Tuesday, October 19, 2010

মাটি ও মানুষের নেতা

অজস্র মৃত্যুরে লঙ্ঘিয়ে টান টান ধনুকের ছিলার মতো কোনো এক দীপ্র মুহূর্তের জরায়ু ছিঁড়ে কনস্টান্টিনোপলের মৃত্তিকায় জন্ম নিয়েছিল রেনেসাঁ আন্দোলন। কালের কালিন্দী বেয়ে তার উদ্দাম ঊর্মিমালা এসে আঘাত করেছিল নিস্তরঙ্গ বাঙালির জীবন-উপকূলে। সেই কল্লোলে যাঁরা ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলেন নতুন সম্ভাবনার সূর্য বুকের মধ্যে বপন করে, স্বাধীনতার সোনালি উষ্ণতা চোখের হূদে জন্ম দিয়ে, তাঁদেরই একজন শহীদ ময়েজউদ্দিন। তাঁর সেই ’৮৪-এর ২৭ সেপ্টেম্বরের আত্মাহুতির মাধ্যমে যে রেনেসাঁ-প্রসারিত চেতনা গড়ে উঠেছিল, এরই ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। সেদিন সরকারের বিরুদ্ধে হরতাল ডেকেছিল তিন বিরোধী রাজনৈতিক জোট। কালীগঞ্জে হরতালে পিকেটিংয়ে দায়িত্বে ছিলেন ময়েজউদ্দিন। এ সময় স্বৈরাচারী সরকারের ভাড়াটে খুনিরা তাঁকে হত্যা করে। ময়েজউদ্দিনসহ অসংখ্য শহীদের রক্তের পথ ধরে নব্বইয়ে পতন ঘটে স্বৈরতন্ত্রের।
১৯৩০ সালের ১৭ মার্চ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার মোক্তারপুর ইউনিয়নের বড়হরা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে শহীদ ময়েজউদ্দিনের জন্ম। প্রথমে নোয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরে রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৪৮ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৫০ সালে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। এরপর ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ (অনার্স) সম্মান ও ১৯৫৫ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালে সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি অর্জন করেন তিনি।
মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন প্রথিতযশা আইনজীবী, রাজনীতিক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজসেবক ছিলেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন দিয়েই তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শাসকগোষ্ঠীর ১৪৪ ধারা ভাঙতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন ভাষাশহীদেরা। তখন রাজপথে অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, শহীদ ময়েজউদ্দিন তাঁদেরই একজন। তখনই তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আইয়ুব-মোনেম চক্র বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার চক্রান্ত করে। তখন শহীদ ময়েজউদ্দিন দেশব্যাপী সাংগঠনিক তৎপরতা চালান, ছয় দফার পক্ষে প্রচারে নামেন। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার জন্য গঠিত ‘মুজিব তহবিল’-এর আহ্বায়কও নির্বাচিত হন তিনি। সেই তহবিলের অর্থ দিয়েই আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের আইনি সহায়তাদানের কাজ পরিচালিত হয়।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ময়েজউদ্দিন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমেদ আহূত সংসদ সদস্যদের সভায় সর্বপ্রথম তীব্র প্রতিবাদ করেন শহীদ ময়েজউদ্দিন। মোশতাক সরকারের প্রতি তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকায় আওয়ামী লীগের অন্যান্য সাংসদও উৎসাহিত হয়েছিলেন।
শহীদ ময়েজউদ্দিন উল্লেখযোগ্য সময় ধরে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি ঢাকা মহানগর এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। এই উত্তাল দিনগুলোতে শহীদ ময়েজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন এবং এ ক্ষেত্রে বেগম মুজিবের অবদান জাতির কাছে অবিস্মরণীয় থাকবে।
১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। একাধারে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি এফপিএবির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইপিপিএফ ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান প্যারেনহুড ফেডারেশনসহ আইওআরের সদস্য ছিলেন। রেক্সোর সভাপতি হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই একই সময়ে সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
এ ছাড়া শহীদ ময়েজউদ্দিন বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। সমাজসেবক হিসেবে পৃথিবীর বহু দেশে সভা-সেমিনার ও সম্মেলনে যোগদান করেছেন তিনি।
শহীদ ময়েজউদ্দিনের পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে মেহের আফরোজ চুমকী কালীগঞ্জের বর্তমান সাংসদ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য।

সুত্র: প্রথম আলো। আমজাদ খান | তারিখ: ২৭-০৯-২০১০

No comments: