অধ্যাপক ড. এ আর মল্লিক আমার কাছে একটি অতি শ্রদ্ধেয় নাম। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের দীর্ঘকাল শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষকতাই ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা। ১৯৪৮ সালের মার্চের সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেপথ্যে রাজশাহীতে যে কজন বুদ্ধিজীবী শিক্ষক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক মল্লিক অন্যতম। ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট মহসীন প্রামাণিক লিখেছেন, ‘ড. আবুল কাশেম চৌধুরীর কাছে জানতে পারি যে ড. মল্লিক ৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তান হাসিলের আনন্দমিছিল শেষে সন্ধ্যার সময় ১০-১২ জন ছাত্রনেতা তাঁর বাড়িতে যান, তখনই তিনি ইতিহাসবিদ হিসেবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, “পাকিস্তান তো তোমরা হাসিল করলে, কত দিন পাকিস্তান টেকে, তাতে আমার সন্দেহ আছে।” যে পণ্ডিত ব্যক্তি পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই এই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন বা করার মতো সাহস রাখেন, তিনি প্রকৃত পণ্ডিত ও সাহসী। আমি এ ব্যাপারে ড. মল্লিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম এবং তিনি এ কথা স্বীকার করেন।’ (সূত্র: রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন: স্মারকপত্র, সম্পাদক অধ্যাপক তসিকুল ইসলাম)।
আমাদের জাতীয় জীবনের মহত্তম ঘটনা রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণে বুদ্ধিজীবীসমাজের মধ্যে ড. মল্লিকের নাম অগ্রগণ্য। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনের (২-২৫ মার্চ ১৯৭১) সঙ্গে তিনি একাত্মতা প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি দ্বিধাহীনচিত্তে যোগ দেন। এ প্রসঙ্গে ড. মল্লিক তাঁর আত্মজীবনী আমার জীবন কথা ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম গ্রন্থে লিখেছেন, ‘নিজ পরিচয়ে নিজ দেশে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করব, নাকি পাকিস্তানিদের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকব—এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাকে মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিত হতে হয়নি।’ ১৯৬৬ সালে ড. মল্লিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এ দায়িত্ব পালনকালেই শুরু হয় আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। নিজ কর্মক্ষেত্রে একজন সেনানায়কের মতো তাঁর নেতৃত্বে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় উপাচার্যের কার্যালয় হয়ে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মুক্তিসংগ্রামের সদর দপ্তর। এখানে অধিনায়কত্ব করেছেন উপাচার্য ড. মল্লিক। একপর্যায়ে চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে গেলে তিনি ভারতে চলে যান। ড. মল্লিকের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের সব পর্যায়ের বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন ‘লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেনসিয়া’, যেখানে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। এ ছাড়া বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গঠিত হলে ড. মল্লিক সভাপতি আর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে এবং গান্ধী শান্তি সংস্থার সহায়তায় আয়োজিত (১৮-২০ সেপ্টেম্বর ’৭১) ওয়ার্ল্ড মিট অন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার পরিমাণ আরও বাড়ানো এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেছেন। এরপর ভারত থেকে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেন। সেই সময়কালে আমেরিকা ও ইউরোপের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতিসংঘে স্বাধীনতার অনুকূলে অকাট্য যুক্তি এবং পূর্ব বাংলায় সংঘটিত মানববিনাশী ও পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের চিত্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তিনি স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেন।
মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরু থেকে ড. মল্লিকের বিশ্বাস ছিল, মুক্তিযুদ্ধ সফল হবেই এবং ডিসেম্বরের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন, ‘১৫ এপ্রিল সকালে ড. মল্লিক, তাঁর বড় জামাই ড. জিয়া উদ্দিন আহম্মেদ, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ড. রশিদুল হক ও ড. মাহমুদ শাহ কোরেশীকে বিদায় জানালাম। আমি স্বভাবত ভাবপ্রবণ নই। কিন্তু যে মুহূর্তে তাঁরা দেশের মাটি থেকে পা তুলতে গেলেন, সেই মুহূর্তে কেঁদে ফেললাম। মল্লিক সাহেব আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “ডোন্ট ইউ ওরি। এ পথেই আমরা একসঙ্গে ফিরে আসব—বিফোর দি ইয়ার ইজ আউট।” কেন এবং কিসের জোরে কথাটা তিনি বলেছিলেন, জানি না। তবে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টায় তিনি এই বিশ্বাস লালন করেছিলেন এবং অন্যদেরও বলেছিলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা স্বাধীন দেশে ফিরে যাব।”’ (সূত্র: আমার একাত্তর, আনিসুজ্জামান)। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বলার মতো। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সফল একজন কূটনীতিবিদ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু জাতিকে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষ পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙেচুরে দিয়ে যায়, যাতে সমস্যার চাপে এবং অর্থনীতির বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এর অস্তিত্ব হয় বিপন্ন। বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ড. মল্লিক দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিকে সফল করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি অনেকটা সফল হয়েছিলেন। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড না ঘটলে এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে দারিদ্র্যের বহুমাত্রিক সমস্যা দূর করে দেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যেত। জাতির জনক শেখ মুজিব সপরিবারে শহীদ হওয়ার দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে ড. মল্লিকের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘যে দলটির ছত্রচ্ছায়ায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, সেটি আবার ক্ষমতাসীন হয়েছে, আর দুঃখ নেই, এখন শান্তিতে মরতে পারব।’ (সূত্র: আত্মজৈবনিক গ্রন্থ আলো ছায়ায় সাত পুরুষ, অধ্যাপক সৈয়দ মকসুদ আলী)। অধ্যাপক সৈয়দ মকসুদ আলীর ভাষায়, ‘তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণের চেয়ে ভালোবেসেছেন, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেছেন বলেই স্বদেশকেও ভালোবাসতে পেরেছিলেন।’ বঙ্গবন্ধুও তাঁকে খুবই শ্রদ্ধাপূর্ণ চোখে দেখতেন। ১৯৮৩ সালে সম্পূর্ণ বাঙালি মূলধনে বাংলাদেশি নাগরিকদের মালিকানায় ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হলে ড. মল্লিক প্রতিষ্ঠানটির প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। আশির দশকে গঠিত শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তানদের হাতে গড়া সংগঠন ‘প্রজন্ম ৭১’-এর প্রতি তিনি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। এদের বিভিন্ন কার্যক্রমে মুক্তিযোদ্ধা এই বুদ্ধিজীবীর সমর্থন ও সহায়তা ছিল অপরিসীম।
১৯১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্ম আর ১৯৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পবিত্র লাইলাতুল কদরের রাতে ৭৯ বছরের বর্ণিল জীবনের ইতি টেনে দেহান্তরিত হয়েছেন। অসাধারণ মানুষ ড. মল্লিকের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করছি বিনম্র শ্রদ্ধা, সম্মান ও গভীর ভালোবাসা। জয়তু ড. এ আর মল্লিক।
আমাদের জাতীয় জীবনের মহত্তম ঘটনা রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণে বুদ্ধিজীবীসমাজের মধ্যে ড. মল্লিকের নাম অগ্রগণ্য। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনের (২-২৫ মার্চ ১৯৭১) সঙ্গে তিনি একাত্মতা প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি দ্বিধাহীনচিত্তে যোগ দেন। এ প্রসঙ্গে ড. মল্লিক তাঁর আত্মজীবনী আমার জীবন কথা ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম গ্রন্থে লিখেছেন, ‘নিজ পরিচয়ে নিজ দেশে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করব, নাকি পাকিস্তানিদের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকব—এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাকে মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিত হতে হয়নি।’ ১৯৬৬ সালে ড. মল্লিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এ দায়িত্ব পালনকালেই শুরু হয় আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। নিজ কর্মক্ষেত্রে একজন সেনানায়কের মতো তাঁর নেতৃত্বে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় উপাচার্যের কার্যালয় হয়ে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মুক্তিসংগ্রামের সদর দপ্তর। এখানে অধিনায়কত্ব করেছেন উপাচার্য ড. মল্লিক। একপর্যায়ে চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে গেলে তিনি ভারতে চলে যান। ড. মল্লিকের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের সব পর্যায়ের বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন ‘লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেনসিয়া’, যেখানে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। এ ছাড়া বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গঠিত হলে ড. মল্লিক সভাপতি আর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে এবং গান্ধী শান্তি সংস্থার সহায়তায় আয়োজিত (১৮-২০ সেপ্টেম্বর ’৭১) ওয়ার্ল্ড মিট অন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার পরিমাণ আরও বাড়ানো এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেছেন। এরপর ভারত থেকে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেন। সেই সময়কালে আমেরিকা ও ইউরোপের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতিসংঘে স্বাধীনতার অনুকূলে অকাট্য যুক্তি এবং পূর্ব বাংলায় সংঘটিত মানববিনাশী ও পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের চিত্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তিনি স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেন।
মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরু থেকে ড. মল্লিকের বিশ্বাস ছিল, মুক্তিযুদ্ধ সফল হবেই এবং ডিসেম্বরের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন, ‘১৫ এপ্রিল সকালে ড. মল্লিক, তাঁর বড় জামাই ড. জিয়া উদ্দিন আহম্মেদ, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ড. রশিদুল হক ও ড. মাহমুদ শাহ কোরেশীকে বিদায় জানালাম। আমি স্বভাবত ভাবপ্রবণ নই। কিন্তু যে মুহূর্তে তাঁরা দেশের মাটি থেকে পা তুলতে গেলেন, সেই মুহূর্তে কেঁদে ফেললাম। মল্লিক সাহেব আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “ডোন্ট ইউ ওরি। এ পথেই আমরা একসঙ্গে ফিরে আসব—বিফোর দি ইয়ার ইজ আউট।” কেন এবং কিসের জোরে কথাটা তিনি বলেছিলেন, জানি না। তবে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টায় তিনি এই বিশ্বাস লালন করেছিলেন এবং অন্যদেরও বলেছিলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা স্বাধীন দেশে ফিরে যাব।”’ (সূত্র: আমার একাত্তর, আনিসুজ্জামান)। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বলার মতো। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সফল একজন কূটনীতিবিদ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু জাতিকে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষ পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙেচুরে দিয়ে যায়, যাতে সমস্যার চাপে এবং অর্থনীতির বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এর অস্তিত্ব হয় বিপন্ন। বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ড. মল্লিক দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিকে সফল করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি অনেকটা সফল হয়েছিলেন। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড না ঘটলে এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে দারিদ্র্যের বহুমাত্রিক সমস্যা দূর করে দেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যেত। জাতির জনক শেখ মুজিব সপরিবারে শহীদ হওয়ার দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে ড. মল্লিকের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘যে দলটির ছত্রচ্ছায়ায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, সেটি আবার ক্ষমতাসীন হয়েছে, আর দুঃখ নেই, এখন শান্তিতে মরতে পারব।’ (সূত্র: আত্মজৈবনিক গ্রন্থ আলো ছায়ায় সাত পুরুষ, অধ্যাপক সৈয়দ মকসুদ আলী)। অধ্যাপক সৈয়দ মকসুদ আলীর ভাষায়, ‘তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণের চেয়ে ভালোবেসেছেন, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেছেন বলেই স্বদেশকেও ভালোবাসতে পেরেছিলেন।’ বঙ্গবন্ধুও তাঁকে খুবই শ্রদ্ধাপূর্ণ চোখে দেখতেন। ১৯৮৩ সালে সম্পূর্ণ বাঙালি মূলধনে বাংলাদেশি নাগরিকদের মালিকানায় ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হলে ড. মল্লিক প্রতিষ্ঠানটির প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। আশির দশকে গঠিত শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তানদের হাতে গড়া সংগঠন ‘প্রজন্ম ৭১’-এর প্রতি তিনি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। এদের বিভিন্ন কার্যক্রমে মুক্তিযোদ্ধা এই বুদ্ধিজীবীর সমর্থন ও সহায়তা ছিল অপরিসীম।
১৯১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্ম আর ১৯৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পবিত্র লাইলাতুল কদরের রাতে ৭৯ বছরের বর্ণিল জীবনের ইতি টেনে দেহান্তরিত হয়েছেন। অসাধারণ মানুষ ড. মল্লিকের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করছি বিনম্র শ্রদ্ধা, সম্মান ও গভীর ভালোবাসা। জয়তু ড. এ আর মল্লিক।
মাকসুদুল হক খান |
মুলসুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-12-31/news/119667
No comments:
Post a Comment