Sunday, October 10, 2010

শতবর্ষী মাটির স্কুল

নাটোর সিংড়া উপজেলার শতবর্ষী মাটির স্কুল চৌগ্রাম উচ্চ বিদ্রালয়

গত ১০০ বছরে এই পৃথিবীতে কী কী পরিবর্তন হয়েছে? ইন্টারনেট এসেছে, সোভিয়েতের পতন হয়েছে, আরও এক বাঙালি নোবেল পেয়েছেন—তালিকা করতে গেলে লাখ লাখ পৃষ্ঠা ভরে যাবে।
কিন্তু গত ১০০ বছরে নাটোরের একটি জিনিসের কোনো পরিবর্তন হয়নি—চৌগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের মাটির ভবন!
নাটোর সদর থেকে সিংড়া উপজেলার চৌগ্রামের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। এই সিংড়া চৌগ্রামের জমিদার ছিলেন রসিক রায়। এলাকার শিক্ষাবিস্তারে অনেক কাজই করেছেন রসিক রায় ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা। রসিক রায়েরই উত্তরাধিকারী রাজা রমণীকান্ত রায় বাহাদুর ১৯১০ সালে জমিদার বাড়িসংলগ্ন প্রায় সাড়ে তিন একর জায়গা দান করেন স্কুল তৈরির জন্য। সেখানে নিজ উদ্যোগে তৈরি করেন সম্পূর্ণ মাটির তৈরি এই স্কুল।
স্কুলের ছাউনি দেওয়া হয় ১০০ বান্ডিল টিন দিয়ে। আকৃতিতে এটি ইংরেজি ‘ই’-এর মতো। মোট কক্ষ ১০টি। সামনে এক বিশাল খেলার মাঠ। স্কুলের পেছনে একটা বড় পুকুর। সেখানে নানা জাতের গাছগাছালিতে আলো-ছায়ার লুকোচুরি।
মাটির এই স্কুলটিতে ব্যবহার করা হয়েছে ৪২ জোড়া শালকাঠের দরজা। স্কুলটিতে কোনো জানালা ব্যবহার করা হয়নি। দুই পাশে সমান্তরালভাবে বানানো হয়েছে উঁচু দরজা। মেঝে সেই সময়ই পাকা করা হয়েছিল। বারান্দার খুঁটি ও চাল তৈরিতে শালকাঠ ব্যবহূত হয়েছে।
প্রায় ৪৫ বছর আগে টিনের চালাটি নষ্ট হয়ে গেলে ওই স্কুলের এক প্রাক্তন ছাত্রের বাবা আবুল বাশার ১০০ বান্ডিল টিন দিয়ে আবার চালটি নতুন করে তৈরি করে দেন। স্কুলটি যখন তৈরি করা হয়, তখন এখানে শুধু ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করা হতো।
সেই শুরুর সময় থেকেই এখানে মেট্রিকুলেশন পর্যন্ত চালু ছিল। প্রথম বছর কলকাতা বোর্ডের অধীনে এই বিদ্যালয় থেকে ১৪ জন মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে ১৪ জনই পাস করেন। তাঁদের মধ্যে চিকিত্সক গোলাম মওলা বক্স প্রথম বিভাগে পাস করেন। সে সময় স্কুলটি কলকাতা বোর্ডের অধীনে ছিল। ১৯১৫ সালে বিদ্যালয়টি বাংলা মাধ্যমে পড়ানোর জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতি পায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্কুলটি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই স্কুলে পড়ালেখা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মাদার বক্স সাহেব, বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান খাদেমুল বাশারের মতো গুণীজনেরা। তাঁদের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই।
কিন্তু জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে বেঁচে আছে এই স্কুলটি। ২০০৪ সালে এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে কলেজ শাখা ও ভোকেশনাল শাখা। কলেজ শাখাটি আলাদা দোতলা পাকা ভবন। বিদ্যালয়টির অফিস সূত্রে জানা যায়, স্কুল ও কলেজ মিলিয়ে বর্তমানে ছাত্রছাত্রী রয়েছে ৮০০ জন। এখানে স্কুল শাখায় বর্তমানে কর্মরত আছেন ২২ জন শিক্ষক, কলেজ শাখায় ২০ জন এবং অফিস কর্মচারী ১২ জন।
স্কুলের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মীর সোলায়মান আলী জানান, প্রতিবছর বিদ্যালয়ের সার্বিক পাসের হার বোর্ডের সমান হলেও গত তিন বছরে স্কুলটি থেকে মাত্র একজন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
শুধু সোলায়মান আলী নন, স্কুলের সব শিক্ষকের দাবি, বিদ্যালয় ভবনটির সংস্কার। দরজা, ছাদের রুয়া, বাটাম, খুঁটি—সবই নষ্ট হয়ে গেছে। মাটির দেয়ালটি লেপামুছা করতে কষ্ট হয়, তাই বছরখানেক হলো দেয়ালে চুনকাম করা হয়েছে। মেঝের প্লাস্টারও উঠে গেছে। আগে আশপাশের ১৫-২০টি গ্রাম থেকে এই স্কুলে ছা্ত্রছাত্রী আসত।
এখন প্রায় সব এলাকায় বিদ্যালয় থাকায় শুধু চৌগ্রাম, নিমা, কদমা, বড়িয়া গ্রাম থেকে ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে।
বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. আবুল কালাম আজাদ প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহ্য রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন। সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিদ্যালয়টির সভাপতি আতাউল গণি বলেন, ‘প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠের লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক বিকাশেও সুনাম ছিল। অথচ বর্তমানে এটি সুনাম হারাতে বসেছে।’
অন্য সব স্কুল-কলেজের মতো এখানেও সমস্যার অন্ত নেই। কিন্তু সমস্যার চেয়ে বড় বোধহয় শতবর্ষী একটি মাটির ভবনের গর্ব। 
 
আঞ্জুমান আরা | তারিখ: ০৯-১০-২০০৯

No comments: