শেষ বিকেলে সোনারোদ মেখে গাছের পাতাগুলো যখন রং বদলে ফেলতে শুরু করেছে, তখন গিয়ে পৌঁছালাম একটা টিলার মতো উঁচু জায়গার পাশে। লাল মাটির দেশে চারদিকেই রঙের বাহার। দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর মারাজের অবস্থান। এই ঢিবি বা টিলা নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনি চালু আছে লোকমুখে। প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ-এ সীতার দ্বিতীয় বনবাসের যে কাহিনি বর্ণিত আছে, সেটি নাকি এখানেই ঘটেছিল। সীতার দ্বিতীয় বনবাসজীবন বাল্মীকির আশ্রয়ে এখানে কেটেছিল বলে এ জায়গাটি সীতার কোট বা সীতাকোট অর্থাত্ সীতার দুর্গও বলা হয়। সে অনুযায়ী রাস্তার ধারে মাস্ত এক নামফলক লাগানো হয়েছে। সেখানেও এটিকে ‘সীতার কোট’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য এ কাহিনির ঐতিহাসিক সত্যতা খোঁজার তেমন দরকার নেই বলেই মনে হয়।
অনুমানের ওপর নির্ভর করে ইংরেজ কর্তা ওয়েস্টম্যাকট এটিকে বাঁধানো একটি মজে যাওয়া জলাশয় বলে মনে করেছিলেন। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক থাকাকালে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার উদ্যোগে জেলা পরিষদের অর্থায়নে ১৯৬৮ সালে প্রত্ন খননের মাধ্যমে এখানে একটি বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল। তখনই প্রথম হাতেনাতে প্রমাণ মিলল যে এখানে আসলে একটি বৌদ্ধবিহার ছিল। এও প্রমাণ করা গেছে, বিহারটি নির্মিত হয়েছিল খ্রিষ্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে, অর্থাত্ প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। বিহারটির নির্মাণ কাঠামো অনেক সরল ও আড়ম্বরহীন। পরবর্তীকালের বিশাল ও জটিল নির্মাণ কাঠামোর বিহারগুলোর চেয়ে প্রাচীনতার এটিও একটি প্রমাণ। নওগাঁর পাহাড়পুরে অবস্থিত সোমপুর মহাবিহার ও কুমিল্লার শালবন বিহারের চেয়েও প্রাচীন বৌদ্ধবিহার এটি। রাজশাহীর বিহারৈল বিহার ছাড়া বাংলাদেশে যতগুলো প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের পুরো কাঠামো আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তা সুরক্ষিত আছে, তার মধ্যে এটিকে প্রাচীনতম বলে বিবেচনা করা হয়। আসলে এখানে ছিল একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সবচেয়ে পুরোনো সুরক্ষিত কাঠামোসহ এটি বিদ্যমান। তাই মনের মধ্যে প্রবল আবেগ ও উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম। ইতিহাসের দেশে উপস্থিত হয়েছি পথিকের বেশে।
প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক ব্যবস্থা ছিল। চারধারেই ছোট ছোট কক্ষে বাস করত ছাত্ররা। ছাত্রাবাসের মোট কক্ষসংখ্যা ৪১। সব কটি কক্ষের মুখ ছিল ভেতরের উদ্যানের দিকে। আর পেছন দিকের দেয়ালটা ছিল ভীষণ চওড়া, ঠিক যেন দুর্গপ্রাচীর। যখন নির্মিত হয়েছিল এ বিহার, তখন সিমেন্ট তো দূরে থাক, চুন-সুরকির গাঁথুনি পর্যন্ত দেওয়া শেখেনি মানুষ, তাই কাদার গাঁথুনিই ছিল ভরসা। এখানে ছিল কাদার গাঁথুনি।
বিহারে ঢোকার পথ ছিল উত্তর দিকে। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দেয়ালটি ছিল প্রায় ৬৬ দশমিক ২৩ মিটার, আর পূর্ব ও পশ্চিম দেয়াল ছিল প্রায় ৬৪ দশমিক ৬২ মিটার লম্বা। তার মানে বিহারটি ছিল প্রায় বর্গাকার। পেছনের দেয়ালের পুরুত্ব ছিল প্রায় ২ দশমিক ৫৯। প্রবেশপথটির প্রতি পাশে দুটি করে ছোট ছোট কক্ষ ছিল, ওই কক্ষ দুটোর চিহ্ন এখনো পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়নি। কক্ষ দুটোতে দরজা-জানালার কোনো বালাই ছিল না।
কেন যে এমন বিচিত্র কক্ষ তখনকার দিনের মানুষ বানিয়েছিল, তা আজও বিস্ময় হয়েই রয়েছে। এ রহস্য ভেদ করার চেষ্টা অবশ্য চলেছে। ছাত্রাবাসের কক্ষগুলোর পেছনে যে দেয়াল রয়েছে, সেটার ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখতে লাগলাম এর নির্মাণকৌশল, ঠিক দুর্গই যেন ছিল এটি। সহজে বাইরে থেকে কারও পক্ষে ভেতরে ঢোকা কঠিনই ছিল। তাই মজবুত ও নিরাপদই ছিল এই বিহার। ছাত্রাবাসের কক্ষগুলোর সামনে ছিল টানা একটা বারান্দা। সব কক্ষের ছাত্ররা দরজা খুলতেই এসে পড়ত ওই বারান্দায়। রাতের বেলা ছাত্ররা যাতে প্রদীপ রাখতে পারে, সে জন্য কক্ষের ভেতরে সামনের দিকের দেয়াল বাদে অন্য সব দিকেই ছিল দেয়ালের গায়ে কুলুঙ্গি। সামনের দেয়ালের বাইরেও কুলুঙ্গি ছিল।
কক্ষগুলোর মেঝে সুরকি পিটিয়ে শক্ত করে বানানো হয়েছিল। বারান্দার মেঝেও তেমন করে সুরকি পিটিয়ে বানানো হয়েছিল। যতটুকু নমুনা আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে বোঝা গেছে যে কাঠের কড়ি-বর্গা লোহার পেরেক দিয়ে লাগিয়ে তার ওপর সুরকি বিছিয়ে তা শক্ত করা হয়েছিল পিটিয়ে। উত্তর-পূর্ব কোণের একটি কক্ষে ছিল ছাদে ওঠার সিঁড়ি। এর দক্ষিণ দিকের মাঝামাঝি জায়গায় অর্থাত্ উত্তর দেয়ালের প্রবেশপথের ঠিক বিপরীতে একটি বড় মন্দির কক্ষ ছিল। এটির সামান্য সামনেই বিহার চত্বরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি চাক বসানো কুয়ো ছিল বলে জানা যায়। তবে এখন সেসবের কোনো অস্তিত্বই নেই। সেখানে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি তালগাছ।
বিহারটিতে ১৯৭২-৭৩ সালেও খনন চালানো হয়েছিল। তবে প্রথমবার অর্থাত্ ১৯৬৮ সালেই এখানে পাওয়া গিয়েছিল ব্রোঞ্জের তৈরি দুটি অমূল্য মূর্তি। একটি লোকেশ্বর পদ্মপাণি ও অন্যটি মঞ্জুশ্রী। শোনা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকের ‘উত্তরের চকচকে কালো মৃত্পাত্রের’ খণ্ডাংশও এখানে পাওয়া গিয়েছিল। পরে এগুলোকে দিনাজপুর জাদুঘরে দান করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এগুলো লুণ্ঠিত হয়েছিল। মূর্তিগুলো ছাড়াও লোহার পেরেক, অলংকৃত ইট, নকশা করা মাছ, মাটির পুতুল, দোয়াত প্রভৃতি পাওয়া গেছে এখানে।
ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে কখন যে সূর্য ডুবতে বসেছে টের পাইনি। দুই মেয়ে ঐশী ও ঋদ্ধির দৌড়-ঝাঁপ থামাতে ব্যর্থ হয়ে ভাই তাহমিদুল হাসান তাড়া দিয়ে বলল,‘এখনই এদের গাড়িতে তুলতে না পারলে রাতের আঁধারে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি ছুটলাম দূরের মাঠে। সেখান থেকে ওদের এনে তুললাম গাড়িতে। তারপর শুরু হলো নতুন যাত্রা। পেছনে পড়ে রইল দূর অতীতের স্মৃতিমাখা সীতার কোট।
সুত্র: প্রথম আলো। খন্দকার মাহমুদুল হাসান | তারিখ: ১৯-০২-২০১০
No comments:
Post a Comment