Tuesday, October 26, 2010

সুখমন আর দুখমন

মামুনুর রশিদ | তারিখ: ২৬-১০-২০১০

দুপুর ছুঁইছুঁই। প্রখর রোদ। রোদ যেন দুষ্টুমি করেই চোখেমুখে পড়ছিল তাঁদের। রোদ থেকে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করছেন তাঁরা, যেন পেরে উঠছেন না। ঘেমে চলেছেন অবিরাম। শাড়ির আঁচল দিয়ে কয়েকবার ঘাম মুছে নিলেন। আবার ঘোমটা টেনে নিলেন গ্রাম্য বধূর মতো। রাজশাহীর বাগমারার চানপাড়া ভবানীগঞ্জ সেতুর পাশে ফুটপাতে পাশাপাশি বসে আছেন তাঁরা।
দুজনের পাশেই রয়েছে বাঁশের লাঠি। একটু দূর থেকে লক্ষ করছিলাম তাঁদের। চেহারায়ও অদ্ভুত মিল। বয়স আন্দাজ ৪২ অথবা ৪৫। উচ্চতায় অনেক ছোট। এ কারণেই চোখ আটকে গেল সেদিকে। তাঁদের সম্পর্কে জানার কৌতূহল হলো।
বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি, আপনাদের নাম কী?
এমন প্রশ্ন করতে দুজনেই হেসে ফেললেন। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করলেন। কে আগে জবাব দেবেন, এ নিয়ে যেন দ্বিধা। কোনোকিছুর ইঙ্গিত পাওয়ার আগেই খুব জোরেই একজন বললেন, ‘সুখমন।’ অপরজনের দিকে তাকাতেই তিনি একটু আস্তে বললেন, ‘দুখমন।’
সুখ আর দুঃখ যে তাঁদের জীবনের সঙ্গে গাঁথা রয়েছে তা তাঁদের সুরেই বোঝা গেল। এও বোঝা গেল, সুখ কত শক্তিশালী আর দুঃখ কত দুর্বল। তাঁদের কথার জোরই এর প্রমাণ। তবে, একটি তাঁদের জীবনের সঙ্গী হলেও অপরটির নাগাল পাননি তাঁরা। এই নামের মাঝেই সুখ, তা ভেবেই হয়তো সুখমন নিজের নামটা একটু জোরেই বলেছিলেন। মা-বাবা সে রকম ভেবেই হয়তো তাঁদের নাম রেখেছিলেন। হয়তো তাঁদের প্রত্যাশা ছিল, সুখমনের জীবনে সুখ আসবেই। তবে তা আর হয়নি। দুজনই যেন দুখমন হয়ে বেঁচে আছেন। একটি নামের সার্থকতা না পেলেও অপর নামের ঠিকই পেয়েছেন।
রাজশাহীর বাগমারার কাঁঠালবাড়ী গ্রামে তাঁদের বাড়ি। জানা গেল তাঁদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প। সুখমন আর দুখমন হয়ে ওঠার গল্পও শোনালেন তাঁরা। তাঁদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ দেখে কোনোকিছু রাখঢাক না করে নিজেরাই বলতে লাগলেন। তাঁরা সম্পর্কে বোন। তবে সুখমন ঘণ্টা খানেকের বড় দুখমনের চেয়ে। তাঁরা দুজনেই একসঙ্গে জন্মেছেন। তাঁদের পরে আরও চার বোন, তবে তাঁরা তাঁদের মতো প্রতিবন্ধী নয়। ছয় বোনের মধ্যে তাঁরাই বড়। বাবা হারুন অর রশিদ আর মা তছিয়া বেওয়া মারা গেছেন অনেক আগেই। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর প্রতিবন্ধী হয়েও ছোট বোনদের দায়িত্ব নিতে হয় তাঁদের। বড় হিসেবে অভিভাবকের দায় তো তাঁদের ঘাড়েই আসে। চেষ্টা করেছেন সে দায়িত্ব পালন করতে। এখনো পালন করে চলেছেন সে দায়িত্ব। উচ্চতায় খাটো হওয়ার কারণে নানা ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হয় তাঁদের। তার পরও সুখমন আর দুখমন নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছেন অনেকবার। তবে পারেননি অভাব, অনটন আর প্রতিবন্ধিতার কারণে। এটিই যেন তাঁদের জন্য অভিশাপ। একসময় বাড়িতে বসেই নকশিকাঁথা সেলাই করে বিক্রি করতেন সুখমন আর দুখমন। শুয়ে-বসে নিজেদের সুবিধামতো এ কাজ করতেন তাঁরা। এলাকার লোকজন তাঁদের কাছ থেকে সেগুলো কিনে নিয়ে যেতেন। এতে তাঁদের দু-চার পয়সা রোজগারও হতো। এভাবে ভালোই চলছিল তাঁদের। তবে সমস্যার কারণে বেশি দিন পারেননি এ পেশায় থাকতে। বেশিক্ষণ বসে থাকতে সমস্যা হয়, ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। পুরো শরীর ব্যথা হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে এ কাজ ছেড়ে দিতে হয় তাঁদের। অন্য কিছু খোঁজার চেষ্টা করেন দুজনেই। ভাবলেন, ঘরসংসার করলে হয়তো এ যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পাবেন।
ঘরসংসার করার আগ্রহও রয়েছে তাঁদের। অন্যদের মতো সংসার যসাজিয়ে নেবেন। সন্তান লালন-পালন করবেন—কত স্বপ্ন তাঁদের। এ স্বপ্ন ও ভাবনা থেকে আজ থেকে ১৬ বছর আগে সংসারও শুরু করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু বেশি দিন টেকেনি তাঁদের সংসার। সব স্বপ্ন যেন ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। দুখমনের বিয়ে হয়েছিল একই উপজেলার হামিরকুৎসা গ্রামের একজনের সঙ্গে। আর ফরিদপুরের এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সুখমনের। কিছুদিন সংসার করার পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাঁদের। প্রতিবন্ধিতার অপবাদে ভেঙে যায় সংসার। আর কোনো এক রাতে সুখমনকে রেখে চলে যান ফরিদপুরের প্রতারক স্বামী। আর সন্ধান পাওয়া যায়নি তাঁর। অনেক খুঁঁজেছেন, ভেবেছিলেন ফিরে আসবেন। এখনো আশা ছাড়েননি, তবে হতাশ সুখমন। সংসারের স্বপ্ন যেন স্বপ্নই থেকে গেছে তাঁদের। সে থেকেই তাঁরা আবারও একা।
নিজেদের উপার্জনে চলার অদম্য ইচ্ছা রয়েছে। টাকাপয়সা পেলে হয়তো কিছু একটা করতে পারবেন। শক্তি-সামর্থ্য কোনোটাই নেই তাঁদের। ইচ্ছা না থাকলেও জীবিকার তাগিদে মাঝেমধ্যে মানুষের সহযোগিতা নিতে হয় বেঁচে থাকার জন্য। তাঁরা চান না এ রকম সহযোগিতা নিতে। এ জন্য খুব খারাপ লাগে। অনাহার-অর্ধাহারেও থাকতে হয় সুখমন- দুখমনকে।
তাঁরা বেশিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে পারেন না। কিছু দূর গিয়েই উল্টে পড়তে হয় রাস্তার মধ্যে। এ জন্য দুই বোন বাঁশের লাঠি বানিয়েছেন এক জোড়া করে। লাঠির ওপর ভর করে কোনোরকমে চলাচল করেন। কয়েক মিনিট হাঁটার পরই বিশ্রাম নিতে হয়। জিরিয়ে নিয়ে আবার লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুকঠুক করে হেঁটে চলেন। নিজেদের স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, আশা-প্রত্যাশা আর বঞ্চনার কথা শুনিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা। কথার ফাঁকে ফাঁকে বারবার ঘোমটা টেনে ঢেকে দিচ্ছিলেন মুখমণ্ডল। ছবি তোলার প্রস্তাব দিতেই দুজনেই লাঠি হাতে করে লাফিয়ে উঠলেন। ঘোমটা টেনে কাছাকাছি এলেন সুখমন আর দুখমন। 
সুত্র: প্রথম আলো।

No comments: