Tuesday, October 12, 2010

বৃষ্টি-বাদলের বিয়ে

বাদ্য বাজিয়ে বরযাত্রী চলল ট্রাকে করে। দুই কিলোমিটার দূরে পার্শ্ববর্তী মনোহরপুর গ্রাম থেকে ঠাকুর এলেন বিয়ে পড়াতে। বিয়ে পড়িয়ে ঠাকুর ৫০০ টাকা নিয়ে গেলেন। বিয়ে শেষ হলো, পাঁচ শতাধিক বরযাত্রী আবার হইচই করে ফিরে এল। যার যার বাড়ি ফিরল কনেপক্ষের নিমন্ত্রিত লোকজন। সব মিলে বিরাট উত্সব।
নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার পাঁচ গ্রামের অনেক মানুষ এই উত্সব দেখে ধরে নিয়েছিল, এলাকার কোনো প্রভাবশালী পরিবারে বিয়ে হচ্ছে। তা, বিয়ে হলো বইকি। কিন্তু প্রভাবশালী তো দূরে থাক, কোনো মানুষেরই বিয়ে নয়—ব্যাঙের বিয়ে!
আষাঢ় শেষে শ্রাবণ এল তবু বৃষ্টির দেখা নেই। এদিকে আমন ধান রোপণের ভরা মৌসুম পার হয়ে যাচ্ছে। দিশেহারা হয়ে পড়েন গ্রামের কৃষকেরা। এ মৌসুমে গভীর নলকূপ থেকে সেচ দিতে হলে লাভের গুড় পিঁপড়াতেই খাবে। পানি দিতে দিতেই শুকিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে লোডশেডিং তো আছেই।
এমন খরা থেকে মুক্তি পেতে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া কিছু নতুন কাজ না। আশপাশের জেলা, পাশের দেশ তো বটেই, এই রাজশাহীতেও কাজটা আগে হয়েছে। কিন্তু এবারের জাঁকটা বড় বেশি করে দেখল এলাকাবাসী।
নওগাঁ জেলার বাগধানা গ্রামের কৃষক ও পল্লী চিকিত্সক প্রদ্যুত্ কুমার হিসাব করে দেখলেন, এই গ্রামের কৃষকদের যদি গভীর নলকূপ থেকে সেচ দিয়ে এবার আমন আবাদ করতে হয়, তাহলে তাদের যে পরিমাণ ব্যয় হবে, ব্যাঙ বিয়ে দিয়ে সারা গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়ালে তার চেয়ে কম খরচ হবে। যেই কথা সেই কাজ। নিজে সাজলেন কনের বাবা। আর বাগধানা পশ্চিম পাড়ার বিপন কুমার মণ্ডল রাজি হয়ে গেলেন বরের বাবা হতে।
পাড়া-মহল্লায় যুক্তি-পরামর্শ হলো। সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ল। একদিকে বিয়ের আনন্দ হবে, অন্যদিকে বৃষ্টির দেখা মিলবে। এক ঢিলে দুই ঘুঘু। গ্রামে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। বেজে উঠল ঢাকঢোল।
কনের নাম দেওয়া হলো বৃষ্টি আবার বরের নাম দেওয়া হলো বাদল। বৃষ্টি-বাদলের বিয়ে হলো ১৯ জুলাই রাতে। মনোহরপুরের ঠাকুর স্বপন বাবুর ছেলে গোপাল চক্রবর্তী রাজশাহী কলেজে অনার্সে পড়েন। বাবার বদলে এখন তিনিই বিভিন্ন বিয়েতে যাচ্ছেন। শখ করে এলেন তিনিই। গোপাল চক্রবর্তী বলেন, মানুষের বিয়ের মতোই সব আয়োজন করা হয়েছিল। বিয়ে পড়ানোর আগে বর-কনে দুজনকেই স্নান করিয়ে নারায়ণ পূজা করা হয়। তারপর তাদের অধিবাস (দুজনকে মন্ত্র পড়ানো) করানো হয়। সাত পাকে বাঁধা, মন্ত্র পড়া, শাঁখ বাজানো কোনোটিই বাকি ছিল না। অবশ্য ব্যাঙ কতটা মন্ত্র পড়তে পেরেছে তা নিয়ে তর্ক করতে পারেন।
রাত তিনটায় ছিল বিয়ের লগ্ন। ঠাকুর বললেন, শাস্ত্রমতে ব্যাঙের বিয়ের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বৃষ্টি হবে। হয়েছেও তাই। বিয়ে চলাকালেই হালকা বৃষ্টি হয়েছে। পরে আবার রাতে বৃষ্টি হয়েছে।
উপজেলার চৌমাশিয়া গ্রামের রেনুকা পাহান দাওয়াত পেয়েছিলেন ব্যাঙের বিয়ের। রেনুকা বললেন, ‘আমাদের সমপ্রদায়ের অনেক মানুষের বিয়েতে এত বড় আয়োজন করা হয় না। বিয়েবাড়িতে মাছ-ভাত, চা-বিস্কুট, আদর-আপ্যায়ন—কোনো কিছুরই ঘাটতি ছিল না।’ একই ধরনের অনূভূতির কথা বলেন নলোবলো গ্রামের লিটন কুমার মণ্ডল। গ্রামীণ ব্যাংকের মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর শাখার কোষাধ্যক্ষ শ্যামল কুমার প্রামাণিক বলেন, ব্যাঙ বিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের বেশ পুরোনো, কিন্তু ব্যাঙের বিয়ের এত বড় আয়োজন বোধহয় আগে কোথাও হয়নি।
উপজেলার মহেষপুর গ্রামের পল্লী চিকিত্সক ও স্থানীয় সাংবাদিক কাউসার আলী বলেন, তিনি তিন কিলোমিটার দূর থেকে ব্যাঙের বিয়ে দেখতে গেছেন। তিনি বলেন, চার-পাঁচ গ্রামের মানুষের মধ্যে এই বিয়ে নিয়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেছে। তিনি বলেন, তাঁরা আগেও অনাবৃষ্টির সময় ব্যাঙের বিয়ে দেখেছেন কিন্তু বিয়ের এত বড় আয়োজন দেখেননি। কাউসার আলী বলেন, পুরো তিন দিন বাগধানা গ্রামে উত্সব লেগেছিল। মানুষের বিয়ের উত্সবকে ছাড়িয়ে গেছে এই আয়োজন।
মহাদেবপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ফটিক চন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরাও এ ধরনের কাজ করেছেন। আমরা দেখেছি, যখন বিধাতা বিমুখ হন, তখন মানুষ উদ্ভট কাজ করে বিধাতার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। এতে হয়তো কাজও হয়। তবে এত বড় বিয়ের আয়োজন মনে হয় আগে কখনো হয়নি।’
কনের বাবা প্রদ্যুত্ কুমার বলেন, এবার দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ার কারণে তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। যদি বৃষ্টি না হয়, তাহলে ভরা ধানের মৌসুমে তাঁরা ধান চাষ করতে পারবেন না। ফলে এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে, এই ভয়ে তাঁরা ব্যাপক আয়োজন ও ধুমধাম করে ব্যাঙের বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের সিংহভাগ খরচ প্রদ্যুত্ কুমার দিলেও গ্রামের সবাই কমবেশি সহযোগিতা করেছে। যাঁর পুকুর আছে তিনি পুকুরের মাছ দিয়েছেন। যাঁর ঘরে চাল আছে তিনি চাল দিয়েছেন। এ কারণেই এত বড় আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে।
বিয়ের আয়োজন শেষে সত্যিই বৃষ্টি হলো। গ্রামের লোকদের বিশ্বাস, এই ব্যাঙ বিয়ে কারণেই বৃষ্টি হলো। তবে এত বড় বিয়ের আয়োজনের মধ্যে বর-কনে বৃষ্টি-বাদলের কোনো খাওয়া হলো না। তাদের কেউ কিছুই খাওয়াতে পারেনি। পরে বৃষ্টি নামলে বৃষ্টি আর বাদলকে একই পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হলো।
বিয়ের চেয়ে ওদের শান্তি পুকুরেই তো বেশি! 
\
সুত্র: প্রথম আলো।   আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ | তারিখ: ৩১-০৭-২০০৯

No comments: