Friday, October 15, 2010

প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন না বিধ্বস্ত মারিও

আন্দালিব রাশদী | তারিখ: ১৫-১০-২০১০

অখ্যাত কবিদেরও প্রেসিডেন্ট হওয়ার নজির আছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদে খ্যাতিমান কোনো ঔপন্যাসিককে পাওয়া যায়নি। সম্ভাবনা ছিল মারিও বার্গাস য়োসার। প্রথম দফায় এগিয়েও ছিলেন, কিন্তু কংগ্রেসে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত না হওয়ায় দ্বিতীয় দফার আশ্রয় নিতে হলো—ততক্ষণে গণেশ উল্টে গেছে। ১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্সিয়া যখন ব্যাংক জাতীয়করণের ঘোষণা দিলেন, তিনি মনে করলেন, সিদ্ধান্তটি রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী। রাজধানী লিমার কেন্দ্রস্থলে ‘মিটিং ফর ফ্রিডম’-এর ব্যানারে জাতীয়করণের বিরোধিতা করে কড়া বক্তৃতা দিলেন য়োসা। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশ্য রাজনৈতিক ভাষণ। তিনি ব্যবসায়ীদের সমর্থন পেলেন, ডানপন্থী দলগুলো সহানুভূতি জানাল। একসময় তিনিই হয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ‘ন্যাচারাল ক্যান্ডিডেট’। বাদ সাধেন ওক্তাবিও পাজ, বিশ্বখ্যাত একজন কবি এবং বার্গাস য়োসার শুভানুধ্যায়ী। লেখকদের অনেকেই পাজকে সমর্থন করলেন। ঔপন্যাসিকের কাজ উপন্যাস রচনা করা, পদের জন্য দৌড়ানো নয়। কয়েক বছর আগে তিনিই রাজনীতিকে বলেছেন ‘অত্যন্ত নোংরা একটি ব্যবসা’। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তাঁকে বলা হলো, আপনি তো মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস ও লেনিনের পাঠ নিয়েছেন। আপনি তো ফিদেল কাস্ত্রোর ভক্তও ছিলেন, সরে এলেন কেন? বার্গাস য়োসা বললেন, ফিদেলই একসময় ছিলেন প্রগতির পথ। এখন তিনি ডাইনোসর হয়ে গেছেন।

অনেক এগিয়ে আছেন বার্গাস য়োসা
১৬ মার্চ ১৯৯০ জনমত জরিপে অনেক এগিয়ে আছেন ঔপন্যাসিক, রাজনীতিবিদ মারিও বার্গাস য়োসা। চতুর্মুখী লড়াইয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ সমর্থন তাঁর জন্য। উল্লেখ্য, তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। ইতিমধ্যে ব্রাজিলের মুক্তবাজারপন্থী নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। তিনি বরাবরই নিকারাগুয়ার গ্রান্দানিস্তার বিরোধিতা করে এসেছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ভায়োলেটাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, মাথাপিছু আয়ের হিসাবে ৩০ বছর আগে লাতিন আমেরিকায় পেরুর অবস্থান ছিল অষ্টম। দারিদ্র্যের কশাঘাতে এখন চতুর্দশ। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস পেরুর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচকমণ্ডলী মনে করে, বার্গাস য়োসা, বাজারপন্থী এই আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব আগামী দিনে পেরুর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।
এদিকে মাওবাদী উগ্র সন্ত্রাসী দল শাইনিং পাথের গেরিলারা তাঁকে নির্বাচন থেকে হটানোর জন্য চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বার্গাস য়োসা বরাবরই এ ধরনের উগ্র কট্টরপন্থীদের বিরোধিতা করে আসছেন।

য়োসার দখলে প্রথম স্থান
৮ এপ্রিল ১৯৯০ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ভোট জালিয়াতিসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রেসিডেন্ট পদের প্রধান চারজন প্রার্থীর মধ্যে ৫৪ বছর বয়সী ঔপন্যাসিক বার্গাস য়োসা প্রথম রাউন্ডের ভোটের ফলাফল অনুযায়ী প্রথম স্থানে রয়েছেন। তিনি প্রদত্ত ভোটের ৩১ শতাংশ পেয়েছেন। আকস্মিকভাবে ২৫ শতাংশ সমর্থন পেয়ে কৃষি-প্রকৌশলী ফুজিমোরি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। তৃতীয় স্থানে আছেন লুই আলভা কাস্ত্রো।
১৯৮৫-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রানারআপ প্রার্থী, পরাজয় মেনে নেওয়ায় দ্বিতীয় রাউন্ড নির্বাচনের আর প্রয়োজন হয়নি। তখনই বর্তমান প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্সিয়াকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়।
পেরুর পাঁচটি প্রদেশে শাইনিং পাথ সশস্ত্র হরতাল ঘোষণা করায় সেসব এলাকায় ভোটারদের উপস্থিতি অনেক কম ছিল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী আক্রমণে ৬৫ জন জখম হয়েছে।
মাত্র দুই মাস আগেও যে ফুজিমোরির কোনো জনসমর্থন ছিল না, তাঁর পক্ষে এত ভোট পড়ায় অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। মারিও বার্গাস য়োসার সমর্থকেরা ফুজিমোরির সমর্থকদের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন।

সম্ভাবনা কমে আসছে
১৫ এপ্রিল, ১৯৯০ জাপানি বংশোদ্ভূত পেরুভিয়ান ফুজিমোরি পরাজয় মেনে নেবেন না, দেশকে দ্বিতীয় রাউন্ড নির্বাচনে যেতে হবে তা নিশ্চিত হয়েছে। প্রথম রাউন্ডের প্রথম স্থান অধিকারী বার্গাস য়োসার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়েছে—তিনি বাদামিদের সঙ্গে নেই, তাঁকে ঘিরে আছে সাদা ও ধনীরা। তাঁর সমর্থন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। জনরব আছে, বার্গাস য়োসা নিজেই নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার জন্য পদত্যাগপত্র তৈরি করেছেন।

ফুজিমোরি প্রেসিডেন্ট
১০ জুন, ২০১০ জাপানি এক অভিবাসীর সন্তান আলবার্তো ফুজিমোরি উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে ঔপন্যাসিক মারিও বার্গাস য়োসাকে পরাজিত করে পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ফুজিমোরি বামপন্থীদের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন। ৫৪ বছর বয়সী ঔপন্যাসিক ফল ঘোষণার পরপরই ফুজিমোরির নির্বাচন সদর দপ্তরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন, তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং পেরুর জনগণ তাঁকে যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে, সে দায়িত্ব পালনে তাঁর সাফল্য কামনা করেছেন।

য়োসা কেন হারলেন?
তিন বছর পর প্রকাশিত আংশিক আত্মজীবনী এ ফিশ ইন দ্য ওয়াটার-এ তিনি লিখেছেন: রাজনৈতিক আদর্শবাদের উল্টো পিঠে রয়েছে জালিয়াতি, যড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা। উপলব্ধি: পেরু একটি ঘৃণা ও বিদ্বেষে পূর্ণ দেশ। সততার সঙ্গে, সরল বিশ্বাসে নির্বাচন প্রচারে যা বলেছেন, তা-ই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। এই বইয়ে একজন ঔপন্যাসিকের রাজনীতিতে যোগদান এবং নির্বাচন করাকে মারাত্মক ভুল বলে স্বীকার করেছেন তিনি। আবার রাজনীতিতে ফিরবেন? কখনো না।

অতঃপর আলবার্তো ফুজিমোরি ও বার্গাস য়োসা
ফুজিমোরি
ক্ষমতা গ্রহণের অল্পকাল পরই সংসদ অকার্যকর করে প্রেসিডেন্ট ফুজিমোরি একনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অপশাসন ও দুর্নীতি তাঁর পতন ডেকে আনে। তিনি জাপানে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে এক গোপনীয় সফরের সময় চিলির একটি এয়ারপোর্টে গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে পেরুর কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি এখন কারারুদ্ধ।
বার্গাস য়োসা
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ঠিক তিন দিন পর তিনি প্যারিসে চলে যান। আবার ঢুকে পড়েন বইপত্র ও লেখালেখির জগতে। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের অন্যতম স্তম্ভ মারিও বার্গাস য়োসার নাম অনেক দিন ধরে নোবেল পুরস্কারের জন্য আলোচিত হয়ে আসছে।
৭ অক্টোবর ২০১০ তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। তিনি এখন নোবেল লরিয়েট।

No comments: