মহাসাগরের বুকে যাত্রা করা পালতোলা বিশাল এক জাহাজের কথা কল্পনা করুন। একটা কার্গো হোল্ড রয়েছে জাহাজটিতে। তার ভেতর আছে এক বস্তা আলু। ওই বস্তার একটা আলুর ভেতর বাস করে ছোট্ট এক পোকা।
ধরা যাক, জাহাজটি যে মহাসাগরের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলছে, তার প্রকৃতি উপলদ্ধি করার চেষ্টা করছে পোকাটা। মানুষের মহাবিশ্বের রূপরহস্য অনুসন্ধানের প্রচেষ্টাকে একবার আলুর ওই পোকার কার্যকলাপের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন বিখ্যাত এক বিজ্ঞানী। তিনি ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ স্যার আর্থার এডিংটন। মাত্রাগত দিক থেকে তুলনা করলে তিনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। তবে প্রকৃত অর্থে তাঁর কথাটা একদম ভুল। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে, আলুর ছোট্ট ওই পোকাকে জ্যোতির্বিদ ও কসমোলজিস্ট বললেই বেশি মানায়। ওই জ্যোতির্বিদ বা কসমোলজিস্ট হয়তো মহাবিশ্বের বিষয়বস্তু ও প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছেন।
মেঘমুক্ত স্বচ্ছ রাতে আকাশের দিকে এক পলক তাকালে একগুচ্ছ উজ্জ্বল নক্ষত্র ঝিলমিল করতে দেখতে পাবেন। তার সঙ্গে হয়তো দেখতে পাবেন রূপালী চাঁদ ও কিছু গ্রহ। আবার বিগ বিয়ারের মতো কিছু পরিচিত নক্ষত্রমণ্ডলও শনাক্ত করতে পারবেন কেউ কেউ। এসব দেখে কারও কারও ধারণা জন্মাতে পারে, মহাবিশ্ব হয়তো স্রেফ কিছু নক্ষত্রগুচ্ছ দিয়ে তৈরি। আর সেগুলো বিভিন্ন গ্রহ ও উপগ্রহসহ বেশ চিত্তাকর্ষক। কিন্তু না, এগুলোই মহাবিশ্বের সবটা নয়। আসলে এসব মহাজাগতিক বস্তু থেকে দূরে, আরও বহুদূরে মহাবিশ্বের আরও অনেক কিছু রয়েছে। তবে সেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না!
আকাশে যেসব নক্ষত্র দেখা যায়, তাদের প্রতিটিই আমাদের সূর্যের মতো। নক্ষত্রদের ওসব গুচ্ছকে বলা হয় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি (বাংলায় আকাশগঙ্গা ছায়াপথ)। টেলিস্কোপের মাধ্যমে উদঘাটিত হয়েছে, এরকম লাখো গ্যালাক্সি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের মহাবিশ্বে। এদের প্রতিটিই গঠিত হয়েছে বিপুল সংখ্যক নক্ষত্র দিয়ে। আবার এসব গ্যালাক্সির অবস্থান পরস্পরের কাছ থেকে বিপুল দূরত্বে। অন্য গ্যালাক্সিগুলো আমাদের কাছ থেকে এত দূরে রয়েছে যে সেগুলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। কাজেই রাতের আকাশে যেটুকু দেখা যায়, সেটা হলো বিশাল-বিপুল মহাবিশ্বের অতি সামান্য কণামাত্র। কাজেই আমাদের মহাবিশ্বকে সঠিকভাবে বুঝতে এবং একে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হলে প্রথমেই মহাজাগতিক বিবরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বড় বড় সংখ্যাগুলো আয়ত্ব করা জরুরি।
নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেটা করতে হবে। সেজন্য চলুন, আমাদের নিজেদের গ্রহ পৃথিবী দিয়ে কাজটা শুরু করা যাক। পৃথিবীর ব্যাসার্ধ প্রায় ৬ হাজার ৪০০ কিলোমিটার (সংক্ষেপে কিমি)। আধুনিক পরিবহন বা যাতায়াতের মানদণ্ডে এটা বেশ ছোট একটা সংখ্যা। পৃথিবীর চারপাশে একটা বাণিজ্যিক বিমান প্রায় ৪০ ঘন্টায় একপাক ঘুরে আসতে পারে। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের মহাজাগতিক বস্তুটির নাম চাঁদ। এই উপগ্রহটা পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০০,০০০ কিমি বা ৪ লাখ কিমি দূরে অবস্থিত। এই দূরত্বটা পৃথিবীর ব্যাসার্ধের ৬০ গুণ।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার অ্যাপোলো ১১ নভোযানে চড়ে প্রথমবার চাঁদে পা রেখেছিল পার্থিব মানুষ। এই দূরত্ব পাড়ি দিতে নভোযানটির সময় লেগেছিল প্রায় চার দিন। চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। প্রায় ৩০ দিনে পৃথিবীর চারদিকে একবার পাক খায় এটি। আবার পৃথিবী নিজেও সূর্যের চারদিকে প্রতিনিয়ত ঘুরছে। আমাদের গ্রহ থেকে সূর্য রয়েছে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন বা ১৫ কোটি কিমি দূরে। হিসেব মতে, এই দূরত্ব পাড়ি দিতে অ্যাপোলো ১১ নভোযানের সময় লাগবে প্রায় পাঁচ বছর।
সূর্যের চারপাশের বিভিন্ন দূরত্বের কক্ষপথে ঘুরছে পৃথিবীর মতো আরও কিছু গ্রহ। সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহটির নাম বুধ। এরপরে রয়েছে শুক্রগ্রহ (এটা আমাদের কাছে পরিচিত সন্ধ্যাতারা নামে)। সূর্যের তৃতীয় গ্রহটিই হলো আমাদের পৃথিবী। পৃথিবীর পরে আরও বেশি দূরত্বে রয়েছে যথাক্রমে মঙ্গল (লাল গ্রহ), বৃহস্পতি, শনি (এর বলয় রয়েছে), ইউরেনাস, নেপচুন এবং প্লুটো। [আসলে বৃহস্পতি, ইউরেনাস এবং নেপচুনেরও বলয় আছে। তবে এগুলো শনির বলয়ের তুলনায় নিতান্ত ছোট। সেজন্য শনির কথাই বিশেষভাবে বলা হয়েছে।—অনুবাদক] একসময় সৌরজগতের সবচেয়ে দূরবর্তী গ্রহ ছিল প্লুটো। এর দূরত্ব পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যবর্তী দূরত্বের প্রায় ৪০ গুণ। এভাবে আমাদের গ্রহ ব্যবস্থার ব্যাসার্ধ প্রায় ৬ হাজার মিলিয়ন কিমি। [চলতি শতকের প্রথম দিকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে প্লুটো। একে এখন বলা হয় বামন গ্রহ। কাজেই সৌরজগতের গ্রহের সংখ্যা এখন ৮টি।—অনুবাদক]
দেখা যাচ্ছে, দূরত্বগুলো এরই মধ্যে বেশ বড় হতে শুরু করেছে। কাজেই এসব বড় এককগুলোকে যদি জ্যোতির্বিদ্যাগত দূরত্বে প্রকাশ করা হয়, তাহলে আমাদের জন্য সুবিধাজনক। একটা পেন্সিলের দৈর্ঘ্য সেন্টিমিটারে মাপা যায়, কিন্তু দুটো শহরের মধ্যবর্তী দূরত্ব বেশ বড় একটা সংখ্যা। তাই একে মাপা হয় কিলোমিটার এককে। একইভাবে মহাজাগতিক মাত্রা প্রকাশের জন্য কিলোমিটারের মতো কোনো পার্থিব একক অপর্যাপ্ত। ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত এরকম একটা একক হলো ‘লাইট ইয়ার’ বা আলোকবর্ষ। এখানে ‘ইয়ার’ বা ‘বর্ষ’ শব্দটা থাকলেও এটা আসলে সময় পরিমাপের একক নয়, বরং দূরত্ব পরিমাপের একক। এক আলোকবর্ষ দূরত্ব হলো এক বছরে আলো যেটুকু দূরত্ব পাড়ি দেয়। এক সেকেন্ডে আলো পাড়ি দেয় প্রায় ৩০০,০০০ বা ৩ লাখ কিমি পথ [বা ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল]। সে হিসেবে এক আলোকবর্ষ হল প্রায় ১০ মিলিয়ন মিলিয়ন কিমি। পুরোটা অঙ্কে লিখলে সংখ্যাটা হবে এরকম: ১০,০০০,০০০,০০০,০০০ কিমি। লেখার সুবিধার্থে এ পরিমাণ বোঝাতে আমরা ১০১৩ কিমি চিহ্ন ব্যবহার করি। এই চিহ্নের মানে হলো ১০ সংখ্যাটিকে ১৩ বার গুণ করা বা ১-এর পর ১৩টি শূন্য। কাজেই এক আলোকবর্ষ মানে প্রায় ১০১৩ কিমি বলা যায়।
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে সূর্য যেমন গড়পড়তা একটা নক্ষত্র, মহাবিশ্বের বিপুল সংখ্যক গ্যালাক্সির ভেতর আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিও তাই। শক্তিশালী টেলিস্কোপে দেখা গেছে, মহাবিশ্বে আমাদের নিজে গ্যালাক্সির মতো প্রায় ১০০ মিলিয়নের বেশি গ্যালাক্সি রয়েছে।
আমরা যখন বড় পরিসরের কথা বিবেচনা করি, তখন আলোকবর্ষ আসলেই দরকারি একক। আগেই বলেছি, মিল্কিওয়ে নামে আমাদের গ্যালাক্সিতে নক্ষত্রের সংখ্যা প্রায় ১০০,০০০ মিলিয়ন। এসব নক্ষত্রের ভেতর সূর্যও একটা সাধারণ নক্ষত্র। সংক্ষিপ্ত প্রতীক পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা বলতে পারি, আমাদের গ্যালাক্সিতে নক্ষত্র রয়েছে প্রায় ১০১১টি। আমাদের সূর্যের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রের নাম প্রক্সিমা সেন্টাউরি (এর অবস্থান সেন্টোরাস নক্ষত্রমণ্ডলে)। নক্ষত্রটি আমাদের কাছ থেকে প্রায় ৪ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। অন্য কথায়, একটা আলোক রশ্মি আমাদের সৌরজগতের গ্রহব্যবস্থা পাড়ি দিতে সময় লাগে প্রায় ১১ ঘন্টা। আর সেই আলো আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টাউরিতে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় চার বছর! (এই পথ পাড়ি দিতে অ্যাপোলো ১১ নভোযানের সময় লাগবে প্রায় এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ বছর!) পৃথিবীর আকাশে যেসব নক্ষত্র খালি চোখে দেখা যায়, তার সবই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্তর্গত। এগুলো আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত। তাদের প্রতিটিই আমাদের সূর্যের মতোই অনেক বড় ও উজ্জ্বল। আবার তাদের চারপাশে সৌরজগতের মতো গ্রহব্যবস্থাও থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটির নাম সিরিয়াস। আমাদের কাছ থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৮ আলোকবর্ষ। অরিয়ন বা কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডলে আমাদের পরিচিত নক্ষত্র লাল বর্ণের বেটেলজুস বা আর্দ্রা। নক্ষত্রটির দূরত্ব প্রায় ৬৪২ আলোকবর্ষ। আমাদের কাছ থেকে পোল স্টার বা ধ্রুবতারার দূরত্ব প্রায় ৪৫০ আলোকবর্ষ। ধ্রুবতারা থেকে আমরা আজকে যে আলো পাচ্ছি, তা আসলে নিঃসৃত হয়েছে সেই ১৭ শতকের মাঝামাঝি!
সর্বশেষ হিসেবে, গোটা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ব্যাপ্তি প্রায় এক লাখ আলোবর্ষ। এই ছায়াপথকে বর্ণনা করতে গেলে আমরা দেখতে পাব, আলোকবর্ষও অপর্যাপ্ত বা ছোট একক। সে কারণে জ্যোতির্বিদরা এর চেয়ে বড় একটা একক ব্যবহার করেন। এর নাম কিলোপারসেক (সংক্ষেপে কেপিসি বা kpc)। এক কিলোপারসেক প্রায় ৩ হাজার আলোকবর্ষের সমান। কোনো সাধারণ ছায়াপথের ব্যাসার্ধ প্রায় ১৫ কেপিসি। মহাবিশ্ব ম্যাপিং করার ক্ষেত্রে কিলোপারসেক একক সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। (এই এককে মিল্কিওয়ের ব্যাপ্তি প্রায় ৩০ কেপিসি।)
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে সূর্য যেমন গড়পড়তা একটা নক্ষত্র, মহাবিশ্বের বিপুল সংখ্যক গ্যালাক্সির ভেতর আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিও তাই। শক্তিশালী টেলিস্কোপে দেখা গেছে, মহাবিশ্বে আমাদের নিজে গ্যালাক্সির মতো প্রায় ১০০ মিলিয়নের বেশি গ্যালাক্সি রয়েছে। মিল্কিওয়ের নিকটতম বড় গ্যালাক্সিটির নাম অ্যান্ড্রোমিডা। এর দূরত্ব প্রায় ৭৭০ কেপিসি (প্রায় ২.৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ)। অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রমণ্ডলে একে খালি চোখে অস্পষ্ট ফুটকি হিসেবে দেখা যায়। মিল্কিওয়ের মতোই অ্যান্ড্রোমিডাও গঠিত হয়েছে প্রায় ১০১১টি নক্ষত্রের সমাহারে। (মনে আছে নিশ্চয়, ১০১১ মানে হলো ১০০,০০০,০০০,০০০ বা ১-এর পর ১১টি শূন্য। এই বইতে প্রতীকটা আমরা বারবার ব্যবহার করব।) তবে ছায়াপথটা আমাদের কাছ থেকে বহুদূরে থাকায় এর ভেতরের নক্ষত্রগুলোকে আমরা খালি চোখে আলাদাভাবে দেখতে পাই না।
মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমিডার চারপাশে আরও প্রায় ৩০টি গ্যালাক্সি রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটাকে বলা হয় ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি বা বামন ছায়াপথ। সেগুলোর আকার বেশ ছোট এবং তাদের প্রতিটিতে মাত্র প্রায় দশ লাখ বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি নক্ষত্র থাকতে পারে। বাকি গ্যালাক্সিগুলো বেশ বড়। মিল্কিওয়ে, অ্যান্ড্রোমিডা এবং এসব গ্যালাক্সি একত্রে মিলে এরপরের মহাজাগতিক একক গঠন করেছে। এদের সাধারণত বলা হয় লোকাল গ্রুপ অব গ্যালাক্সি । এই লোকাল গ্রুপের আকার প্রায় ৩ হাজার কেপিসি (বা ১০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ) বা ৩ মেগা পারসেক। (১০০০ কিলোপারসেককে বলা হয় ১ মেগাপারসেক। সংক্ষেপে এমপিসি বা Mpc।)
দল বা গুচ্ছাকারে গ্যালাক্সিদের একত্রিত হওয়াটা আমাদের মহাবিশ্বের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। জ্যোতির্বিদরা বিপুল সংখ্যক গ্যালাক্সি ক্লাস্টার বা গ্যালাক্সিগুচ্ছ শনাক্ত করেছেন। এদের মধ্যে অনেকগুলোই আমাদের লোকাল গ্রুপের চেয়ে অনেক অনেক বড়। আমাদের লোকাল গ্রুপে গ্যালাক্সির সংখ্যা প্রায় ৮০টি। [সাম্প্রতিক হিসেবে, লোকাল গ্রুপের সদস্য অন্তত ৮০, যার বেশিরভাগই বামন ছায়াপথ। তবে সঠিক সংখ্যাটা এখনও জানেন না জ্যোতির্বিদেরা।—অনুবাদক] গ্যালাক্সি ক্লাস্টারগুলোর মধ্যে কিছু বড় ক্লাস্টারে প্রায় ১ হাজারটি গ্যালাক্সিও থাকতে দেখা গেছে। এদের মধ্যে একটার নাম কোমা ক্লাস্টার।
পৃথিবী থেকে ধাপে ধাপে সুপারক্লাস্টার পর্যন্ত (অন্য কথায়, মহাজাগতিক সিঁড়ি) পৌঁছাতে আমাদের কাঠামোগুলোকে একটি শ্রেণিবিন্যাসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোটটা হলো কোনো নক্ষত্রের চারপাশের গ্রহব্যবস্থা বা প্ল্যানেটারি সিস্টেম।
মহাবিশ্বে গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের চেয়ে বড় কোনো কাঠামো আছে কি? বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, ক্লাস্টারগুলো নিজেরাই আরও বড় সমষ্টি গঠন করে। একে বলা হয় সুপারক্লাস্টার। এদের একেকটার আকার প্রায় ৩০ থেকে ৬০ মেগাপারসেক। যেমন আমাদের লোকাল গ্রুপকে ভার্গো সুপারক্লাস্টারের এক প্রান্তিক সদস্য বলে মনে করা হয়। তবে গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের মতো সুপারক্লাস্টারের সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তাহলে আমাদের মহাবিশ্বটা কত বড়? শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আমরা এখন পর্যন্ত ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার মেগাপারসেক দূরত্ব পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছি। অন্য কথায়, আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণযোগ্য এলাকার আকার একটা গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের চেয়ে প্রায় ১ হাজার গুণ বড়। [জ্যোতির্বিদদের সাম্প্রতিক হিসেব মতে, একটা গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের চেয়ে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব কয়েক হাজার গুণ বড় (প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার গুণ)। পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের দূরত্ব যেকোনো দিকে প্রায় ১৪ দশমিক ২৬ গিগাপারসেক বা ৪৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ (১ হাজার মেগাপারসেক = ১ গিগাপারসেক বা জিপিসি)। কাজেই গোলকীয় পর্যবেক্ষণযোগ্য এই মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ২৮ দশমিক ৫ গিগাপারসেক বা ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ।—অনুবাদক]
হয়তো খেয়াল করেছেন, পৃথিবী থেকে ধাপে ধাপে সুপারক্লাস্টার পর্যন্ত (অন্য কথায়, মহাজাগতিক সিঁড়ি) পৌঁছাতে আমাদের কাঠামোগুলোকে একটি শ্রেণিবিন্যাসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোটটা হলো কোনো নক্ষত্রের চারপাশের গ্রহব্যবস্থা বা প্ল্যানেটারি সিস্টেম। এ ধরনের একটা ব্যবস্থার আকার হতে পারে প্রায় ১০ আলোক-ঘন্টা। অন্যদিকে ছায়াপথ গঠন করা নক্ষত্রের সমাহারে আকার হতে পারে প্রায় ২০ কেপিসি (যেখানে নক্ষত্রের সংখ্যা হতে পারে প্রায় ১০১১টি) । গ্যালাক্সিগুলো নিজেরা একত্রিত হয়ে একটা দল এবং গুচ্ছ গঠন করে, যার গড়পড়তা আকার কয়েক মেগাপারসেক হতে পারে। আবার গ্যালাক্সি ক্লাস্টার বা ছায়াপথগুচ্ছ হলো সুপারক্লাস্টারের অংশ, যার আকৃতি প্রায় ৫০ মেগাপারসেক বা তারও বেশি। আর মহাবিশ্বের গোটা পর্যবেক্ষণযোগ্য এলাকার আকার প্রায় ১৪ দশমিক ২৬ গিগাপারসেক।
যদি ধরে নেওয়া হয় প্রায় ১ সেমি আকারের একটা সিকি পয়সা গ্রহব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করছে, তাহলে আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রটি হবে প্রায় ৬০ মিটার দূরে। আর আমাদের গ্যালাক্সির আকার হবে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার (মিল্কিওয়ের সীমা প্রায় এক লাখ আলোকবর্ষ হিসেবে)! এখান থেকে আমাদের বোঝা উচিত, আমরা যে গ্যালাক্সিতে বাস করি, তার তুলনায় আমাদের সৌরজগৎ কতটা ক্ষুদ্র। গ্যালাক্সিদের ক্লাস্টারের আকার এর চেয়ে আরও ১ হাজার গুণ বড়। আর গোটা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব আরও কয়েক হাজার গুণ বড়!
মহাজাগতিক এই সিঁড়ির একদম নিচে রয়েছে সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণনরত গ্রহগুলো। তাহলে এই শ্রেণিবিন্যাসের বড় বড় কাঠামো বিষয়টা কী? দেখা যাচ্ছে, ওপরে বর্ণিত কোনো কাঠামোই স্থির নয়। এক্ষেত্রে সূর্য বা গ্যালাক্সির অন্য নক্ষত্রগুলো গ্যালাক্সিতে সেকেন্ডে প্রায় ২০০ কিমি গতিতে ঘুরছে (সংক্ষেপে কিমি সে-১ বা কিমি/সে)। এমনকি আমাদের গ্যালাক্সিও স্থির নেই। সেটাই অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির দিকে প্রায় ১০০ কিমি সে-১ গতিতে ছুটে যাচ্ছে। আবার গোটা লোকাল গ্রুপ প্রায় ৬০০ কিমি সে-১ গতিতে ছুটে যাচ্ছে (ভার্গো সুপারক্লাস্টারের দিকে কোথাও)। এখানে গতি এবং মহাকর্ষীয় বলের মধ্যে একটা সূক্ষ্ণ ভারসাম্য রয়েছে, যা আমাদের মহাবিশ্বকে সচল রেখেছে।
প্রদত্ত বিভিন্ন সিস্টেমের আকার ও এসব সিস্টেমের সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বস্তুর গতি থেকে এসব কাঠামোর প্রতিটি কক্ষপথের সময় গণনা করা যায়। সবচেয়ে ছোট পরিসরে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে একপাক ঘুরতে সময় নেয় এক বছর। সেখানে সবচেয়ে দূরের বামনগ্রহ প্লুটো নেয় ২৫০ বছর। গ্যালাক্সিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাল পরিসর বেশ বড়। যেমন সূর্যের মতো একটা নক্ষত্র আমাদের গ্যালাক্সির চারপাশের কক্ষপথে একপাক ঘুরে আসতে সময় নেয় ২০০ মিলিয়ন বছর। আবার কোনো গ্যালাক্সি একটা ক্লাস্টারের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে যেতে সময় লাগে প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর। আমাদের মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তুর বয়সের সঙ্গে এসব সংখ্যার তুলনা করা বেশ মজার। হিসেব মতে, আমাদের পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন বছর। অন্য কথায়, পৃথিবী গঠিত হওয়ার পর থেকে তা সূর্যের চারপাশে ৪ বিলিয়নের বেশি বার ঘুরে এসেছে। সূর্যের মতো সাধারণ নক্ষত্রের আয়ু প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর। এ সময়কাল গ্যালাক্সির চারপাশে ঘুরে আসার চেয়ে প্রায় ৫০ গুণ বেশি। বিভিন্ন গ্যালাক্সি, ক্লাস্টার ইত্যাদির মতো বড় বড় কাঠামোর সঠিক বয়স কত, তা আমরা এখনো নিশ্চিত জানি না। তবে আধুনিক হিসেবে এর বয়স প্রায় ১৩ বিলিয়ন বছর হতে পারে [সাম্প্রতিক হিসেবে ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৭০ কোটি বছর]। এই সময়কালেই মহাবিশ্বের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ মহাজাগতিক ঘটনাগুলো ঘটেছিল।
প্রথম গ্যালাক্সিটা গড়ে উঠছিল প্রায় ১২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২০০ কোটি বছর আগে [সাম্প্রতিক হিসেবে ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি বছর আগে]। আর ওই গ্যালাক্সির ভেতরের পদার্থ থেকে একে একে গড়ে উঠেছিল নক্ষত্র ও গ্রহগুলো।
আমাদের মহাবিশ্ব যে চমকপ্রদ বৈচিত্র দেখায়, তা শুধু মাত্রাগত দিক দিয়েই সীমাবদ্ধ নয়, বিভিন্ন পরিসরে এর ভৌত পরিঘটনাও প্রচণ্ডভাবে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলোর আকার ও বয়স বিভিন্ন রকম। এখানে কিছু নক্ষত্র তাদের শৈশব অবস্থায় রয়েছে, আবার কিছু নক্ষত্র রয়েছে মধ্য বয়সে এবং কিছু বার্ধক্যে। মৃত নক্ষত্রদের কিছু অবশিষ্টাংশও দেখা যায়, যাকে বলা হয় হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত বামন, নিউট্রন স্টার এবং সম্ভবত ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। এই গ্যালাক্সিতে এমন কিছু অঞ্চলও আছে, যেখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও ধুলি। সেগুলো উজ্জ্বল নক্ষত্রদের চেয়ে ভিন্ন রকম আচরণ করে। এর পরের পর্বে গ্যালাক্সিগুলোকেও বিভিন্ন রকম আকার ও আকৃতি এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের মহাবিশ্বে কোয়াসারের মতো কিছু রহস্যময় বস্তুও আছে।
ওপরের বিবরণ বেশ কিছু প্রশ্ন তোলে: গ্রহ থেকে সুপারক্লাস্টারের মতো এসব কাঠামো গড়ে উঠল কীভাবে? এরা কবে গড়ে উঠল? সেগুলো নিজেদের ধর্মগুলো পেল কোন ভৌত প্রক্রিয়ায়? মহাকাশে এরা কীভাবে বিন্যস্ত? ভবিষ্যতে এসব কাঠামোর এবং মহাবিশ্বের ভাগ্যে কী ঘটবে?
এসব প্রশ্নগুলোর এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত বেশকিছু উত্তর খুঁজে পেয়েছে আধুনিক কসমোলজি। এসব দেখে মনে হয়, প্রথম গ্যালাক্সিটা গড়ে উঠছিল প্রায় ১২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২০০ কোটি বছর আগে [সাম্প্রতিক হিসেবে ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি বছর আগে]। আর ওই গ্যালাক্সির ভেতরের পদার্থ থেকে একে একে গড়ে উঠেছিল নক্ষত্র ও গ্রহগুলো। বিভিন্ন গ্যালাক্সি একত্রিত হয়ে পারস্পারিক মহাকর্ষীয় আকর্ষণের অধীনে আসার পর সম্ভবত গড়ে উঠেছিল ক্লাস্টার ও সুপারক্লাস্টারগুলো মতো বড় বড় কাঠামোগুলো। পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়মগুলোর প্রেক্ষিতে এসব ঘটনাগুলো বোধগম্য বলে মনে হয়। এসব নিয়মের মাধ্যমে বস্তু ও বিকিরণের চরিত্র ব্যাখ্যা করা যায়। পরে এ বিষয়গুলো নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করবো।
অনুবাদক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
মূল: আফটার দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস: আমাদের মহাবিশ্বের কাহিনি/ থানু পদ্মানাভান