Tuesday, October 19, 2010

নোবেল পুরস্কারের আদ্যোপান্ত


পাহাড় দেখোনি, এমন কাউকে তো খুঁজেই পাওয়া যাবেনা। পাহাড়ের মাঝের সুড়ঙ্গ হয়তো দেখোনি অনেকেই। কিন্তু শুনেছো নিশ্চয়ই, অনেক দেশেই পাহাড়ের মাঝে আছে সুড়ঙ্গ। আর সেই সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে চলে যায় রেলগাড়ি। পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করা কিন্তু এতো সহজ নয়। তবুও মানুষ সে কাজ করে চলেছে খুব সহজে। কীভাবে বলো তো? এর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ডিনামাইট। ডিনামাইট হচ্ছে খুবই শক্তিশালী এক বিস্ফোরক। যেকোনো বড় সড় পাহাড় মুহূর্তে ধ্বংস করার জন্য ডিনামাইটের বিকল্প নেই। এর আবিষ্কারের আগে পাহাড় বা বড়ো পাথর সরিয়ে কাজ করার প্রয়োজন হলেও মানুষ সহজে তা করতে পারতো না। কিন্তু ডিনামাইট আবিষ্কার হওয়ার পর এরকম সব কাজ পানির মতো সহজ হয়ে গেল। কে তবে আবিষ্কার করেন এই ডিনামাইট? তার নাম আলফ্রেড নোবেল। একাধারে রসায়নবিদ,  প্রকৌশলি আলফ্রেড নোবেলের মোট আবিষ্কারের সংখ্যা ৩৫৫, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার ডিনামাইট। এতো বিশাল সংখ্যক আবিষ্কার করে প্রচুর টাকা রোজগার করেন সুইডেনে জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানী। সেই টাকা দিয়েই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরষ্কার ‘নোবেল পুরষ্কার’।

নোবেল পুরষ্কার প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্পটা বেশ মজার। আলফ্রেড নোবেলের অধিকাংশ আবিষ্কারই ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। ডিনামাইট বা অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র যেমন মানুষের কল্যানের কাজে ব্যাবহৃত হয়, তেমনি ব্যবহৃত হয় ধ্বংসাত্বক কাজেও। সে কারনে অনেক নিন্দা জোটে আলফ্রেড নোবেলের কপালে। ১৮৮৮ সালে আলফ্রেডের ভাই লুডভিগ ফ্রান্সে ঘুরতে গিয়ে মারা যান। এক ফ্রেঞ্চ পত্রিকা ভুলে ধরে নেয় আলফ্রেড নোবেলই মারা গেছেন। সেই পত্রিকা তখন আলফ্রেডের মৃত্যুর সংবাদ ছাপে। সেখানে তারা আলফ্রেডেকে বর্ণনা করে ‘মৃত্যুর সওদাগর’ বলে। আলফ্রেড মানুষ হত্যার বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করে প্রচুর টাকা উপার্জন করেছেন, কিন্তু সেই টাকা পুরো মানব জাতির কল্যানের কোনো কাজে ব্যয় করেননি বলে তার প্রচন্ড নিন্দা করে। পত্রিকার এই লেখাটি আলফ্রেড নোবেল নিজে পড়েন। পড়া শেষে তিনি বেশ কষ্ট পান। অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন তাঁর উপার্জিত অর্থ মানব কল্যানের কাজে ব্যয় করবেন। এরপর ১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসে আলফ্রেড নোবেল তার মোট উপার্জনের ৯৪% (৩ কোটি সুইডিশ ক্রোনার) দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নোবেল পুরষ্কার।
নোবেল পুরষ্কারের মূল লক্ষ্য মানব কল্যানের জন্য কোনো কাজকে উৎসাহিত করা। সেই উদ্দেশ্যে নোবেল তার রেখে যাওয়া সম্পদ হতে উপার্জিত অর্থ ৫ ভাগ করে পুরষ্কার হিসেবে দান করার কথা বলে যান তার উইলে। এই পাঁচ ভাগ পাবে সমান অংশে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, সাহিত্য এবং শান্তিতে অসাধারন অবদান রাখা ব্যাক্তি বা ব্যক্তি বর্গ। পরবর্তীতে, ১৯৬৮ সালে সুইডিশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রিক্সব্যাঙ্কেন তাদের ৩০০ বছর পূর্তিতে আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতিকে স্মরণ করে অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখা ব্যাক্তিদের জন্যও নতুন একটি পুরষ্কার ঘোষনা করে। এই পুরষ্কারের দায়িত্বও দেওয়া হয় নোবেল ফাউন্ডেশনকে এবং এর বিজয়ী নির্বাচনের ভার থাকে রয়েল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস এর উপর। তখন থেকেই এই পুরষ্কারকে অর্থনীতির নোবেল পুরষ্কারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়; যদিও এই পুরষ্কারের অর্থের যোগান দেয় রিক্সব্যাঙ্কেন।

আলফ্রেড নোবেল উইলে সাক্ষর করেন ১৮৯৫ সালে, কিন্তু পুরষ্কার ঘোষণার সার্বিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এই উইল বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পিত হয় রাগনার সোহলমান এবং রুডলফ লিলিযেকুইস্ট নামের দুই ভদ্রলোকের উপর। ১৮৯৭ সালে আইনসভায় নোবেলের উইল পাস হওয়ার পর এই দুই ভদ্রলোক গঠন করেন নোবেল ফাউন্ডেশন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নোবেল ফাউন্ডেশন থেকে পুরষ্কার দেওয়া হলেও এই ফাউন্ডেশন নোবেল পুরষ্কারের বিজয়ী নির্বাচন করে না। এই ফাউন্ডেশনের মুল কাজ হলো নোবেলের রেখে যাওয়া অর্থের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন করা এবং নোবেল পুরষ্কারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা করা। পুরষ্কার ঘোষনার দায়িত্ব নোবেল ভাগ করে দিয়ে যান তার উইলে। পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়ন এর পুরষ্কার ঘোষনা করার দায়িত্ব দেন রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সকে। চিকিৎসা শাস্ত্রের পুরষ্কার দেওয়ার দায়িত্ব দেন ক্যারোলিন্সকা ইন্সটিটিউটকে। সুইডিশ একাডেমি কে দায়িত্ব দেন সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী ঘোষনা করার দায়িত্ব। আর শান্তি পুরষ্কার ঘোষনার দায়িত্ব দেন নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটিকে। এখানে আরেকটা মজার ব্যাপার আছে। তা হলো, যে সময় নোবেল পুরষ্কার প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন সুইডেন ও নরওয়ে ছিলো একসঙ্গে যা পরবর্তীতে ভেঙ্গে যায়। ফলে নোবেল পুরষ্কার ঘোষনার দায়িত্ব ভাগ হয়ে যায় দুই দেশের মধ্যে।

নোবেল ফাউন্ডেশন গঠনের পর পরই আলফ্রেড নোবেল পুরষ্কার ঘোষণার জন্য যেই প্রতিষ্ঠান গুলো ঠিক করে দিয়ে যান, সেই প্রতিষ্ঠান গুলো গঠন করে নোবেল কমিটি। এই নোবেল কমিটি গুলোই ঘোষণা করে পুরষ্কার। পুরষ্কার ঘোষণার জন্য প্রত্যেক বছর সেপ্টেম্বর মাসে নোবেল কমিটি গুলো মনোনয়ন আহবান করে। সেই মনোনয়ন পরের বছর জানুয়ারীর মধ্যে জমা করতে হয়। অতঃপর সেই মনোনয়ন থেকে সংক্ষিপ্ত তালিকা গঠন করা হয়। সেই তালিকার উপর কমিটির সদস্যদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয় নোবেল পুরষ্কার। প্রত্যেক বছর নোবেল পুরষ্কার ঘোষণা করা হয় অক্টোবর মাসে। অর্থাৎ এক বছরেও বেশী সময় ধরে চলে এই পুরষ্কারের বিজয়ী নির্বাচন করার প্রক্রিয়া।

১৯০০ সালের নোবেল পুরষ্কার ঘোষণার কিছু নিয়ম নির্ধারন করা হয়। সেই নিয়ম অনুসারে প্রত্যেক নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা, একটি গোল্ড মেডেল এবং একটি সার্টিফিকেট পেয়ে থাকে। এই অর্থের পরিমান নির্ভর করে নোবেল ফাউন্ডেশনের আয় এর উপর। যদি একাধিক ব্যাক্তি একই ক্ষেত্রে পুরষ্কারের জন্য নির্বাচিত হন, তাহলে তাদেরকে এই ভাগ করে দেয়া হয়। শুধু মাত্র শান্তি পুরষ্কারের জন্য কোনো ব্যাক্তির বাইরে কোন প্রতিষ্ঠানকেও নির্বাচন করা যায়। 

এই সব নিয়ম কানুন ঠিক করে প্রথম পুরষ্কার ঘোষণা করা হয় ১৯০১ সালে- আলফ্রেড নোবেলের উইল স্বাক্ষরের ৫ বছর পর। পদার্থ বিজ্ঞানে পুরষ্কার পান জার্মান বিজ্ঞানী রন্টজেণ্ট। এক্স-রে আবিষ্কার করার স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরষ্কার পান তিনি। রসায়নে অনবদ্য অবদান রাখায় জ্যকব হান্ট হফ নোবেল পান সেই বছর। ডিপথেরিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কার করে চিকিৎসায় নোবেল পান এমিল বেরিং। সাহিত্যে নোবেল দেওয়া হয় সুলি ফরুডহোমকে। শান্তিতে যুগ্ম ভাবে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন ফরাসী নাগরিক ফেডেরিক পুসি এবং রেড ক্রসের প্রতিষ্ঠাতা জীন হেনরী ডুনান্ট। আর এভাবেই পথ চলা শুরু করে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরষ্কার- নোবেল পুরষ্কার।

সৌরভ ওয়াহেদ 
বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম/সৌরভ/এসএ/সাগর/অক্টোবর ১৪/১০
মুল লেখা পড়ুন:
http://kidz.bdnews24.com/bishesh_rochona.php?bisheshrochonaid=125

No comments: