আলপনা, এক ধরনের লোকশিল্প এবং মানুষের সহজাত অভিব্যক্তি বলা যায়। এতে সমাজের অতীত অভিজ্ঞতা যেমন প্রকাশ পায়, তেমনি একই সঙ্গে ফুটে ওঠে বর্তমানের অস্তিত্ব। প্রধানত মহিলারাই এ লোকশিল্পটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তারা একই সঙ্গে বহু পুরনো ঐতিহ্য যেমন ধরে রেখেছে, তেমনি নতুন আঙ্গিক ও বর্ণের সংযোজনেও এ শিল্প হয়েছে সপ্রতিভ। প্রকৃতির রূপ বদলের সঙ্গে তারা যেমন পরিচিত, তেমনি তাদের সৃজনশীলতাও ঋতুচক্রকে দেয় পৃথক মাত্রা। বাংলার মহিলারা বেশ কয়েকটি ব্রত পালন করেন। এ ব্রত পালনে কাদামাটির প্রকৃতি ও আলপনা একটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে চলে আসে। পূর্বসূরিদের কাছ থেকে শেখা নকশায় তারা অলঙ্কৃত করে তোলে তাদের গৃহ, রাঙায় ঘরের দেয়াল। প্রচলিত রীতির সঙ্গে প্রায় প্রত্যেকেই স্বীয় মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করে কল্পনার আপন ভুবন। সাধারণ চালের গুঁড়ার পিটালির মধ্যে ছোট এক টুকরা কাপড় চুবিয়ে নিয়ে এ নকশা করা হতো। সম্ভবত সাদা চালের গুঁড়া ছিটিয়ে অথবা ছড়ানো চালের গুঁড়ার আস্তরণের উপরে দাগ কেটে আলপনা করা হতো। আলপনা শব্দটির উৎপত্তি সম্ভবত সংস্কৃত 'আলিমপনা' থেকে। এর অর্থ প্লাস্টার করা অথবা প্রলেপ দেওয়া। কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে, আলপনা শব্দটি সম্ভবত এসেছে 'আলিদোনা' থেকে। এর অর্থ আইল অথবা বাঁধ দেওয়া। প্রাচীন কোনো শিল্পবিষয়ক গ্রন্থে আলপনার উল্লেখ পাওয়া যায় না, যদিও কোথাও কোথাও রঙ্গবলীর উল্লেখ পাওয়া যায়। রঙ্গবলী দ্বারা রং করা লতানো নকশা বোঝায়। এ শিল্পের বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, রঙ্গবলী ছিল এক ধরনের আলপনা। আলপনা শিল্পের কাল নিরূপণ করা কঠিন। অনেক পণ্ডিতই ব্রত ও পূজার সঙ্গে সম্পর্কিত আলপনাকে প্রাক-আর্য সময়কালের উৎপত্তি বলে চিহ্নিত করেন। কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন যে, আমরা আলপনার উত্তরাধিকার লাভ করেছি অস্ট্রিক জাতির কাছ থেকে। যারা আর্যদের আগমনের অনেক আগ থেকেই এ দেশে বাস করত। তাদের মতে, ধর্মীয় আচার সংবলিত ও ঐতিহ্যগত লোকশিল্পসমূহ, প্রকৃতপক্ষে কৃষি যুগে শস্যের প্রচুর উৎপাদন ও অপদেবতা বিতাড়নের নিমিত্তে উদ্ভূত। সে সময় নকশার মূল উপাদান ছিল চালের গুঁড়া, পানিতে গোলানো চালের মণ্ড, শুকনো পাতা গুঁড়ো করে তৈরি রংয়ের গুঁড়া, কাঠকয়লা, পোড়ামাটি ইত্যাদি। সাধারণত মেঝের উপরই আলপনা করা হতো। স্মরণাতীতকাল থেকেই বাংলার মহিলারা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদির উদ্দেশ্যেই এ নকশার অনুশীলন করে আসছেন। বিভিন্ন প্রজন্মের চিত্রকরদের সুবিধার্থে আলপনার উপস্থাপনা ব্যাপকভাবে যুগের প্রচলিত রীতিতে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তারপরও আলপনা তার ঐতিহ্যগত বেশিষ্ট্য প্রকাশ করতে সক্ষম। আলপনার স্বাতন্ত্র্য ও একই রূপ এঁকে দিয়েছে একটি সূক্ষ্ম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। গোলাকৃতির আলপনা দেবীর পূজায়, বিশেষ করে লক্ষ্মীপূজায় পবিত্র বেদি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আলপনায় ব্যবহৃত মোটিভগুলো হলো_ সূর্য, ধান গাছ, পেঁচা, মই, লাঙল, লক্ষ্মীর পা, মাছ, পান, পদ্ম, শক্সখলতা, সিঁদুরকৌটা ইত্যাদি। বাংলার আলপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিমূর্ত, আলঙ্কারিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্তমান যুগে মুসলমানরাও বিয়ে ও অন্যান্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আলপনা অঙ্কন করে থাকেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও মিনার সংলগ্ন সড়কগুলোতে এবং নববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা এবং অন্যান্য স্থানে প্রচুর আলপনা তৈরি করা হয়। এটি সত্য যে, বাংলাদেশে আলপনা একটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হিসেবে বিবেচিত।
শামীম রহমান রিজভী
শামীম রহমান রিজভী
Ref: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=09-01-2011&type=gold&data=Cricket&pub_no=253&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=1