১৭৯৫ সালের বসন্ত। পুরাতত্ত্ব সংগ্রাহক স্যামুয়েল আয়ারল্যান্ডের শিল্পকর্ম ভরা বাড়িতে ভিড় করেছেন পণ্ডিত, গণ্যমান্য ব্যক্তি, এক হবু বিশপ ও ইংল্যান্ডের রাজকবি। আয়ারল্যান্ডের ১৯ বছর বয়সী ছেলে উইলিয়াম হেনরির কিছু কাগজপত্র দেখতে এসেছেন তাঁরা। পুরোনো ট্রাঙ্ক হাতড়াতে গিয়ে ফিকে হয়ে আসা হলদে কাগজে লেখা কিছু কাগজ পাওয়ার কথা বলেছে হেনরি। সম্ভবত শেক্সপিয়ারের চিঠি, কবিতা ও রচনা সেগুলো। আইনি দলিলের চারটি স্বাক্ষর বাদে এ পর্যন্ত কবির নিজের হাতের লেখা টিকে থাকার কথা জানা ছিল না। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, শেক্সপিয়ার-রচিত এক অজ্ঞাত নাটকের অংশবিশেষ, যা হবে নাট্যকারের বিশাল রচনাসম্ভারে রোমাঞ্চকর নতুন সংযোজন।
স্যামুয়েল জনসনের সম্মানিত জীবনীকার জেমস বসওয়েল ছিলেন অতিথিদের একজন। দীর্ঘ সময় আলোর সামনে কাগজগুলো ধরে আলংকারিক লেখনী জরিপ করছিলেন। বেশ কয়েকবার এই মহান মানুষটি জরিপে বিরতি দিয়ে ব্র্যান্ডি আর পানি খেয়েছেন। অবশেষে দলিলগুলো টেবিলে রেখে সামনে ঝুঁকে সবচেয়ে ওপরের পৃষ্ঠায় চুমু খেয়ে দম ছেড়ে বললেন, ‘এবার সম্ভবত এত দিন বেঁচে থেকে তৃপ্ত হলাম।’ তিন মাস পরে ৫৪ বছর বয়সে দৃশ্যত তৃপ্ত মনেই মারা যান তিনি ।
শেক্সপিয়ারভক্ত বাবার কাছ থেকে সম্মান পেতে সাজানো নাটক হিসেবে সূচিত ব্যাপারটি খুব দ্রুত ইতিহাসের অবিশ্বাস্যতম ঐতিহাসিক সাহিত্যিক জালিয়াতির ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। ১৭৯৫ সালে প্রবল প্রতাপে শেক্সপিয়ারের রচনার স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন তরুণ আইনবিদ। চিঠি, কবিতা, ছবিসহ সবচেয়ে দুঃসাহসী কাজ ছিল শেক্সপিয়ারের সর্বাধিক পরিচিত নাটকের চেয়েও দীর্ঘ একটি নাটক হাজির করা। দ্রুততার সঙ্গে সারা হয়েছিল জালিয়াতির কাজ। যাচাইয়ে প্রথমে বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলেও বেশির ভাগ যাচাইকারীই শেষ পর্যন্ত ভ্রান্তি বোঝেননি। প্রাচীন দলিলপত্র বিষয়ে দক্ষতার জন্য খ্যাত কলেজ অব হেরাল্ডের সেক্রেটারি ফ্রান্সিস ওয়েব সদ্য আবিষ্কৃত নাটকটি নিঃসন্দেহে উইলিয়াম শেকিপয়ারেরই রচনা বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ‘হয় তাঁর কলম থেকে এসেছে, নয়তো স্বর্গ থেকে,’ বলেছেন তিনি।
উইলিয়াম হেনরির শেক্সপিয়ার হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। অভিনেতা, কবি কিংবা অন্ততপক্ষে নাট্যকার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও ছাত্র হিসেবে একেবারেই যাচ্ছেতাই ছিলেন তিনি। কোনো শিক্ষাই কাজে লাগায়নি। বাজে আচরণের দোষে বেশ কয়েকবার সাজা পেয়েছে। এমনকি বাবা-মাও ছেলেকে বোকাই জানতেন। এমনকি সামাজিকভাবে উচ্চাভিলাষী বাবা তাঁকে নিজের ছেলে বলে স্বীকার করতে চাননি। ছেলেকে লন্ডনের থিয়েটার এলাকার স্ট্র্যান্ডের নরফোক স্ট্রিটে এক আইনজীবী বন্ধুর প্রতিষ্ঠানে অল্প পরিশ্রমের কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। আইনবিদের চেম্বারে শত বছরের পুরোনো দলিলের মধ্যে ঘেরাও হয়ে মোটামুটি চোখের আড়ালেই দিন কাটাচ্ছিল উইলিয়াম হেনরি।
বাবার প্রাচীন সামগ্রী সংগ্রহের নেশা না থাকলে হয়তো এমন অজ্ঞাতবাসেই কেটে যেত উইলিয়াম হেনরির জীবন। স্যামুয়েলের সংগ্রহে ছিল হোগার্থ ও ভ্যান ডাইকের চিত্রকর্ম, বিরল বইপত্র, একটা টুকরো মমির আচ্ছাদন, মালবারি কাঠ খুদে বানানো রুপার আস্তরণ দেওয়া একটা গামলা, তাতে নাকি শেক্সপিয়ার গাছ লাগিয়েছিলেন।
‘প্রায়ই বাবা বলতেন, কবির নিজের হাতে লেখা কোনো কিছু পেলে অমূল্য রত্নে পরিণত হবে সেটা।’ ১৮৩২ সালে স্মৃতিচারণা করেছে উইলিয়াম হেনরি।
ঠিক কখন জালিয়াতির ভাবনা উইলিয়াম হেনরির মাথায় জায়গা করে নিয়েছিল, সেটা পরিষ্কার নয়। কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও তেমন একটা কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি তাঁর। ১৭৯৪ সালের বড়দিনের অল্প আগে নতুন কিছু করার চেষ্টার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বাবার একটা বইয়ে একটা প্রাচীন দলিলে শেক্সপিয়ারের প্যাঁচানো হাতের লেখার অনুলিপি চোখে পড়ে। চুপিসারে বইটা ল চেম্বারে এনে চোখ বুজে হুবহু নকল করতে না পারা পর্যন্ত হাত মকশো করে চলেন তিনি। পুরোনো খাজনার বই থেকে কাটা পার্চমেন্টে বই বাঁধাইকারীর রাসায়নিক পদার্থে কালি পাতলা করে নতুন একটা দলিল লিখে ফেলেন তিনি। আগুনের কাছে ধরে লেখা গাঢ় করে তারপর অফিসের পুরোনো দলিল থেকে কেটে নেওয়া মোমের সিল লাগান তাতে।
কয়েক দিন পর এক সন্ধ্যায় আয়ারল্যান্ডের ড্রয়িংরুমে হাজির হয়ে কোটের পকেট থেকে নতুন দলিল বের করে বাবাকে বলেন, ‘এই যে বাবা, এটা দেখো!’
সিলের দিকে বিশেষ নজর দিয়ে বেশ কয়েক মিনিট নীরবে দলিলটা পরখ করলেন তিনি। তারপর সেটা ভাঁজ করে রেখে কণ্ঠ শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললেন, ‘দলিলটা আসলই মনে হচ্ছে।’ কিন্তু কণ্ঠের সন্দেহ পুরো ঢাকতে পারলেন না ছেলের কাছে।
পরদিন সকালে বন্ধু, পুরোনো সিলমোহর বিশেষজ্ঞ স্যার ফ্রেডেরিক এডেনকে দলিলটা দেখালে তিনি সেটাকে কেবল খাঁটি বলেই নিশ্চিত করলেন না, বরং শেক্সপিয়ারের স্বাক্ষরের ঠিক নিচে সিলমোহরের ইমেজটাও শনাক্ত করলেন। এই আবিষ্কারে উত্তেজিত হয়ে পড়েন তাঁরা। নাট্যকারের স্বাক্ষর সত্যি না হয় কীভাবে, যেখানে তাঁর প্রতীকসহ সিল রয়েছে?
এ থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছিলেন উইলিয়াম হেনরি। লোকে তাদের ইচ্ছাটাকেই দেখতে চায়। জালিয়াতকে কেবল একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প ফাঁদতে হবে, শিকার বাকি অংশ পূরণ করবে। উইলিয়াম হেনরি গল্প ফেঁদেছিলেন: জনৈক ‘এইচ’ নামে এক ভদ্রলোকের পুরোনো ট্রাঙ্ক হাতড়াতে গিয়ে শেক্সপিয়ারের পুরোনো লেখার সন্ধান পেয়েছেন তিনি। বেশ পয়সাওয়ালা এই ‘এইচ’ ভদ্রলোক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে যা ইচ্ছে নিতে বলেছেন তাঁকে।
বাবাকে খুশি করতে ট্রাঙ্ক থেকে নতুন রত্ন খুঁজে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন উইলিয়াম হেনরি। প্রাচীন কাগজের প্রয়োজন মেটাতে পুরোনো বইয়ের ফ্লাইলিফ কেটে বেশ কিছু ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ফেলেন তিনি। বিভিন্ন অভিনেতার সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি, শেক্সপিয়ারের লেখা ও তাঁকে লেখা চিঠিপত্র, এমনকি তাঁর প্রেমিক অ্যানা হ্যাথওয়েকে নিয়ে লেখা একটা কবিতা পর্যন্ত। একগোছা চুল দিয়ে সেটাকে সম্পূর্ণতা দেওয়া হয়েছিল। একটা সুবিদিত নাটকের পাণ্ডুলিপি বানাতে ছাপানো সংস্করণকেই স্রেফ হাতের লেখায় পরিণত করেছিলেন তরুণ জালিয়াত। ব্যস, তাতেই মিলে যায় শেক্সপিয়ারের অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া মূল পাণ্ডুলিপি। এলিজাবেথীয় বানান নকল করতে সর্বত্রই ‘ই’ হরফ জুড়ে দিয়েছেন তিনি। নকল করার সময় নাটকের ভাষা পাল্টে দিয়েছেন। কোথাও লাইন বাদ দিয়েছেন। আবার কোথাও নিজের মতো এক-আধটা অনুচ্ছেদ জুড়ে দিয়েছেন। অল্পদিনের ভেতরই কিং লিয়ার-এর প্রথম খসড়া বাবার সামনে হাজির করেন তিনি; এর পর পরই হ্যামলেট-এর অংশবিশেষ।
অতীতের সব জালিয়াতির মতো উইলিয়াম হেনরি লক্ষ করেছিলেন, তাঁর দাবি যত বিরাট হচ্ছে, মানুষ ততই আগ্রহের সঙ্গে বিশ্বাস করছে। তাঁর সবচেয়ে দুঃসাহসী কাজ ছিল, শেক্সপিয়ারের হাতে লেখা অজ্ঞাত নাটক। আগের মতোই ট্রাঙ্কে ওটা পাওয়ার দাবি করেছিলেন তিনি।
বিষয় হিসেবে পঞ্চম শতাব্দীর ভোর্টিগার্ন নামে এক যুদ্ধবাজ সরদারকে বেছে নিয়েছিলেন হেনরি। কিংবদন্তি অনুযায়ী, রোয়েনা নামে এক নারীর প্রেমে পড়েন তিনি। শেক্সপিয়ারের মতো উইলিয়াম হেনরিও বাবার স্টাডি থেকে সরানো হোলিনশেডে’স ক্রনিকল অনুসরণ করেছেন এ নাটক লেখায়।
নতুন নাটকটা ছিল এলোমেলো, অনেক সময় বিভ্রান্তিকর ও গতিসামঞ্জস্যহীন। কবিতা প্রায়শই মামুলি, তবে ভোর্টিগার্ন অ্যান্ড রোয়েনায় কিছু অনুচ্ছেদ ছিল অনস্বীকার্যভাবে আকর্ষণীয়। কিন্তু শেক্সপিয়ারের নতুন আবিষ্কৃত লেখা প্রত্যাশীদের কাছে ওটা মাস্টারপিসের মতোই লেগেছে।
অতিথি ও সমালোচকেরা শেক্সপিয়ার তাঁর সেরা সৃষ্টিটাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে উইলিয়াম হেনরি একটা জাল চিঠি হাজির করতেন। এই চিঠিতে ইঙ্গিত ছিল যে, নাট্যকার এটিকে তাঁর সেরা সৃষ্টি বিচার করে প্রকাশকের প্রস্তাবিত অর্থের চেয়ে বেশি প্রত্যাশা করেছিলেন।
প্রায় ২০০ বছরের ভেতর প্রথমবারের মতো শেক্সপিয়ারের কোনো নাটকের প্রদর্শনী রাতের পর রাত থিয়েটার ভরে রাখবে, শেক্সপিয়ারের তেমন ভক্ত না হলেও রিচার্ড ব্রিন্সলি শেরিডান এটা জানতেন। সবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার দর্শকের বসার উপযোগী করতে ড্রুরি লেন থিয়েটারের সম্প্রসারণের কাজ শেষ করেছিলেন তিনি। এই সম্প্রসারণ ও জুয়ায় টাকা খুইয়ে তিনি ঋণের ভারে ভারাক্রান্ত। একমাত্র শেক্সপিয়ার-চমকই তাঁকে এখন উদ্ধার করতে পারে।
১৭৯৫ সালের বসন্তে ভোর্টিগার্ন যাচাই করতে স্যামুয়েল আয়ারল্যান্ডের বাড়িতে এলেন শেরিডান। স্টাডিতে বসে কয়েক পাতা পড়ার পর অকবিসুলভ, আসলে আনাড়ি মনে হওয়া একটা অনুচ্ছেদে এসে থমকে গেলেন।
‘খুব অদ্ভুত,’ আরও কয়েক পাতা পড়ার পর ফের থেমে মেজবানের দিকে চোখ তুলে তাকালেন তিনি, ‘কিছু কিছু সাহসী ধারণা আছে বটে, কিন্তু খুবই চাঁছাছোলা, ঠিকমতো আত্মস্থ হয়নি। এটা লেখার সময় শেক্সপিয়ার নিশ্চয়ই অল্পবয়সী ছিলেন।’
কিন্তু এর পর পরই আবার যোগ করলেন, ‘কেউই সংগৃহীত দলিলগুলো শেক্সপিয়ারের নয় বলে ভাববে না, কারণ কাগজ দেখে কে বলবে যে এগুলো প্রাচীন নয়?’ শেরিডানের কাছে ভোর্টিগার্ন তেমন ভালো ঠেকেনি, তবু ড্রুরি লেনের জন্য চাইলেন ওটা।
শেক্সপিয়ারের স্বহস্তে লেখা পাণ্ডুলিপির একটা সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করলেন স্যামুয়েল। দাম রাখা হবে চার গিনি, যা একজন শ্রমিকের কয়েক মাসের বেতনের সমান। এইচ ভদ্রলোকের অনুমতি নেই, দাবি করে ভীষণভাবে বাধা দিলেন উইলিয়াম হেনরি। ছাপার হরফে সাজানো হলে আরও অচেনা-অজানা লোকজনের পরীক্ষার মুখে পড়বে। ‘ওগুলোর প্রকাশনা প্রত্যক্ষ করার চেয়ে আমি বরং সব রকম তিরস্কার সহ্য করে আসল কথা স্বীকার করার কথা ভেবেছি,’ পরে লেখেন হেনরি ।
১৭৯৫ সালের ক্রিসমাস ইভে শেক্সপিয়ারের রচনা প্রকাশ করলেন স্যামুয়েল। লন্ডনের বেশ কয়েকটি পত্রিকা মহানন্দে হামলে পড়ল। ইংল্যান্ডে শেক্সপিয়ারের সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত এডমন্ড ম্যালোনে শেক্সপিয়ারের রচনাগুলো ভুল ও স্ববিরোধিতায় ভরা ‘আনাড়ি ও বেপরোয়া জালিয়াতি’ উল্লেখ করে বেশ বড়সড় নিবন্ধ লেখেন। রানির উদ্দেশে কথিত কবির ধন্যবাদ জানিয়ে লেখা একটি চিঠি সম্পর্কে ম্যালোনে লেখেন, ‘বানানগুলো এলিজাবেথ বা তাঁর আমলের তো নয়ই, বরং কোনো কালের বানানরীতিতেই পড়ে না।’ এত বিচিত্র ধরনের বিষয়বস্তু একটা ট্রাঙ্কে জমা হওয়ার ব্যাপারেও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
ম্যালোনে ভোর্টিগার্ন-এর প্রথম প্রদর্শনীর ঠিক দুই দিন আগে, ৩১ মার্চ ১৭৯৬ তারিখে লেখাটি প্রকাশ করেন।
নাটক শুরু হওয়ার আগেই ম্যালোনের নিবন্ধের সব কপি বিক্রি হয়ে যায়। তুমুল শোরগোল পড়ে যায়। তবে তাঁর যুক্তিগুলো অনেক পণ্ডিতসুলভ ও অনির্দিষ্ট হওয়ায় সবাইকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়।
প্রথম দুটি অঙ্ক ভালোয় ভালোয়ই সেরে গিয়েছিল। শেক্সপিয়ারের চেনা নাটকের রেশ ফসকানো সম্ভব ছিল না। এটা ছিল ম্যাকবেথ-এর সঙ্গে হ্যামলেট-এর মিশেল, সঙ্গে জুলিয়াস সিজার ও রিচার্ড-থার্ডের ছোঁয়া। আসলে বিভিন্ন চরিত্রের এমনি চেনাচেনা ভাবই হয়তো অনেক দর্শককে নিশ্চিত করে এটা শেক্সপিয়ারের রচনা।
ভোর্টিগার্ন নিশ্চিতভাবেই মহান নাটক ছিল না। তৃতীয় অঙ্কের অভিনয়ের সময়ই দেখা দিয়েছিল বিপর্যয়ের প্রথম লক্ষণ। একজন কুশীলব, কিম্বলের মতো একজন নামী অভিনেতা, লোক হাসাতে নিজের সংলাপ নিয়ে অতি-অভিনয় করে ফেলেন। শেষ দৃশ্যে দর্শক আরও অস্থির হয়ে ওঠেন। কিম্বল তখন পরিহাসময় গাম্ভীর্যের সঙ্গে রাজা ভোর্টিগার্নের মৃত্যুকে সম্বোধন করার সংলাপ উচ্চারণ করছিলেন। দর্শকদের হাসাতেই সংলাপের পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি। দর্শকেরা হাসিতে ফেটে পড়লেন। এখানেই হয়তো শেষ হয়ে যেত অভিনয়। কিন্তু কিম্বল সামনে গিয়ে দর্শকদের কাছে অভিনয় চলতে দেওয়ার অনুমতি চাইলেন।
শেষ দৃশ্য উৎসাহী প্রশংসা ও প্রলম্বিত টিটকারি ডেকে আনল। একপর্যায়ে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসীদের ভেতর শুরু হয়ে গেল মারপিট। ওই গন্ডগোলে প্রদর্শনীতে উপস্থিত উইলিয়াম হেনরি নিজেকে স্বস্তি বোধ করতে দেখে অবাক হয়েছিলেন। দীর্ঘমেয়াদি এই জালিয়াতি তিক্ত-ক্লান্তিতে ভরে তুলেছিল তাঁকে। শেক্সপিয়ারের লেখার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক চলেছিল আরও কয়েক মাস।
শেষে সবকিছু স্বীকার করে বিতর্কের ইতি টানেন হেনরি। বাবার মুখোমুখি হতে না পেরে বোন, মা ও বাবার এক পুরাতত্ত্ব সংগ্রাহক বন্ধুকে ব্যাপারটা প্রথম জানান তিনি। তাঁরা স্যামুয়েলকে জানান; কিন্তু তাঁর সরল মনের ছেলে এমন কাণ্ড করতে পারে, এ কথা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেন তিনি।
ক্ষুব্ধ উইলিয়াম হেনরি বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এক চিঠিতে বাবাকে লেখেন, ‘লেখাগুলোর লেখককে প্রতিভার জন্য তারিফ করার থাকলে, সেটা আমার প্রাপ্য, কারণ সেই ব্যক্তিটি আমি, তোমার ছেলে।’
শেক্সপিয়ারের রচনা খাঁটি ছিল, বিশ্বাস নিয়েই চার বছর পর স্যামুয়েল কবরে যান। প্রতারণার কাজটি করার সময় নাবালক ছিলেন উইলিয়াম হেনরি। এ কাজ থেকে তেমন কোনো ফায়দা নিতে পারেননি বলে আদালতেও তলব করা হয়নি তাঁকে।
উইলিয়াম হেনরি কখনোই তাঁর কাজের জন্যে অনুতাপ করেননি, বরং গর্ব করেছেন। সব সামাজিক উন্নাসিকতা, অর্থকষ্ট আর ১৮৩৫ সালে ৫৯ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে সাহিত্যিক হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হলেও টানা দেড় বছর সাফল্যের সঙ্গে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার হয়ে লোককে বোকা বানাতে পারায় তিনি গর্বিত ছিলেন। সূত্র: স্মিথসোনিয়ান
শওকত হোসেন | প্রথম আলো ।তারিখ: ১৬-০৭-২০১০
No comments:
Post a Comment