Monday, October 11, 2010

 ‘সুরমা পারে’ হাসন রাজার জাদুঘর

সুনামগঞ্জ শহরে সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে হাসন রাজার বাড়ি। এই বাড়িতেই হাসন রাজা জন্মেছেন ১৮৫৪ সালে। এই বাড়িতেই রচিত হয়েছে অসামান্য সব গান। বাড়িটার কাছে পৌঁছাতে মনে হয়, এই বুঝি দেখা মিলবে সাধক সেই গীতিকার, গায়কের।
তা তো আর হয় না। কিন্তু হাসন রাজার স্মৃতি জেগে থাকে তাঁর নামে নামাঙ্কিত জাদুঘরে। জাদুঘরের প্রবেশপথে প্রথমেই লালনের এটি ছবি। তারপর হাসন রাজার ছবি। তার নিচে লেখা ‘ছবি তোলা নিষেধ’।
জাদুঘরে হাসন রাজার এই একটি মাত্র আলোকচিত্র। কলকাতার একটি স্টুডিও থেকে সংগ্রহ করা ১৯৬২ সালে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা আট-নয়টি ছবি আছে।
তবে ছবি নয়, জাদুঘরটিকে জীবন্ত করে রেখেছে হাসন রাজার স্মৃতিবিজড়িত নানা জিনিসপত্র।
‘হাসন রাজা মিউজিয়াম’ নামে বর্তমান জাদুঘরটির বয়স বেশি নয়, বছরখানেক আগে হাসন রাজার লন্ডন-প্রবাসী প্রপৌত্র সামারীন দেওয়ান এই জাদুঘরটি তৈরি করেন। সেই থেকে তিনি দেখভাল করছেন প্রতিষ্ঠানটি।
তবে জাদুঘরের মূল উপকরণগুলো সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত ছিল অনেক দিন ধরেই। ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে এই বাড়িতে ‘হাসন ফকিরের মেলা’ বলে একটি মেলা আয়োজন করা হয়েছিল। তখন থেকেই হাসন রাজার বাড়ি ও তাঁর ব্যবহূত সামগ্রী দেখতে মানুষ ভিড় করত। এরপর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ‘হাসন একাডেমি’র জন্য ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেন। আর এই সবকিছুর ধারাবাহিকতায়ই আজকের জাদুঘর।

জাদুঘরের আকর্ষণ
টেবিল-চেয়ার
এই চেয়ারে বসে হাসন রাজা গান রচনা করতেন বলে শোনা যায়।
রঙিন আলখাল্লা
এমনিতে হাসন সাদাসিধে পোশাকই পরতেন। লোকে বলে, তিনি সব সময় সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরতেন। সঙ্গে সাদা গেঞ্জির ওপর চাদরের মতো করে আরেকটি ধুতি গায়ে জড়িয়ে রাখতেন। তবে অন্য কোনো রাজা বা ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে দেখা করার সময় বিশেষ পোশাক হিসেবে এই আলখাল্লাটি পরতেন।
পানি পরিশোধন পাত্র
ছোট জগের মতো দেখতে এই ফিল্টারটি হাসন পেয়েছিলেন তাঁর এক নায়েবের কাছ থেকে। উইলিয়াম লিটল নামে এই ইংরেজ নায়েব ১৯০২ সালে অস্ট্রিয়া থেকে এটি এনে উপহার দিয়েছিলেন।
তলোয়ার
হাসন রাজার পারিবারিক তলোয়ার ছিল এটি। পুরুষানুক্রমে তাঁর হাতে এসেছিল তলোয়ারটি।
মাটির হাঁড়ি
জনশ্রুতি আছে, এই হাঁড়িতে পয়সা ভরে হাসন রাজা শিশুদের মধ্যে তা ছিটিয়ে দিতেন। এই জনশ্রুতির পক্ষেই কথা বললেন নব্বই-ঊর্ধ্ব মকবুল হোসেন, যিনি শিশুকালে হাসন রাজাকে দেখেছেন। এমনকি হাসন রাজার ছিটানো পয়সাও কুড়িয়েছেন।

আরও কিছু
ওপরের জিনিসগুলো ছাড়াও জাদুঘরে দেখতে পাবেন হাসন রাজার চায়ের টেবিল, দুধ খাওয়ার পাত্র, বাটি, দুধ দোহনের পাত্র, পানদানি, হাসন রাজার ব্যবহূত কাঠের খড়ম, শেষ বয়সে ব্যবহূত লাঠি, মোমদানি, পিতলের পানির কলস, নিজের হাতে লেখা গানের কপি। আছে কিছু বাদ্যযন্ত্রও—ঢোল, করতাল, মন্দিরা ইত্যাদি। জমিদারির কাজে ব্যবহূত ক্যাশবাক্সটিও রয়েছে।

জাদুঘরের বাইরের স্মৃতি
জাদুঘরের পেছনেই সেই ঘরটি, যে ঘরে জন্মেছিলেন হাসন রাজা। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে হাসন রাজার মায়ের ঘরটি ভেঙে যায়। সেটি আর মেরামত করা হয়নি। এখন শুধু ভিটে-মাটি। একই চত্বরে হাসন রাজার মায়ের ঘরের পেছনে বাঁধানো পাকা ঘাট। এই ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে হাসন রাজা হাওর-বাঁওড়ে ঘুরে বেড়াতেন।
হাসন রাজার মা হুরমত জাহান বিবির কবরের পাশেই হাসন রাজা চিরনিদ্রায় শায়িত। হাসনকে এখানে কবর দেওয়ার ব্যাপারটি তাঁর ইচ্ছেতেই হয়েছে বলে শোনা যায়। এ সম্পর্কে একটি গল্পও আছে।
হাসন রাজার শেষ বয়সে আসাম থেকে একজন লোক এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। লোকটি এসে হাসন রাজাকেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাসন রাজার বাড়ি কোথায়?’
তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘আমিই হাসন রাজা।’ হাত তুলে মায়ের কবরটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে হাসন রাজার বাড়ি।’

সারোয়ার তমিজউদ্দিন | তারিখ: ২৫-০৯-২০০৯

No comments: