Wednesday, October 6, 2010

মুক্তিযুদ্ধে বিমান


অটার অটার

মাত্র তিনটি বেসামরিক বিমান নিয়ে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে মুক্তিসংগ্রামে লড়েছিলেন আমাদের বিমানযোদ্ধারা। একাত্তরের সেই তিনটি বিমান আর যোদ্ধাদের নিয়ে লিখেছেন শামীম আমিনুর রহমান

২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। ভারতের নাগাল্যান্ডের পাহাড়ি এলাকা ডিমাপুর। উঁচু পাহাড়ঘেরা এই জায়গায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্যবহূত একটি রানওয়ে পড়ে ছিল। তিন দিকে পাহাড়ঘেরা দুর্গম এই নির্জন জায়গায় জড়ো হয়েছিলেন বাংলাদেশের কিছু মুক্তিপাগল মানুষ। এই রানওয়েতে দাঁড়িয়ে সেদিন তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি বিমানবাহিনীর।
দেশের নানা জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা তখন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে লড়ছিলেন। এই যুদ্ধকে আরও শক্তিশালী করার জন্য একটি বিমানবাহিনী খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সামরিক ও বেসামরিক বিমানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে সেদিন ডিমাপুরে জড়ো হয়েছিলেন।
সে সময় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ভরসা বলতে ছিল ভারত থেকে উপহার পাওয়া তিনটি বিমান। তত্কালীন উপ-সেনাপ্রধান ও বিমানবাহিনীর প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার ও প্রবাসী সরকারের প্রচেষ্টাতেই বিমান তিনটি পাওয়া গিয়েছিল। এই নতুন বিমানবহরের নাম ছিল ‘কিলো ফ্লাইট’। কিলো ফ্লাইটের অধিনায়ক ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। আশির দশকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন বীর উত্তম সুলতান মাহমুদ।
তিনটি বিমানের একটি ছিল ডাকোটা বিমান (ডিসি-৩)। এটি প্রবাসী সরকারকে উপহার দিয়েছিলেন ভারতের যোধপুর রাজ্যের মহারাজা। অন্য দুটির একটি ছোট আকারের হেলিকপ্টার ও অন্যটি পুরোনো অটার বিমান। তাই নিয়ে যাত্রা শুরু।
এই বিমানগুলো ছিল সেকেলে বেসামরিক বিমান। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দক্ষ প্রকৌশলীরা এগুলোকে যুদ্ধে ব্যবহারোপযোগী করে গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সে সময় যুদ্ধনীতি ছিল ‘হিট অ্যান্ড রান’। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ দক্ষতার সঙ্গেই এ পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বিমানসেনারা। বাংলাদেশের সেই ক্ষুদ্র বিমানবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের তো বটেই, ভারতীয় বাহিনীকেও কোথাও কোথাও যুদ্ধে সহায়তা করেছিল।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে বিমানবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হলেও মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই তারা তাদের যুদ্ধাভিযান শুরু করে। অক্টোবরে বিমানবাহিনী লালমনিরহাটের মোগলহাট ও ঠাকুরগাঁওয়ে অভিযান চালিয়ে সফল হয়। নভেম্বরে ঝিনাইদহের চৌগাছায় বাংলাদেশের অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে একযোগে আক্রমণ চালায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৬টির মধ্যে ১১টি ট্যাংক ধ্বংস হয়। এতে প্রায় ১০০ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অটার ও অ্যালুয়েট মোট ৫০টি ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান চালিয়ে সাফল্যের সঙ্গে তা পরিচালনা করেছিল।
এমন অনেক জায়গা ছিল, যা ভারতীয় বৈমানিকেরা চিনতেন না। সেখানে আমাদের এই ক্ষুদ্র বিমানবাহিনীর বৈমানিকেরা গিয়ে আক্রমণ চালিয়েছিলেন। এই অল্প সময়ে আমাদের এই স্বল্প ক্ষমতার বিমানবাহিনীর বলার মতো অনেক গল্পই আছে।
এর মধ্যে খুব উল্লেখযোগ্য একটি গল্প ৩ ডিসেম্বর তেলের ডিপোয় আক্রমণ চালানো। এদিন একই সঙ্গে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ও নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের তেলের ডিপোতে আক্রমণ চালিয়েছিল আমাদের বিমানবাহিনী। পাকিস্তানের বিভিন্ন বাহিনীকে এই ডিপোগুলো থেকে জ্বালানি সরবরাহ করা হতো। গেরিলা বাহিনী বারবার চেষ্টা করেও ডিপোগুলোর ক্ষতিসাধন করতে পারেনি।
এবার ওই দুটি ডিপোতে আঘাত করার জন্য একই সময়ে দুই ভাগে আক্রমণ চালানো হয়। ভারতের কৈলাশহর থেকে অটার বিমানটি আক্রমণ করে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ডিপোতে এবং ভারতের তেলিয়ামুরা থেকে অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার আক্রমণ চালায় নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে।
অটার বিমানটি সমুদ্র বরাবর পথ ধরে পতেঙ্গার তেলের ডিপোর কাছে এসে বোমা হামলা করে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ এ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। বোমা হামলার সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে পতেঙ্গা ডিপোতে আগুন জ্বলে ওঠে। এদিকে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম হামলা চালান অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারটি নিয়ে। নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পৌঁছেই তেলের ট্যাংকারের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন তাঁরা। মুহূর্তের মধ্যে ট্যাংকারগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।
এই খুদে বিমানবাহিনী ১১ ডিসেম্বর আরও একটি উল্লেখযোগ্য আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্যাগ করার সময় ভৈরব ব্রিজটি ধ্বংস করে দেয়। এতে মিত্রবাহিনীর ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার সড়কপথ বন্ধ হয়ে যায়। উপায় না দেখে মিত্রবাহিনী নরসিংদীতে হেলিকপ্টার দিয়ে ছত্রীসেনা অবতরণ করায়।
ওই সময় পাকিস্তানি বাহিনী উল্টো অ্যাম্বুশ করে আক্রমণ করলে মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনারা বিপাকে পড়ে যান। এ সময় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ রেডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সহায়তা চেয়ে পাঠিয়েছিল। সাহায্য করতে অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের বৈমানিকেরা।
বেশি নিচে নেমে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে গিয়ে বিপদেও পড়েছিলেন অ্যালুয়েটের যোদ্ধারা। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানবাহিনী সব বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর সফল অপারেশন চালাতে সক্ষম হয়। বিমানবাহিনীর এ অভিযানে ওই দিন পাকিস্তানি ২০ জন সেনা নিহত ও ২০ থেকে ২৫ জন আহত হয় এবং বাকিরা নরসিংদী ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এই অভিযানের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন বলছিলেন, ‘আমাদের স্বল্প সামর্থ্য নিয়ে এই সফল অভিযান দেখে ভারতীয় সেনারা বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই এই তিনটি বিমানের মালিক হয়েছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এর মধ্যে ডাকোটা বিমানটি (ডিসি-৩) বাংলাদেশ বিমানকে দিয়ে দেয়। ঢাকা-চট্টগ্রামের কয়েকটি ফ্লাইট চালানোর পর একটি ট্রেনিং ফ্লাইটে গিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয় ডাকোটা বিমানটি। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের দুই বিমানযোদ্ধা বীরউত্তম ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ ও বীরপ্রতীক ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক।
অটার বিমানটি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। আর অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারটিকে ডাকোটা বিমানেরই পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে এটি
বিধ্বস্ত হয়।

অটার
এটি ছিল প্রেস্ট অ্যান্ড হুইটনি ১৩/৪০ নামের পিস্টন ইঞ্জিন সংযোজিত ছোট বিমান। এই অটার বিমানের গতি ছিল খুবই কম। ঘণ্টায় ৮০ মাইল ছিল এর গতি, যা যুদ্ধের জন্য উপযোগী নয়। বাঙালি দক্ষ টেকনিশিয়ানদের চেষ্টায় এটিকে রকেট, মেশিনগান ও বোমাবর্ষণের উপযোগী করে সাজানো হয়েছিল। বিমানের প্রতিটি ডানার নিচে সাতটি রকেটের একটি করে পড, পেছনের দরজা খুলে মেশিনগান স্থাপন ও বিমানের মেঝের পাটাতন খুলে ২৫ পাউন্ডের ১০টি বোমা সংযোজন করা হয়েছিল। বোমাগুলো হাত দিয়ে পিন খুলে নিক্ষেপ করা হতো।
এই বিমানটি পরিচালনায় ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ (পরে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট অপারেশনস পরিচালক) ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ। তিনজনই বীর উত্তম স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।

ডাকোটা বা ডিসি-৩
ডাকোটা বা ডিসি-৩ বিমান ১৯৩৫ সালে আমেরিকার ম্যাগডোনাল অ্যান্ড ডগলাস কোম্পানির তৈরি। সে সময়ের একটি বিখ্যাত নির্ভরযোগ্য যাত্রীবাহী বিমান এটি। এই উড়োজাহাজটির পেছনের হ্যাচ (মালামাল ওঠানো-নামানোর দরজা) খুলে ফেলা হয়েছিল। এই বিমানটিকে পাঁচ হাজার পাউন্ড বোমা বহন করার উপযোগী করা হলেও এটির কারিগরি সীমাবদ্ধতার জন্য সার্বিকভাবে যুদ্ধের উপযোগী করে তোলা যায়নি। তবে এই বিমানটি যুদ্ধসামগ্রী ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তর করার কাজ করত। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র তদারকিতে ব্যবহূত হয়েছিল এটি।
ডাকোটা বিমানটির দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক, ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার (বর্তমানে লেখক) ও ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত। তিনজনই বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত।

অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার
অ্যালুয়েট ছিল ফ্রান্সের নির্মিত ছোট একটি পুরোনো হেলিকপ্টার। এটিকেও সাজানো হলো অটারের মতো করে। দুই পাশে দুটি করে মোট ১৪টি রকেট যুক্ত করা হলো এবং বসানো হলো মেশিনগান। এটি শত্রুর রাডার ফাঁকিসহ অতি নিচু দিয়ে আক্রমণ করতে সক্ষম ছিল। কম উচ্চতায় ওড়ার সময় শত্রু-গোলা যাতে ভেদ করতে না পারে, তার জন্য পাটাতনে লাগানো হয়েছিল বাড়তি এক ইঞ্চি পুরু স্টিলের প্লেট।
এই বিমানটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম ও ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন (বর্তমানে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমির সভাপতি)। তিনজনই স্বাধীনতার পর বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন।

ভারতীয় ও পাকিস্তানি বিমান
আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত ব্যবহার করেছিল প্রধানত হান্টার বিমান, মিগ-২১ এফএল ও জিন্যাট বিমান। এই বিমানগুলোর প্রতিটির একটি করে বিমানবাহিনীর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
এ ছাড়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধবিমান স্যাবর জেট এফ-৮৬ বা স্যাবর জেট বিমান ব্যবহার করেছিল, তারও একটি এই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী এ রকম প্রায় ১৪টি বিমান ধ্বংস করে ফেলে; যাতে বাংলাদেশ এগুলোকে আর ব্যবহার করতে না পারে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রকৌশলীদের চেষ্টায় চারটি বিমান ব্যবহারোপযোগী করে তোলা সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এগুলো সফলভাবে ওড়ানো সম্ভব হয়েছিল।

তথ্যসূত্র: বেলুন থেকে বিমান: আলমগীর সাত্তার, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়), বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ওয়েবসাইট এবং মুক্তিযোদ্ধা বিমানসেনাদের সাক্ষ্য। 
 
শামীম আমিনুর রহমান | তারিখ: ২৫-১২-২০০৯

No comments: