সামসুল ওয়ারেস
যাঁরা স্থাপত্যবিদ্যা পড়তে চান, তাঁদের বলব, এটি একটি স্বাপ্নিক জায়গা। পরিবেশকে সুন্দর করে গোছানোর একটি মাধ্যম হলো স্থাপত্যবিদ্যা। সভ্যতার বিকাশে স্থাপত্যবিদ্যা একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। স্থাপত্যবিদ্যা হচ্ছে বিজ্ঞান ও কলার সংমিশ্রণ। এটি শুধু কলা নয়, আবার শুধু বিজ্ঞানও নয়। স্থাপত্যকে এক সময় কলার অন্তর্ভুক্ত বলা হলেও কালক্রমে এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি বিষয় হয়ে উঠেছে।
১৯৬২ সালের কথা। আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যখন ১৯৬২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমানে বুয়েট) রূপান্তরিত হয়, তখন থেকেই এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে স্থাপত্যবিদ্যার যাত্রা শুরু। ইউএস-এইডের আর্থিক সহায়তায় এ বিভাগটি গড়ে ওঠে। শুরুর পাঁচ বছর মার্কিন শিক্ষকদের মাধ্যমেই বিভাগটি পরিচালিত হতো। ১৯৬৩ সালে আমি ছিলাম এ বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র। সারা পৃথিবীতে যেভাবে স্থাপত্যবিদ্যা পড়ানো হয়, ঠিক সেভাবেই আমাদের এখানেও স্থাপত্যবিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়।
স্থাপত্যবিদ্যার বিশ্বমানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ তৈরি হলেও তখন এ দেশে কাজের ক্ষেত্র তেমন বিকাশ লাভ করেনি বললেই চলে। স্বাধীন বাংলাদেশেও অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৭২ থেকে ’৮০ পর্যন্ত সময়টা ছিল স্থাপত্যের জন্য অনেকটা স্থবির সময়। সদ্য স্বাধীন দেশে সেটা অস্বাভাবিকও নয়। সে সময় স্থাপত্য বিষয়ক দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। তেমন কাজ ছিল না। আশির দশকে পেশা হিসেবে স্থাপত্য একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর আবাসিক ভবন তৈরি হতে থাকে। সরকারি অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও নির্মিত হয় সে সময়। স্থপতিরা মেধাবিকাশের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হওয়ার সুযোগ পান।
স্থপতির কাজ ডিজাইন করা—বাংলায় বলা যেতে পারে ‘নকশা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন’। কিন্তু সাধারণ মানুষ স্থাপত্য এবং পুরকৌশলকে (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) এক করে ফেলেন। সেটা সম্পর্কে একটু বলা দরকার। আমরা ছোটবেলায় যেকোনো রোগের চিকিৎসার জন্য এমবিবিএস চিকিৎসকের কাছে যেতাম— চোখের অসুখ হোক আর হার্টের অসুখ হোক। সব চিকিৎসাই করতেন একজন এমবিবিএস চিকিৎসক। এখন কিন্তু সব রোগের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা চিকিৎসক। এখানেও ব্যাপারটা তা-ই। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক স্থপতিই প্রকৌশলী, কিন্তু সব প্রকৌশলী স্থপতি নন। কর্মক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য। একজন স্থপতি তাঁর স্থাপত্যের নকশা এবং নকশাসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় দেখে থাকেন। আর সেই স্থাপত্যের কাঠামোগত ব্যাপারগুলোরই বাস্তবায়নে সার্বিক দায়িত্বে থাকেন একজন সিভিল বা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার। (দেশের বাইরে এখন ‘সিভিল ইঞ্জিনিয়ার’ না বলে ‘স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার’ বলা হচ্ছে।) স্থপতি হচ্ছেন স্রষ্টা। তিনি সৃজনশীল মানুষ। তিনি পুরো প্রকল্পের রূপকার।
বাংলাদেশ বেশি মানুষের দেশ। মানুষ থাকলেই তো ঘরবাড়ি লাগবে। বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক সক্ষমতা দিন দিন বাড়ছে। বাসস্থান নির্মাণের সুন্দর পরিকল্পনার জন্য স্থপতিদের চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন। আমাদের দেশের মতো ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশে স্থপতিদের কর্মক্ষেত্র দিন দিন প্রসারিত হবে, তা বলা বাহুল্য।
১৯৬২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এ দেশে প্রায় ১০ হাজার স্থপতি বেরিয়েছেন। কিন্তু সবাই হয়তো পেশাজীবনে জড়িত নেই। এখনো দেশে প্রচুর স্থপতির চাহিদা রয়েছে। নতুনেরা যতই আসবে এ বিষয়ে পড়তে, স্থাপত্যের নতুন নতুন ধারণা ততই বিকশিত হবে।
বাংলাদেশে স্থাপত্যবিদ্যার ক্রমপ্রসার ঘটেই চলেছে। নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও স্থাপত্য বিষয়ে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বুয়েট কিংবা অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু হয়েছে বেশ কিছু মানসম্মত স্থাপত্য অনুষদ।
যাঁদের প্রকৌশলীর মন আছে, আবার আঁকাআঁকিরও শখ আছে, তাঁদের বলব স্থাপত্যবিদ্যায় পড়তে আসতে। শুধু আঁকতে চাইলে চারুকলায় পড়া ভালো। আর যাঁর দুটি মাধ্যমেই আগ্রহ আছে, তিনি স্থাপত্যবিদ্যায় ভালো করবেন। স্থাপত্য এমন একটি জায়গা যেখানে নিজের সৃষ্টিশীলতা খুবই ভালোভাবে প্রকাশ করা যায়। ভালো আঁকতে তো পারতেই হবে, তার পরও সবকিছু নিজের মতো করে দেখতে জানতে হবে। যেকোনো কিছুকেই দেখতে হবে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। তাহলেই সৃষ্টিশীলতার জায়গাটির উন্নতি হবে।
স্থাপত্যবিদ্যার সবখানে বিজ্ঞান ও শিল্পের সমাহার। একজন শিক্ষার্থীকে দুটি ক্ষেত্রেই দক্ষ হতে হয়। এখানে পড়তে এসে যদি কেউ আনন্দ পায়, তাহলে তাকে কেউ থামাতে পারবে না। এখানে পড়তে এটি জীবিকার বাহন হিসেবেও কাজ করবে, আবার মনের তৃপ্তিও মেটাতে পারবে।
সামসুল ওয়ারেস: বিশিষ্ট স্থপতি ও স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষক। তিনি ১৯৭২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অধ্যাপনা করেছেন। তাঁকে বাংলাদেশের আবাসিক ভবনের নকশা প্রণয়নের (১৯৮৪-২০০০) ক্ষেত্রে অগ্রণী স্থপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া তাঁর অন্যতম কাজের মধ্যে রয়েছে: শিশু পার্ক (শাহবাগ), বোটানিক্যাল গার্ডেন (মিরপুর), লাইভস্টক রিসার্স ইনস্টিটিউট (সাভার) প্রভৃতি।
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত
সামসুল ওয়ারেস | তারিখ: ২৯-০৯-২০১০
No comments:
Post a Comment