Thursday, October 7, 2010

নোবেলের অন্য গল্প

নোবেলের গল্প

শিবরাম চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘হাফ এ বেল ইজ বেটার দ্যান নো-বেল (নোবেল)’! কিন্তু দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ শিবরাম বাবুর সঙ্গে একমত নয়। তাদের মতে, বরং নোবেলই এই জগতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার।
সেই ১৯০১ সাল থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্মাননা হয়ে টিকে আছে নোবেল পুরস্কার; আলফ্রেড নোবেলের স্বপ্ন।
১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর সুইডেনের স্টকহোমে জন্ম নিয়েছিলেন শিল্পপতি ইমানুয়েল নোবেলের তৃতীয় সন্তান আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল। ব্যক্তিজীবনে আলফ্রেড নোবেল রসায়নবিদ, প্রকৌশলী ও অস্ত্রনির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। নিজের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ডিনামাইটের ধ্বংসাত্মক ব্যবহার দেখে শেষজীবনে খুবই অনুতপ্ত হয়ে পড়েছিলেন আলফ্রেড নোবেল। এ কারণেই মৃত্যুর বছরখানেক আগে নতুন একটি দানপত্র তৈরি করেন তিনি। সেই দানপত্রে নিজের মোট সম্পত্তির ৯৪ শতাংশ (তত্কালীন ৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার) দান করে দেন।
বিপুল এই অর্থ দিয়েই শুরু হয় পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিত্সাবিজ্ঞান অথবা ওষুধবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান।

গণিতে নোবেল কই?
গণিতে নোবেল না দেওয়া নিয়ে গল্পের শেষ নেই। বলা হয়, আলফ্রেড নোবেল এক ভদ্রমহিলাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। এই বিরহে নোবেল বিয়ে করেননি। এই প্রত্যাখ্যানের ক্ষোভ ঝেড়েছেন তিনি গণিত শাস্ত্রটিরই ওপর! কারণ, সেই ভদ্রমহিলা একজন গণিতবিদ ছিলেন।
আরও বলা হয়ে থাকে, নোবেল যখন তাঁর পুরস্কারসংক্রান্ত উইলটি করলেন, তখন গণিতে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান একটি বিখ্যাত পুরস্কার প্রচলিত ছিল। তিনি ওই পুরস্কারটির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েই নিজে আর গণিতে কোনো পুরস্কার প্রবর্তন করতে চাননি।
এ ছাড়া একটি তাত্ত্বিক যুক্তির কথাও বলা হয়। গণিত সম্পর্কে বলা হয়, এ শাস্ত্রীয় আবিষ্কারের ব্যবহারিক কোনো প্রত্যক্ষ প্রয়োগ নেই। অথচ নোবেল পুরস্কারের মূল কথাই হলো, মানবকল্যাণে সংশ্লিষ্ট আবিষ্কারের গুরুত্ব বিচার করা।

মরণোত্তর নোবেল
নোবেল পুরস্কারের জন্য মরণোত্তর মনোনয়নের কোনো সুযোগ নেই। তবে মনোনয়ন পাওয়ার পর যদি কেউ মারা যান, সেই মনোনীত ব্যক্তিকে পুরস্কার দেওয়ার সুযোগ আছে। এই নিয়মে এ পর্যন্ত দুজন মনোনীত ব্যক্তিকে মরণোত্তর নোবেল দেওয়া হয়েছে। ১৯৩১ সালে সাহিত্যে মনোনয়ন পাওয়ার পর মৃত্যুবরণ করেন এরিক অ্যাক্সেল কার্লফেল্ড। এর পরও সুইডিশ এই কবি পুরস্কার পান।
১৯৬১ সালে একই ঘটনা ঘটে তখনকার জাতিসংঘের মহাসচিব দ্যাগ হ্যামারশেল্ডের ক্ষেত্রে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে মনোনীত হওয়ার পর বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান সুইডিশ এই কূটনীতিবিদ।

নোবেল পরিবার
পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে, যাদের ভাঁড়ারে একটিও নোবেল পদক নেই। আবার এই দুনিয়ায় এমন পরিবারও আছে, যাদের শোকেসে নেই নেই করে ছয়টি নোবেল পদক জমা হয়েছে! কুরি পরিবারের এই দাপট শুরু হয়েছিল মারিয়া কুরি ও পিয়েরে কুরির মাধ্যমে। ১৯০৩ সালে পদার্থবিদ্যায় এই দম্পতি নোবেল জেতেন। ১৯১১ সালে আবার নোবেল জেতেন মারিয়া, রসায়নে। ১৯৩৫ সালে মারিয়া-পিয়েরের মেয়ে ইরিন জোলিয়ট কুরি রসায়নে নোবেল পান। সঙ্গী ছিলেন তাঁর স্বামী ফ্রেডেরিক জোলিয়ট কুরি। সর্বশেষ ১৯৬৫ সালে ইউনিসেফ যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতল, তখন এর পরিচালক ছিলেন হেনরি ল্যাবোয়িসে; মেরি-পিয়েরের আরেক জামাতা!

তাঁরা নোবেল নেননি!
নোবেল প্রত্যাখ্যান! সবাই না হলেও তিনজন মানুষ এ কাজটি করেছেন। নোবেল পেয়ে প্রথম প্রত্যাখ্যান করেন রাশিয়ান সাহিত্যিক বরিস পাস্তেরনাক। পাস্তেরনাককে ১৯৫৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয় সুইডিশ একাডেমি।
পুরস্কার পাওয়ার খবর শুনে আনন্দিত প্রতিক্রিয়া জানালেও চার দিন পরই পাস্তেরনাকের কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম পায় সুইডিশ একাডেমি। যাতে লেখা ছিল, ‘আমার সমাজে এই পুরস্কারের তাত্পর্য বিবেচনা করে আমি তা গ্রহণ করতে পারছি না। অনুগ্রহ করে আমার এই স্বেচ্ছা প্রত্যাখ্যানে আহত হবেন না।’
কেন এই প্রত্যাখ্যান, তা পাস্তেরনাক কখনো পরিষ্কার করেননি। তবে অনুমান করা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
নোবেলের দ্বিতীয় প্রত্যাখ্যানটিও সাহিত্যে, পাস্তেরনাকের ঠিক পাঁচ বছর পর। ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, রাজনৈতিক কর্মী জাঁ পল সার্ত্রে। মূলত অস্তিত্ববাদী দর্শনের জনক বলে খ্যাত সার্ত্রে নোবেল প্রত্যাখ্যান করেন তাঁর নীতিগত কারণে। সার্ত্রের প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে নোবেল কমিটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘জনাব সার্ত্রে উল্লেখ করেছেন, তিনি সব ধরনের আনুষ্ঠানিক সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করে থাকেন। তাই তাঁর এই কাজটিকে (নোবেল প্রত্যাখ্যান) অস্বাভাবিক বলা যায় না।’
সার্ত্রে ও পাস্তেরনাক ছাড়া আরেকজন নোবেল প্রত্যাখ্যানকারী হলেন লি ডাক থো। ভিয়েতনামের এই বিপ্লবী ও কূটনীতিবিদ শান্তিতে নোবেল পান ১৯৭৩ সালে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি টানা শান্তিচুক্তি করার জন্য হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে ডাক থো-কেও নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তাঁর কর্মকাণ্ড ভিয়েতনামে কোনো শান্তি আনতে পেরেছে বলে মনে করেননি ডাক থো। এ জন্যই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নোবেল।

তাঁরা নোবেল পাননি
রুশ ঔপন্যাসিক লিও তলস্তয় নোবেল পাননি। দুনিয়ার লাখ লাখ মানুষ এ কারণেই নোবেল পুরস্কারকে খুব ‘ছোট’ মনে করে। কারণ, এই পুরস্কার লিও তলস্তয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি! পারেনি মহাত্মা গান্ধীর উচ্চতায় উঠতেও।
১৯০১ সালেই মনোনয়ন পেয়েছিলেন তলস্তয়। মনোনয়ন পেয়েছিলেন পরের বছরও। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত পুরস্কারটা তলস্তয় পাননি। বলা হয়, চার্চের সঙ্গে তলস্তয়ের শীতল সম্পর্কই এর নেপথ্য কারণ। কারণ যা-ই হোক, নোবেল না পেয়ে কিন্তু বেশ আনন্দিত ছিলেন তলস্তয়! তলস্তয় নিজেই বলেছিলেন, ‘এতে (নোবেল না পাওয়ায়) আমি টাকাপয়সা নিয়ে অনাহূত কিছু কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়া থেকে বেঁচে গেছি।’
পর্যায়ক্রমে ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯ ও ১৯৪৭ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও শেষ বিচারে মহাত্মা গান্ধীকে যোগ্য মনে করেননি বিচারকেরা। গান্ধী শেষ পর্যন্ত ১৯৪৮ সালে নোবেলজয়ী হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুরস্কার ঘোষণার ঠিক দুই দিন আগে হত্যা করা হয় তাঁকে।
তাত্ক্ষণিক বৈঠকে গান্ধীকে মরণোত্তর নোবেল দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। বরং ওই বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারই স্থগিত রাখা হয়। গান্ধীকে নোবেল না দিতে পারাকে নিজেদের সবচেয়ে বড় ‘ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা’ বলে উল্লেখ করেছে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি।

শান্তি পুরস্কারের ফল
নেলসন ম্যান্ডেলা, অং সান সু চি, দালাই লামা, ডেসমন্ড টুটু—এমন অনেক অনেক যোগ্য লোকের হাতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার উঠেছে। এর পরও শান্তিতে এই নোবেল পুরস্কারই নোবেল পুরস্কারের গলায় সবচেয়ে বড় কাঁটা হয়ে আছে।
১৯১৯ সালে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনকে। যুক্তি ছিল, ‘লিগ অব ন্যাশনস’ গঠনে ভূমিকা রেখে তিনি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। অথচ ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত মেক্সিকো, হাইতি, কিউবা ও পানামায় মার্কিন সেনা পাঠিয়ে নির্বিচারে গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছেন উইলসন। প্রায় একই রকম কাজ করেছিলেন আরেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট। ১৯০৬-এ শান্তিতে নোবেল পান ‘যুদ্ধপ্রেমী’ বলে পরিচিতি এই প্রেসিডেন্ট। কিউবা, ফিলিপাইন ও স্পেনে তাঁর সময়ে মার্কিন বাহিনী ভয়ানক সব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়ায় ভয়াবহ সব যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া হেনরি কিসিঞ্জার বা আফগানিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করা জিমি কার্টারের শান্তিতে নোবেল পাওয়া নিয়েও বিতর্ক কম না।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, www.nobelprize.org, অন্যান্য বিদেশি সূত্র।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায় | তারিখ: ১৬-১০-২০০৯

No comments: