লি জং ইয়নের মন খুব বিষণ্ন।
বন্ধুর শেষকৃত্য সেরে তিনি ধীরপায়ে বেরিয়ে আসছেন। ইয়নের গতি মন্থর। খালি পায়ে অল্প অল্প চাপ দিয়ে হাঁটছেন। ফটকের কাছাকাছি আসতে তিনি কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন। না, বাইরে মৃত্যুর গুমোট হাওয়া নেই। তাঁর ভালো লাগতে শুরু করেছে। যেন উনি হাঁটা দিয়েছেন জীবনের পথে।
কিন্তু ফটকের বাইরে আসতেই তাঁর চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। তাঁর জুতো কই? তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। নানান সাইজের জুতো, তার কত রং, কত ডিজাইন। কিন্তু এই বৈচিত্র্য দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন না। তাঁর নিজের জুতোজোড়া নেই। তার জায়গায় পড়ে আছে ছেঁড়া দেড়-পাটি চটি।
জুতো হারানোর ব্যথা তিনি সহজে ভুলতে পারলেন না। এই জুতোর জন্য তিনি সুদূর চীনদেশে গিয়েছেন। ওস্তাদ লোকের হাতে করা ডিজাইন। তিনি ফটকের সামনেই হইচই জুড়ে দিলেন।
তদন্ত করে দেখা গেল—ইয়ন একা নন; শেষকৃত্য করতে এসে জুতো হারিয়েছেন—এমন সমব্যথী অনেক। কোরিয়ার সৌজন্য হলো ঘরের বাইরে জুতো খুলে রাখা; বিশেষত শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে জুতো পরে কেউ ভেতরে যান না। বাইরে তখন অগুনতি জুতোর স্তূপ জমে যায়। কে বা কারা এই জুতোর দিকে বদনজর দিচ্ছে। প্রায়ই হাপিশ হয়ে যাচ্ছে চকচকে নতুন জুতো। তার জায়গায় পড়ে আছে বদখত একজোড়া চটি। এই জুতো দেখে পিলে চমকায় না তেমন আদমি খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
সন্ধের দিকে ইয়ন সাধারণত বাড়িতে থাকেন। কাজ তেমন কিছু নয়—চুপচাপ বসে থাকা। হঠাত্ ফোন বাজল। সুসিও পুলিশ স্টেশন থেকে ফোন করেছে। ইয়নের জুতোজোড়া উদ্ধার হয়েছে। ইয়ন এখনই স্টেশনে গেলে জুতোজোড়া সহি-সালামতে ফেরত পেতে পারেন। এই সংবাদে ইয়ন অসামান্য আনন্দ পেলেন। তাড়াহুড়ো করে জামা-জুতো পড়তে গিয়ে প্রায় ঘেমে উঠলেন।
থানার কাছাকাছি আসতেই তাঁর ভয় হতে লাগল। জুতোজোড়া ঠিকঠাক পাবেন তো? নাকি অন্য কারও বাংলা পাঁচের মতো জুতো দেখিয়ে পুলিশ গম্ভীর গলায় বলবে, ‘জুতোজোড়া পরে গটগট করে বাড়ি চলে যান।’
কিন্তু স্টেশনের পেছনে এসে দাঁড়াতেই তাঁর মুখ হাঁ হয়ে গেল। উনি নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলেন। চোখের সামনে হাজার হাজার জুতো গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাঁর কি ইল্যুশন হচ্ছে? জুতোর শোকে হ্যালুসিনেশন বা এ রকম কিছু? উনি হাত দিয়ে চোখ কচলালেন। ঠিকই তো—বাহারি ডিজাইনের অগুনতি জুতো। যেন একটা জুতো-সভা। প্রতিটি জুতো থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে আলো। উনি জুতোর লোভে পড়ে গেলেন।
প্রায় হুড়মুড় করে উনি জুতো-তল্লাশিতে নেমে পড়লেন। কত জোড়া জুতো আছে এখানে? কোনো পুলিশকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে হবে? প্রায় কুড়ি মিনিট খোঁজাখুঁজির পর নিজের জুতো খুঁজে পেলেন তিনি। খুশিতে জুতোজোড়া তিনি বুকে চেপে ধরলেন। তাঁর চোখে প্রায় পানি এসে গেল।
আধঘণ্টা পর ইয়ন পুলিশ সুপারের রুমে বসে চা খাচ্ছেন। তাঁর মনে গাদা গাদা প্রশ্ন। কে তাঁর জুতো চুরি করেছে? সেই চোর ব্যাটা এখন কোথায়? কোত্থেকে এল এত জুতো? অফিসার ঠান্ডা মাথায় সব প্রশ্ন শুনে জবাব দিতে লাগলেন। সব মিলিয়ে যা বোঝা গেল তাতে সংক্ষেপে গল্পটা এ রকম—
চোর ব্যাটাকে ধরতে পুলিশের একটা গোয়েন্দা দল সিমেট্রিতে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। খানিক পরে কালো পোশাক পরিহিত একজন ভদ্রলোক আসেন। সুন্দর পরিপাটি পোশাক, মুখে প্রশান্তির ভাব। কিন্তু তাঁর পায়ে খুবই বেমানান একজোড়া চটি। ভদ্রলোক ফটকের সামনে এসে এদিক-ওদিক ঘুরলেন, যেন কাউকে খুঁজছেন। তারপর ঝটিতে নিজের চটি খুলে উনি দশাসই একজোড়া জুতো পরে নিলেন। তারপর শান্ত পায়ে বেরিয়ে গেলেন।
পুলিশ কিছুটা হতভম্ব। ভদ্রলোক সিনা টানটান করে চলে যাচ্ছেন। যেন জুতো সটকাতে নয়, উনি এসেছিলেন রাষ্ট্রীয় পয়গাম নিয়ে। সংবিত্ ফিরতেই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। কিছু চোটপাট লাগাতেই লোকটা সবকিছু স্বীকার করে ফেললেন। তাঁর নাম পার্ক। মিস্টার পার্ক। একটা পুরোনো জুতোর দোকান আছে তাঁর। তিনি নিয়মিত জুতো সাফাই করেন। এটাই তাঁর পেশা। পুলিশের ধমক খেয়ে নিমরাজি মনে চোরমশাই সবাইকে তাঁর সংগ্রহশালায় নিয়ে গেলেন। নানা জাতের সতেরো শ জোড়া জুতো সেখানে। যেন আলাদিনের গুহা—সেখানে মণি-মুক্তার বদলে থরে থরে সাজানো দুর্লভ দামি জুতো।
জুতো তো উদ্ধার হলো, এখন যাঁর যাঁর জুতো তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া চাই। পুলিশ শহরময় ঢেঁড়া পিটিয়ে দিয়েছে, যাঁরা জুতো হারিয়েছেন তাঁরা যেন নিজের গরজে জুতো খুঁজে নেন। কিন্তু পরিস্থিতি খুব সন্তোষজনক নয়; মাত্র পঁয়ত্রিশ জোড়া জুতো ফেরত দেওয়া গেছে।
সূত্র :প্রথম আলো। পবন চক্রবর্তী | তারিখ: ২৬-০২-২০১০
No comments:
Post a Comment