানাতে এখন পুরোদমে কাজ চলছে। এই কারখানা দিয়েই আজ সচ্ছল মানুষ তিনি। তিন ছেলের মধ্যে এক ছেলেকে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছেন, মেজো ছেলে কবি নজরুল কলেজে অনার্স পড়ছেন ও ছোট ছেলে মিরপুর বাংলা কলেজে বিএ পড়ছেন। তাঁর অধীনে প্রায় ২০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। এসব শ্রমিক প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মজুরি পান। তিনি একসময় বিসিকের সঙ্গে কাজ করেতেন। বিভিন্ন পণ্য নিয়ে বিসিকের বিভিন্ন মেলায় অংশ গ্রহণ করতেন। কারুপণ্য নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন বাংলা ক্রাফট, ঢাকা হ্যান্ড্রি ক্রাফটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদস্য হয়েছেন।
পণ্ডিত দাস বলেন, ‘আমাদের এসব পণ্যের মূল কাঁচামাল হলো বাঁশ ও বেত। বাঁশ স্থানীয় বাজার ও পাশের থানার পাড়াগ্রাম হাট থেকে কিনলেও বেত কিনতে হয় বহু দূরান্ত থেকে। বেত কেনার জন্য আমরা যাই রাজবাড়ীর পাংশা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল ও সিলেটের বিভিন্ন এলাকায়। মূলত অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন মাস বেত সংগ্রহের আসল সময়। বাগান থেকে আমরা বেত কিনি। এ বেত বাড়িতে এনে সারা বছর সংরক্ষণ করে চাহিদা অনুযায়ী কাজ করি। একটা সময় দেশে বনজঙ্গল বেশি ছিল। তখন বেতের সরবরাহও বেশি ছিল, কিন্তু এখন বনজঙ্গল কমে যাওয়ায় বেতের দামও বেড়ে গেছে।’
এ এলাকার বেশির ভাগ ঘরে এলিফ্যান্ট রোড ও গাউছিয়ার বিয়েসামগ্রী বিক্রির দোকানের নানা পণ্য তৈরি হয়। গাউছিয়া ও এলিফ্যান্ট রোডের দোকানমালিকেরা বিয়ের ডালা, ফুলের ঝুড়িসহ একসঙ্গে অনেক পণ্য বানানোর অর্ডার দেন।
এ ছাড়া এ এলাকার পণ্য আড়ং, কারিতাসের প্রজেক্ট ‘কোর দি জোট ওয়ার্কস’, একতা, হিড বাংলাদেশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিনে নেয়। এসব প্রতিষ্ঠান পণ্যগুলো কিনে নিয়ে ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। রপ্তানিকারকেরা তাদের উত্পাদনের মজুরি সঠিকভাবে পরিশোধ করেন কি না, তা দেখার জন্য বিদেশিরাও এখানে পর্যবেক্ষণে আসেন।
পণ্ডিত দাসের আশপাশের প্রতি বাড়িতেই তখন কাজ চলছিল। দুই বাড়ি পরে গিয়েই দেখা গেল, ঘরের ভেতরে কাজ করছিলেন ব্রজেন দাসের ছেলে সাগর দাস, মেয়ে তিথি ও সূচিত্রা। তারা জানায়, প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ টি ট্রে’র তলা বানাতে পারে। পড়াশোনার ফাঁকে তারা এ কাজ করে। তাদের মতো তাদের মা-চাচিরাও সংসারের কাজের সঙ্গে এ কাজ করেন।
এভাবে প্রতি বাড়িতেই কেউ ঘরের ভেতরে বসে, কেউ বারান্দায় বা উঠানে বসে কাজ করছেন। কেউ তলা বানাচ্ছেন, কেউ বাঁশ-বেত চিকন করছেন, কেউ পণ্যে বার্ণিশ করছেন। দিন-রাত অনবরত কাজ চলে পুরো এলাকায়।
ব্রজেন দাসের ছেলে সাগর দাস বলেন, ‘আমি কবি নজরুল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়ি। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে এ কাজ করি। কী করব, কাজ না করলে তো সংসার চলে না।’
এভাবে নিজের খরচ চালাতে বা সংসার চালাতেই মধুপুরের বাসিন্দারা ধরে রেখেছেন অসামান্য এক শিল্প।
No comments:
Post a Comment