নেলসন ম্যান্ডেলা
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে কথোপকথন
আমরা কখনোই বহুজাতিক সমাজকে মেনে নিইনি। আমরা চেয়েছি অসাম্প্রদায়িক একটি সমাজ, কারণ তুমি যখন বহুজাতের কথা বলো, তুমি আসলে অনেক সম্প্রদায়ের কথাই বলো: তুমি বলতে চাও তোমার এ দেশে একসঙ্গে অনেক জাতির মানুষের বসবাস করে। আর এভাবেই আসলে বংশ বা জাতির ধারণা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে, তাই আমরা এমন একটি সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি, যেখানে জাতি, ধর্ম ও বর্ণভিত্তিক কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সেখানে মানুষকে বিভক্ত করা হয়, এমন কোনো কথাই উচ্চারিত হবে না।
...অনেক চিন্তাভাবনা করেই আমরা এ কথাগুলো বলেছি। ব্যাপারটি নিয়ে অনেক গভীরভাবে ভেবেছিও। আমরা কোনোমতেই বহু সম্প্রদায়ভিত্তিক সমাজকে স্বীকার করি না। আমাদের লক্ষ্য এমন একটা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন, যেখানে কোনো মানুষ আরেকজনের গায়ের রংকে ভিত্তি করে কথা বলবে না। (৯. পৃষ্ঠা: ১১৮) সম্পাদক ও লেখক, ম্যান্ডেলার আত্মজীবনী: লং ওয়াক টু ফ্রিডম-এর লেখায় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।
রিভনিয়া বিচারের রায়
আহমেদ কাতরাদার সঙ্গে কথোপকথন
রিভনিয়া বিচারের রায় কী হবে, এই চিন্তা আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মুখে ‘আমি এসব নিয়ে ভাবছি না’, ‘যা হবার হবে’—এসব কথা খুব বলা যায়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মামলার রায় কী হবে, সেই দুশ্চিন্তা আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছিল। রিভনিয়া মামলায় আমাদের মৃত্যুদণ্ড হবে, মোটামুটি ধারণা করতে পারছিলাম। কারণ রায়ের আগের দিন সকালেও পুরো জেলে আমাদের মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারটিই আলোচিত হচ্ছিল। সরকারের চোখে আমরা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতোই ‘অপরাধী’। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কেউ যখন তোমার সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করছে: ‘তোমার জীবন এখানেই শেষ’, তা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা শোনাটা বেশি কষ্টের। তবে রায়ের আগে এই অনুভূতিটা আমরা ভুলে থাকার চেষ্টা করছিলাম। একে অপরকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে মনের দিক দিয়ে আমার সঙ্গীরা সে সময়ে আমার চেয়েও বেশি শক্ত ছিল। এটা না বললে খুবই অন্যায় হবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিচারক আমাদের মৃত্যুদণ্ড দেননি সেই মামলায়। (১৬. পৃষ্ঠা: ১২৪) আহমেদ কাতরাদা: বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মী, রাজনীতিক, প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক উপদেষ্টা
জেনি ও জেন্দজিকে লেখা চিঠি
শেষবার তোমাদের দেখেছি, তা প্রায় আট বছর হয়ে গেল। এক বছর আগে তোমাদের মাকেও গ্রেপ্তার করেছে ওরা।
গত বছর দুটো চিঠি লিখেছিলাম তোমাদের। আমি নিশ্চিত, সেগুলো তোমাদের কাছে পৌঁছানো হয়নি। কারণ তোমাদের কারোর বয়সই ১৬ হয়নি, তাই এ চিঠি তোমাদের কাছে পৌঁছানোর কথাও নয়। অপেক্ষা করছি, কবে তোমরা একজন কয়েদির সঙ্গে দেখা করার মতো বড় হবে, আমি সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছি।
পাবে না জেনেও আমি তোমাদের চিঠি লিখি কেন জানো? তোমাদের যখন লিখি, অসম্ভব আনন্দ পাই। মনে হয়, আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি। তোমাদের ভালোমন্দের খোঁজ নিচ্ছি। তাই যখনই সময় পাই, চিঠি লিখতে বসি তোমাদের। এই কারাবাসে আমি সবচেয়ে বেশি চিন্তায় থাকি তোমাদের নিয়ে। এক বছরেরও বেশি হয়ে গেছে, এ পর্যন্ত তোমাদের ব্যাপারে বলতে গেলে নির্ভরযোগ্য কোনো খবরই পাইনি। জানি না, কীভাবে চলছে তোমাদের। কীভাবে তোমরা স্কুলে যাচ্ছ, তোমাদের স্কুলের বেতনই বা আসছে কোত্থেকে। ছুটির দিনগুলো কীভাবে কাটে তোমাদের, কে তোমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছে, কে তোমাদের কাপড়চোপড় কিনে দিচ্ছে। তোমরা চিঠি পাবে না, তার পরও তোমাদের লিখি, কারণ আমি বিশ্বাস করি, একদিন নিশ্চয়ই ভাগ্য আমাদের সহায় হবে, তোমরা আমার সব চিঠি পাওয়া শুরু করবে। তোমাদের চিঠি লেখার আরেকটা কারণ আছে: মা, মনিরা, আমি তোমাদের অসম্ভব ভালোবাসি। আমার ভালোবাসার কথা তোমাদের এই চিঠি ছাড়া আর কোনোভাবে বলার সুযোগ নেই। চিঠিগুলো লিখে আমি তোমাদের না দেখতে পাওয়ার কষ্টও ভুলি, মনে শান্তি পাই। (১৬. পৃষ্ঠা: ১৮০)
জেলখানার গান
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে কথোপকথন
জেলে থাকার সময় চুনাপাথরের খনিতে কাজ করতে হতো আমাদের। চুনাপাথরের খনির কাজ অসহনীয়, কঠোর পরিশ্রমের। খনিতে কাজ করার সময় আমাদের দেওয়া হতো একটি লোহার শাবল। সেই শাবল দিয়ে আমাদের চুনাপাথরের শক্ত-কঠিন স্তরগুলো ভাঙতে হতো। ব্যাপারটি যে কী কষ্টের, বলে বোঝানো যাবে না। খনিতে কাজ করতে পাঠানোর পেছনে কারা কর্তৃপক্ষের একটা যুক্তি ছিল, তারা মনে করত, জেল খাটা কোনো আনন্দদায়ক ব্যাপার নয়। এখানে কেউ বেড়াতে আসে না, কাজেই জেলে এলে তাকে কষ্ট করতেই হবে। কয়েদিদের খনিতে কাজ করাটা যেন শাস্তিরই অংশ।
খনিতে কাজ করতে করতে আমরা অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। মনোবল ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হতো। বুঝতে পারতাম, মনোবল ভাঙতেই ওরা আমাদের দিয়ে এত কষ্ট করায়। এটা ভেবে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতাম। খনিতে কাজ করতে করতে আমরা তাই গণসংগীত গাইতাম। সেসব মুক্তির গান। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের বিমূর্ত প্রতিবাদ ফুটে উঠত সেসব গানে। গণসংগীত শুনে সবাই চাঙা হয়ে উঠত। শোষকের বিরুদ্ধে নিজেদের সংগ্রামের জন্য গর্ব করত।
খনির এই ভয়াবহ পরিশ্রমের মাঝেও কাজ করতে করতে কয়েদিরা গণসংগীত গাইছে, গণসংগীতের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে, এটা ভালো লাগল না কারা কর্তৃপক্ষের। কারা আচরণবিধি সংশোধন করে সব ধরনের সংগীত নিষিদ্ধ করল তারা। এই নিষেধাজ্ঞা আমরা মেনে নিইনি। চুনাপাথরের খনির কারারক্ষীদের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে আমরা গান গাইতে পারতাম না ঠিক, কিন্তু সন্ধ্যায় নিজেদের সেলে ফিরেই চিৎকার করে গান গাইতে শুরু করতাম। নববর্ষে কিংবা বড়দিনে আরও বেড়ে যেত আমাদের গানের আওয়াজ। একসময় কারা কর্তৃপক্ষের কাছেও ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গেল। গান গাইলে তারা আর বাধা দিতে আসত না। (১০. পৃষ্ঠা: ১৪১)
নির্বাসনের একাকিত্ব
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে কথোপকথন
নির্বাসন খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার। বিশেষ করে তুমি যখন জেলে বন্দী। একে তো কারাগারের একাকিত্ব, তার পর যদি তোমাকে সতীর্থদের থেকেও আলাদা করে রাখা হয়, এর চেয়ে নির্মম আর অমানবিক কিছু হতে পারে না। রিভনিয়া বিচারের রায় ঘোষণার পর জেলখানায় বিভিন্ন দাবি নিয়ে আমি সোচ্চার হই। এর মধ্যে প্রধান এবং মৌলিক দাবিটি ছিল আমাদের রাজবন্দীর মর্যাদা দেওয়া, এই দাবি তোলায় আমাকে অন্য কারাবন্দীদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হলো। এমন ব্যবস্থা করা হলো, যেন আমি কারও সঙ্গে দেখা করতে না পারি। এমনকি আমার প্রতিদিনের খাওয়াও আলাদা করে দেওয়া হলো। একজন কারারক্ষী আমাকে খাবার দিয়ে যেত। ওই রক্ষী ছাড়া আর কোনো মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হতো না। নিয়ম করে সকালে আধঘণ্টা ও রাতে আধঘণ্টার জন্য আমাকে সেলের বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো। সে সময় অনেক চেষ্টা করেও আমি অন্য কারাবন্দীদের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। দেখা করতে পারব কী করে, আমাকে যখন সেলের বাইরে আনা হতো, অন্য কয়েদিদের তখন পাঠিয়ে দেওয়া হতো ‘লক আপে’ তাদের নিজেদের সেলে। (১৪. পৃষ্ঠা: ১৪৮)
স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলাকে লেখা চিঠি
শেষ পর্যন্ত আমার পরিবারের একটা ছবি পেলাম। কী চমৎকার ছবি! ম্যাকগাথো আর ওর বোনদের সঙ্গে তোমাকে কী চমৎকার দেখাচ্ছে! এই ছবিটা আমার এই নিঃসঙ্গ কারাজীবনের একমাত্র আনন্দের উৎস। তবে ছবিটা দেখতে দেখতে আনন্দের পাশাপাশি আমার অন্য রকম এক অনুভূতিও হয়। তোমার চেহারায় এক অব্যক্ত স্থায়ী দুঃখের ছাপ পড়ে যাচ্ছে, অন্যমনস্কতাও। তার পরও তোমার চেহারার সেই অসাধারণ সৌন্দর্য এখনো অটুট আছে। তোমার সৌন্দর্য এখনো আমার মাথা খারাপ করে দেয়। বিয়ের পরের ১০ বছর কী দারুণ আনন্দে কেটেছে আমাদের। সেই স্মৃতি আমার মনে ঝাপসা হয়ে যায়নি। আমার মনে হচ্ছে, এ ছবির মধ্য দিয়ে তুমি আমার কাছে অব্যক্ত কোনো অনুভূতি প্রকাশ করতে চেয়েছ। সেটা আমি বুঝে নিয়েছি। তবে একটা কথা তোমাকে বলি, ছবিটি দেখার পর আমার মনের অনেক দুঃখকষ্ট দূর হয়ে গেছে। চমৎকার এক সুখানুভূতি ঘিরে আছে এখন আমাকে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা যেন আরও গভীরভাবে অনুভব করছি, স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি ভীষণ রকম, মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের ছোট্ট সুন্দর বাড়িটাকে...। (১৯. পৃষ্ঠা: ১৫৩)
মায়ের মৃত্যু (এই চিঠি লেখা হয় ১৪ অক্টোবর ১৯৬৮ সালে)
গত বছরের সেপ্টেম্বরে শেষবারের মতো আমি মাকে দেখেছি। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে চলে যাওয়ার সময় কেন যেন আমার মনে হচ্ছিল, মাকে আমি আর কোনো দিন দেখতে পাব না। আমার মা আমার খুব প্রিয় মানুষদের একজন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমাকে হতবাক করে দিল। মনে হলো আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে অসাড় করে দিয়েছে মায়ের মৃত্যুসংবাদ। চারপাশের পৃথিবীটা যেন একদম শূন্য হয়ে গেছে। এই ভয়ংকর শোকের মধ্যেও আমার জেলখানার বন্ধুরা, আমার সহবন্দীরা আমার পাশে থেকেছে, সান্ত্বনা দিয়েছে। আমার মাতৃশোক ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে তারা আপ্রাণ, শোক কাটিয়ে মনোবল চাঙা করতে সাহায্য করেছে সব সময়। মায়ের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকতে না পেরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছে, কিন্তু যখন শুনেছি, মায়ের শেষ বিদায়ের সময় আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব উপস্থিত ছিল, শুনে ভীষণ খুশি হয়েছি। তারা সবাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আমার মাকে বিদায় দিয়েছে, তার মৃত্যুতে তারা চোখের জল ফেলেছে—আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। (১. পৃষ্ঠা: ১৫৯)
ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে
খুব ভালো বক্তা ফিদেল কাস্ত্রো। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর একটি অনুষ্ঠানে কাস্ত্রোর সঙ্গে ভাষণ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। দেখলাম, তিন ঘণ্টা টানা বলে গেল, কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই। তিনি বলছেন, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছেন, কাউকে উদ্ধৃত করছেন। সত্যিই অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। এই পুরো সময়টা তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন। এ সময় কেউ হলের বাইরে গেল না। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার তাড়াও যেন ভুলে গেল। পুরো বক্তৃতায় তিনি অনেকবারই আমেরিকাকে ধুয়ে দিলেন, বললেন, ওরা রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া।
বক্তৃতা শেষে আমরা একসঙ্গে গাড়িতে করে শহরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। উনি চুপচাপ বসে আছেন, আমি একাই শুধু সাধারণ মানুষের উদ্দেশে হাত নাড়লাম। একটা পর্যায়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম, উনি কেবল কালো মানুষদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। সন্দেহ হলো, ব্যাপারটি কি তিনি আমাকে খুশি করার জন্য করছেন? নাকি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করছেন। আমার চিন্তা ভুল ছিল, পরে দেখলাম ভিড়ের মধ্যে করমদর্নের সময় তিনি প্রথমে একজন সাদা পরেরজন একজন কালোকে বেছে নিচ্ছেন। আমি উপলব্ধি করলাম, তিনি আন্তরিকভাবেই এটা করছেন। কাস্ত্রো মনে-প্রাণে একজন আন্তরিক মানুষ। (১৫. পৃষ্ঠা: ৩৮৯)
মুল সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-12/news/108442