Wednesday, October 13, 2010

৩৬ বছরেই নোবেল জয়

নিজ গবেষণাগারে কনস্তান্তিন সের্গিয়েভিচ নোভাসেলোভ

মাত্র ৩৬ বছর বয়সে নোবেল পেয়ে বিশ্বকে অবাক করে দিলেন নোভাসেলোভ। গ্রাফিন আবিষ্কারের জন্য রুশ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী কনস্তান্তিন সের্গিয়েভিচ নোভাসেলোভ এবং আন্দ্রেই কনস্তান্তিনোভিচ গেইম যৌথভাবে ২০১০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ৩৬ বছর বয়সী নোভাসেলোভকে নিয়ে এ প্রতিবেদন।

গ্রাফিন। পৃথিবীটাই যা বদলে দিতে পারে। যুগটাই তো এখন কম্পিউটারের। তাই কম্পিউটারে চাই আরও গতি। তাহলে সিলিকন চিপের বদলে চাই গ্রাফিন চিপ। কারণ গ্রাফিনের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ খুব ভালোভাবে পরিবাহিত হতে পারে। আর এটা খুব বেশি গরমও হবে না। তাই গ্রাফিন চিপও গরম হবে না। গাড়ি-মহাকাশযান, সৌরকোষ, পৃথিবীর সবকিছুই বদলে দিতে পারে গ্রাফিন। এই গ্রাফিন আবিষ্কার করার জন্য যে দুজন এবার নোবেল পেয়েছেন, তাঁদের একজন নোভাসেলোভ। সবকিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, নোভাসেলোভ নোবেল পেলেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে! ১৯৭৩ সালের পর বিজ্ঞানের সব শাখা মিলিয়ে সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী তিনি।
গ্রাফিনের গুণকীর্তন যতটা বিস্ময়কর, তার চেয়েও বিস্ময়কর হলো গ্রাফিনের আবিষ্কার। মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য জানতে যেখানে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বড় জটিল যন্ত্র দিয়ে গবেষণা চলছে, সেখানে গ্রাফিন আবিষ্কার করতে মাত্র এক টুকরো কাগজ, একটা পেনসিল আর একটা স্কচ টেপই যথেষ্ট!
১৯৭৪ সালের আগস্টের ২৩ তারিখ। রাশিয়ার নিঝনি তাগিলে জন্ম নিল এক শিশু। সেদিন কিন্তু কেউ ভাবতেই পারেনি যে এই শিশুই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে নোবেল পেয়ে যাবে। হ্যাঁ, সেই শিশুটিই আজকের নোবেলজয়ী নোভাসেলোভ। তাঁর জন্মের বছর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানের সব শাখা মিলিয়ে নোবেলবিজয়ীদের মধ্যে তিনিই এখন ‘সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানী’। তরুণ এই বিজ্ঞানী এখন হয়ে উঠেছেন তরুণ প্রজন্মের প্রেরণার এক উজ্জ্বল উৎস।
৫ অক্টোবর, ২০১০। পদার্থে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার দিন। অথচ এটা যে নোবেল মৌসুম চলছে, সে কথাটা বেমালুম ভুলে গেছেন নোভাসেলোভ! আগের রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে একটা খসড়া বানিয়েছেন। কোন সময়ে কোথায় যাবেন, কী কী কাজ বাকি আছে ইত্যাদির একটা খসড়া। সবার আগে ছিল গবেষণাগারে যাওয়া। একটা বিষয় নিয়ে কয়েক দিন ধরেই পরীক্ষা করছেন তিনি। তো সেদিন গবেষণায় ব্যস্ত তিনি, এমন সময় ঘোষণা হলো: গ্রাফিন আবিষ্কারের জন্য এবার পদার্থে নোবেল দেওয়া হচ্ছে আন্দ্রেই কনস্তান্তিনোভিচ গেইম ও কনস্তান্তিন সের্গিয়েভিচ নোভাসেলোভকে! কত না আনন্দের বিষয়। পৃথিবীর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। সেটা যাঁর অধিকারে, তাঁর তো আনন্দের বানে ভেসে যাওয়ারই কথা। কিন্তু নোভাসেলোভ তাঁর এক বন্ধুকে মেইল করে জানালেন, ‘যত্ত সব। প্রতিবছর অক্টোবর আসবে। একজন করে নাম করবে। আর সবাই মিলে কাজের প্রতি মনোযোগ হারাবে।’ কী বিস্ময়কর মানুষ রে বাবা! নোভাসেলোভ যেন নোবেল পুরস্কারকে পাত্তাই দিলেন না। ‘এটা খুবই অপ্রত্যাশিত। আমি চিন্তা করলাম কী আর হলোটা কী। কত যে কাজ বাকি। আজ বেশ কিছু পরিকল্পনা ছিল। মনে হচ্ছে সব পরিকল্পনাই আজ ভেস্তে যাবে।’ তাঁর এই কথাতে স্পষ্ট হয়, কাজকে তিনি কতটা ভালোবাসেন। কাজ সম্পর্কে নোবেল ফাউন্ডেশনের অ্যাডাম স্মিথকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘নোবেলের জন্য কেউ কাজ করে না। কাজ করেই কেউ কেউ নোবেল পায়।’
মস্কো ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ডিপ্লোমা করেন নোভাসেলোভ। এরপর পিএইচডি করতে যান নেদারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব নিজমেগান-এ। আন্দ্রেই গেইমের সঙ্গে নোভাসেলোভের পরিচয় সেখানেই। তাঁরা দুজনে এখন ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের শিক্ষক। সেখানে একসঙ্গে আছেন ২০০১ সাল থেকে। সম্পর্কটা তাঁদের গুরু-শিষ্যের। গুরু গেইম যেভাবে কাজ করতে বলেন, শিষ্য নোভাসেলোভ সেভাবেই কাজ করার চেষ্টা করেন। নতুনকে জানার অদম্য আগ্রহ আছে নোভাসেলোভের মধ্যে। তাঁর এই কৌতূহলের কথা ভালোভাবে জানতেন গেইম। তাই তাঁকে নিয়ে অদ্ভুত খেলা শুরু করলেন গেইম।
সপ্তাহের শুক্রবারের সন্ধ্যাটা হবে একেবারেই আলাদা। শুধু আনন্দ আর মজা করার জন্য। গবেষণাগারের সব ঝামেলা ছেড়ে শুধু ছোট ছোট বিষয় নিয়ে খেলা করা। সেদিন কোনো জটিল যন্ত্র থাকবে না। খালি হাত-পা নিয়ে খেলা। খেলা মানে, যা করতে, যা ভাবতে ভালো লাগে, তা-ই করা। তো, নোভাসেলোভ বেছে নিলেন কাগজ আর একটা পেনসিল। প্রতিদিন কাগজে পেনসিল দিয়ে দাগ কাটতে থাকেন। তাঁর ইচ্ছে কতটা সরু দাগ টানা যায়, সেটা দেখা। ধীরে ধীরে, সপ্তাহের আর সব দিনের গবেষণা ছাড়িয়ে শুক্রবারের সান্ধ্য গবেষণাতেই মন গেঁথে গেল নোভাসেলোভের।
২০০৪ সালের একদিন। ‘পেয়ে গেছি’ বলে আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন নোভাসেলোভ। পেনসিলের (গ্রাফাইট) আঁকের ওপর স্কচ টেপ দিয়ে এমন একটা পদার্থ বের করলেন, যেটা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র পদার্থ, সামান্য একটা পরমাণুর সমান! নাম দিলেন গ্রাফিন। এর ভর খুবই কম—এর চেয়ে হালকা কোনো পদার্থ নেই। তাই, মহাকাশযানে জ্বালানি খরচ হবে আগের চেয়ে কম। টেকসই মজবুত গাড়ি কিংবা মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার জন্য শক্তিশালী নভোযান দরকার। সেখানেও গ্রাফিন। কারণ এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী আর কোনো পদার্থ পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। ইস্পাতের চেয়েও শতগুণ শক্তিশালী গ্রাফিন!
কৌতূহল থাকলে আর কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারলে যেকোনো অসাধ্যই সাধন করা যায়। বর্তমানে রয়েল সোসাইটির রিসার্চ ফেলো নোভাসেলোভ সেটা প্রমাণ করলেন। তিনি নোবেল ফাউন্ডেশনকে বলেন, ‘আমরা মূলত বিজ্ঞানচর্চা করছি। এবং এটার মানে হলো আমাদের কৌতূহল অনেক। পদার্থবিজ্ঞান বা পদার্থবিজ্ঞানের কোনো একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের পরিবর্তে আমাদের কৌতূহলের পরিধি অনেক বেশি প্রশস্ত। সুতরাং সবকিছুতেই কৌতূহলী হওয়ার চেষ্টা করি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিজ্ঞানকে মজা করে বুঝতে শেখা। এটা গেইম শুক্রবারের সন্ধ্যাকালীন গবেষণায় প্রথম চালু করেছিলেন এবং তিনি বলতেন নিজেকে কাজে উৎসর্গ করো।’
কী তাঁকে কৌতূহলী করে তোলে? কী তাঁর প্রেরণা? সাক্ষাৎকারে নোভাসেলোভ বলেন, ‘প্রেরণার আসল উৎসটা হলো এমন একটা বিষয়, যেটা আগে কখনো আমি ভাবিনি এবং সেটা নিয়ে কোনো কাজ করিনি। যে পদার্থ নিয়ে আগে কখনো কিছু করতে পারিনি অথচ এটা করার জন্য শুধু হাত-পা-ই যথেষ্ট, সে কাজটাতে আমি সত্যিই মজা পাই।’
নোভাসেলোভ সম্পর্কে তাঁর গুরু গেইম বলেছেন, ‘আমি তাকে রাশিয়া থেকে এখানে আসার আমন্ত্রণ জানাই। আমরা একসঙ্গে প্রায় ১২ বছর ধরে কাজ করছি। সম্পর্কের যখন শুরু, তখন তো সে পিএইচডি-ই করেনি। যাঁরা কঠোর পরিশ্রমী নয়, তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সময় আমি হোঁচট খেয়েছি। কিন্তু নোভাসেলোভের সঙ্গে কাজ করে আমি হোঁচট খাইনি। কারণ, ও খুবই পরিশ্রমী। সে অনেক ভালো, অনেক অমায়িক।’ সত্যিই অমায়িক ও বিনয়ী নোভাসেলোভ। নোবেল পাওয়ার খবর শুনে তিনি প্রথম যে চিন্তাটা করেছিলেন, ‘এটা প্রত্যাশাই করিনি। তবে সবার আগে আমি ল্যাবে যাই। এবং যাঁরা সাতটা বছর ধরে আমাকে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের সবার কাছে আমি ঋণী।’
চারদিকে এখন নোভাসেলোভের জয়গান। ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের উপাচার্য কলিন বেইলি বলেন, ‘এটা অদ্ভুত ও অসাধারণ অর্জন।’ এত অল্প বয়সেই নোবেল জয় করলেন নোভাসেলোভ। এটা তাঁর ভবিষ্যৎ গবেষণায় কী রকম প্রভাব ফেলতে পারে, তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন স্মিথ। নোভাসেলোভ বলেন, ‘আমি এটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করিনি। কেননা, এটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলে, আমি মনে করি, এটা ভালো কিছু বয়ে আনবে না।’
২০০৮ সালে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষসেরা গবেষক নির্বাচিত হয়েছিলেন নোভাসেলোভ। তাঁর একটা বিস্ময়কর অভ্যাস আছে। কোনো কাজেই বেশি দিন মজা পান না। কিন্তু গ্রাফিন নিয়ে কাজ করছেন ছয় বছর ধরে। কেন? নোভাসেলোভ-এর উত্তরটা স্মিথের কাছে কিছুটা বিব্রতকর ঠেকেছে। কারণ নোভাসেলোভ বলেন, ‘এটা কিছুটা দুর্ভাগ্যের! আমিও কাজটা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ নোভাসেলোভ এরপর কী নিয়ে গবেষণা করবেন, সেটা জানতে পারলে ভালোই হয়। কিন্তু তিনি এড়িয়ে গেলেন, ‘মাথায় কিছু বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এটা আমি শুক্রবারের সান্ধ্য-গবেষণার জন্য রেখেছি। এটা কাজ করতেও পারে আবার নাও পারে।’ সেই গবেষণাগার। যেখানে কোনো জটিল যন্ত্র নেই। কিন্তু আছে নোবেল জয়ের মন্ত্র। সেখানেই আবার আরেকটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করবেন নোভাসেলোভ? যদি সেটা কাজ করে? তবে কি আরও কোনো বিস্ময় দেখাবেন নোভাসেলোভ? নোবেল পুরস্কার পাওয়ার চেয়েও বেশি বিস্ময়কর? হতেও পারে। কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। নোভাসেলোভ নিজেই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
(তথ্যসূত্র: নোবেল ফাউন্ডেশনকে দেওয়া নোভাসেলোভের সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য ওয়েবসাইট)
জাহাঙ্গীর আলম | তারিখ: ১৩-১০-২০১০

No comments: