মূলত সামরিক ট্রেনিংয়ের কাজে ব্যবহূত হওয়া দ্বীপটিতে আজ অন্য রকম একটা আমেজ। লেগুনের নীল জলরাশি ওপর থেকে বরাবরের মতোই শান্ত।
কিন্তু সমুদ্রের তলদেশে এক বিরাট দক্ষযজ্ঞ। মালদ্বীপের মন্ত্রিসভার ১৪ সদস্যের ১১ জনই সেখানে অংশ নিচ্ছেন এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে। সবার পরনে স্কুবা ডাইভিং গিয়ার। প্রত্যেকের সঙ্গে একজন ডাইভিং ইনস্ট্রাক্টর ও একজন নিরাপত্তারক্ষী। ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট মাছ। আর গভীর সমুদ্রের দিকে মুখ করে আছে হার্পুন হাতে একদল হাঙরশিকারি। আছেন টেলিভিশন ও বিভিন্ন মাধ্যমের সাংবাদিকেরা। আধঘণ্টা ধরে চলল মন্ত্রিসভার বিশেষ মিটিং।
সারা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখল বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরুদ্ধে এক অভিনব প্রতিবাদ।
পেছনের কথা
ধনী দেশগুলোতে বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। কলকারখানা আর যন্ত্রদানবগুলো ক্রমাগত উদিগরণ করে যাচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সিএফসিসহ নানা ক্ষতিকর গ্যাস। বেড়েই চলেছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। গলছে মেরুর বরফ। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে অপেক্ষাকৃত নিচু দেশগুলো। আর এই হুমকির মুখে সবার আগে দাঁড়িয়ে আছে মালদ্বীপ। কারণ আয়তন ও জনসংখ্যায় এশিয়ার সবচেয়ে ছোট এ দেশটি উচ্চতার দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু দেশ। চার ফুট ১১ ইঞ্চি গড় উচ্চতার এ দেশে সবচেয়ে উঁচু জায়গাটির উচ্চতা মাত্র সাত ফুট সাত ইঞ্চি। বিজ্ঞানীদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে প্রতিবছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে গড়ে সাত থেকে ২৪ ইঞ্চি করে। দেশের ৮০ শতাংশ এলাকার উচ্চতা তিন ফুটেরও কম। এ রকম অর্ধশত দ্বীপ এর মধ্যেই পানির নিচে হারিয়ে যেতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশটি পুরোপুরি পানির নিচে চলে যাবে ২১০০ সালের মধ্যে। হারিয়ে যাবে ১১৯০টি কোরাল দ্বীপ ও ২৬টি অ্যাটলের (চেইন অব কোরাল আইল্যান্ড) সমন্বয়ে গড়ে ওঠা দ্বীপদেশটি। মালদ্বীপের সাড়ে তিন লাখ মানুষ হবে গৃহহীন। মালদ্বীপ তখন থাকবে ইতিহাসের পাতায়। আর দেখতে চাইলে সোজা সমুদ্রে নামতে হবে স্কুবা ডাইভিং গিয়ার পিঠে চড়িয়ে।
কোয়েটা থেকে কোপেনহেগেন
বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিরোধে ১৯৯৭ সালে হওয়া কোয়েটা চুক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে ২০১২ সালে। কিন্তু ধনী দেশগুলো সে চুক্তি খুব একটা মানেনি। আগামী ডিসেম্বরে কোপেনহেগেনে বসতে যাচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে জাতিসংঘের বৈঠক। কিন্তু মালদ্বীপ সে আয়োজনে অংশ নিচ্ছে না।
মালদ্বীপের তরুণ পরিবেশবাদী রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ নাশিদ বলেছেন, ‘কোপেনহেগেন গিয়ে মন্ত্রিসভার থাকা-খাওয়ার বিলাসিতা করার মতো টাকা এ মুহূর্তে মালদ্বীপের নেই। সে কারণেই সাগরতলে এই বৈঠক। আমাদের এখন সাড়ে তিন লাখ মানুষের থাকার জায়গা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। যদি এখনই কেউ কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তবে মালদ্বীপ অচিরেই ডুবে যাবে। আর সে ক্ষেত্রে আমাদের মাথা গোঁজার জন্য একট জায়গা দরকার হবে।’
নাশিদের মতে, পরিবেশবিষয়ক বৈঠকগুলোতে যা হয়, তা নিতান্তই শিশুতোষ। সেখানে কাজের কাজ কিছুই হয় না। বড় বড় দেশ শুধু একে অপরকে দোষারোপ করে পরিবেশ নষ্ট করার জন্য। সেটা বন্ধ করতে কাজের কাজ কিছু করে না।
মালদ্বীপের দাবি, কোয়েটা চুক্তি বাতিল করে কোপেনহেগেনে নতুন করে আরও কঠোরভাবে একটা চুক্তি করা হোক।
বৈঠকের প্রস্তুতি
মাত্র ১০ মাস আগে ক্ষমতায় এসেই তোলপাড় তুলে দিয়েছেন মালদ্বীপের তরুণ রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ নাশিদ। তিনি জনগণকে কথা দিয়েছেন, তাঁদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। একান্তই যদি না পারেন, তাহলে সাড়ে তিন লাখ মানুষের জন্য নতুন ভূখণ্ডের ব্যবস্থা করবেন।
বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রতিবাদে সাগরতলে মন্ত্রিসভার এ বৈঠকের চিন্তা প্রথমে আসে তাঁর মাথাতেই। শুরু হয়ে যায় তোড়জোড়। কিন্তু সমস্যা হলো স্কুবা ডাইভিং গিয়ার চালানোর সনদপত্র না থাকলে মালদ্বীপে স্কুবা ডাইভিং করা যায় না। নাশিদ নিজে চৌকস স্কুবা ডাইভার।
কিন্তু মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে এক নিরাপত্তারক্ষামন্ত্রী ছাড়া আর কারোরই স্কুবা ডাইভিংয়ের অভিজ্ঞতা নেই। সুতরাং শুরু হয়ে গেল প্রশিক্ষণ। দীর্ঘ দুই মাস মন্ত্রিসভার ১৪ জন মন্ত্রীকে স্কুবা ডাইভিংয়ের কলাকৌশল শেখালেন ডাইভারস অ্যাসোসিয়েশন অব মালদ্বীপের ইনস্ট্রাক্টররা। তাঁদের মতে, মন্ত্রীরা স্কুবা ডাইভিংয়ের খুবই মনোযোগী ছাত্র। সমস্যা হলো, দুর্বল হূিপণ্ডের কারণে দুই মন্ত্রীকে চিকিত্সক অনুমতি দিলেন না স্কুবা ডাইভিংয়ের। পরবর্তী সময়ে আরও এক মন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় মন্ত্রিসভার মিটিংয়ে যোগ দিতে পারেননি।
মিটিংয়ের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হলো গিরিফুশা লেগুনের তলা। এই দ্বীপেই সামরিক জওয়ানদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। লেগুনের আশপাশে হাঙর থাকলেও তারা বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। মানুষের ওপর খুব একটা হামলা চালায় না। এর পরও নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকল ষোলআনা। সাগরের নিচে বালির ওপরে বসানো হলো পানিতে ক্ষতি হবে না এমন বিশেষ চেয়ার-টেবিল। জড়ো করা হলো সাদা বোর্ড ও বিশেষ ধরনের কলম। পানিতে যার লেখা মুছে যায় না।
২০ ফুট নিচে
সকাল ১০টা বাজতেই মন্ত্রীরা নেমে এলেন গিরিফুশা লেগুনের ২০ ফুট নিচে। কথা ছিল মিটিংয়ে বসে হাতের ইশারা ও মাইক্রোফোন দিয়ে কথা বলবেন মন্ত্রীরা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাদ দেওয়া হলো মাইক্রোফোন। প্রত্যেক চেয়ারের সামনে মন্ত্রীদের নাম ও পদবি লেখা ছোট বোর্ড। সবাই একে একে নির্ধারিত আসনে বসলেন। শুরু হলো সভা। সাগরতলায় বলে কেতাদুরস্তেও কমতি নেই এতটুকু। সেই আদিম যুগের মতো হাতের ইশারায় ভাব বিনিময় করলেন সবাই। একান্তই সমস্যা হলে ছিল সাদা বোর্ড। সেখানে লিখেও নিজের কথা বুঝিয়েছেন মন্ত্রীরা। এ সময় সাঁতার কেটে যাওয়া ছোট ছোট সামুদ্রিক মাছ মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে সবার।
হাতের ইশারাতে ও লিখে মনের ভাব প্রকাশের সুযোগ সীমিত। বৈঠকে তাই আলোচনাও হয়েছে সীমিত পরিসরে। বৈশ্বিক উষ্ণতাই ছিল একমাত্র আলোচ্য বিষয়। সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি হয়নি খুব একটা। আধঘণ্টার মধ্যেই বৈঠক শেষ। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্বনেতাদের অনুরোধ জানানো হবে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের নির্গমন কমানোর জন্য। সিদ্ধান্ত একটি বিশেষ বোর্ডে লেখা হয় অমোচনীয় কালি দিয়ে। মালদ্বীপের সেই বৈঠকে অংশ না নিলেও বোর্ডটি পাঠানো হবে ডিসেম্বরে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সম্মেলনে।
বৈঠক শেষে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভা নিয়ে বসলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে, সাগরতলাতেই। এক মন্ত্রী অনুভূতি জানাতে গিয়ে বললেন, তাঁর মনে হচ্ছিল, বিশাল এক অ্যাকুয়ারিয়ামে বসে তিনি মিটিং করছিলেন। ভয়ে ছিলেন কখন না আবার হাঙর এসে পড়ে। তবে নৌবাহিনীর ওপর যথেষ্ট আস্থা ছিল তাঁর। শঙ্কাটা তাই খুব একটা বাড়েনি। মোহাম্মদ নাশিদ বললেন, ‘এটা একটা প্রতিবাদ। সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যে আমরা কতটা হুমকির মধ্যে আছি। ধনী দেশগুলো যদি মনে করে থাকে যে এটা তাদের না, আমাদের সমস্যা। তবে তারা ভুল করবে। আজ যদি মালদ্বীপ সাগরের পানিতে হারিয়ে যায়। তবে নিউইয়র্ক, প্যারিস, হংকংও একদিন না একদিন ঠিকই পানির নিচে চলে যাবে।’
না, মোহাম্মদ নাশিদ কোনো গল্প বলেননি। বৈশ্বিক উষ্ণতার হুমকির মুখে এটাই সত্য। মালদ্বীপসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ এখন তাকিয়ে আছে ধনী দেশগুলোর প্রতি। কী করবে তারা এখন? তাহলে কি অপূর্ব সুন্দর এ দেশটি হারিয়েই যাবে সাগরতলে? আমরা কি সেটা হতে দেব?
পার্থ সরকার | তারিখ: ২৩-১০-২০০৯
No comments:
Post a Comment