Tuesday, October 5, 2010

জীবন-সংগ্রামের ছবিওয়ালা

জীবন-সংগ্রামের ছবিওয়ালা

জীবন-সংগ্রামের ছবিওয়ালা

গায়ে একটা চাদর, পরনে ফতুয়া, একমুখ দাড়ি। লোকটিকে দেখলে প্রথম দর্শনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আসা কবিদের একজন মনে হয়। কেউ আবার নিবিষ্ট মনে ছবি আঁকিয়েদের একজন বলেই ভাবতে পারেন তাঁকে।
তিনি কবি, তিনি ছবি আঁকেন। তবে আমাদের চেনা কবিতা লেখেন না, চেনা ছবি আঁকেন না। তিনি প্রকৃতির হাতে বিপন্ন মানুষদের নিয়ে সংবাদপত্রে নিবন্ধ লেখেন; কবিতার মতো শক্তিশালী নিবন্ধ। তিনি প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের ছবি আঁকেন, ক্যামেরায় আঁকা ছবি। তিনি জোনাথন বিজার্গ মোলার।
ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের শহরতলির তিরিশোর্ধ্ব এ যুবক সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রকৃতির পরিবর্তন ও তার প্রভাব নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক আলোচনায় পরিণত হয়ে গেছেন। তবে নিজে খ্যাতির ধার ধারেন না। হেসে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ ও এখানকার লোকজনের লড়াইয়ের প্রেমে পড়ে গেছি।’
জোনাথনের এ লড়াইটা শুরু হয়েছে গত বছর। ডেনমার্কের পলিটিক্যান পত্রিকার হয়ে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে কাজ করতে এসেছিলেন বাংলাদেশে। উদ্দেশ্য ছিল, দেশটিতে জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে লেখা এবং ছবি তোলা। সে কাজ জোনাথন করলেন। কিন্তু এরই মাঝে আবিষ্কার করে ফেললেন উপকূলীয় এ দেশটির হাজারো মানুষের সংগ্রামী এক চরিত্র। সুযোগটা করে দিল আইলা।
সাতক্ষীরা থেকে নোয়াখালী, বরগুনা থেকে বরিশাল—পুরো উপকূল চষে বেড়াচ্ছিলেন জোনাথন। এর মধ্যেই মে মাসে বাংলাদেশে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। সঙ্গে সঙ্গে জোনাথন ছুটে যান উপদ্রুত উপকূলে। তাঁবু খাটিয়ে টানা নয় দিন ভাঙা বেড়িবাঁধে থাকেন। মাটি দিয়ে পানির সঙ্গে উপকূলবাসীর যুদ্ধ আলোকচিত্রে বন্দী করেন।
জুনের প্রথম সপ্তাহে জোনাথন যখন ঢাকায় ফিরলেন, তাঁকে দেখে আর সেই কবি-শিল্পীকে খুঁজে পাওয়া ভার! গলায় গামছা জড়ানো, সারা শরীরে কাদা লেগে আছে! বিস্মিত দৃষ্টির জবাবে জোনাথন তাঁর স্বভাবজাত মিষ্টি হেসে বললেন, ‘তোমাদের উপকূলবাসীর লড়াইয়ের সুভ্যেনির সারা শরীরে মেখে নিয়ে এসেছি।’
ওই হাসতে হাসতেই বললেন, ‘কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জানতাম, বাংলাদেশ দুর্যোগে বিপর্যস্ত একটা দেশ। এবার নিজের চোখে দেখলাম, দেশটার লোকজন সেই দুর্যোগের বিপক্ষে লড়তে জানে।’
এ লড়াই দেখার পর জোনাথনের মন বদলে গেছে। এখন তাঁর মনে হচ্ছে, ভুল বিষয় ঠিক করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশে তাঁর ছবি তোলার বিষয়টা হওয়া উচিত ছিল ‘উপকূলবাসীর লড়াই’। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর দুর্যোগ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের উপকূলবাসী কীভাবে টিকে আছে।
জোনাথনের সঙ্গে আবার দেখা কয়েক মাস পর কোপেনহেগেনে। জোনাথন তখন তাঁর ছবি ও লেখা দিয়ে বিরাট খ্যাতি পেয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর মন কেন যেন অশান্ত জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘রাতে ঘুম হয় না। চোখ বুজলেই তোমাদের লড়াকু লোকগুলোর জীবন-সংগ্রাম দেখতে পাই।’
জোনাথন চোখ বুজে দেখতে পান মাটি ও বাঁশ দিয়ে পানির স্রোতের সঙ্গে মানুষের লড়াই। দেখতে পান প্রকৃতির দুর্দান্ত রোষের মুখেও ভেঙে না পড়া মানুষের লড়াই। সেই লড়াইয়ের টানেই আবার বাংলাদেশে ফিরেছেন জোনাথন।
পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে ইউরোপের প্রায় সব দেশে ঘুরেছেন, ঘুরেছেন ভারত-নেপালে। কিন্তু সব দেশ তাঁর কাছে গৌণ হয়ে গেছে। বাকিটা জীবন নাকি বাংলাদেশের মানুষকে ক্যামেরায় বন্দী করে কাটিয়ে দিতে চান! চান তিনি এ দেশের লড়াইয়ের ছবি আঁকতে।
সেই উদ্দেশ্য নিয়ে আবার ঢাকায় এসেছেন জোনাথন। এ শহরের ভাসমান মানুষ, কমলাপুর রেলস্টেশনের মানুষের স্রোতের ছবি তুলবেন। ছবি তুলবেন বিশ্ব ইজতেমার। সবচেয়ে বেশি করে তুলবেন লড়াইয়ের ছবি। 
 
 সুত্র: প্রথম আলো। | তারিখ: ২২-০১-২০১০

No comments: