অসম্ভব মনে হচ্ছে? বেলেভুর অভিধানে ‘অসম্ভব’ নামে কোনো শব্দ হয়তো নয় বছর আগে ছিল। আজ ‘অসম্ভব’ শব্দটি পালিয়ে গেছে।
২০০০ সালে শুরু করা বেলেভুর পায়ে হেঁটে বিশ্বভ্রমণ আয়োজন আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। প্রায় ৮০ শতাংশ পথের সঙ্গে দোস্তি করে প্রায় লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন তিনি। এ কঠিন অভিযাত্রাকে তিনি উত্সর্গ করেছেন বিশ্বের সব শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য, শান্তির জন্য।
বেলেভুর জন্ম কানাডায়। স্বাভাবিক আটপৌরে জীবনটা বেশ চলছিল। চল্লিশের গোড়ায় এসে দেখা দিল ছন্দপতন। ব্যক্তিগত জটিলতায় সিদ্ধান্ত নিলেন, বেরিয়ে আসবেন এই সংকীর্ণ জীবন থেকে। ঘুরে দেখবেন পৃথিবী। বেলেভু কিন্তু নিঃসঙ্গ মানুষ নন। চমত্কার একটি পরিবার আছে তাঁর। তার পরও বেরোতে হবে তাঁকে।
নিজের ৪৫তম জন্মদিনে স্ত্রীকে জানালেন মনের কথা। মনে তখন অনেক ভাবনা-চিন্তা আর হাজারো সংশয় ছিল। বেলেভুকে অবাক করে তাঁর স্ত্রী সম্মতি দিলেন বিশ্বভ্রমণের। শুধু তাই নয়, তিনি বেলেভুকে উত্সাহ দিলেন, এ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে শান্তির বার্তা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে।
শুরুর দিকের আয়োজন নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নেই। সঙ্গে ছিল সামান্য একটি ট্রলিতে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র; যেমন—স্লিপিং ব্যাগ, একটি তাঁবু, কিছু কাপড়চোপড়, সামান্য খাবার, ফার্স্ট এইড বক্স আর তিন হাজার ২১৫ ডলার। এ নিয়েই ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট বিশ্বভ্রমণে রওনা হন তিনি। কানাডার নিজের শহর মন্ট্রিল থেকে রওনা হলেন বিশাল পৃথিবীর পথে। মন্ট্রিল থেকে পথ ঘুরে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর দক্ষিণ আমেরিকার সব দেশ ঘুরে আফ্রিকা। আফ্রিকা পাড়ি দিয়ে ইউরোপ, ইউরোপ হয়ে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্য হয়ে এ বছর বেলেভু শেষ করছেন তাঁর এশিয়া ভ্রমণ। এরপর যাবেন অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে। ২০১১ সালের মধ্যে পৌঁছাতে চান কানাডায়। সব মিলিয়ে ৭৫ হাজার কিলোমিটারের বিশাল পথের তালিকা। ৬৬টি দেশ, পাঁচটি মহাদেশ—পুরোটাই পায়ে হেঁটে!
বেলেভু ২০০৯ সাল পর্যন্ত পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেছেন প্রায় ৫৮টি দেশ। দীর্ঘ এ যাত্রায় তাঁর প্রয়োজন হয়েছে ৪০ জোড়া জুতা। শুধু জুতা নয়, প্র্রয়োজনীয় বেশির ভাগ উপকরণই উপহার হিসেবে পেয়েছেন বিশ্বভ্রমণের পথে অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে হেঁটেছেন বেলেভু। পথের তালিকা আর মানচিত্রের হিসাব-নিকাশ করা ছিল আগেই। তিনি রাত কাটিয়েছেন পথে-ঘাটে, কখনো ভিনদেশি বন্ধুর বাড়িতে, কখনো বা কোনো এক সেতুর তলায়, কখনো জেলহাজতে।
চলার পথে কম বিপত্তিতে পড়তে হয়নি তাঁকে। আফ্রিকার পথে ছিল ঘন জঙ্গল। সে জঙ্গলে আবার সিংহের আস্তানা। স্থানীয় লোকেরা পরামর্শ দিল, পথে সিংহের দেখা মিললে ঘাবড়ানো চলবে না, চুপচাপ শান্তভাবে হেঁটে পার হতে হবে। ভাগ্য ভালো ছিল, সিংহরাজ তাঁকে দেখা দিলেও আক্রমণ করেনি। কিন্তু চিলিতে আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। একটা চিতাবাঘ আঘাত করে ফেলে। তবে স্থানীয় মানুষের সহায়তায় রক্ষা পান শেষ পর্যন্ত।
বেলেভু অবশ্য এ ধরনের ছোটখাটো বিপত্তিকে মোটেও পাত্তা দিতে চান না। হেসেই উড়িয়ে দেন। বিশাল এ পথে বেশ কয়েকবার শরীরও ভেঙে পড়েছিল। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন আলজেরিয়া, আফ্রিকাসহ আরও কয়েকটি স্থানে। অচেনা বন্ধুরাই সব সময় পাশে দাঁড়িয়েছেন। মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর জানতে পারলেন, জাকার্তায় ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলা চলছে, কিন্তু তাঁকে যেতে হবে জাকার্তায়। নিষেধ সত্ত্বেও বেলেভু সেখানে পৌঁছে গেছেন শান্তির বার্তা নিয়ে। থামার সময় নেই তাঁর। বেলেভু মনে করেন, বিশ্বভ্রমণের মতো কঠিন এ কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে মানুষের সীমাহীন সমর্থন, ভালোবাসা আর সহযোগিতার কারণে।
পুরো পথে এ পর্যন্ত এক হাজার ২৫০টি পরিবার তাঁকে অকৃত্রিম সাহায্য জুগিয়েছে। তাঁর অগণিত সমর্থক, স্থানীয় সংস্থা ও আন্তর্জাতিক কিছু প্রতিষ্ঠান প্রায় সময়ই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। ব্রাজিলীয় এক বন্ধু তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত যাওয়ার বিমানের টিকিট করে দিয়েছিলেন। মেক্সিকোর একটি পরিবার তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে, খেতে দিয়েছে। নাইজেরীয় এক চিকিত্সক তাঁর বিনামূল্যে চিকিত্সা ও অস্ত্রোপচার করে দেন। ভারতীয় এক হাসপাতাল তাঁর যাবতীয় ওষুধপথ্যের জোগান করে দেয়। আলজেরীয় এক হাসপাতাল তাঁর অস্ত্রোপচার করে দেয়।
আরও অনেক অসুবিধা ছিল তাঁর চলার পথে। ইথিওপিয়ায় বিদেশি দেখে বেলেভুর দিকে পাথর ছুড়ে মারে স্থানীয় অধিবাসীরা। জাপানে কারও সঙ্গেই কথা হয়নি। বেলেভুর মনে হয়েছিল, যেন একগুচ্ছ ক্যাকটাসকে তিনি বলছেন, ‘হ্যালো।’ খারাপ আবহাওয়ার জন্য রাশিয়াসহ আরও বেশ কিছু দেশ তাঁর তালিকা থেকে বাদ দিতে হয়েছে। বেলেভুর স্মরণীয় মুহূর্তগুলো হলো: সুন্দর প্রকৃতির পেরুর আন্দিজ পর্বতমালা, চিলি-বলিভিয়ায় ভূমি থেকে চার হাজার ৬৬০ মিটার ওপরে আরোহণ, দক্ষিণ আমেরিকার অ্যাটাকামা মরুভূমি অতিক্রম—সবকিছুই ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতায় পূর্ণ।
পরিবারকে পেছনে রেখে এলেও কখনোই তারা সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। পুরো যাত্রাতেই নিয়মিত সমর্থন ও যোগাযোগ ছিল পরিবারের। ছেলেমেয়েরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে চলে আসত। ২০০৬ সালে ছেলে থমাস আর মেয়ে লিসা ফ্রান্সে বাবার সঙ্গে দেখা করে। সঙ্গে ছিল বেলেভুর ছোট নাতি-নাতনিরা। যে স্ত্রীর সমর্থনে শান্তির বার্তা নিয়ে পৃথিবী অভিযাত্রায় বের হয়েছেন, সেই স্ত্রীও দূরে থাকেননি; প্রতিবছর তিনি বেলেভুর সঙ্গে দেখা করতে চলে আসেন বিভিন্ন দেশে, বেলেভুর যাত্রাবিরতিতে। চলতি বছর তাইওয়ানে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে, সামনে দেখা হবে অস্ট্রেলিয়ায়।
ফরেস্ট গাম-এর ‘রান, ফরেস্ট রান’ কথাটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় বেলেভুর বিশ্বভ্রমণের সঙ্গে। শুধু পার্থক্যটা বাস্তবতা আর কল্পনার। বেলেভুর অভিযাত্রাটা বাস্তবতা। শান্তির জন্য একজন মানুষের উদার আহ্বান। শুধু নিজের শান্তি নয়, বিশ্বঘুরে এই ব্রহ্মাণ্ডের জন্য শান্তি খুঁজছেন একজন বেলেভু।
‘এক্সপ্রেস ইন্ডিয়া’ ও অন্যান্য বিদেশি সূত্র অবলম্বনে শিখ্তী সানী
| তারিখ: ২৫-০৯-২০০৯
No comments:
Post a Comment