Wednesday, October 6, 2010

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা

কল্পনা করুন। ১২৪ তলায় এক পর্যবেক্ষণ ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। একদিকে চেয়ে দেখতে পাচ্ছেন দিগন্তছোঁয়া সমুদ্র আর একদিনে আকাশ মিশে গেছে মরুভূমিতে!
এমন দৃশ্য কয়েক দিন আগেও শুধু কল্পনায় দেখতে হতো। এবার কল্পনার সেই দৃশ্যগুলোকে বাস্তবে নিয়ে এল ‘বুর্জ খলিফা’; বর্তমান বিশ্বের উচ্চতম ভবন। ডজন ডজন বিশ্বরেকর্ড হাতে নিয়ে দুবাইয়ের মরুভূমিতে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন এই উচ্চতম ভবন।
বিশ্বমন্দাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মরুর বুকে তাঁরা গড়ে বুর্জ খলিফা।
আকাশছোয়া এই স্থাপনার উদ্বোধন হয়ে গেল ৪ জানুয়ারি। তার আগের দিন পর্যন্ত নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান এমার প্রপার্টিজ অট্টালিকাটি নিয়ে রহস্য করেছে। লোকজনকে জানতে দেয়নি আসলে তাদের ভবনটির সঠিক উচ্চতা কত। তবে এটি যে বিশ্বরেকর্ড করতে যাচ্ছে, সেটা অনুমান করতে বেগ পেতে হয়নি।
উদ্বোধনের পরপরই জানা গেল, ‘বুর্জ খলিফা’ গোটা দশেক বিশ্ব রেকর্ড করে বসে আছে। উচ্চতম দালানের রেকর্ড তো আছেই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চতম মসজিদ, উচ্চতম সুইমিংপুল, এলিভেটরে চড়ে দীর্ঘতম ভ্রমণের রেকর্ড।
বুর্জ খলিফা উচ্চতায় এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের দ্বিগুণ। বুর্জ খলিফা তৈরির আগ পর্যন্ত পৃথিবীর উচ্চতম দালান ছিল তাইওয়ানের ‘তাইপে ১০১’। তাইপের উচ্চতা এক হাজার ৬৬৭ ফুট।
বুর্জ খলিফা এখন শুধু বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবনই না, এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্থাপনাও বটে। পোল্যান্ডোর ওয়ারশ রেডিও মাস্টকে (২,১২০.৬৭ ফুট) টপকে বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থাপনার রেকর্ডটিও দখলে নিয়ে নিয়েছে বুর্জ খলিফা।
দুবাইয়ের এই দানবীয় ভবন নির্মাণে পাক্কা দেড় শ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে। সময় লেগেছে পাঁচ বছর। ২০০৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ভবনটির কাজ শুরু হয়। কী নেই ১৬০ তলার ওই দালানে!
সাত তারা হোটেল থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ, করপোরেট অফিস, আবাসন ব্যবস্থা, মসজিদ, সুইমিংপুল সবই আছে। অভ্যন্তরীণ সজ্জায় এক হাজার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। এই প্রথম কোনো আকাশছোঁয়া ভবনে আবাসনের ব্যবস্থাও রাখা হলো।
ভবনের ১৯ থেকে ৩৭ তলা এবং ৭৭ থেকে ১০৮ তলায় থাকার ব্যবস্থা আছে। প্রায় ৯০০ অ্যাপার্টমেন্ট আছে ভবনে। নির্মাতাদের দাবি, ঘোষণা দেওয়ার মাত্র আট ঘণ্টার মাথায় সবকটি অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়ে গেছে।
বুর্জ খলিফায় প্রতি বর্গফুট জায়গার মাসিক ভাড়া (অফিস-আদালতের জন্য) চার হাজার ডলার বা দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা।
ভবনটির নকশা করেছে স্কিডমোর ওয়িংস অ্যান্ড মেরিল (এসওএম) নামে একটি প্রতিষ্ঠান। গগনচুম্বী দালান-কোঠা নির্মাণে প্রতিষ্ঠানটির খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। প্রতিষ্ঠানটি শিকাগোর উইলস টাওয়ার, নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের মতো বিশাল সব স্থাপনার নকশা করেছে। বুর্জ খলিফার প্রধান প্রকৌশলী এসওএম-এর বিল ব্যাকার। তাঁর সহযোগী ছিলেন অ্যাড্রিন স্মিথ।
সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে স্টিলের কাঠামো এখন বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু অতি উচ্চতা ও দীর্ঘ স্থায়িত্বের কথা ভেবে নির্মাতারা ভবনটিতে কংক্রিট ব্যবহার করেছেন। কংক্রিটের ঢালাই দিতে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেতে হয়েছে। দুবাইয়ে দিনের বেলা তাপমাত্রা প্রায়ই ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে ঠেকে। এত উচ্চ তাপমাত্রায় সিমেন্ট, বালু ও পাথরের মিশ্রণ সহজে জমাট বাঁধে না। তাই তাঁরা রাতের বেলাটা বেছে নিয়েছিলেন। রাতের ঠান্ডা আবহাওয়ায় বাতাসের আর্দ্রতা থাকে বেশি। ফলে কংক্রিটের ঢালাই দ্রুত জমাট বাঁধে। আর গ্রীষ্মে ঢালাইয়ের কাজে পানির পাশাপাশি বরফও ব্যবহার হতো।
বুর্জ খলিফাকে ঢাকতে ১৫ লাখ ২৮ হাজার বর্গফুট কাচ লেগেছে। বহিরাঙ্গে সাজসজ্জার জন্য চীন থেকে আনা হয়েছিল ৩০০ বিশেষজ্ঞ। বিশাল এই ইমারতটি একসঙ্গে ২৫ হাজার লোকের ভার সইতে পারবে। এই ভবনে ৫৭টি লিফট আছে, আছে আটটি চলন্ত সিঁড়ি। এত উঁচুতে ওঠাটা যেন ক্লান্তিকর না হয় সেটিও বিবেচনায় রেখেছেন প্রকৌশলীরা। বিশ্বের দ্রুততম লিফট বানিয়ে দিয়েছেন বুর্জ খলিফার জন্য। একেকটি এলিভেটর সেকেন্ডে ৩৩ ফুট ওপরে উঠতে পারে।
তাজমহলের মতো বুর্জ খলিফা নির্মাণের পেছনেও আছে হাজার হাজার শ্রমিকের দুঃখগাথা। টাওয়ারটি নির্মাণে শ্রমিক আনা হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়া থেকে। অভিযোগ আছে, সেসব শ্রমিকদের পারিশ্রমিক ঠিকমতো দেওয়া হয়নি। মাঝে একবার শ্রমিকদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল দেশটির সরকারকে। একজন দক্ষ কাঠমিস্ত্রি রোজ ৪ দশমিক ৩৪ পাউন্ড করে পেতেন। আর সাধারণ শ্রমিকদের দেওয়া হতো দৈনিক ২ দশমিক ৮৪ পাউন্ড করে। এই যত্সামান্য পারিশ্রমিকও প্রায়ই আটকে দেওয়া হতো। এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়েই আড়াই হাজার শ্রমিক ২০০৬ সালের ২১ মার্চ কর্মবিরতি ঘোষণা এবং বিক্ষোভ করেন।
বৃহত্ স্থাপনা মানেই ঘাম-রক্তের বঞ্চনার ইতিহাস! সে পিরামিড, তাজমহল হোক বা বুর্জ খলিফা। দিনশেষে এই বঞ্চনার গল্পের চেয়েও নিশ্চয়ই বড় হয়ে উঠবে এই স্থাপনার বিশালত্বের গল্প। যত দিন পর্যন্ত আরেকটি ভবন এসে তাকে হারিয়ে না দেয়, তত দিন সবার ওপরে দাঁড়িয়ে রইবে বুর্জ খলিফা।

বুর্জ খলিফার রেকর্ড
 সর্বোচ্চ ভবন: ২ হাজার ৭১৭ ফুট (৮২৮ মিটার)
 বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তলাবিশিষ্ট ভবন: ১৬০ তলা
 দীর্ঘতম এলিভেটর যাত্রা
 পৃথিবীর দ্রুততম এলিভেটর: গতি ঘণ্টায় ৬৪ কিলোমিটার
 উচ্চতম আবাসনব্যবস্থা: ১০৮ তলা পর্যন্ত
 সর্বোচ্চ স্থানে মসজিদ: ১৫৮ তলা
 উচ্চতম স্থানে সুইমিংপুল: ৭৬ তলা
 সর্বোচ্চ স্থানে পর্যবেক্ষণ ডেক: ৪৪২ মিটার উঁচুতে 
 
সুত্র: প্রথম আলো।আবুল হাসনাত | তারিখ: ০৮-০১-২০১০

No comments: