Tuesday, November 30, 2010

নেলসন ম্যান্ডেলা (নিজের সঙ্গে কথোপকথন)

নেলসন ম্যান্ডেলা নেলসন ম্যান্ডেলা
    ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, ভাষণ, সাক্ষাৎকার, বহু দশকের পুরোনো দলিল-দস্তাবেজ একত্র করে ম্যান্ডেলার যাপিত জীবনকে তুলে আনা হয়েছে কনভারসেশন উইথ মাইসেলফ বইয়ে। উঠে এসেছে দিনপঞ্জির আদলে কারাগারে অতিবাহিত তাঁর সেই নিরানন্দ মামুলি দিনের বিবরণ থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেসবও। এখানে ম্যান্ডেলাকে পাওয়া যায় একজন পণ্ডিত ও রাজনীতিক হিসেবে, একজন সংসারী মানুষ ও বন্ধু হিসেবে; দেখা যায় একজন দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতাকে। ম্যান্ডেলা তাঁর আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেনলং ওয়াক টু ফ্রিডম। সেই অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পরের অংশও বলা যায় এ গ্রন্থকে। তাঁর জীবনের দীর্ঘ অভিযাত্রার অনেক অজানা কাহিনি ও ভিন্নতর পথপরিক্রমার গল্প নতুনভাবে আবিষ্কারে সুযোগ করে দেবে নতুন এই বই।

    বর্ণবাদের বিরুদ্ধে
    রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে কথোপকথন
    আমরা কখনোই বহুজাতিক সমাজকে মেনে নিইনি। আমরা চেয়েছি অসাম্প্রদায়িক একটি সমাজ, কারণ তুমি যখন বহুজাতের কথা বলো, তুমি আসলে অনেক সম্প্রদায়ের কথাই বলো: তুমি বলতে চাও তোমার এ দেশে একসঙ্গে অনেক জাতির মানুষের বসবাস করে। আর এভাবেই আসলে বংশ বা জাতির ধারণা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে, তাই আমরা এমন একটি সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি, যেখানে জাতি, ধর্ম ও বর্ণভিত্তিক কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সেখানে মানুষকে বিভক্ত করা হয়, এমন কোনো কথাই উচ্চারিত হবে না।
    ...অনেক চিন্তাভাবনা করেই আমরা এ কথাগুলো বলেছি। ব্যাপারটি নিয়ে অনেক গভীরভাবে ভেবেছিও। আমরা কোনোমতেই বহু সম্প্রদায়ভিত্তিক সমাজকে স্বীকার করি না। আমাদের লক্ষ্য এমন একটা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন, যেখানে কোনো মানুষ আরেকজনের গায়ের রংকে ভিত্তি করে কথা বলবে না। (৯. পৃষ্ঠা: ১১৮) সম্পাদক ও লেখক, ম্যান্ডেলার আত্মজীবনী: লং ওয়াক টু ফ্রিডম-এর লেখায় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।

    রিভনিয়া বিচারের রায়
    আহমেদ কাতরাদার সঙ্গে কথোপকথন
    রিভনিয়া বিচারের রায় কী হবে, এই চিন্তা আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মুখে ‘আমি এসব নিয়ে ভাবছি না’, ‘যা হবার হবে’—এসব কথা খুব বলা যায়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মামলার রায় কী হবে, সেই দুশ্চিন্তা আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছিল। রিভনিয়া মামলায় আমাদের মৃত্যুদণ্ড হবে, মোটামুটি ধারণা করতে পারছিলাম। কারণ রায়ের আগের দিন সকালেও পুরো জেলে আমাদের মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারটিই আলোচিত হচ্ছিল। সরকারের চোখে আমরা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতোই ‘অপরাধী’। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কেউ যখন তোমার সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করছে: ‘তোমার জীবন এখানেই শেষ’, তা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা শোনাটা বেশি কষ্টের। তবে রায়ের আগে এই অনুভূতিটা আমরা ভুলে থাকার চেষ্টা করছিলাম। একে অপরকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে মনের দিক দিয়ে আমার সঙ্গীরা সে সময়ে আমার চেয়েও বেশি শক্ত ছিল। এটা না বললে খুবই অন্যায় হবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিচারক আমাদের মৃত্যুদণ্ড দেননি সেই মামলায়। (১৬. পৃষ্ঠা: ১২৪) আহমেদ কাতরাদা: বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মী, রাজনীতিক, প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক উপদেষ্টা

    জেনি ও জেন্দজিকে লেখা চিঠি
    শেষবার তোমাদের দেখেছি, তা প্রায় আট বছর হয়ে গেল। এক বছর আগে তোমাদের মাকেও গ্রেপ্তার করেছে ওরা।
    গত বছর দুটো চিঠি লিখেছিলাম তোমাদের। আমি নিশ্চিত, সেগুলো তোমাদের কাছে পৌঁছানো হয়নি। কারণ তোমাদের কারোর বয়সই ১৬ হয়নি, তাই এ চিঠি তোমাদের কাছে পৌঁছানোর কথাও নয়। অপেক্ষা করছি, কবে তোমরা একজন কয়েদির সঙ্গে দেখা করার মতো বড় হবে, আমি সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছি।
    পাবে না জেনেও আমি তোমাদের চিঠি লিখি কেন জানো? তোমাদের যখন লিখি, অসম্ভব আনন্দ পাই। মনে হয়, আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি। তোমাদের ভালোমন্দের খোঁজ নিচ্ছি। তাই যখনই সময় পাই, চিঠি লিখতে বসি তোমাদের। এই কারাবাসে আমি সবচেয়ে বেশি চিন্তায় থাকি তোমাদের নিয়ে। এক বছরেরও বেশি হয়ে গেছে, এ পর্যন্ত তোমাদের ব্যাপারে বলতে গেলে নির্ভরযোগ্য কোনো খবরই পাইনি। জানি না, কীভাবে চলছে তোমাদের। কীভাবে তোমরা স্কুলে যাচ্ছ, তোমাদের স্কুলের বেতনই বা আসছে কোত্থেকে। ছুটির দিনগুলো কীভাবে কাটে তোমাদের, কে তোমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছে, কে তোমাদের কাপড়চোপড় কিনে দিচ্ছে। তোমরা চিঠি পাবে না, তার পরও তোমাদের লিখি, কারণ আমি বিশ্বাস করি, একদিন নিশ্চয়ই ভাগ্য আমাদের সহায় হবে, তোমরা আমার সব চিঠি পাওয়া শুরু করবে। তোমাদের চিঠি লেখার আরেকটা কারণ আছে: মা, মনিরা, আমি তোমাদের অসম্ভব ভালোবাসি। আমার ভালোবাসার কথা তোমাদের এই চিঠি ছাড়া আর কোনোভাবে বলার সুযোগ নেই। চিঠিগুলো লিখে আমি তোমাদের না দেখতে পাওয়ার কষ্টও ভুলি, মনে শান্তি পাই। (১৬. পৃষ্ঠা: ১৮০)

    জেলখানার গান
    রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে কথোপকথন
    জেলে থাকার সময় চুনাপাথরের খনিতে কাজ করতে হতো আমাদের। চুনাপাথরের খনির কাজ অসহনীয়, কঠোর পরিশ্রমের। খনিতে কাজ করার সময় আমাদের দেওয়া হতো একটি লোহার শাবল। সেই শাবল দিয়ে আমাদের চুনাপাথরের শক্ত-কঠিন স্তরগুলো ভাঙতে হতো। ব্যাপারটি যে কী কষ্টের, বলে বোঝানো যাবে না। খনিতে কাজ করতে পাঠানোর পেছনে কারা কর্তৃপক্ষের একটা যুক্তি ছিল, তারা মনে করত, জেল খাটা কোনো আনন্দদায়ক ব্যাপার নয়। এখানে কেউ বেড়াতে আসে না, কাজেই জেলে এলে তাকে কষ্ট করতেই হবে। কয়েদিদের খনিতে কাজ করাটা যেন শাস্তিরই অংশ।
    খনিতে কাজ করতে করতে আমরা অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। মনোবল ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হতো। বুঝতে পারতাম, মনোবল ভাঙতেই ওরা আমাদের দিয়ে এত কষ্ট করায়। এটা ভেবে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতাম। খনিতে কাজ করতে করতে আমরা তাই গণসংগীত গাইতাম। সেসব মুক্তির গান। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের বিমূর্ত প্রতিবাদ ফুটে উঠত সেসব গানে। গণসংগীত শুনে সবাই চাঙা হয়ে উঠত। শোষকের বিরুদ্ধে নিজেদের সংগ্রামের জন্য গর্ব করত।
    খনির এই ভয়াবহ পরিশ্রমের মাঝেও কাজ করতে করতে কয়েদিরা গণসংগীত গাইছে, গণসংগীতের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে, এটা ভালো লাগল না কারা কর্তৃপক্ষের। কারা আচরণবিধি সংশোধন করে সব ধরনের সংগীত নিষিদ্ধ করল তারা। এই নিষেধাজ্ঞা আমরা মেনে নিইনি। চুনাপাথরের খনির কারারক্ষীদের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে আমরা গান গাইতে পারতাম না ঠিক, কিন্তু সন্ধ্যায় নিজেদের সেলে ফিরেই চিৎকার করে গান গাইতে শুরু করতাম। নববর্ষে কিংবা বড়দিনে আরও বেড়ে যেত আমাদের গানের আওয়াজ। একসময় কারা কর্তৃপক্ষের কাছেও ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গেল। গান গাইলে তারা আর বাধা দিতে আসত না। (১০. পৃষ্ঠা: ১৪১)

    নির্বাসনের একাকিত্ব
    রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে কথোপকথন
    নির্বাসন খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার। বিশেষ করে তুমি যখন জেলে বন্দী। একে তো কারাগারের একাকিত্ব, তার পর যদি তোমাকে সতীর্থদের থেকেও আলাদা করে রাখা হয়, এর চেয়ে নির্মম আর অমানবিক কিছু হতে পারে না। রিভনিয়া বিচারের রায় ঘোষণার পর জেলখানায় বিভিন্ন দাবি নিয়ে আমি সোচ্চার হই। এর মধ্যে প্রধান এবং মৌলিক দাবিটি ছিল আমাদের রাজবন্দীর মর্যাদা দেওয়া, এই দাবি তোলায় আমাকে অন্য কারাবন্দীদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হলো। এমন ব্যবস্থা করা হলো, যেন আমি কারও সঙ্গে দেখা করতে না পারি। এমনকি আমার প্রতিদিনের খাওয়াও আলাদা করে দেওয়া হলো। একজন কারারক্ষী আমাকে খাবার দিয়ে যেত। ওই রক্ষী ছাড়া আর কোনো মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হতো না। নিয়ম করে সকালে আধঘণ্টা ও রাতে আধঘণ্টার জন্য আমাকে সেলের বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো। সে সময় অনেক চেষ্টা করেও আমি অন্য কারাবন্দীদের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। দেখা করতে পারব কী করে, আমাকে যখন সেলের বাইরে আনা হতো, অন্য কয়েদিদের তখন পাঠিয়ে দেওয়া হতো ‘লক আপে’ তাদের নিজেদের সেলে। (১৪. পৃষ্ঠা: ১৪৮)

    স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলাকে লেখা চিঠি
    শেষ পর্যন্ত আমার পরিবারের একটা ছবি পেলাম। কী চমৎকার ছবি! ম্যাকগাথো আর ওর বোনদের সঙ্গে তোমাকে কী চমৎকার দেখাচ্ছে! এই ছবিটা আমার এই নিঃসঙ্গ কারাজীবনের একমাত্র আনন্দের উৎস। তবে ছবিটা দেখতে দেখতে আনন্দের পাশাপাশি আমার অন্য রকম এক অনুভূতিও হয়। তোমার চেহারায় এক অব্যক্ত স্থায়ী দুঃখের ছাপ পড়ে যাচ্ছে, অন্যমনস্কতাও। তার পরও তোমার চেহারার সেই অসাধারণ সৌন্দর্য এখনো অটুট আছে। তোমার সৌন্দর্য এখনো আমার মাথা খারাপ করে দেয়। বিয়ের পরের ১০ বছর কী দারুণ আনন্দে কেটেছে আমাদের। সেই স্মৃতি আমার মনে ঝাপসা হয়ে যায়নি। আমার মনে হচ্ছে, এ ছবির মধ্য দিয়ে তুমি আমার কাছে অব্যক্ত কোনো অনুভূতি প্রকাশ করতে চেয়েছ। সেটা আমি বুঝে নিয়েছি। তবে একটা কথা তোমাকে বলি, ছবিটি দেখার পর আমার মনের অনেক দুঃখকষ্ট দূর হয়ে গেছে। চমৎকার এক সুখানুভূতি ঘিরে আছে এখন আমাকে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা যেন আরও গভীরভাবে অনুভব করছি, স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি ভীষণ রকম, মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের ছোট্ট সুন্দর বাড়িটাকে...। (১৯. পৃষ্ঠা: ১৫৩)

    মায়ের মৃত্যু (এই চিঠি লেখা হয় ১৪ অক্টোবর ১৯৬৮ সালে)
    গত বছরের সেপ্টেম্বরে শেষবারের মতো আমি মাকে দেখেছি। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে চলে যাওয়ার সময় কেন যেন আমার মনে হচ্ছিল, মাকে আমি আর কোনো দিন দেখতে পাব না। আমার মা আমার খুব প্রিয় মানুষদের একজন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমাকে হতবাক করে দিল। মনে হলো আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে অসাড় করে দিয়েছে মায়ের মৃত্যুসংবাদ। চারপাশের পৃথিবীটা যেন একদম শূন্য হয়ে গেছে। এই ভয়ংকর শোকের মধ্যেও আমার জেলখানার বন্ধুরা, আমার সহবন্দীরা আমার পাশে থেকেছে, সান্ত্বনা দিয়েছে। আমার মাতৃশোক ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে তারা আপ্রাণ, শোক কাটিয়ে মনোবল চাঙা করতে সাহায্য করেছে সব সময়। মায়ের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকতে না পেরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছে, কিন্তু যখন শুনেছি, মায়ের শেষ বিদায়ের সময় আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব উপস্থিত ছিল, শুনে ভীষণ খুশি হয়েছি। তারা সবাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আমার মাকে বিদায় দিয়েছে, তার মৃত্যুতে তারা চোখের জল ফেলেছে—আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। (১. পৃষ্ঠা: ১৫৯)

    ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে
    খুব ভালো বক্তা ফিদেল কাস্ত্রো। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর একটি অনুষ্ঠানে কাস্ত্রোর সঙ্গে ভাষণ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। দেখলাম, তিন ঘণ্টা টানা বলে গেল, কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই। তিনি বলছেন, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছেন, কাউকে উদ্ধৃত করছেন। সত্যিই অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। এই পুরো সময়টা তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন। এ সময় কেউ হলের বাইরে গেল না। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার তাড়াও যেন ভুলে গেল। পুরো বক্তৃতায় তিনি অনেকবারই আমেরিকাকে ধুয়ে দিলেন, বললেন, ওরা রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া।
    বক্তৃতা শেষে আমরা একসঙ্গে গাড়িতে করে শহরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। উনি চুপচাপ বসে আছেন, আমি একাই শুধু সাধারণ মানুষের উদ্দেশে হাত নাড়লাম। একটা পর্যায়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম, উনি কেবল কালো মানুষদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। সন্দেহ হলো, ব্যাপারটি কি তিনি আমাকে খুশি করার জন্য করছেন? নাকি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করছেন। আমার চিন্তা ভুল ছিল, পরে দেখলাম ভিড়ের মধ্যে করমদর্নের সময় তিনি প্রথমে একজন সাদা পরেরজন একজন কালোকে বেছে নিচ্ছেন। আমি উপলব্ধি করলাম, তিনি আন্তরিকভাবেই এটা করছেন। কাস্ত্রো মনে-প্রাণে একজন আন্তরিক মানুষ। (১৫. পৃষ্ঠা: ৩৮৯)
    | তারিখ: ১২-১১-২০১০    
    মুল সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-12/news/108442 

    নেলসন ম্যান্ডেলা কে নিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার লেখা (কিংবদন্তির কথা বলছি)

    প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা | তারিখ: ১২-১১-২০১০
    বিশ্বের অনেক মানুষের মতোই নেলসন ম্যান্ডেলার কথা আমি জেনেছি দূর থেকে, তিনি যখন রোবেন দ্বীপে বন্দী ছিলেন। আমাদের অনেকের কাছে তিনি শুধু তখন একজন ব্যক্তি নন, তিনি এর চেয়েও বেশি কিছু—তিনি আমাদের কাছে পরিণত হয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা তথা গোটা বিশ্বের সাম্য, ন্যায়বিচার এবং সব সংগ্রামের এক প্রতীকে। তাঁর আত্মত্যাগ এতটাই মহৎ, যা দুনিয়াজুড়ে সব মানুষের কাছে আহ্বান আর তাগিদ হয়ে কাজ করেছে মানবতার অগ্রগতির জন্য সম্ভব সবকিছু করার।
    খুব বিনীতভাবে বলতে চাই, আমিও ওই আহ্বানে সাড়াদানকারীদেরই একজন। কলেজে পড়ার সময়ই মূলত প্রথম রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলাম, যোগ দিয়েছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ অবসানের আন্দোলনে। একজন তরুণ হিসেবে সে সময় আমি যেসব ব্যক্তিগত বাধার মুখোমুখি হয়েছি, তার কোনোটাই আফ্রিকায় প্রতিদিন বর্ণবাদী আচরণের শিকার হওয়া সেই সব মানুষের অভিজ্ঞতার তুলনায় কিছুই না। আমি ম্যান্ডেলার সেই সাহসিকতার কথা কল্পনা করতে পারি, যার কারণে তাঁকে বরণ করে নিতে হয়েছে দীর্ঘ কারাবাস। কিন্তু তাঁর ওই নজির আমাকে সজাগ করেছে বৃহত্তর এই জগৎকে এবং জীবনে যা কিছু ন্যায়সংগত, তার পক্ষে দাঁড়ানোর। তাঁর পছন্দের কথা থেকেই বলি, ম্যান্ডেলা খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই পৃথিবীকে যে রকম দেখছ, তোমাকে সেটাই মেনে নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই; আমাদের কাজ হবে, আমরা যে রকম পৃথিবী চাই, যে পৃথিবী আমাদের পছন্দ, তা খুঁজে নেওয়া।
    বিগত বছরগুলোয় আমি গভীর এক শ্রদ্ধা ও বিনয় নিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলাকে লক্ষ করে গেছি, অনুপ্রাণিত হয়েছি নতুন আশায়, ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর জীবনে কত কষ্ট আর আত্মত্যাগ! সত্যিকার অর্থেই, তাঁর জীবন আমাদের সরাসরি দাঁড় করিয়ে দেয় এই জগৎকে, আমাদের জীবনকে প্রায় ক্লিষ্ট করা সব নৈরাশ্যবাদিতা ও আশাহীনতার বিরুদ্ধে।
    কারাবন্দী একজন এখন এক মুক্ত মানুষ; এক স্বাধীন ব্যক্তি, যিনি একই সঙ্গে পরিণত হয়েছেন প্রবল আবেগময় এক ঐক্যে ও সম্মিলনের কণ্ঠস্বরে। একজন দলীয় নেতা থেকে তিনি হয়েছেন রাষ্ট্রপতি এবং গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে নিয়ে গেছেন অনেক দূর। আনুষ্ঠানিক কার্যালয় ছেড়ে এসেও ম্যান্ডেলা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের সাম্য, সুযোগ ও মর্যাদা সমুন্নত রাখায়। তিনি নিজ দেশের পরিবর্তনের জন্য, এই বিশ্বের জন্য, এত কিছু করেছেন যে তাঁকে বাদ দিয়ে গত কয়েক যুগের পৃথিবীর ইতিহাস কল্পনা করাই কঠিন।
    ক্যালিফোর্নিয়ায় কলেজছাত্র থাকা অবস্থায়ই আমি রাজনীতিতে প্রথম পা রেখেছিলাম, যুক্ত হয়েছিলাম রাজনীতি-আন্দোলনের সঙ্গে, আর এরও দুই দশক পর আমি এসে দাঁড়াই রোবেন দ্বীপে ম্যান্ডেলার একসময়কার এই কারাকক্ষে। আমি তখন সদ্য নির্বাচিত এক মার্কিন সিনেটর। কক্ষটিকে অনেক আগেই রূপান্তর করা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আত্মোৎসর্গকারী অসংখ্য মানুষের স্মৃতি জাদুঘরে। সেই কারাকক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেকে আমি পেছনের সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, এখানে প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা ৪৬৬/৬৪ নম্বর কয়েদি—যখন তাঁর সংগ্রাম সফল হবে কি না, একেবারেই নিশ্চিত নয়। ম্যান্ডেলাকে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম: ইতিহাস বদলে দেওয়া এক কিংবদন্তির বীর তিনি—ম্যান্ডেলা নামের এক মানুষ, পরিবর্তনের জন্য যাঁর বিপুল আত্মত্যাগ।
    মানুষ ম্যান্ডেলাকে বোঝার জন্য কনভারসেশন উইথ মাইসেলফ গ্রন্থটি একটি অসাধারণ কাজ। এই বই আমাদের জন্য তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, ভাষণ, সাক্ষাৎকার, বহু দশকের পুরোনো নানা দলিল-দস্তাবেজ সন্নিবেশ করে ম্যান্ডেলার যাপিত জীবনকে যাচাই করার সুযোগ করে দিয়েছে। দিনপঞ্জির আদলে কারাগারে অতিবাহিত তাঁর সেই নিরানন্দ মামুলি দিনের বিবরণ থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এর সব উঠে এসেছে এ বইয়ে। এখানে তাঁকে পাই একজন পণ্ডিত ও রাজনীতিক হিসেবে, একজন সংসারী মানুষ ও বন্ধু হিসেবে; দেখি একজন দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতা হিসেবে। ম্যান্ডেলা তাঁর আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেনলং ওয়াক টু ফ্রিডম। আর এ গ্রন্থটি তাঁর সেই অভিযাত্রার ভিন্ন পদক্ষেপগুলোকে এবং ভিন্নতর পথপরিক্রমাকে নতুনভাবে আবিষ্কারে সুযোগ করে দিয়েছে।
    আমাদের সামনে ফুটে ওঠা তাঁর এই পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতি থেকে নেলসন ম্যান্ডেলাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, তিনি পরিপূর্ণ কোনো মানুষ নন। আমাদের সবার মতো তাঁরও ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, খামতি আছে। কিন্তু তাঁর এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকেই আমাদের প্রত্যেকের খুঁজে নেওয়া উচিত অনুপ্রেরণা। আমরা জানি, প্রতিনিয়তই আমাদের সবাইকে ছোটবড় নানা বাধার মুখে পড়তে হয়—এর কিছু ব্যক্তিগত কিছু রাজনৈতিক। এ ছাড়া জীবনের বিভিন্ন সময়ে মুখোমুখি হওয়া ভয়ভীতি-সন্দেহ কিংবা ফলাফল অনিশ্চিত জেনেও যে কাজ করে যাওয়া কিংবা অন্যদের ক্ষমা করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা—এসব প্রতিকূলতাই জয় করা সম্ভব, যদি আমরা নিজেদের প্রতি সৎ থাকি। (সংক্ষেপিত)
    অনুবাদ: শওকত হোসেন
    মুল সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-12/news/108443 

    মহাবিশ্বেই ছড়িয়ে আছে বিগ ব্যাং পূর্ব রহস্য

    বিগ ব্যাং এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে এই মহাবিশ্বের। কিন্তু বিগ ব্যাং ঘটার পূর্বে মহাবিশ্ব কি অবস্থায় ছিলো সে তথ্য ছড়িয়ে আছে এই মহাবিশ্বেই। সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বিগ ব্যাং ঘটার পূর্বের একটি তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। এই তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্ব জুড়ে থাকা মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনই সব ঘটনার সাক্ষী। খবর বিবিসি অনলাইনের।

    জ্যোতির্বিদ রজার পেনরোজ জানিয়েছেন, কসমিক মাইক্রোওয়েভের বিশ্লেষণই বিগ ব্যাং-এর পূর্বের অবস্থার কথা জানাবে। এই ঘটনা কোনো গ্যালাক্সির বাইরে রিং আকারে থাকতে পারে এবং এর ব্যাকগ্রাউন্ডের পার্থক্যও খুবই সামান্য।

    এই তত্ত্বটি পেনরোজের ‘ইনফ্ল্যাশনারি থিওরি’ কেই সমর্থন করে। এ তত্বের কারণেই ১৯৯৪ সালে পেনরোজ নাইট উপাধি পেয়েছিলেন।

    ‘ইনফ্ল্যাশনারি থিওরি’ অনুসারে মহাবিশ্ব অচিন্তনীয় বিশাল এবং দ্রুতই এটি আরো বিস্তৃত হচ্ছে। আর এর বিস্তৃতি ঘটেছে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকেই।

    পেনরোজের ‘কনফরমাল সাইক্লিক কসমোলজি’ (সিসিসি) অনুসারে প্রাকৃতিক নিয়মগুলো সময় মেনে চলে তবে মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে কোনো তত্ত্বগত নিয়ম মেনে নেয় না তার এই তত্ত্বটি।


    বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম/মিন্টু/এইচবি/নভেম্বর ২৯/১০

    Monday, November 29, 2010

    তলস্তয় ও গান্ধী


    ১৯১০ সালের ৪ এপ্রিল গান্ধী ইয়াসনায়া পলিয়ানার খামারে বসবাসরত ঋষি তলস্তয়কে জানালেন, তিনি তাঁর নিবেদিত অনুসারী, তাঁর রচনা থেকেই তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। মৃত্যুর ঠিক দুই মাস আগে, দুঃখজনক ও নাটকীয় মৃত্যুর আগে তলস্তয়ও গান্ধীকে একটি আন্তরিক পত্রে অহিংস তত্ত্ব নিয়ে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। গান্ধী ও তলস্তয়ের মৌলিক মিল—দুজনেই ভালোবাসার আইন ও অহিংস দর্শনের প্রণেতা। তলস্তয়ের কনফেশন এবং গান্ধীর স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ-এ এই ঐক্যের চিত্র অঙ্কিত। যিশু যেখানে বলেছেন, অন্য গাল পেতে দেবে, ঈশ্বর যেখানে আদেশ দিয়েছেন, হত্যা করবে না; সেখানে তোমরা মানুষ খুন করছ কীভাবে?
    তলস্তয় লিখলেন, লেটার টু আ হিন্দু। (তাঁদের মধ্যে একাধিক চিঠি বিনিময় হয়) ১৯০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর লন্ডনে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের ওয়েস্টমিনস্টার প্যালেস হোটেলে অবস্থানকালে এ চিঠির সকৃতজ্ঞ জবাব দেন গান্ধী। চিঠির শেষে অনুরোধ জানান, তলস্তয় যদি তাঁর পত্রের জবাব দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তাহলে যেন তা দক্ষিণ আফ্রিকায় জোহানেসবার্গের ডাকে প্রেরণ করেন। গান্ধীর অবস্থান তখন দক্ষিণ আফ্রিকায়।
    গান্ধী লিখলেন:
    মহোদয়,
    লন্ডনে আমার স্বল্পকালীন অবস্থানকালে আমার প্রেরিত চিঠির কথা আপনার মনে থাকতে পারে। আপনার একজন সাধারণ অনুসারী হিসেবে আমার লেখা একটি পুস্তিকা প্রেরণ করছি। গুজরাটি ভাষায় লেখা এই বইটি অনুবাদ (ইংরেজি) আমি নিজেই করেছি। বড় কৌতূহলের বিষয়, এটি ভারত সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে। সে জন্য তাড়াতাড়ি করে এই অনুবাদটি সম্পন্ন করেছি।
    আমি উদ্বিগ্ন, পাছে আপনাকে বিরক্ত করি, যদি শরীরে কুলায়, আমার এই পুস্তিকা পাঠ করেন, তাহলে বলাই বাহুল্য, আমি আপনার সমালোচনাকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করব।
    আমি আপনার লেটার টু আ হিন্দুর কিছু কপি আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে তা প্রকাশের অনুমতি দিয়েছিলেন। অপর একটি ভারতীয় ভাষায়ও তা প্রকাশিত হয়েছে।
    আপনার নগণ্য ভৃত্য
    এম কে গান্ধী।
    ৮ মে ১৯১০, তলস্তয় লিখলেন:
    প্রিয় বন্ধু,
    আপনার চিঠি এবং আপনার পাঠানো বই ইন্ডিয়ান হোম রুল কেবল আমার হাতে পৌঁছেছে। গভীর আগ্রহ নিয়ে আপনার বইটি পড়েছি; এই বইটিতে আপনি যে প্রশ্নটি তুলে ধরেছেন—অহিংস প্রতিরোধ—এটা কেবল ভারতের জন্য নয়, সমগ্র মানবতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমি আপনার আগের চিঠিগুলো খুঁজে পাইনি কিন্তু জে ডসের লেখা আপনার জীবনীটি পেয়েছি—এটি পড়ে আপনার সম্পর্কে জানার আগ্রহ বোধ করছি—তবে এই মুহূর্তে ঠিক সুস্থতা বোধ করছি না, তাই জবাব লেখা ও আপনার বই সম্পর্কে মতামত জানানো থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে, কিন্তু ভালো বোধ করা মাত্র এ বিষয়ে লিখব।
    আপনার বন্ধু ও ভাই
    লেভ তলস্তয়

    আত্মজৈবনিক
    হায়াৎ মামুদের লিয়েফ তলেস্তায় গ্রন্থ থেকে কিছু প্রাথমিক অংশ উদ্ধৃত করা হচ্ছে:
    ১৮৪৭: (তলস্তয়ের) জীবনের নীতিমালায় প্রতিজ্ঞা লিপিবদ্ধ হচ্ছে: ‘সকাল (৫টায়) উঠতে হবে। তাড়াতাড়ি ঘুমুতে যেতে হবে (৯টা থেকে ১০টার মধ্যে)...আহার সামান্য, মিষ্টি দিতে হবে...নিজ হাতে সব করতে হবে...সমগ্র জীবনের লক্ষ্যবিন্দু চাই, জীবনের যেকোনো পর্যায়ের জন্যও চাই লক্ষ্য, অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের জন্য লক্ষ্য এবং একেকটি বছরের জন্যও; প্রতি মাসের জন্য, প্রতি সপ্তাহের জন্য, প্রতিদিনের জন্য, প্রতি ঘণ্টার জন্য এবং প্রতি মিনিটের জন্য লক্ষ্য চাই, বৃহত্তর লক্ষ্যের জন্য ক্ষুদ্র লক্ষ্য বিসর্জন দিতে হবে’; ‘মেয়েদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে’; ‘কাজের মাধ্যমে কামনাকে ধ্বংস করা’; ‘ভালো হতে হবে কিন্তু শোরগোল তুলে নয়’; ‘জীবনযাত্রার মান যেন না পাল্টায়’ ইত্যাদি। 
     
    | তারিখ: ২৬-১১-২০১০
    মুল সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-26/news/111075 

    বছরের সেরা আবিষ্কার


    প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুনের। টমাস আলভা এডিসনের বৈদ্যুতিক বাল্ব কালের বিবর্তনে পেয়েছে নানা আধুনিক রূপ। মার্কনি আর জগদীশচন্দ্র বসুর বেতারযন্ত্রের সূত্র ধরে মানুষ খুলেছে যোগাযোগের অনেক বন্ধ দরজা। সবার অগোচরে চলতি বছর কয়েকটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান সৃষ্টি করেছে নতুন কিছু বিস্ময়ের। এ বছর এমন গাড়ি তৈরি করা হয়েছে, যা চালাতে জ্বালানি তেল কিংবা প্রাকৃতিক গ্যাসের দরকার হবে না। সাধারণ ডিসি বিদ্যুতেই সেই গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করে তা চালানো যাবে। আবিষ্কৃত হয়েছে এমন গণপরিবহন, যা কয়েক শ যাত্রী নিয়ে রাস্তায় চলতে পারবে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সেই গণপরিবহনের তলদেশ দিয়ে অনায়াসে পূর্ণ গতিতে চলাচল করতে পারবে শত শত গাড়ি। কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যা আগামী দিনে চিকিৎসাবিজ্ঞানে সৃষ্টি করবে অনন্য বিপ্লব। পানি খরচ না করে যন্ত্রে কাপড় ধোয়ার ব্যাপার কি কেউ কখনো ভেবেছিল, তাও আবিষ্কৃত হয়ে গেছে ২০১০ সালে। আবিস্কার হয়েছে জেটপ্যাক যাদিয়ে একজন লোক অনায়াসে ওঠে যেতে পারবে আকাশে, যেমন দেখা যায় সাইন্স ফিকশন সিনেমাগুলোয়, চালকবিহীন গাড়ি আবিষ্কার করেছে গুগল। পোশাক তৈরি হবে এক পলকে, শুধু শরীরে স্প্রে করতে হবে কাপড়র তৈরি হয়ে যাবে। কৃত্রিম ফুসফুস আবিস্কারের কথাও বলা হচ্ছে— অর্থাৎ সব মিলিয়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ২০১০ সাল অনন্য মাইলফলকের বছর হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বিজ্ঞানের এসব অনন্য আবিষ্কার নিয়ে বিশ্বখ্যাত সাময়িকী টাইম চলতি নভেম্বর মাসে এক প্রচ্ছদ কাহিনি প্রকাশ করেছে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য সেই প্রচ্ছদ কাহিনি থেকে কিছু নতুন আবিষ্কার বাছাই করে তুলে ধরা হলো।

    বৈদ্যুতিক গাড়ি
    এই গাড়িতে পেট্রল কিংবা প্রাকৃতিক গ্যাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয় না। তবে প্রকৃতির খুব গুরুত্বপূর্ণ সূর্যের আলো এই গাড়িটির মূল জ্বালানি। মূলত গাড়ির ওপর রক্ষিত একটি সোলার প্যানেলের মাধ্যমে মূল শক্তি উৎপাদিত হয়।

    পানি ছাড়া কাপড় ধোয়ার যন্ত্র
    ব্রিটেনের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যানুযায়ী কেবল যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরাই নিজেদের পোশাক-পরিচ্ছদ ধোয়ার জন্য এক ট্রিলিয়ন লিটার পানি খরচ করে। একবার ভেবে দেখুন তো, এই এক ট্রিলিয়ন লিটার পানি একটি দেশের মানুষ কেবল কাপড় ধোয়ার কাজে ব্যয় করছে, আর পৃথিবীর নানা প্রান্তে মানুষ প্রতিনিয়ত পানির জন্য হাহাকার করে মরছে। এসব বিষয় চিন্তা করেই যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন এমন ধোলাইযন্ত্র, যা পানির খরচ কমাবে শতকরা ৯০ ভাগ। আগামী বছরের মধ্যেই বাণিজ্যিকভাবে এই ধোলাইযন্ত্র বাজারজাত করা হবে।

    বিদ্যুৎ চার্জ স্টেশন
    আমরা এখন রাস্তার পাশে পেট্রলপাম্প কিংবা গ্যাস স্টেশনে গাড়ি থামিয়ে এর জ্বালানি সংগ্রহ করি। কিন্তু ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গাড়ি চালানোর কথা চিন্তা করেই বিদ্যুৎ চার্জ দেওয়ার স্টেশন উদ্ভাবিত হয়েছে এ বছরই। এটি আর কিছুই নয়, রাস্তার পাশে বিদ্যুতে চলা গাড়ি দাঁড় করিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে আপনি এখান থেকে গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করিয়ে নিতে পারবেন। ব্যাপারটি অনেকটা মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়ার মতো। ভবিষ্যতের জ্বালানি-নিরাপত্তার জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গাড়ি চালানোর উদ্যোগ পৃথিবীময় খুব জোরেশোরেই শুরু হয়েছে।

    মার্টিনস জেট প্যাক
    ১৯৬১ সালে তৈরি বেল রকেট বেল্টের নতুন সংস্করণ এই জেট প্যাক, যা মার্টিনস জেট প্যাক নামে পরিচিত। নিউজিল্যান্ডের গ্লেন মার্টিন নামের এক ব্যক্তি আকাশে ওড়ার এই যন্ত্রের আবিষ্কারক। ১৯৬১ সালে বেল রকেট বেল্টের মাধ্যমে আকাশে ওড়ার যে স্বপ্ন স্থাপিত হয়েছিল, ৩০ বছর প্রচেষ্টার পর মার্টিন তাঁর জেট প্যাক দিয়ে তাকে দিয়েছেন বাস্তব রূপ। বেল রকেট বেল্টের সঙ্গে মার্টিনের জেট প্যাকের পার্থক্য হলো, এটি অনেক বেশি বাস্তবানুগ। এই জেট প্যাকে দুটি ব্লোয়ারের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন করে আকাশে ওড়া যাবে। এতে ব্যবহূত হয়েছে ২০০ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন। যে ইঞ্জিনের শক্তি একটি হোন্ডা অ্যাকর্ড গাড়ির চেয়েও বেশি। মার্টিনের জেট প্যাকের মাধ্যমে দুই হাজার ৫০০ মিটার পথ আকাশে ভেসে অতিক্রম করা যায়।

    যে মশা ম্যালেরিয়া ছড়ায় না
    যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারাইজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা একধরনের মশা প্রজনন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এই মশা প্রাকৃতিকভাবেই জন্মাবে, কিন্তু তাঁদের বিরক্তিকর কামড়ে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ছড়াবে না। তাঁরা আরও একধরনের মশার জাত উদ্ভাবন করেছেন; যেই জাত আগামী ১০ বছরের মধ্যে প্রকৃতিতে বর্তমান জাতের মশা—যারা ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি রোগবালাইয়ের জন্য দায়ী, সেগুলো বিলুপ্ত করে দেবে। সেই নতুন জাতের মশা কামড়ালেও রোগজীবাণু ছড়াবে না।
    নাইর ইকবাল, সূত্র: টাইম ম্যাগাজিন

    ই-লেগ
    প্যারালাইসিসে আক্রান্ত রোগীরা নিজেদের প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিকে ব্যবহার করেও চলেফিরে বেড়াতে পারেন না। তাঁদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই দুঃখজনক ব্যাপারটি লাঘব করতেই প্যারালাইসিস রোগীদের জন্য এ বছর তৈরি করা হয়েছে ই-লেগ। ই-লেগ একধরনের অত্যাধুনিক কৃত্রিম পা, যার মূল যন্ত্রটি সৈনিকদের হ্যাভারসেকের মতো রোগীর পিঠে সংযুক্ত থাকবে। রোগীর দুই পা থাকবে দুটি পা-সদৃশ খোলের মধ্যে। যন্ত্র চালু করলেই রোগী খুব সহজে ও সুন্দরভাবেই স্বাভাবিক মানুষের মতো হেঁটে বেড়াতে পারবে। ২০১৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে এটি কিনতে পাওয়া যাবে।

    স্ট্র্যাডলিং বাস
    মূলত যেসব শহরে রাস্তার পরিমাণ কম কিন্তু যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেশি; সেই শহরে যানজট ও গণপরিবহন সমস্যার এক যুগান্তকারী সমাধান এটি। ইংরেজি স্ট্র্যাডলিং শব্দের অর্থ পা ফাঁক করে দাঁড়ানো। এর নাম স্ট্র্যাডলিং বাস। কারণ, এর তলা দিয়েই রাস্তার অন্যান্য যানবাহন চলাচল করতে পারে। রাস্তার যে প্রান্ত দিয়েই এই বাস চলাচল করুক না কেন, অন্যান্য যানবাহন চলাচলে এটি কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবে না। তবে যাত্রী ওঠানো ও নামানোর সুবিধার জন্য এক পাশ দিয়েই মূলত এই বাস চলাচল করবে। এই বাসের আবিষ্কারক হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ চীন। চীনের যানজটবহুল বেইজিং, সাংহাইয়ের মতো শহরগুলোর কথা মাথায় রেখেই মূলত এই বাস উদ্ভাবন করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০১১ সালের কোনো এক সময় এটি বিশ্বের বিভিন্ন জনবহুল শহরে চলতে দেখা যাবে। 
    | তারিখ: ২৬-১১-২০১০
    সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-26/news/111072 

    মৃত্যুশতবার্ষিকীর তলস্তয়

    বিখ্যাত রাশিয়ান চিত্রশিল্পী ইলিয়া রেপিনের (১৮৪৪-১৯৩০) আঁকা ছবিতে জমিতে হালচাষ করছেন তলস্তয়
    ঊনিশ শতকের সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ কাউন্ট লেভ নিকোলাইভিচ তলস্তয়, তাঁর ওয়ার অ্যান্ড পিস আর আনা কারেনিনার মতো কালজয়ী উপন্যাস দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন বিশ্বসাহিত্যকে, সমাজের সীমাহীন দারিদ্র্য আর অসমতা দেখে ব্যথিত হয়েছেন, অভিজাত ঘরে জন্ম (১৮২৮) নিয়েও তাই কলমকে ব্যবহার করেছেন অহিংস ও দরিদ্র-সেবার দর্শনে—যা অনুপ্রাণিত করেছে গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিংকে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই সাহিত্যিকের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল ২২ নভেম্বর ২০১০। মৃত্যুশতবর্ষে তলস্তয়ের জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি।

    একবার এক জার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সুস্থ হয়ে ওঠার এমনই আকুল আগ্রহ তাঁর যে তিনি ঘোষণাই দিলেন, ‘যে আমাকে সুস্থ করে তুলতে পারবে, আমি তাকে আমার রাজত্বের অর্ধেক অংশই দিয়ে দেব।’ রাজ্যের সব জ্ঞানী লোক একত্রে মাথা খেলাতে শুরু করলেন, কেমন করে জারকে সারিয়ে তোলা যায়, কিন্তু কেউই নিশ্চিত নন। জ্ঞানী লোকদের একজন বললেন, সত্যিকার এক সুখী মানুষের গায়ের শার্ট যদি জারকে পরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে জার সেরে উঠবেন।
    জার আদেশ করলেন, এখনই একজন সুখী মানুষ খুঁজে বের করা হোক। প্রজারা গোটা রাজত্বের ভেতরে ও বাইরে, যত জায়গায় যাওয়া সম্ভব, হন্যে হয়ে সুখী মানুষ খুঁজে বেড়াল। কিন্তু কারও সঙ্গেই সবকিছু পুরোপুরি মিলছে না। একজন ধনী তো স্বাস্থ্য খারাপ, অন্যজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কিন্তু পকেট ফাঁকা। একজনের স্বাস্থ্য ও সম্পদ দুই-ই আছে কিন্তু বউটা ভীষণ খিটিমিটি প্রকৃতির। কোনো না কোনো ব্যাপারে প্রত্যেকেরই ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে।
    একদিন জার-পুত্র অনেক দূরের কোনো এলাকা থেকে রাজপ্রাসাদে ফিরছিল। হঠাৎ শুনল, একটি কুটিরের ভেতর থেকে কে যেন বলছে, ‘হে খোদা, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, তুমি আমাকে এমন চমৎকার একটি দিন দিয়েছ। আজ আমি কিছুটা কাজকর্ম করতে পেরেছি, খাওয়ার মতোও কিছু জুটেছে। এখন আমি শান্তির সঙ্গে একটা দারুণ ঘুম দেব। তোমার কাছে আমার আর চাওয়ার কিছু নেই। আমার আর কোনো কিছুর প্রয়োজনও নেই।’
    এই কথা শুনে জার-পুত্র আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ‘সুখী মানুষ পেয়ে গেছি।’ প্রাসাদে ফিরে এসে রাজদূতদের অনেক টাকা-পয়সা দিয়ে বলল, সে যা চায় তা-ই দেবে, তার শার্টটা এখনই কিনে নিয়ে এসো।
    রাজদূতেরা টাকা নিয়ে রওনা হলো, লিটল ফাদারকে (সে আমলে প্রজারা জারকে ছোট বাবাই বলত) সেই সুখী লোকটির শার্ট পরিয়ে রোগমুক্ত করা হবে। কিন্তু তারা যখন পৌঁছাল, দেখল সেই সুখী লোকটির পরার মতো কোনো শার্টই নেই।
    তলস্তয় নিজের জন্যও চেয়েছিলেন সবচেয়ে সস্তা কফিন এবং সবচেয়ে সস্তা ও অতি সাধারণ কফিন।
    সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে অতিনন্দিত লেভ তলস্তয়ের মৃত্যুবার্ষিকী ২২ নভেম্বর ২০১০। মৃত্যুশতবর্ষে তলস্তয়ের জন্য অন্য আলোর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

    শতবর্ষ আগে: ১৯১০
    ভার্জিনিয়া ওলফ মনে করেন, ১৯১০ (আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ডিসেম্বর ও কাছাকাছি সময়) মানব চরিত্র বদলে দিয়েছে। তিনি বলছেন, যখন মানুষের সম্পর্ক প্রভু ও ভৃত্যের, স্বামী ও স্ত্রীর, পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে পাল্টে যেতে থাকে, তখন একই সঙ্গে ধর্ম, আচরণ, রাজনীতি ও সাহিত্যেও মানুষের সম্পর্ক বদলে যায় (পিটার স্ট্যানস্কির ‘আর্লি ব্লুমসবারি অ্যান্ড ইটস ইন্টিমেট ওয়ার্ল্ড’)।

    ১৯১০-এ কী ঘটেছে?
    তলস্তয় মৃত্যুবরণ করেছেন।
    হ্যালির ধূমকেতু দেখা দিয়েছে।
    চিত্রকলায় কিউবিজম বিকাশ লাভ করতে শুরু করেছে।
    স্ট্যাভিনস্কির ব্যালে ‘দ্য ফায়ারবার্ড’ ইউরোপ মাতিয়ে তুলেছে। আধুনিকতার চাপ ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করেছে। পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্টদের প্রদর্শনী শুরু হয়েছে।
    আরও অনেক ঘটনা—অটোমান শাসনবিরোধী আন্দোলনে আলবেনিয়া স্বাধীন হয়েছে, নিহত হয়েছেন মিসরের প্রথম দেশীয় প্রধানমন্ত্রী বুট্রোস ঘালি, নতুন দেশ সাউথ আফ্রিকা ইউনিয়নের জন্ম, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মৃত্যু, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস ভবনে বোমা বিস্ফোরণ এবং ২৭ জনের মৃত্যু, উড়োজাহাজের প্রথম বাণিজ্যিক ব্যবহার, অটোমোবাইল বিপ্লব, হেনরি ফোর্ডের ১০ হাজার গাড়ি বিক্রি, মার্ক টোয়েন এবং ও’হেনরির মৃত্যু।
    সবকিছু ছাপিয়ে লেখালেখির জগতে কালো বর্ডারে মুদ্রিত হয়ে আছে তলস্তয়ের মৃত্যুর কথা।

    সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ
    বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রকাশক, পত্রপত্রিকা, রাইটার্স গিল্ড বিভিন্ন সময় সেরা বইয়ের সমীক্ষা চালিয়ে থাকে। নতুন সহস্রাব্দে একটি সিন্ডিকেটেড সমীক্ষায় ৫৪৪টি গ্রন্থ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যাচাই-বাছাইয়ের পর তা ১২৫-এ হ্রাস করা হয়। এর ওপর পুনরায় জরিপের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০টি গ্রন্থ। সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ২০০৭-এর জানুয়ারিতে (গ্রেটেস্ট বুক অব অল টাইম—লেভ গ্রসম্যান)।
    ১. আনা কারেনিনা—লেভ তলস্তয়, ২. মাদাম বোভারি—গুস্তাভ ফ্লবেয়র,
    ৩. ওয়ার অ্যান্ড পিস—লেভ তলস্তয়, ৪. লোলিটা—ভ্লাদিমির নবোকাভ, ৫. দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন—মার্ক টোয়েন, ৬. হ্যামলেট—উইলিয়াম শেকসপিয়ার, ৭. দ্য গ্রেট গ্যাটসবি—এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, ৮. ইন সার্চ অব লস্ট টাইম—মার্শেল প্রাউস্ত, ৯. দ্য স্টোরিজ অব আন্তন শেখভ—আন্তন শেখভ, ১০. মিডলমার্চ—জর্জ এলিয়ট
    সর্বশ্রেষ্ঠ দশের প্রথম তিনটির দুটোই লেভ তলস্তয়ের। আর শ্রেষ্ঠ দশের শীর্ষস্থানে তাঁরই অসামান্য সামাজিক উপন্যাস আনা কারেনিনা, যার সূচনাবাক্যটিই এমন : All happy families resemble one another, but each unhappy family is unhappy in its own way.

    নোবেল পুরস্কার কমিটির পাপ
    তলস্তয় পুরস্কার পাননি।
    আলফ্রেড নোবেলের উইলে (১৮৯৫) নোবেল পুরস্কারের ঘোষণাটি আসে। প্রথম পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯০১ সালে। তবে ১৮৯৮ সালেই গুজব রটে যায়, নোবেল কমিটি পুরস্কারের জন্য তলস্তয়কে বিবেচনা করছে। ব্যাপারটি তলস্তয় সম্ভবত বিশ্বাসও করেছিলেন। হায়াত মামুদের লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘তলস্তয় সরাসরি সুইডেনের একটি কাগজে এই মর্মে চিঠি ছাপালেন যে পুরস্কার যদি তাঁকে দেওয়া হয়, তাহলে পুরস্কারের অর্থ এক হাজার রুবলের মতো, যেন দুখবোর সম্প্রদায়ের হাতে অর্পণ করা হয়। যা হোক, পুরস্কার দানের ব্যাপারটি জনশ্রুতি ছিল মাত্র। তখন তলস্তয় তাঁর “ফাদার সিয়ের্গি” ও “পুনরুত্থান” গ্রন্থ বিক্রীর সমস্ত অর্থ, মোট আশি হাজার রুবল, দুখবোরদের দান করলেন। যদিও বইটি প্রকৃতপক্ষে বেরোয়নি, তিনি পত্রিকা সম্পাদকের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়েছিলেন। ওই টাকায় জাহাজ কিনে সমগ্র দুখবোর সম্প্রদায় স্বদেশ ছেড়ে কানাডায় চলে গিয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করে।
    ১৯০১ সালের পুরস্কার ঘোষিত হলো। প্রথম সাহিত্য পুরস্কার পেলেন ফরাসি কবি সালি প্রুদম। একাডেমির এই সিদ্ধান্ত অবিবেচনাপ্রসূত মনে করে সুইডিশ লেখকেরা তলস্তয়কে চিঠি লিখলেন। ২২ জানুয়ারি ১৯০২ তিনি জবাব দিলেন, ‘নোবেল পুরস্কার যে আমাকে দেওয়া হয়নি, তাতে আমি ভারি খুশি হয়েছি। প্রথমত, এত টাকা দিয়ে কী করতাম, সে সমস্যা থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে; কারণ আমার বিবেচনায় অর্থ কেবল অশুভের দিকেই নিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, আমি যাঁদের চিনি না, জানি না, এমন কত জ্ঞানীগুণী মানুষের সমবেদনা লাভের সম্মান ও সৌভাগ্য তো আমার হতো না।’
    ১৯১০ সালের পুরস্কার ঘোষণাকাল পর্যন্ত তলস্তয় বেঁচে ছিলেন। নোবেল কমিটি তাঁর নাম শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিবেচনায় আনেনি। এ সময় আরও যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন—থিওডোর মোমসেন (১৯০২), বিয়র্নস্টার্ন বিয়র্নসন (১৯০৩), ফ্রেডরিখ মিস্ত্রাল, ইয়োসে এশগ্যারে (১৯০৪), হেনরিক জিয়ানকাইভিকস (১৯০৫), গিওসু কার্দোচ্চি (১৯০৬), রুডিয়ার্ড কিপলিং (১৯০৭), রুডলফ ইউকেন (১৯০৮), সেলমা লেগারলফ (১৯০৯) এবং পাউল হেইসে (১৯১০)। বাদ পড়ে গেলেন তলস্তয়।
    নোবেল পুরস্কার কমিটির ব্যর্থতা যখন আলোচনায় আসে তলস্তয়কে পুরস্কার দিতে না পারাটা কমিটির পাপ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। এ সময় বাদ পড়েছেন, সাহিত্যের আরও দুজন দিকপাল হেনরিক ইবসেন, এমিল জোলা ও আন্তন শেখভ। এমনকি মার্ক টোয়েন। প্রথম পুরস্কার বিজয়ী সালি প্রাদুম কবি হিসেবে এমনকি নিজ দেশ ফ্রান্সেও সুপরিচিত ছিলেন না। রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স নোবেল পুরস্কারের জন্য তলস্তয়কে মনোনয়ন দিয়ে তাঁকে পুরস্কৃত করার জন্য সুইডিশ একাডেমিকে চিঠিও দেয়। আর একথা জানামাত্রই তলস্তয় ফিনল্যান্ডের লেখক ও তাঁর বন্ধু আরভিদ আর্নফেল্ডকে লিখলেন, ‘যদি ব্যাপারটা ঘটেই যায়, এটা প্রত্যাখ্যান করা আমার জন্য খুবই অপ্রীতিকর হবে। সে জন্যই আমি তোমার সহযোগিতা চাচ্ছি। সুইডেনের সঙ্গে তোমার যদি কোনো যোগাযোগ থেকে থাকে (আমার ধারণা আছে) তাহলে দেখো যেন আমাকে পুরস্কার দেওয়া না হয়। আমার বেলায় এই পুরস্কার এড়িয়ে যেতে আমি আশা করি, তুমি সর্বাধিক চেষ্টা করে যাবে।’
    যাঁদের প্রাপ্য নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এমন দশজন শ্রেষ্ঠ লেখকের একটি তালিকা, সাইবার সূত্র থেকে প্রাপ্ত।
    লেভ তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০), মার্ক টোয়েন (১৮৩৫-১৯১০), জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১), মার্শেল প্রাউস্ত (১৮৭১-১৯২২), হেনরিক ইবসেন (১৮২৬-১৯০৬), এমিল জোলা (১৮৪০-১৯০২), রবার্ট ফ্রস্ট (১৮৭৪-১৯৬৩), ডব্লিউ এইচ অডেন (১৯০৭-১৯৭৩), ভ্লাদিমির নবোকভ (১৮৯৯-১৯৭৭) এবং হোর্হে লুই বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬)।
    তলস্তয়কে নোবেল পুরস্কার দিতে সুইডিশ একাডেমির ব্যর্থতা তলস্তয়কে হেয় করতে পারেনি, হেয় করেছে পুরস্কারকে। আইজাক বাবেল বলেছেন, পৃথিবী নিজে যদি লিখতে পারত, তাহলে তলস্তয়ের মতো লিখত।

    অর্থ ব্যবস্থাপনা
    বাবা নিকোলাই ইলিচ তলস্তয়ের জমিদারি যখন, তখনকার রুশ বিধান অনুযায়ী ভাগ করা হলো, চার ভাইয়ের মধ্যে লেভই পেলেন সবচেয়ে কম উৎপাদনশীল অংশ। তাঁর ভাগে পড়ে চার হাজার একর জমি ও ৩৩০ জন ভূমি দাস। এই জমি পছন্দের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি যা বললেন তা হলো: যেহেতু তাঁর বেশি টাকার দরকার নেই, সেই জন্যই কম আয়ের ভাগটা নিয়েছেন।
    তাঁর জীবনের লিখিত প্রতিজ্ঞাগুলোর একটি হচ্ছে যতটা সম্ভব কম খরচে জীবন পরিচালনা করা। অন্যটি নিজের সব কাজ নিজে করা।
    হায়াৎ মামুদের লেখা থেকে উদ্ধৃত: ১৮৫১: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসেবে (তলস্তয়) লিখেছেন, ‘আর্থিক উন্নতির যেসব উপায় আমার সামনে খোলা আছে তা হলো—১. জুয়াড়ির দলে যোগ দেওয়া এবং পয়সা থাকলে জুয়া খেলা, ২. সমাজের উঁচু মহলে ঘোরাফেরা করা এবং অবস্থা মনমতো হলে বিয়ে করে ফেলা, ৩. দামি একটা চাকরি বাগানো।’
    উল্লেখ্য, জুয়ার নেশায় তলস্তয়কে প্রচুর টাকা হারতে হয়েছে। ১৮৫৭ সালেও জার্মানি এসে দিনরাত জুয়া খেলেছেন এবং সর্বস্বান্ত হয়ে পুনরায় ধার করে আবার জুয়ার টেবিলে হাজির হয়েছেন।
    আবার এটাও সত্য, মৃত্যুর ১০ দিন আগে লাখ লাখ মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ফেলে অজানার উদ্দেশে যেদিন ঘর ছাড়েন, সেদিন তাঁর হাতে ছিল মাত্র ৩৯ রুবল। 
     
    আন্দালিব রাশদী | তারিখ: ২৬-১১-২০১০
    মুল সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-26/news/111071 

    Tuesday, November 9, 2010

    ট্রোজান হর্স বা ট্রয়ের ঘোড়া


    ট্রয়ের যুদ্ধ বা ট্রোজান ওয়ারের কথা কমবেশি সবার জানা। প্রাচীন গ্রিক এবং ট্রয় (বর্তমান তুরস্কে অবস্থিত)-এর অধিবাসীদের মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব ১২৩০ অব্দে ট্রয় নগরেই এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ১২৪০ অব্দে এই যুদ্ধ শুরু হয়। যার প্রধান কারণ ছিল ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস, স্পার্টার রাজা মেনিলাসের সুন্দরী স্ত্রী হেলেনকে অপহরণ করে নিজ বাসভূমিতে নিয়ে যান। মেনিলাসের ভাই আর্গসের রাজা আগামেমন গ্রিক নগরসমূহের রাজাদের আহ্বান করেন এবং ১ হাজারটি জাহাজ নিয়ে তিনি যাত্রা করেন হেলেনকে ফিরিয়ে আনার জন্য। টানা ১০ বছর ধরে গ্রিকরা ট্রয় নগর অবরোধ করে রাখেন কিন্তু তারা সাফল্য লাভ করতে অসমর্থ হন। তাই তখন তারা শত্রুদের পরাজিত করার জন্য পরিকল্পনা শুরু করেন। শত্রুদের পরাজিত করার জন্য তারা একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তারা একটি বিরাট কাঠের ঘোড়া তৈরি করেন, যার নাম ছিল ট্রোজান হর্স বা ট্রয়ের ঘোড়া। এ বিরাট ঘোড়ার ভেতর গ্রিকরা এক আক্রমণকারী বাহিনীকে লুকিয়ে রাখল এবং ট্রয় নগরের দেয়ালের বাইরে তা ফেলে রেখে চলে এলো। এপিয়াস নামে একজন দক্ষ ছুতার বা মুষ্টিযোদ্ধা এ ঘোড়াটি তৈরি করেন। পলায়নের ভান করে গ্রিকরা জাহাজে করে নিকটবর্তী টেনিডোস দ্বীপে চলে গেলেন। যাবার সময় তারা সাইননকে সেখানে রেখে গেলেন। সাইনন ট্রয়বাসীকে বোঝাল যে, এই ঘোড়াটি এথিনাকে উপহার দেওয়া হয়েছে ট্রয় নগরকে অপরাজেয় করে তোলার জন্য। ট্রয়বাসী আনন্দ-উল্লাস করতে করতে ঘোড়াটিকে নগর-দেয়ালের অভ্যন্তরে নিয়ে এলো। তারা বুঝতেই পারেনি যে, ঘোড়াটি গ্রিক সৈন্য দ্বারা পরিপূর্ণ। মধ্যরাতে ওই সৈন্যরা কাঠের ঘোড়ার খোল ভেঙে বেরিয়ে এলো এবং নগরের দ্বারসমূহ খুলে দিয়ে অন্য গ্রিক সৈন্যদের নগরে ঢোকার সুযোগ করে দিল। তারা যত ট্রয়বাসীকে সামনে পেল সবাইকেই হত্যা করল এবং পুরো ট্রয় নগরীতে আগুন ধরিয়ে দিল। দেখতে দেখতে নগরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেল। ট্রোজান ওয়ার বা ট্রয়ের যুদ্ধে এ ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বন করে অন্ধ গ্রিক মহাকবি হোমার একটি বিখ্যাত মহাকাব্য রচনা করেন যার নাম 'ইলিয়াড'। ট্রয়ের অপর নাম ছিল ইলিয়াম। ইনিডের দ্বিতীয় পুস্তকে ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এছাড়াও 'ওডিসি'তেও এর কিছু কিছু উল্লেখ আছে।

    -প্রীতম সাহা সুদীপ 
    মুল সুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&type=pratidin&pub_no=196&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=0

    ডলুছড়ার শান্ত পল্লি

    


    পাহাড়ি, লালচে মাটির পথ। একটু একটু করে ওপরের দিকে উঠে গেছে। টিলার ওপরে উঠে পথ এদিকে-ওদিকে ছুটেছে। পথের দুই পাশে মাটির দেয়াল তোলা ছোটবড় ঘর। যতই সামনে এগিয়ে যাই, কেমন শান্ত আর কোলাহলহীন পরিবেশ। মানুষ আছে, অকারণ হইচই নেই। এটি একটি আদিবাসী গ্রাম। টিপরা বা ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর লোকজন এই গ্রামটিতে বাস করে। শ্রীমঙ্গল উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় প্রাচীন এই গ্রামটির নাম ডলুছড়া ত্রিপুরা পল্লি।
    সঙ্গে ত্রিপুরা যুবক সনজিত দেব বর্মণ। গ্রামটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে কয়েকটি শিশু একটি দোকানের সামনে ক্যারম খেলছে। অন্য শিশুরাও নিজেদের মতো ছোটাছুটি করছে। সেদিন স্কুল বন্ধ, তাই সারা দিন ছুটি। গ্রামটির ভেতর বাড়িগুলো পরিপাটি। ডলুছড়ায় (ডলুবাড়ি) অনেক দিন পর চোখে পড়ল ছনের চাল। প্রাকৃতিক শীতাতপ ব্যবস্থা। আজকাল দুর্লভ ও দামি হওয়ায় ছন দিয়ে ছাউনি দেওয়ার সুযোগ কম।
    সনজিত দেব বর্মণ জানালেন, ডলুছড়ায় ৭৫টি ত্রিপুরা পরিবার আছে। তাদের প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে লেবু চাষ। প্রায় ১২ মাসই কমবেশি লেবু ফলে। লেবু বিক্রি করেই জীবিকা চলে। তবে মৌসুমি ফল আনারস ও কাঁঠালও আয়ের একটি উৎস তাদের। ডলুছড়া গ্রামের সমতলে ডলুছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টি থাকায় আদিবাসী ত্রিপুরা শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যা অর্জনের কাজটি সেরে নিতে সহজ হয়েছে। তবে উচ্চবিদ্যালয় বা কলেজ বেশ দূরে। ডলুছড়া থেকে শ্রীমঙ্গল সদরের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। এতটা পথ পাড়ি দেওয়া অনেক আদিবাসী শিশুর পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। সনজিত দেব বর্মণ জানালেন, এই গ্রামের ১০-১২ জন কলেজে ও ৩০ জনের মতো হাইস্কুলে পড়ালেখা করছে। আসা-যাওয়াটা তাদের জন্য বেশ সমস্যা; বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে বেশ কঠিনই।
    সমস্যা আরও একটা আছে। ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর নিজেদের একটি ভাষা আছে। সেই ভাষার নাম ‘ককবরক’। ত্রিপুরা আদিবাসী তরুণী মল্লিকা দেব বর্মণ বললেন, ‘ককবরকে কথা বলি, কিন্তু অক্ষর চিনি না। লিখতে পারি না। তবে জানার আগ্রহ আছে।’ এই জানার আগ্রহ আরও অনেকেরই। কিন্তু সেই সুযোগটি তাঁরা পাচ্ছেন না। তাঁরা জানেনও না কীভাবে নিজেদের ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখবেন। মল্লিকা দেব বর্মণ একটি ব্র্যাক স্কুলে শিশুদের পড়ান। সেই স্কুলেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়। নিজেদের ভাষা নিয়ে এ অবস্থা ডলুছড়ার লেখাপড়া জানা না-জানা প্রায় সবার। নিজেদের ভাষাটি এভাবে হয়তো একদিন তাঁরা হারিয়ে ফেলবেন। এই তরুণ-তরুণীরা জানালেন, ‘গড়িয়া’ নামে তাঁদের একটি নিজস্ব পূজা আছে। শুধু বাঁশ দিয়ে বাংলা বছরের শুরুতে এই পূজা হয়ে থাকে। এই পূজায় মূর্তি নির্মাণ থেকে শুরু করে সব কাজ সম্পন্ন করা হয় বাঁশের তৈরি উপকরণ দিয়ে।
    ঘুরতে ঘুরতে দেখা মিলল ‘ত্রিপুরা হস্তশিল্পকেন্দ্র’ নামে একটি দোকানের। দোকানে কেউ নেই। মনে হলো, কেউ না থাকলেও নিরাপদেই আছে দোকানটি। সনজিত দেব বর্মণ নিজেই দোকানটি খুলে দেখালেন। ত্রিপুরাদের নিজেদের তৈরি তাঁতের বস্ত্র রাখা আছে এখানে। নানা রকমের গামছা, ঝোলা ইত্যাদি দোকানের দড়িতে ঝুলছে। এই দোকানের কাপড় নিজেরাই নিজেদের তাঁতে তৈরি করেন। তার বড় ক্রেতাও নিজেরাই। ডলুছড়ার ডলুবাড়ির পুরো গ্রামটিতে কেমন বিন্যস্ত এক জীবনপদ্ধতি। কোথাও উচ্চস্বর নেই, যন্ত্র-দুনিয়ার কোলাহল নেই। সবাই সবার মতো চলছে, ঘর-সংসারের কাজ করছে। কেউ বা লেবুবাগানে, কেউ বাড়ি ফিরছে, কেউ অবসর সময় বসে কাটাচ্ছে। সনজিত দেব বর্মণ ডলুবাড়িতে একটি তাঁত কারখানার কথা জানালেন। সেটি দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে একটি ব্যানার। তাতে লেখা ‘আমাদের তাঁত ঘর’ এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি নারী উদ্যোগ। তবে তখন তাঁতগুলো খালি পড়ে আছে। শুধু একজন বৃদ্ধ নারী আপন মনে একটি কোমর-তাঁতে কাপড় বুনে চলেছেন।
    তাঁর নাম রেশমবতী বর্মা। বয়স ৬২ বছর। জানালেন, তিনি ‘রিচা’ (কোমরে পরার বস্ত্র) তৈরি করছেন। রেশমবতী বর্মা বললেন, ‘সংসারে আমার কেউ নাই। একলা মানুষ। ছেলেমেয়ে নাই। স্বামী নাই পাঁচ বছর।’ আরও জানালেন, মাসে চারটার মতো চাদর তৈরি করতে পারেন। এ ছাড়া জুমে লেবুবাগানে কাজ করেন। এতে যা মেলে, তা দিয়ে নিজে নিজেই চলেন। এই বয়সে একলা আপন পায়ে দাঁড়িয়ে চলার এক নীরব সংগ্রাম চলছে রেশমবতী বর্মার। খোলা দুনিয়ার মেরেকেটে বা হাত পেতে খাওয়ার লোভ-লালসা তাঁর ধারেকাছেও যেতে পারেনি।
    ডলুবাড়ি থেকে নেমে ডলুছড়ার ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পাকা পথে আসতেই দেখা সর্বানন্দ দেব বর্মার সঙ্গে। বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। তিনি ডলুছড়ার ‘গ্রাম চৌধুরী’—গ্রামপ্রধান। গ্রামে ঝগড়া-বিবাদ হলে তিনিই মিটমাট করেন। তিনি জানালেন, এই ডলুছড়ার পত্তন হয়েছে প্রায় ৭০০ বছর হলো। আগে রাস্তা ছিল না। পুরোটাই জঙ্গল ছিল। বাঘ-ভালুক ছিল প্রতিবেশী। এখন এসব নেই। কিন্তু এখন যেটা আছে, শান্তি। গ্রাম চৌধুরী বললেন, ‘শান্তিতে আছি। কোনো সমস্যা নেই।’ শান্তির যে কোনো বিকল্প নেই, তাঁর সরল-শান্ত চেহারাটি সেই সত্যকেই যেন প্রকাশ করছে। 
     
    আকমল হোসেন | তারিখ: ০৯-১১-২০১০
    মুল সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-09/news/107853 

    Monday, November 8, 2010

    যমুনা আনন্দ পার্ক এর পেছনের মানুষ


    সভ্যতার বিবর্তনের পথ ধরে মানুষ আজ অনেক দূর পাড়ি দিয়েছে। অর্জন করেছে অজেয় অনেক কিছুই। তেমনি এক অসাধ্যকে সাধন করেছেন এ এইচ এম আতাউর রহমান। যমুনা রিসোর্টের একটি প্রোজেক্ট হলো যমুনা আনন্দ পার্ক। যেখানে আজ থেকে ৪ বছর আগে তিনি গার্ডেন ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে এমএসসি পাস করে তিনি এখানে যোগদান করেন। এ পার্কটি সম্পূর্ণ বালু দিয়ে ভরাট করা ঠিক যেন মরুভূমির মতো, কোথাও কোথাও ৬৫ থেকে ৭০ ফুট বালু। প্রজেক্টটি করার জন্য প্রথমে থাইল্যান্ড থেকে একদল গবেষক আসে। তারা এই বালুমাটি দেখে এই প্রজেক্টে কাজ করার অস্বীকৃতি জানায়। পরে এই প্রজেক্টে কাজ করতে ইচ্ছা পোষণ করেন এ এইচ এম আতাউর রহমান। তারপর শুরু করেন প্রজেক্টের কাজ। এখন যমুনা আনন্দ পার্কে এলে আপনি দেখবেন এখানে প্রকৃতি যেন সবুজ ঘাসের চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে। আর তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে দুরন্ত যমুনা নদী। যার সৌন্দর্য এখানে জুগিয়েছে বাড়তি আনন্দ। এই পার্কে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফুল, ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ। এর মধ্যে রয়েছে হরীতকী, বহেরা, আমলকী, জামরুল, আম, পেয়ারা, জলপাই ইত্যাদি আর ফুলের মধ্যে রয়েছে দেশি-বিদেশি মিলে প্রায় শতাধিক রকমের গাছ।

    এ পার্কে আরও আছে আধুনিক বিনোদন ব্যবস্থা, যেখানে বিভিন্ন ধরনের রাইড যেমন_ মিনি ট্রেন, ব্যাটারি কার, প্যাডেল বোট, বৈদ্যুতিক দোলনা ইত্যাদি। কিন্তু আজ থেকে ৪ বছর আগে এখানে ছিল ভিন্ন এক পরিবেশ। এই প্রজেক্ট প্রসঙ্গে আতাউর বলেন, প্রজেক্টে আমি কাজ শুরু করি আজ থেকে ৪ বছর আগে। তখন এই জায়গাটা ছিল একটি বালুর স্তূপ। এই বালুমাটিকে আমি নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহার করে গাছের উপযোগী করে গড়ে তুলেছি। পার্কটির সমস্ত জায়গায় সবুজ ঘাসে আবৃত করেছি। এখানে প্লান অনুপাতে বিভিন্ন ফলদ, ফুল, বনজ ও অর্নামেন্টাল উদ্ভিদ দিয়ে সাজিয়েছি। এখানে গার্ডেন ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে কালচার পদ্ধতিতে পর্যটকদের খাওয়ার জন্য বিভিন্ন সবজি যেমন লাউ, কুমড়া, বাঁধাকপি, তরমুজ, আলু, পিঁয়াজ, মিষ্টি কুমড়া, শশা, লেটুস, পেঁপে, কলাসহ বিভিন্ন সবজি সম্পূর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। শীতকে সামনে রেখে নতুন করে বাগানটাকে সাজানোর চেষ্টা করছি। শুধু তাই নয় এই পার্কে সুন্দর করার জন্য যা যা দরকার হয় আমি তাই করব। এবং প্রমাণ করে দেব যে, আমাদের দেশের ছেলেরাও অনেক কাজ করতে পারে।

    আলী আফতাব 
    তথ্য সুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=07-11-2010&type=pratidin&pub_no=194&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=0

    অবাক পৃথিবী: পৃথিবী চেয়ে রয়

    ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি
    জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি’—
    কোনো নবজাতকের জন্ম হলেই বুকটায় কেমন একটা অনুভূতি হয়, কেন পৃথিবীতে জন্ম নিল শিশুটি? একদিকে পৃথিবীটায় ঋতু পরিক্রমা বিধ্বস্ত, অন্যদিকে বিশ্বায়নের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সংকট বাড়ছে। শিশুটি জন্মেই ঋণগ্রস্ত। একটা বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে পৃথিবী। এসবই আবার মানুষের তৈরি। ঋণগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি তো আমরা চোখের সামনে দেখলাম। অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করলেন, ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যের প্রকোপ কমাতে পারছে না। ছয় কোটি লোক ভয়াবহ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। এই দারিদ্র্য কমানোর আশুপদক্ষেপ যে ক্ষুদ্রঋণ বা ঋণ নয়, তা আজ বিশ্বে স্বীকৃত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঋণের সুদ দিয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চেয়েছিল, কিন্তু তাতে তার অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? সম্ভবত বর্তমানে সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সারা পৃথিবী থেকে থাবা দিয়ে টাকা নিয়ে তারা দেশ চালায়। আবার এই মাস্তানির অর্থ সাহায্য হিসেবেও সারা পৃথিবীতে বিতরণ করে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি টাকা ধার করে সে গণচীনের কাছ থেকে।
    বাংলাদেশে অনেক পরীক্ষিত সম্ভাবনা ছিল। এর মধ্যে কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে পাট। একসময় পাটই ছিল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় উপায়। অনেক পাটকল গড়ে উঠেছিল এ দেশে। বৃহত্তম ছিল আদমজী। কীভাবে পাটকলগুলো ধ্বংস হলো, কার ষড়যন্ত্রে—তাও আজ আর অজানা নয়। কৃষিকে আধুনিকায়নের ফলে খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। গার্মেন্টসে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বিদেশে মানবসম্পদ রপ্তানিও একটা উল্লেখযোগ্য খাত। শিল্প-কলকারখানাও গড়ে উঠছে সর্বত্র। মাছ চাষের ক্ষেত্রেও একটা নীরব বিপ্লব সাধিত হচ্ছে। কলকারখানায় চাকরি নিলে, বিদেশে একটা চাকরি নিলে ঋণের আওতা থেকে বেঁচে যাওয়া যায়, কিন্তু বিশাল ও ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থান হয় না। এই যে বেকার দরিদ্র মানুষ, এর মধ্যে ঢুকে গেছে ক্ষুদ্রঋণ। ক্ষুদ্রঋণ কিছু করতে পারছে না, শুধু কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে সে দিশেহারা। তাহলে উপায় কী? উপায়ের উদাহরণ আমাদের চারপাশেই আছে। সবচেয়ে দ্রুততম উপায়ে উন্নয়নের উদাহরণও আছে। মালয়েশিয়া। মাত্র ২৫ বছর আগেও ছিল হতদরিদ্র। বিশাল দেশের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার তারা করতে পারত না। সে দেশের নেতা মাহাথির মোহাম্মদ শিল্পায়নে বিপুল বিনিয়োগকে সম্ভব করে তুললেন। দেশি এবং বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগের ফলে দেশে একটা শিল্পবিপ্লব হয়ে গেল। জনসংখ্যা তেমন নয়, তাই বিদেশ থেকেও শ্রমিক আনতে হলো।
    আমাদের দেশে বিনিয়োগ এক রাজনৈতিক বিষয়। অস্থিতিশীল সমাজ, সর্বত্র দলীয় বিবেচনা এবং দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব—সব মিলিয়ে একটা আস্থা সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন পর্যায়ে যে গুণসম্পন্ন কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন, তা-ও নেই। আসলে বৃহত্তর অর্থে সবকিছুই রাজনৈতিক। ’৭৫ থেকে ’৯০ পর্যন্ত দেশে ন্যূনতম জবাবদিহি ছিল না, কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিটা ছিল। ক্ষমতার ছিটেফোঁটা নিয়ে কিছু রাজনীতিক জবাবদিহির বিষয়টাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
    গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগণকে নিয়ে, জনগণের শ্রেষ্ঠ মেধাটিকে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে যদি নেতৃত্বের মধ্যে একজন একনায়কের উত্থান হয়, তাও ক্ষতির কিছু নেই। মাহাথিরও একনায়ক ছিলেন। ১৬ কোটি জনগণকে মানবসম্পদে পরিণত করলে বাংলাদেশ সিংহ হয়ে যেতে পারে। প্রবাসে অনেক মেধা অন্য দেশের উন্নয়নে কাজে লাগছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনেও বড় কাজে লাগানো যায়।
    কালক্রমে আমলাতন্ত্র একটা বড় প্রতিবন্ধক হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা বিদেশি কনসালট্যান্টদের স্বাগত জানাবেন, কিন্তু দেশের মেধাকে সেখানে ঢুকতে দেবেন না। অবসরপ্রাপ্ত আমলা, শিক্ষক তাঁরা বিদেশি নানা সংস্থায় কাজ করে দেশের সেবার চেয়ে সেসব সংস্থার স্বার্থকেই বড় করে দেখবেন। ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা কমিশনে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের স্থান হয়েছিল, কিন্তু ক্যাডার সৃষ্টির মাধ্যমে সেসব আর নেই। আমলারাই প্রমোশন পেয়ে সেসব সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করছে আর ক্ষমতা বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ভেস্তে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সরকার ও বিরোধী দলের সম্পর্ক থাকছে ভীষণভাবে দ্বান্দ্বিক। একেবারেই জাতীয় প্রশ্নে তাদের ঐকমত্য হচ্ছে না। তুচ্ছ বিষয়ে বিতর্ক চলছে অথচ জাতিরক্ষার প্রশ্নে একযোগে কাজ করার কোনো প্রতিশ্রুতি আসছে না। এ অবস্থা কত দিন চলবে? ৫০ বছর, ১০০ বছর, ২০০ বছর? না, বেশি দিন তা চলে না। একটা উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবশ্যম্ভাবী উত্থান হতে হবেই।
    তাহলে আর ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি থাকবে না বরং হতে পারে এক অবাক বাংলাদেশ, পৃথিবী চেয়ে রয়।
    মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।তারিখ: ০৮-১১-২০১০
    মুল সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-08/news/107448

    বন্দী বার্মার ডাক শুনুন

    ব্রিটিশ অধীনতা থেকে স্বাধীনতার অল্পদিন পরে ক্ষণিকের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার পর থেকেই বার্মা ৫০ বছর ধরে এক চরম স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসনে বন্দী। বার্মা এখন বিশ্বের দরিদ্রতম দেশ। এর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা খুবই নড়বড়ে। ওষুধ মেলে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। কঠোর বিধিনিষেধের সঙ্গে রয়েছে প্রতিবাদীদের জন্য চরম শাস্তি। শান, কারেন, চিন, রোহিঙ্গাসহ অন্য সংখ্যালঘুদের সঙ্গে নির্মম নিপীড়নমূলক আচরণ করা হয়। যাকে-তাকে ইচ্ছামতো বন্দী করা হয়, চলে ভয়াবহ নির্যাতন। রাষ্ট্র নিজেই উচ্ছেদ করে মানুষকে, চালায় সংগঠিত ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড। এবং জনগণ যখন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, তখন সরকার কেবল সাহায্যেই বিমুখ নয়, অন্যদের সাহায্যের হাতও ঠেকিয়ে দেয়। ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘নার্গিস’-এর সময় এটাই হয়েছিল, আন্তর্জাতিক সাহায্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
    সামরিক জান্তা দেশটির নাম বদলে মিয়ানমার রাখে। সত্যিই তো, শত শত বছর ধরে বার্মা নামে যে সুন্দর দেশটি বিকশিত হয়েছিল, সেই দেশটি আর কোথাও নেই। এই মিয়ানমার সেই বার্মার ধ্বংসের ওপর সৃষ্টি হয়েছে।
    এই বিপদ এক দিনে ঘটেনি। কেবল বার্মার সরকার ও নাগরিকদের একটি অংশই নয়, বার্মার এই পতনে অবদান রেখেছে প্রতিবেশী দেশগুলো, এমনকি গোটা বিশ্ব। বার্মার সরকারের কথাই প্রথমে আসবে। দেশটির সামরিক শাসকেরা এমন এক ‘আমরা’, যাদের বিপরীতে ‘ওরা’ হচ্ছে তাঁদেরই জনগণ। যে দেশে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত হয়, মুক্ত মত প্রকাশ যেখানে অসম্ভব, সেখানে এই দুইয়ের দূরত্ব কমানো কঠিন।
    বার্মার শাসকদের কোনো অংশই এই বাধা দূর করতে ইচ্ছুক নন। কিন্তু বাইরে থেকেও তেমন চাপ আসছে না। বার্মার শক্তিশালী প্রতিবেশীরা, বিশেষ করে চীন, ভারত এবং থাইল্যান্ডও সামরিক জান্তাকে মদদ দিয়ে চলছে। জাতিসংঘের এখানে করণীয় ছিল। কিন্তু জাতিসংঘ দূতের মিনমিনে গলার প্রতিবাদ দিয়ে বার্মার সরকার নড়বে না। আসিয়ানের নেতারাও বার্মাকে চাপে ফেলেননি। কিন্তু বার্মার জনগণের এখন দরকার বাস্তব সহায়তা।
    তা হলেও প্রমাণ আছে যে বার্মার সামরিক শাসকেরা বিশ্ব জনমতকে হিসেবে রাখেন। গতকালের (৭ নভেম্বর) নির্বাচন সেই উদ্দেশ্যেই দেওয়া হয়েছে। কেন তাঁদের একটি নির্বাচন প্রয়োজন? কারণ, তাঁরা এখন গণতান্ত্রিক লেবেল লাগিয়ে মানুষকে ধোঁকা দিতে চান। এটা এমন এক নির্বাচন, যেখানে শাসকেরা নিজেদের বিজয়ের সব বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। নির্বাচন সেখানে আগেও হয়েছিল। ১৯৯০ সালের সেই নির্বাচনে অনেক বাধা সত্ত্বেও অং সান সু চির দল বিপুল বিজয় পায়। ৪৮৫ আসনের মধ্যে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি পায় ৩৯২টি আসন আর সরকারি দল পায় মাত্র ১০টি। কিন্তু নির্বাচনের ফল অস্বীকার করা হয় এবং তখন থেকেই সু চিসহ দেশটির অনেক নেতা এ অবধি বন্দী আছেন।
    সেই অভিজ্ঞতা থেকে শাসকেরা একটি শিক্ষা নেন। এবারের নির্বাচনের আগেই তাই শাসকেরা নিজেদের জন্য বেশ কিছু আসন সংরক্ষিত রাখেন, সত্যিকার বিরোধীদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর পথ বন্ধ রাখেন, প্রকাশ্য আলোচনা নিষিদ্ধ করেন, বিরোধী নেতাদের প্রায় সবাইকে আটক করেন।
    এমন অবস্থায় বিশ্ব কী করতে পারে? প্রথমতো, এই নির্বাচন যে একটা জোচ্চুরি, তা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। কেউ যদি ভালো মনে ভেবে থাকেন যে নির্বাচনের পর পরিস্থিতি কিছুটা বদলাবে, তবে তিনি বার্মার সত্যিকার বাস্তবতা জানেন না। নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রচারণা-যুদ্ধে শাসকদের জয়ী হওয়ার মানে বর্মি জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রামকে হেয় করা।
    আজ যদি ভাবা হয়, ‘নির্বাচনে কী হয় দেখা যাক’, তাহলে পরে এই ভাবনাও আসবে যে ‘আচ্ছা, তাদের আরেকটু সময় দেওয়া যাক।’ এর মানে হবে বর্মি জনগণের দুঃখ-কষ্টকে আরও দীর্ঘদিন ধরে চলতে দেওয়া। এ মুহূর্তেই উচিত, বার্মার পরিস্থিতি বিষয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করার ঘোষণা দেওয়া।
    এ বিষয়ে বিশ্ব কি এককভাবে কিছু করতে পারে? এ বিষয়ে প্রথমেই আসবে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা জারির কথা। জানা কথা যে, যে অবরোধে জনগণের কষ্ট হবে তা নিয়ে শাসকেরা চিন্তিত নন। তাঁরা চিন্তিত হবেন তখনই যখন তাঁদের স্বার্থে আঘাত আসবে। তাই সর্বাত্মক অবরোধের চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে অবরোধ আরোপ করাই উত্তম।
    কী হতে পারে সেই সুনির্দিষ্ট অবরোধের ক্ষেত্র? সবার আগে সামরিক জান্তাকে সব ধরনের অস্ত্র ও যুদ্ধ-সরঞ্জাম দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এর মধ্যে সরাসরি বা অপ্রত্যক্ষভাবে দেওয়া সামরিক সহযোগিতাও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একইভাবে সেসব ব্যবসার ওপর আর্থিক বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে, যা থেকে বার্মার সামরিক নেতারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছেন। অনেক কিছুর সঙ্গে তাঁরা জড়িত। এর মধ্যে আছে খনিজ রপ্তানি, হীরা-মানিক-তেল-গ্যাস ও কাঠ। এসব ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে জনগণ সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
    বার্মার শাসনকাঠামোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিদেশ সফরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। চিকিৎসার জন্যই হোক আর ব্যবসার খাতিরেই হোক, তাঁদের বিদেশে ঘোরাফেরা থেকে সামরিক শাসনই লাভবান হয়।
    বার্মার সামরিক শাসন টিকে থাকায় কয়েকটি দেশেরও ভূমিকা আছে। চীনা সরকার দীর্ঘদিন ধরে বার্মার সঙ্গে ব্যবসা করছে এবং সে কারণে জান্তার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটোক্ষমতা থাকার সুবাদে বার্মার শাসকদের জন্য চীনই সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল।
    চীনের পরে আছে বার্মার অন্য দুই প্রতিবেশী ভারত ও থাইল্যান্ড। দুটি দেশই বার্মার সঙ্গে ব্যাপক ব্যবসা-বাণিজ্য চালাচ্ছে। ভারত তো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহ দমনে সরাসরি বার্মার সাহায্য পাচ্ছে। এসব কারণেই চীনের সঙ্গে সঙ্গে ভারত ও থাইল্যান্ড কেবল বার্মাকে সাহায্যই করছে না বরং সামরিক শাসন টিকিয়ে রাখায় কাজ করছে। একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আমার মন ভেঙে যায় দেখে যে আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী, যিনি বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে মানবিক ও সহমর্মী রাজনৈতিক নেতা, তিনি নিজেও বার্মার কসাইদের দিল্লিতে অভ্যর্থনা জানান, তাঁদের সঙ্গে হাত মেলান।
    ভারতে বার্মার পরিস্থিতি কিংবা ভারত সরকারের বার্মা-নীতি কমই আলোচিত হয়। এমন নয় যে, তা সংবাদমাধ্যমে ছাপা হবে না বা কেউ করলে শাস্তি হবে; বরং উল্টোটা। আমি নিজে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক সভায় সরকারের বার্মা-নীতির কঠোর সমালোচনা করেছি এবং তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে। সমস্যা হলো, ভারতের সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ-চিন্তা। ভারতে এখন এমন এক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে নেহরুর আমলের উদার সৎসাহসিকতাগুলো ভুলে যেতে চাওয়া হচ্ছে। অথচ বার্মায় সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর পর ভারতই সেখানকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অনেক সহায়তা করেছিল। অং সান সু চিও ভারতের বন্ধুত্ব ও সাহায্য পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন ভারত চীনের অনুকরণে ক্ষুদ্র স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নেহরু যেসব চিন্তা লালন করতেন, আজ ভারতে তার জায়গা কম। ভারত নিজেকে সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা দিয়ে নতুন করে গড়ে নিচ্ছে।
    এ বিষয়ে কোনো পরিবর্তন হতে হলে ভারতের অবস্থান বদলাতে হবে। এ বিষয়ে সেখানে জনস্বার্থের আলোচনা উঠতে হবে। বৈশ্বিক জনমত সৃষ্টিও বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। বার্মার পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘের তদন্ত কমিশনের অনুসন্ধান ভারতে রাজনৈতিক আবহাওয়া বদলে দিতে পারে।
    তিনটি চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ হচ্ছে—এক. বার্মা বিষয়ে ভারত, চীন ও থাইল্যান্ডের অবস্থান দায়িত্বহীন ও ক্রুর। অন্যদিকে যে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বার্মার সামরিক জান্তার কঠোর সমালোচনা করে, সাধ্য থাকা সত্ত্বেও তারা বার্মার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বদলাচ্ছে না। বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশসহ বাইরের কিছু দেশও বার্মার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্কে জড়িত, বিশেষত তেল ও গ্যাস উত্তোলন ক্ষেত্রে। তাই দেখা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডা বার্মার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে রাজি হয় না। এভাবে তারা তাদের নীতি না পাল্টালে বার্মার প্রতিবেশীদের জন্যও কঠিন হয়ে পড়ে অবস্থান বদলানো।
    দ্বিতীয়ত, কোনো দেশের তথাকথিত জাতীয় স্বার্থ কেবল বর্তমানের জন্যই নয়, ভবিষ্যতের নিরিখেও সমস্যাজনক হতে পারে। চীন, ভারত ও থাইল্যান্ডের বেলায় এ কথাগুলো খাটে। বিশ্বের জুলুমবাজ শাসনের ইতিহাস শিক্ষা দেয়, একটা সময় বার্মার স্বৈরশাসকেরা আর থাকবেন না। কিন্তু কয়েকটি দেশের বিশ্বাসঘাতকতার স্মৃতি বার্মার জনগণের মনে আরও অনেক দিন রয়ে যাবে।
    তৃতীয়ত, বিশ্বের অনেক মানুষের মনেই বার্মা বিষয়ে একটা হাল ছেড়ে দেওয়া মনোভাব দানা বেঁধেছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যৌক্তিক গণমতামতের বিস্তার আর সংঘবদ্ধ বৈশ্বিক পদক্ষেপের মাধ্যমে অচিরেই বর্তমানের থেকে অনেক বেশি কিছু অর্জন করা সম্ভব।
    ১৯৯৯ সালের মার্চের শেষের দিকে আমি ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে পড়াতাম। তখন এক সকালে আমার কাছে একটি ফোন আসে। ফোনটি করেন আমার পুরোনো বন্ধু মাইকেল হ্যারিস, অং সান সু চির স্বামী। আমি জানতাম, হ্যারিস তখন প্রস্ট্রেট ক্যানসারে চরমভাবে ভুগছেন। মাইকেল সেদিন আমাকে বলেছিলেন যে তাঁর জীবনের একটা লক্ষ্য হলো সু চিকে সাহায্য করে যাওয়া। অসুস্থতা সত্ত্বেও তাঁর কণ্ঠে সেই সংকল্প ফুটে উঠছিল। সেই কণ্ঠেই তিনি আমাকে বোঝাতে লাগলেন, কেন আমাদের সবার নজর এখন বার্মার সামরিক জান্তাকে মোকাবিলা করার দিকে ফেলা দরকার। ‘অমর্ত্য, কোনো ভুল করা যাবে না’ মাইকেল বলেন আমাকে, ‘এই রোগ আমাকে মারতে পারবে না। আমার কাজে নামার জন্যই আমার সুস্থ হওয়া দরকার। আমার সু চি এবং আমার বার্মার পাশে আমাকে দাঁড়াতেই হবে।’ সেটা ছিল সম্ভবত ২৪ মার্চ। ২৭ মার্চ খবর পেলাম, মাইকেল মারা গিয়েছেন। ওই তারিখই ছিল তাঁর জন্মদিন।
    মাইকেল হ্যারিস আর আমাদের এসে বলবেন না, কোথায় আমাদের নজর দেওয়া দরকার। কী আমাদের করা দরকার। কিন্তু তাঁর বিদায়বার্তাটি এখনো সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সম্মিলিত পদক্ষেপের এমন প্রয়োজন অতীতে আর আসেনি। বার্মার দানবীয় শাসকেরা এখনো দেশটাকে নরক বানিয়ে রেখেছেন। এ মুহূর্তে ভুয়া নির্বাচনের প্রহসনে ভুললে চলবে না। এ মুহূর্তে বার্মার জনগণের পাশে দাঁড়ানোর উপায় হাতড়ানোরও আর সময় নেই। যা করার, এখনই করতে হবে। আর করতে হবে স্পষ্টভাবে, যুক্তির ভিত্তিতে।
    যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে বার্মা বিষয়ে দেওয়া বক্তৃতা।
    ভারতের দি আউটলুক থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
    অমর্ত্য সেন: নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ ও লেখক।  তারিখ: ০৮-১১-২০১০
    মুল সুত্র:  http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-08/news/107471

    মনে পড়ে ১৯১৭?

    সহযোদ্ধাদের চোখ কপালে উঠে গেছে। কেউ তাঁকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এমনকি দীর্ঘদিনের সঙ্গী, স্ত্রী ক্রুপস্কায়া পর্যন্ত বলছেন, ‘লেনিন পাগল হয়ে গেছেন’। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী নেতা বোগদানভ তো বলেই ফেললেন, লেনিন ‘পাগলের প্রলাপ’ বকছেন। মহাকাব্যের বীরের মতো একা লেনিন তবু গোঁ ধরে আছেন, ক্ষমতা দখলের এখনই সময়। নইলে রুশ বিপ্লব হাতছাড়া হয়ে যাবে, পিছিয়ে যাবে কয়েক যুগ। কেউ শুনল না, তিনি বললেন, ‘জনগণ আমার সঙ্গে, আমি তা প্রমাণ করব।’
    ওদিকে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বলশেভিক পার্টির প্রতিনিধিরা আসছেন। কেউ বা শত কেউ বা হাজার মাইল পেরিয়ে আসছেন বিপ্লবের নির্দেশনা নিতে। পিটার্সবার্গের সেই সোভিয়েত কংগ্রেস লেনিনের ডাকে সাড়া দিল, ঘোষণা করল, সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে চাই। এখনই। প্রমাণ হলো লেনিনই সঠিক। এত কঠিন আত্মবিশ্বাস আর এত বড় ঝুঁকি ইতিহাসে বিরল।
    সেটা ছিল ৭ নভেম্বর, ১৯১৭ সাল। মহান রুশ বিপ্লবের সন্ধিক্ষণ। পার্টির ভেতর এটা ছিল তাঁর প্রথম ক্যু। দ্বিতীয় ক্যু হলো, সবচেয়ে ছোটো কিন্তু ইস্পাতের মতো কঠিন এক বিপ্লবী বাহিনী নিয়ে রুশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দখলের ঘটনা। লেনিনের বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’ ছিল সেই দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবেরই ডাক। পৃথিবীতে কারও কলম যদি শক্তিমান হাতিয়ার হয়ে উঠে থাকে, তা লেনিনেরই কলম।
    অথচ এই মানুষটিই কিছুদিন আগে বন্ধুকে লিখেছেন, ‘যদি আমাকে ওরা মেরে ফেলে, তাহলে রাষ্ট্র ও বিপ্লব বিষয়ে আমার সবুজ রংয়ের নোট খাতাটি তোমরা প্রকাশ কোরো।’ এপ্রিল থিসিস যদি বিপ্লবের ইশতেহার হয়ে থাকে, তাহলে তার রূপরেখা হলো এই বই।
    হাজার বছর আগের এক বাঙালি কবি লিখেছিলেন, ‘বউ শিশুটাকে বাঁচিয়ে রাখিস, আবার বৃষ্টি হবে, ঘাসগুলো হবে সবুজ।’ বিপ্লব যেন এক বৃষ্টি, যাতে সবকিছু ভিজে যায়। হাজার হাজার বছর ধরে এই স্বপ্ন মানুষ দেখে এসেছে। রুশ বিপ্লব সেই স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিল। সত্যিই ১৯১৭ সালের রাশিয়ায় মনে হচ্ছিল সব কিছুই সম্ভব। মানুষ সব পারে। পারে শোষণের জিঞ্জির ছিঁড়তে, পারে এই নিষ্ঠুর জগৎটাকে খোলনোলচেসহ বদলে দিতে। এক বিরাট আশাবাদের জন্ম দিয়েছিল রাশিয়ার খেটে খাওয়া মানুষ। তারা ঘোষণা করল, কোনো শ্রেণী থাকবে না, মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ অসম্ভব হবে। রচিত হবে নতুন মানবজমিন, নতুন মানবচরিত। মানুষ হবে অমৃতের সন্তান।
    পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল এই ঘোষণায়। এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার পরাধীন জাতিগুলো চমকে উঠেছিল এই ডাকে। বিশ্বের শ্রমিকেরা হয়ে উঠেছিল আত্মবিশ্বাসী। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এই প্রথম পরাজয়ের তিতা স্বাদ পেয়েছিল।
    যে মানুষটি এই বিপ্লবের কারিগর, নদীর নামে নাম ছিল তাঁর। দাদা ছিলেন ভূমিদাস, বাবা শিক্ষক, তিনি তরুণ বয়স থেকেই বিপ্লবী। পুরো নাম ভ্লাদিমির এলিচ লেনিন। বন্ধুরা ডাকত ইভান ইলিচ বলে।
    অথচ ১৯১৭ সালের প্রথমে তিনি ইউরোপে প্রায় অপরিচিত এক নির্বাসিত বিপ্লবী। রুশ বিপ্লবের আরেক কিংবদন্তি লিও ট্রটস্কি লিখেছেন, ‘লন্ডনে এক ভোরে যখন তাঁকে দেখি, তাঁর কপালের রেখায়, গভীর চোখের চাহনিতে আর দৃঢ় ঠোঁটের ভাঁজে আমি পাঠ করেছিলাম রাশিয়ার ভবিষ্যৎ।’ রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি মনে করতেন ‘সময়ের থেকে বহুদূর অবধি দেখতে পেতেন লেনিন।’
    আজ আমরাও বহুদূর থেকে ১৯১৭ সালকে দেখছি। বিপ্লবের ৭৩ বছরের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ল। লেনিন ও তাঁর অনুসারীদের মৃত্যুর পর থেকেই অনেক ভুল আর আপসে ক্ষয়ে যাচ্ছিল নতুন সমাজের নবীন শেকড়। গৃহযুদ্ধ আর বিশ্বযুদ্ধে বিপ্লবী বলশেভিকদের বেশির ভাগই মরে গিয়েছিল। স্ট্যালিনের ভুলেও মারা পড়েন অনেক খাঁটি শ্রমিক। সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত ও আমলারা ক্ষমতার সব আসনে বসে পড়েছিল। রাশিয়ার মানুষ বাঘের ছাল পরা সেই শেয়ালের শাসন মানেনি। উল্টে ফেলে দিয়েছিল, যেভাবে তারা উল্টে দিয়েছিল জারের মসনদ। কিন্তু আজও
    লেনিন তাদের প্রিয় নেতা। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা মহানায়কদের মধ্যেও আছেন মহামতি লেনিন। তাঁকে দেখে এক শ্রমিক বলেছিল, ‘লেনিন, সত্যের মতো কঠিন ও সরল’। রুশ বিপ্লবও ছিল তেমনই এক সরল ও কঠিন বিজয়।
    ব্রিটিশ নাট্যকার ব্যাট্রল্ড ব্রেখট রুশ লেখেন, ‘তখন থেকেই পৃথিবীতে আশা ফিরে এল।’ পৃথিবীর হেন দেশ নেই যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠেনি এবংনিষিদ্ধ হয়নি। জগতের লাঞ্ছিত-হতভাগ্য মানুষ এই পার্টিকেই মনে করতে থাকে তাদের মুক্তির আশ্রয়।
    দেশে দেশে বিপ্লবের পর বিপ্লব ঘটতে থাকে পরের দশকগুলোতে। চীন, ভিয়েতনাম, পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা থেকে মুক্তির খবর আসতে থাকে। বিপ্লবের ভয়ে বড় বড় পুঁজিবাদী দেশে শোষণ কিছুটা কমে। অনেকের মনেই বিশ্বাস আসে, মানুষের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ মানুষেরই হাতে। রুশ বিপ্লবই হলো ইতিহাসের প্রথম পরিকল্পিতভাবে, সংগঠিত জনগণের শক্তিতে শোষণের দুর্গ ভাঙার শিক্ষা।
    গত শতকের ষাটের দশক ছিল সে রকমই এক উথালপাতাল সময়। বাংলাদেশে তখন পাকিস্তানি স্বৈরশাসন চলেছে। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। কিন্তু গোপনে তারা কাজ করে চলছে তেভাগা আন্দোলনে, চল্লিশের খাদ্য আন্দোলনে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে, তেষট্টির ছাত্র আন্দোলনে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেরও প্রধান শক্তি তারা। ইতিহাসের ঢেউ ওঠা-পড়ার সে রকমই এক সময়ের গল্প:
    গোপন মিটিং বসেছে যশোরের এক দরিদ্র কমিউনিস্টের বাড়িতে। গোপনে হাতে হাতে চিরকুট পাঠিয়ে খবর দেওয়া হয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে কমরেডরা এসেছেন। বাড়ির একটি ঘরে বৈঠক চলল সারা দিন। সন্ধ্যার দিকে যখন সবার অন্ধকারে লুকিয়ে যাওয়ার সময়, তখন হঠাৎ ভেতর-বাড়ি থেকে বুকচাপা ডুকরানো কান্নার শব্দ এল যেন।
    ‘কে কাঁদছে?’, বাড়ির কর্তার দিকে তাকিয়ে বললেন একজন।
    তিনি চুপ। তাঁর মাথা নিচু হতে হতে বুকের সঙ্গে লেগে গেল। আবারও প্রশ্ন: কী হয়েছে, বলুন কমরেড? তিনি তবু নীরব, কেবল গাল বেয়ে অশ্রুর রেখা দেখা যায়। শেষে একজন উঠে ঢুকে পড়লেন ভেতর-বাড়িতে। পিছু পিছু অন্যরাও। তাঁরা যা দেখলেন, তা অবিশ্বাস্য। কমিউনিস্টও তো মানুষ। তাঁরও স্ত্রী-সন্তান ছিল। বড় ছেলেটা আগের রাতে মারা গেছে। পার্টির মিটিং হবে বলে মৃত্যুর খবরটা জানতে দেননি কাউকে। স্ত্রীকে বলে রেখেছিলেন, যেন না কাঁদেন, যেন কেউ টের না পায়। তারপর নিজে এসে সহযোদ্ধাদের নিয়ে সভা করেছেন। কেবল সন্ধ্যার দিকে সেই মানুষটি, যিনি মা, যিনি নারী, যিনি শোকতপ্তা; আর পারেননি, কেঁদে উঠেছিলেন।
    রুশ বিপ্লব বিশ্বময় এ রকম অগণিত মানুষ সৃষ্টি করেছিল। তাঁদের অবদানে পৃথিবী কিছুটা এগিয়েছিল। তাঁরা এ রকম পারতেন, যেমন পারতেন তাঁদের সবার গুরু কার্ল মার্ক্সও। অভাবে-অনটনে আর বিনা চিকিৎসায় তাঁরও একমাত্র শিশুপুত্র অকালে মরে গিয়েছিল। তিনিও সন্তানদের দাফনের টাকা জোগাড় করতে না পারা এক ব্যর্থ বাবা। কিন্তু আজও যেখানেই অন্যায়, যেখানেই মানুষের উঠে দাঁড়ানোর স্পর্ধা, যেখানেই মানুষের মতো বাঁচার সংগ্রাম চলছে বা চলবে, সেখানেই উঠে আসবে মার্ক্সের নাম, লেনিনের নাম আর রুশ বিপ্লবের সেই ডাক—জাগো লড়ো, বাঁচো।

    ফারুক ওয়াসিফ | তারিখ: ০৮-১১-২০১০

    মুল সুত্র:  http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-08/news/107472

    Saturday, November 6, 2010

    খুরি মরুভূমি:প্রাচ্যের সাহারা

    সমভূমি, মালভূমি, পাহাড়-পর্বত থেকে শুরু করে মরুভূমি ও বরফের ছোঁয়া পর্যন্ত পাওয়া যায় ভারতের প্রকৃতিতে। প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় লীলাখেলা দেশটির একেক রাজ্যে এককভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতির এই খেলাকে কেন্দ্র করে ভারতে পর্যটন শিল্প বিশাল পরিধি ধারণ করেছে। প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছোটে আসেন পর্যটকরা। কেউবা আসেন কাশ্মীরের শীতল ছোঁয়া পেতে, কেউবা দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের কোলে আবার কেউবা আসেন মরুভূমিতে। এ রকম একটি স্থান রাজস্থানের খুরি মরুভূমি। অনেকেই একে প্রাচ্যের সাহারা বলে থাকেন। এ স্থানকে কেন্দ্র করে সমগ্র রাজস্থান বিশ্ব পর্যটকের নজরে আসতে সক্ষম হয়েছে। যে কেউ এখান থেকে পেতে পারেন মরুভূমির উষ্ণ ছোঁয়া। ভাবিয়ে তুলতে পারে পৃথিবীর বৈচিত্র্য নিয়ে।

    জয়সলমের থেকে ৪০ কিলোমিটার পথ পেরুলেই পেঁৗছা যায়, খুরি মরুভূমির সীমানায়। রাস্তায় যানবাহন খুব একটা দেখা যায় না। শুধু পর্যটকদের আনা-নেয়ার জন্য রয়েছে কিছু বাস। প্রকৃতপক্ষে খুরি হলো এ মরুভূমির বহু পুরনো একটি গ্রাম। পাকিস্তানের সীমান্তসংলগ্ন গ্রাম হলেও রাজস্থানের অন্যান্য ১০টি গ্রামের মতোই শান্ত। অনেকেই এখানে আসতে ভয় পান। কারণ হিসেবে যেটা বলেন, সেটা হলো পাক-ভারত সীমান্তের অস্থিরতা। অনেকেই মনে করেন, যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই ভীতি বর্তমান সময়ে একেবারে অবাস্তব। খুরি গ্রামটি সীমান্ত থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত। তারপরও সতর্কতা অবলম্বন করা ভালো। অনেক পর্যটকই ভুল করে ভারত সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু মাঝপথে সীমান্তরক্ষী মনে করিয়ে দেয় আপনার অবস্থান। তবে সঙ্গে গাইড থাকলে এ সমস্যা এড়ানো যেতে পারে। মরুভূমির মাঝে খুরি গ্রামটির অবস্থানের জন্য মরুভূমি এখানে হাতের মুঠোয়। বাড়ির জানালা দিয়ে বা তাঁবুর দরজা ফাঁক করলেই আদিগন্ত বালিয়াড়ি। সোনালি তরঙ্গ। খুরির পশ্চিম আর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটি পুরোটাই মরুভূমি।

    এ মরুভূমির নিজস্ব ঐতিহ্য এখনও চোখে পড়ে। প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীনত্ব নিয়ে খুরি ঐতিহ্যশালী। খড় বা টিনের চালের নিচে গোলাকার ঘর। মাটি লেপা দেয়ালজুড়ে নানা রঙিন কলকা। এসব ঘরেই মরুভূমির মধ্যে রাত পোহাতে হয় পর্যটকদের। আধুনিকতার কোল ছেড়ে এরকম মাটির তৈরি মাটির বিছানাতে ঘুমালে যে কারও মনে পড়ে প্রকৃতির কোমলতা। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যেতে পারেন ইট-পাথরের কাঠখোট্টা এ জীবনের কথা। মরুপ্রদেশের রংয়ের বিন্যাস_ সতেজতার বহিঃপ্রকাশ সব কিছুই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন নকশা বা কারুকাজের মাধ্যমে। এগুলো পরিলক্ষিত হয় ঘরের মাটির দেয়ালে। গ্রামের লোকজনের বাড়িগুলোর মধ্যেই কয়েকটা গেস্ট হাউসও রয়েছে। গেস্ট হাউস ছাড়াও আছে তাঁবুতে রাত কাটানোর রোমাঞ্চকর সুযোগ। মরুভূমিতে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ হলো উটের পিটে চড়ে ধু ধু বালির সমুদ্রে এগিয়ে যাওয়া। উটে চাপার জন্য ভিড় বেশি না হওয়ায় ঘণ্টাপ্রতি ভাড়াও কম। ভারতের অন্যান্য পর্যটন শহর যেমন কলকাতা, দার্জিলিং, দিলি্ল, শিমলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক পর্যটককে দেখা যায়। কিন্তু রাজস্থানের এই খুরি মরুভূমিতে বাংলাদেশের কোনো পর্যটক খুব একটা দেখা যায় না। এর কারণ দূরত্ব ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে ইউরোপের পর্যটকরা এখানে সবচেয়ে বেশি আসা-যাওয়া করেন।

    কুটির শিল্পের জন্য এ গ্রাম ভুবনবিখ্যাত। বয়নশিল্প ও মৃৎশিল্প খুরির অহঙ্কার। এখানে বিভিন্ন আদি ডিজাইনের পাশাপাশি আধুনিক ডিজাইনের মেলবন্ধনে কাপড়ের ওপর অঙ্কিত পোশাক পাওয়া যায়। মাটির হাঁড়ি-কলসিগুলোতে রয়েছে অপূর্ব কারুকাজ।

    খুরিতে রাতযাপন করলে আপনি যা আতিথেয়তা পাবেন তা চিরকাল মনে থাকবে। রাজস্থানি লোকসংগীতের আসর জমে উঠবে সন্ধ্যাবেলা। রঙিন হয়ে উঠবে আপনার সন্ধ্যা। এ মরুভূমিতে পানির অভাব কিছুটা রয়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের ঘাটতি নেই। পর্যটন শিল্পের কথা চিন্তা করে এখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। সন্ধ্যায় সব অতিথিশালার বারান্দাগুলো ঝলমলিয়ে ওঠে। পান-ভোজনের আয়োজন থাকে পর্যাপ্ত। এমনকি বুফে সিস্টেমে ডিনারও সারতে পারেন। ডিনারের আগে হয় ক্যাম্প-ফায়ার। এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করে আপনি থাকতে পারবেন না। মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে চারদিকে বিভিন্ন দেশের পর্যটক নিজেদের কথাবার্তা ভাগাভাগি করে নেন। খুরি থেকে যেতে পারেন ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্কে। খুব একটা দূরে নয়। এখানে আছে চিঙ্কারা, ময়ূর। বাড়তি আকর্ষণ গ্রেট ইন্ডিয়ান ব্যাস্টার্ড। মাঝে-মধ্যে বড় গাছ। শুকনো, রুক্ষ। এই সবুজহীনতায় মনকে চাঙ্গা রাখতে ওয়াচ-টাওয়ারে উঠে ক্যামেরা তাক করুন। চোখের সামনে ডেজার্ট-ফক্স, ডেজার্ট-ক্যাট, চিঙ্কারা, ময়ূূরের ছোটাছুটি। কিন্তু গ্রেট ইন্ডিয়ান ব্যাস্টার্ডদের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ধূসর রংয়ের সঙ্গে কালো-বাদামি মিশানো গ্রেট ইন্ডিয়ান ব্যাস্টার্ড বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীকুলের অন্যতম। এদের গলার নিচ থেকে পেট পর্যন্ত সাদা। সর্বদা দ্রুত চলে। নিচু ঘাসের জমিতে আস্তানা বানিয়ে থাকে। ডানা মেললে গোটা বৃত্তের আকার হয় প্রায় ৮ ফুট। জমিতে দৌড়ে চললেও এরা উড়তে পারে। তবে একটু উড়েই ক্লান্ত হয়। পাকিস্তান সীমান্ত যতই কাছে হোক_ খুরির বাতাসে নেই বারুদের গন্ধ। কোনো অচেনা, ভয় জাগানো শব্দে ঘুম ভাঙবে না। কানে বাজে রাজস্থানি লোকগীতির সুর। স্বপ্নবিভোর হয়ে পথ চলতে চলতে আপনি পেরিয়ে যাবেন বালিয়াড়ির পর বালিয়াড়ি। 

    শামছুল হক রাসেল
    http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&type=pratidin&pub_no=193&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=0

    হাজরে আসওয়াদের ইতিকথা

    ‘হাজরে আসওয়াদ’ বা কালো পাথর একটি প্রাগৈতিহাসিক ইসলামি নিদর্শন এবং বেহেশতের বহু মূল্যবান বরকতময় উপকরণ। এটি পবিত্র কাবাগৃহের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে প্রায় চার ফুট উঁচু দেয়ালের কিছুটা ভেতরে পোঁতা কালো থালার মতো একটি গোল পাথর। কালো বর্ণের বলে এর নাম রাখা হয়েছে হাজরে আসওয়াদ। কিন্তু এটা প্রথমে কালো ছিল না; এর রং সম্পূর্ণ সাদা ছিল। ক্রমান্বয়ে এর মাথার রংটুকু কালো হয়ে গেছে; তা-ও হঠাৎ করে নয়। বরং আস্তে আস্তে দীর্ঘদিন ধরে কালো হয়েছে। আদম সন্তানের গুনাহ পাথরটিকে কালো করে দিয়েছে। মূলত হাজরে আসওয়াদ ছিল রুপার মতো ধবধবে সাদা বেহেশতের একটি ইয়াকুত পাথর। কোনো এক দুর্ঘটনায় তা কয়েকটি টুকরো হয়ে গিয়েছিল। এ টুকরোগুলো মূল্যবান ধাতুর সাহায্যে জোড়া দিয়ে একত্র করা হয়েছে। একটি চাঁদির পাত্রে কাবাগৃহের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দেয়ালের সঙ্গে এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যা দেখলে ও স্পর্শ করলে একটু উঁচু অনুভূত হবে। হাদিস শরিফে হাজরে আসওয়াদকে বেহেশতি পাথর বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রোকনে আসওয়াদ অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম বেহেশতের দুটো ইয়াকুত পাথর।’ (তিরমিজি)
    প্রতিবছর হজের সময় হাজিদের অন্যতম কাজ আল্লাহর প্রেমে ব্যাকুল হয়ে পবিত্র কাবাঘর জিয়ারত ও তাওয়াফ করা। হাজরে আসওয়াদ তাওয়াফ শুরুর স্থানে অবস্থিত। প্রথমে এখান থেকেই তাওয়াফ শুরু করতে হয়। ‘বায়তুল্লাহ’ বা কাবাগৃহ তাওয়াফ ও প্রদক্ষিণের সময় হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা ও চুম্বন করা সুন্নত। হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন বা সম্মান দেখানোর কারণ সম্বন্ধে বিভিন্ন রকমের মতামত ও কাহিনি বর্ণিত আছে। সর্বজনস্বীকৃত ও অধিকাংশের অভিমতে বলা হচ্ছে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) যখন আল্লাহ তাআলার নির্দেশে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণকাজ শেষ করেন, তখন একটি পাথর ঘরের কাজে না লেগে অবশিষ্ট থেকে যায়। অবশিষ্ট এ পাথরটি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বলেছিল, ‘হে আল্লাহ! আমি কী অপরাধ করেছি যে আমার সঙ্গী-সাথিরা তোমার ঘরে স্থান পেয়েছে, কেবল আমি তা থেকে বঞ্চিত হলাম।’ আল্লাহ তাআলা তার ফরিয়াদের প্রতি-উত্তরে হজরত ইব্রাহিম (আ.)কে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তদনুযায়ী এ পাথরটিকে কাবাঘরের এক কোণে স্থাপন করা হয় এবং তাওয়াফকারীকে এ পাথরে চুম্বন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এমনিভাবে কাবাঘরের মধ্যে যেসব পাথর স্থান পেয়েছিল, কালো পাথরের মর্যাদা তাদের সমতুল্য রাখা হয়।
    বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, হজরত আদম (আ.)-এর নাজিল হওয়ার সময়ে হাজরে আসওয়াদও বেহেশত থেকে নাজিল হয়েছিল। হজরত আদম (আ.)কে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় আল্লাহ তাআলা এ পাথরটিকে কাবা শরিফের স্থানে রেখে দিয়েছিলেন। তখন কাবাঘর ছিল না। জমিন ছিল পবিত্র, এতে কোনো গুনাহ সংঘটিত হতো না। হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের সময় যখন সবকিছু ডুবে গিয়েছিল, তখন হজরত জিব্রাইল (আ.) পাথরটি আবু কোবাইস পাহাড়ে লুকিয়ে রাখেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মিত হলে তাওয়াফ শুরু করার স্থান চিহ্নিত করার লক্ষ্যে হজরত ইসমাইল (আ.) একটি পাথর তালাশ করার সময় হজরত জিব্রাইল (আ.) ওই পাথরটি এনে দেন। অতঃপর হজরত ইব্রাহিম (আ.) তা বায়তুল্লাহ শরিফের সবচেয়ে মর্যাদাবান জায়গায় তথা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপন করেন। তাই এ পাথরটি সাধারণ কোনো পাথর নয়। এটি হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর তৈরি মূল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
    ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির পাঁচ বছর আগে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশ কাবাঘর সংস্কার সাধনের পর ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্থাপন নিয়ে মতভেদ দেখা দিলে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বহস্তে কাবাগৃহে সর্বসম্মতিক্রমে যথাস্থানে কৃষ্ণপাথর স্থাপন করেন। নবী করিম (সা.) হাজরে আসওয়াদে চুমু দিয়েছেন এবং এর ওপর দুই হাত বিছিয়ে দিয়েছিলেন। তাই এতে চুম্বন করার ফজিলত অনেক বেশি। মূলত এই পাথরকে চুমু দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর রাসুলের আনুগত্য করা। এই চুমু খাওয়া সুন্নত। পরকালীন কিছু কল্যাণ লাভের আশায় মুসলমানেরা এতে চুমু খায়। হাজরে আসওয়াদ উভয় হাত দিয়ে স্পর্শ ও চুম্বনের মাধ্যমে স্পর্শকারী ও চুম্বনকারী বান্দা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হস্ত মোবারকে বায়আত করার গৌরব অর্জন করবেন।
    নবী করিম (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণে সাহাবায়ে কিরাম হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ ও চুম্বন করেছেন। প্রখ্যাত সাহাবি হজরত উমর ফারুক (রা.) হাজরে আসওয়াদকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘আমি জানি, তুমি একখানা পাথর, তোমার উপকার ও ক্ষতিসাধন করার কোনো ক্ষমতা নেই। যদি আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)কে তোমার গায়ে চুমু দিতে না দেখতাম, তাহলে আমি কখনো তোমাকে চুমু দিতাম না।’
    সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমান নর-নারীর কাছে হজের সময় হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর অত্যন্ত মূল্যবান। পাথরটির চারপাশে রুপার বৃত্ত লাগানো। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হাজরে আসওয়াদ [হজরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে] জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়। তখন তা দুধের চেয়েও সাদা ছিল; কিন্তু আদম সন্তানের গুনাহ একে কালো করে দিয়েছে।
    প্রতিবছর হজের মৌসুমে মুসলমানদের মধ্যে কিছু লোক আছেন, যাঁরা বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দেন। যদি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন দেওয়া সম্ভব না হয়, ডান হাত দিয়ে ইশারা করলেও হবে। কালো পাথরটির দিকে সম্প্রসারিত করে স্বীয় হস্তে চুম্বন করলেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে এবং আল্লাহ তাআলা হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের অশেষ সওয়াব ও বরকত দান করবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন হজযাত্রীদের নবী-রাসুলদের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ ও চুম্বন করার সৌভাগ্য দান করেন। আমিন।
    ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। তারিখ: ০৫-১১-২০১০
    dr.munimkhan@yahoo.com
     মুল সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-05/news/106754

    অঞ্চলে বাঁধা চঞ্চল টাকা

    অর্থনীতিতে যে অলস অর্থ পড়ে থাকার কথাটি প্রায়ই শোনা যায়, সেটা মূলত ব্যাংক খাতের অবিনিয়োজিত তহবিলকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বস্তুত, আজকাল কেউ আর ‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে’ বেঁধে রাখেন না। অঞ্চলে বাঁধা টাকা বলতে বোঝায় ঘরের সিন্দুকে নগদ টাকা রেখে দেওয়া। (অবশ্য ঘোষণা-অযোগ্য টাকা ব্যাংকে জমা রাখার সুযোগ না থাকলে অনেকেই ঘরের সিন্দুকে নগদ টাকা রেখে দিতে বাধ্য হন। চলতি দশকের প্রথম দিকে ভারতের পাঞ্জাব পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের বাড়ি তল্লাশি করে গোয়েন্দা বিভাগ নগদ সাত কোটি রুপির সন্ধান পেয়েছিল, কঠোর ব্যাংক আইনের কারণে যা ব্যাংকে জমা দেওয়ার সুযোগ ছিল না)। অতএব বর্তমান বাস্তবতায় ঘরের সিন্দুকে রাখা টাকাকড়ি নয়, ব্যাংকের বিতরণযোগ্য ঋণের তুলনায় আমানতের অনুপাত বেশি থাকলে সেটাই অলস অর্থ বা তহবিল।
    আমরা জানি, অর্থ বা টাকাকড়ির রয়েছে তিন ধরনের ভূমিকা: বিনিময়ের মাধ্যম, হিসাবের একক এবং মূল্যের ভান্ডার। টাকার উদ্ভব না হলে পণ্যসামগ্রীর বিনিময় সহজসাধ্য হতো না, হিসাবপত্র রাখা কঠিন হয়ে থাকত এবং কোনো জিনিসের সর্বজনস্বীকৃত মূল্য নির্ধারণ করাও সম্ভব হতো না। মূল্যের ভান্ডার হিসেবে স্বীকৃত অর্থের এই ভূমিকা অর্থনীতিবিদ কেইনসের অর্থভিত্তিক অর্থনৈতিক তত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
    মানুষের ভোগের চেয়ে আয় যখন বেশি হয়, তখনই অলস বা উদ্বৃত্ত অর্থের উদ্ভব ঘটে। এই উদ্বৃত্ত অর্থ বা তহবিলকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যায়। নগদ টাকা ঘরে রেখে দেওয়া যায়, নির্দিষ্ট সুদের হিসাবে অন্যকে ধার দেওয়া যায় অথবা মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করা যায়। মানুষ যদি নগদ টাকা অঞ্চলে বেঁধে রাখে, সেখান থেকে কোনো বাড়তি আয় হয় না। বিকল্প দুটি উপায় থাকা সত্ত্বেও মানুষ এককালে হয়তো নগদ টাকা ঘরের সিন্দুকে ফেলে রাখত, কেইনসও তেমন ধারণাই করেছিলেন। মানুষের এ প্রবণতা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিল যে, নগদ টাকা ঘরে রেখে দেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ, অর্থাৎ বিনিয়োগ করা বা ধার দেওয়ার মধ্যে নিহিত ঝুঁকি থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। হাতে নগদ টাকাকড়ি থাকলে মানুষের মধ্যে যে নিরাপত্তাবোধ থাকে, টাকাকে অন্য কোনো সম্পদে রূপান্তরিত করে রাখলে সে নিরাপত্তাবোধ থাকে না। অথচ উদ্বৃত্ত অর্থ ধার দিলে তা থেকে সুদ আকারে বাড়তি আয়ের সুযোগ থাকে, মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করলে সুদের চেয়ে আরও বেশি আয় হতে পারে। তবু কেইনস মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে নগদ টাকা ধরে রাখার প্রবণতাকে উড়িয়ে দেননি। কারণ, নগদ টাকা ধরে রাখার বিকল্প যে দুটি পন্থা আছে, সেগুলো থেকে বাড়তি আয়ের সম্ভাবনা ও হাতছানি থাকলেও তার মধ্যে আছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এবং লোকসানের ঝুঁকি। নগদ টাকা হাতের কাছে রাখার নিরাপত্তাবোধ সম্পর্কে মানুষের এই মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় নেওয়ার কেইনসীয় ধারণার পেছনে সম্ভবত এ কারণ ছিল যে, তখনকার যুগে ব্যাংকব্যবস্থা ততটা সংহত ছিল না, সুদৃঢ় ছিল না ব্যাংকগুলোর ভিত্তি, সুলভ ছিল না ব্যাংক পরিষেবা এবং ছিল না বিচিত্র ও বিভিন্নমুখী ব্যাংকিং-সুবিধা।
    অলস অর্থ ঘরে রেখে দেওয়ার এই মনস্তত্ত্বের পূর্বানুমান থেকেই কেইনস তাঁর সুদের হার-সম্পর্কিত মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নগদ অর্থ ব্যবহারহীনভাবে ফেলে রাখলে সেটা দিয়ে কোনো প্রকৃত সম্পদ সৃষ্টি হয় না এবং অর্থনীতিতে রাখতে পারে না কোনো অবদান। সঞ্চিত অর্থের বিকল্প ব্যবহার, অর্থাৎ বিনিয়োগের ধারায় প্রবাহিত করা নিশ্চিত করা যায়, যদি বিকল্প বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা থেকে নিশ্চিত আয় সম্পর্কে পূর্ব-নিশ্চয়তা পরিমাপ করে দেওয়া যায়। এই পূর্ব-নিশ্চয়তার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে কেইনসের সুদের হার তত্ত্বে। তাঁর মত ছিল, ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নগদ টাকা ঘরে রেখে দেওয়ার মনুষ্য-প্রবৃত্তিকে পরিবর্তন করার জন্যই সুদ দেওয়া প্রয়োজন। অথচ ধ্রুপদি অর্থনীতিতে সুদকে দেখা হয়েছে সঞ্চয়ের পুরস্কার হিসেবে। বর্তমানে ভোগ না করে ভবিষ্যতে ভোগ করা হবে, এই ত্যাগের জন্যই সঞ্চয়কারীকে পুরস্কৃত করা উচিত—এটাই ছিল ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদদের মতবাদ। অন্যদিকে কেইনস মনে করেন, চঞ্চল টাকাকে অঞ্চলে বেঁধে না রেখে বিনিয়োগের ধারায় প্রবাহিত করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই সুদ দেওয়া প্রয়োজন। নগদ অর্থ ধরে রাখার এই মনুষ্য-প্রবৃত্তিকে কেইনস তুলে ধরেছেন তাঁর নগদপ্রিয়তা (লিকুইডিটি প্রেফারেন্স) তত্ত্বে, যার অর্থ নগদ টাকা ধরে রাখার চাহিদা। তাঁর মতে, মানুষের নগদপ্রিয়তার তিনটি উদ্দেশ্য থাকে: (১) লেনদেনের উদ্দেশ্য, অর্থাৎ স্বাভাবিক লেনদেন পরিচালনা করার জন্য মানুষের নগদ অর্থ ধরে রাখার প্রবণতা। যাদের হাতে টাকা থাকে, তারা যখন ইচ্ছা যেকোনো পণ্য কিনে নগদ টাকাকে পণ্যে রূপান্তরিত করতে পারে। মানুষের আয় যত বেশি হয়, লেনদেনের জন্য নগদ অর্থের চাহিদাও তত বেশি থাকে। (২) পূর্বসতর্কতার উদ্দেশ্য—আকস্মিক ব্যয় এবং জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য মানুষ নগদ অর্থ হাতের কাছে রাখতে চায়। (৩) ফাটকা বাজারির উদ্দেশ্য—সুদের হার কম হলে মানুষ ফাটকা বাজারে বিনিয়োগ করার জন্য নগদ টাকা হাতের কাছে রাখতে চায়, যাতে কোনো বিনিয়োগপত্রের (বন্ড) দাম কমলে সেটা তৎক্ষণাৎ কিনে ফেলা যায়। এখানে একটা বিষয় সহজেই বোঝা যায় যে, নগদপ্রিয়তা সুদের হারের বিপরীতানুপাতিকভাবে ওঠানামা করে, অর্থাৎ সুদের হার কম হলে নগদপ্রিয়তা বেশি থাকে আর সুদের হার বেশি হলে তার বিপরীত।
    কেইনসের মতে, ফাটকা বাজারিতে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে যে তরল অর্থ হাতে মজুদ করে রাখা হয়, সেই নিষ্ক্রিয় টাকাকে সক্রিয় করে বিনিয়োগের ধারায় নিয়ে আসার জন্যই সুদ দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সুদকে সঞ্চয়ের পুরস্কার হিসেবে না দেখে অলস টাকাকে বিনিয়োগের ধারায় সম্পৃক্ত করার প্রণোদনা হিসেবে বিবেচনা করে কেইনস সুদের স্বরূপ সন্ধানে এক অভিনব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। ধ্রুপদি অর্থনীতিতে যখন মজুরি-খাজনা ইত্যাদির ধারণাকে সুদের সঙ্গে সমপর্যায়ে বিবেচনা করা হয়েছে, কেইনস তার বিপরীতে সুদকে বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ তখনকার যুগে মানুষ যখন বিকল্প বিনিয়োগের পরিবর্তে নগদ টাকাকড়ি ঘরে রেখে দিত, সেই প্রবণতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সুদের হারকে একটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে উপস্থাপন করাই ছিল কেইনসের সুদের হার তত্ত্বের মূল ভিত্তি। আজকাল ব্যাংক পরিষেবা বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণেও মানুষ নগদ টাকা ঘরে ফেলে রাখে না। ফলে যেকোনোভাবেই হোক, মানুষের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংক খাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ধারায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু মানুষের জমাকৃত অলস অর্থ যখন ব্যাংকের সিন্দুকে কিংবা স্থিতিপত্রে উদ্বৃত্ত পড়ে থাকে, তখন আমরা সচেতন হওয়ার প্রয়াস পাই এবং দেশের অর্থনীতির নাড়ি ধরে বোঝার চেষ্টা করি এই উপসর্গের কারণ।
    সুদের হার, তার উদ্ভব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এই দীর্ঘ ভূমিকার কারণ আমাদের ব্যাংক খাতের তারল্য তথা অলস তহবিল। কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশের আমানত এবং ঋণ উভয়ের ওপরই সুদের তুলনামূলক উচ্চ হার নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে এবং তার ফলে সুদের হারের কিছুটা নিম্নমুখী প্রবণতাও লক্ষ করা গেছে। এতে অবশ্যই লাভবান হয়েছে ব্যবসায়ী এবং শিল্পোদ্যোক্তা মহল এবং কিছুমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সামান্য কিছু সঞ্চয়স্পৃহা, পরিবর্তনের মোট ফলাফলে যার অবদান অনুল্লেখযোগ্য। কিন্তু সঞ্চয়ী মানুষের স্বাভাবিক এই আয়বঞ্চিতি অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রবাহিত হয়েছে, যার জন্য হয়তো আমাদের এবং সমগ্র অর্থনীতির পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়নি। প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এই খাতটি হচ্ছে আমাদের বিকাশমান শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজারের আচমকা উচ্চকিত ভাব নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল একই সঙ্গে উল্লসিত এবং চিন্তিত; কারণ সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে বহু সঞ্চয়কারী তাঁদের সঞ্চয় নিয়ে ঢুকে পড়েছেন শেয়ারবাজারের মতো একটা অপরিচিত অনিশ্চিত রাজ্যে। এই নতুন প্রবণতার জন্য চাঙা হয়েছে শেয়ারবাজার, কিন্তু শঙ্কিত হয়েছেন বাজার বিশ্লেষকেরা।
    ব্যাংকের আমানতের ওপর সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে গত বছর সাধারণ সঞ্চয়কারীরা সরকারি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু বর্তমান বছরে সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার হ্রাস এবং সুদের ওপর আয়কর আরোপের পর সাধারণ মানুষের সঞ্চয়স্পৃহা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৫৮০ কোটি টাকা। সুদের নিম্ন হারের কারণে সঞ্চয়ের অর্থ ভিন্ন খাত তথা শেয়ারবাজারে প্রবাহিত হওয়া অর্থনীতির সহজ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষের সঞ্চয় শেয়ারবাজারে খাটলেও সেটি থাকে ব্যাংকিং প্রবাহের মধ্যেই। ফলে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে না, যা ঋণের মূল্যকে করে তোলে আরও সুলভ। অন্যদিকে শেয়ারবাজার চলমান এবং সুদৃঢ় থাকলে অর্থনীতিতে শিল্পায়নের জন্য মূলধনের বিকল্প উৎস প্রসারিত হয়। কারণ, নতুন শিল্পোদ্যোগের জন্য ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পায়। একটা সুস্থ বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য স্থিতিশীল শেয়ারবাজার রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
    কিন্তু আমাদের বিকাশমান মূলধন বাজারে শেয়ারের সরবরাহের তুলনায় বহু গুণ বেশি বিনিয়োগকারীর হঠাৎ লোভের হাতছানিকে যদি সঠিক পথে পরিচালিত করা না যায়, সেটা যেমন শেয়ারবাজারে ডেকে আনতে পারে বিপর্যয়, তেমনি নষ্ট করে দিতে পারে মানুষের আস্থা। বিনিয়োগকারীদের দায়িত্বশীল আচরণ, বাজার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান এবং হঠাৎ লোভের হাতছানি থেকে বিরত থাকাই হবে বিকাশমান বাজারকে স্থিতিশীল রাখার প্রাথমিক পদক্ষেপ। বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বৃদ্ধি করার কার্যকর ব্যবস্থার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকেও বিভিন্ন সচেতনতা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে, যাতে যথাযথ প্রস্তুতিহীন বিনিয়োগকারীরা প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করতে পারেন এবং তা করতে হবে আর বেশি কালক্ষেপণ না করে।
    ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার। তারিখ: ০৬-১১-২০১০
    fmainuddin@hotmail.com

    Wednesday, November 3, 2010

    কয়েকশ' বছরের বিলুপ্ত প্রাণী

    ফসিলসমূহ পরীক্ষা দেখা গেছে যে, পৃথিবীর উৎপত্তি ও সৃষ্টির সময় থেকে আজ পর্যন্ত শত শত স্পেসিসেরা বা বিভিন্ন ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদ পৃথিবীতে সৃষ্ট হয়েছে এবং পরবর্তীতে তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রথমত. প্রাকৃতিক কারণে এসব স্পেসিস বিলুপ্ত হয়ে যায়। যে সব প্রাণী ও উদ্ভিদ পৃথিবীর পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে দ্রুতগতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি অথবা যারা সে অবস্থায় প্রাপ্ত খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় নিজেদের খাদ্য সংগ্রহে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ব্যর্থও হয়েছে তারাই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অবশ্য অন্য উদাহরণও রয়েছে। যেমন ডাইনোসরদের ক্ষেত্রে। এদের বিলুপ্তির কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। বহু মিলিয়ন বছর আগে যেসব প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল মানুষ তাদের কখনও দেখতে পায়নি আবার এমন কিছু প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে যারা কয়েকশ বছরআগেও জীবিত ছিল। এবং এদের ক্ষেত্রে তাদের মৃত্যু ও বিলুপ্তির জন্য মানুষই দায়ী। গত কয়েকশ বছরের মধ্যে বেশকিছু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ডোডো নামক একধরনের পাখি ছিল যারা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভারত মহাসাগরের ক্ষুদ্র মরিসাস দ্বীপে এ পাখি বাস করত। নাবিকেরা খাদ্যের প্রয়োজনে এদের বধ করত। ক্রমে কোনোরকম চিহ্ন না রেখে তারা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ঠিক এ কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটে আরেকটি পাখির বিলুপ্তির ঘটনায়। ওই পাখিটির নাম গ্রেট আউক, পেঙ্গুইনের মতো দেখতে এ পাখি ১০০ বছর আগেও স্কটল্যান্ডের উত্তরে দ্বীপপুঞ্জে দেখা যেত। ডিম সংগ্রহকারীরা এবং শিকারিরা এদের বিলুপ্ত ঘটায় ১৮৪৪ সালে। আরেকটি বড় পাখির স্পেসিস হলো মোয়া। যারা আজ বিলুপ্তি হয়ে গেছে। এরা নিউজিল্যান্ডে বাস করত। এদের উচ্চতা ছিল ১০ ফুট। এরা অস্ট্রিচের মতো বৃহদাকার ছিল এবং উড়তে পারত না। খুব সম্ভবত মাওরিরা যখন ৬০০ বছর আগে নিউজিল্যান্ড দ্বীপে পেঁৗছায়, তখন তারা শিকার করে এদের বিলুপ্তি ঘটায়। শুধু পাখিরাই বিলুপ্তির দুর্ভাগ্য ভোগ করেনি, অন্য একটি বিখ্যাত স্তন্যপায়ী প্রাণীও বিলুপ্ত হয়েছে। সেটি হলো, সামুদ্রিক গরু। এই সামুদ্রিক গরু বা সি-কাউ পরিবারভুক্ত প্রাণী এখনও জীবিত আছে।

    এরা হলো ম্যানাটিস এবং সাইরেন। তারা জলে বাস করে এবং দেখতে সিল-এর মতো। ১৭৮১ সালে বেরিং দ্বীপে জাহাজডুবির সময় রুশ পরিভ্রাজকরা সামুদ্রিক গরু দেখতে পান। আর তাই এগুলোও নাবিকদের শিকারের ফলে বিলুপ্ত হয়। এত হিংসভাবে তাদের শিকার হয়ে যে, ২৭ বছরের মধ্যে এ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এন্টিলোপ-এর মতো একটি প্রাণী অরিক্স আরব মরুভূমিতে শিকারের ফলে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরকম আরও অনেক প্রাণী হয়তো আজ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
    তথ্য সুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=30-10-2010&type=pratidin&pub_no=186&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=1

    বাহাদুর শাহ পার্কের অজানা কাহিনী

    জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক বাঙালি জাতির এক দুঃসহ স্মৃতি বহন করে চলেছে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার একশ বছর পর ১৮৫৮ সালে বাহাদুর শাহ পার্কে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার গ্রহণের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। তখন এ পার্কের নামকরণ করা হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। তবে ১৮৫৭ সালে এই পার্কে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহে অন্তত ১১ জন সিপাহীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিদ্রোহের সূত্রপাত ছোট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এ সময় সিপাহীদের মধ্যে এনফিল্ড রাইফেল নামে এক ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। এই রাইফেলের কার্তুজ গরু ও শূকরের চামড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে বলে গুজব ছাড়িয়ে পড়লে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমপ্রদায়ের সিপাহীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। কারণ মুসলমানদের কাছে শূকর অপবিত্র হিন্দুদের কাছে গরু নিষিদ্ধ বলে চিহ্নিত। দেশীয় সৈন্যদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ইংরেজরা এভাবে কার্তুজ তৈরি করেছে বলে সিপাহীরা ঐকমত্য পোষণ করে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। দিলি্লতে আক্রমণ চালিয়ে দিলি্ল দখল করে নেয় এবং বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতবর্ষের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে ঘোষণা করে। এদিকে ইংরেজরা বিপুল শক্তি সনি্নবেশিত করে সিপাহীদের নির্মূল ও বন্দী করে একে একে ভারতবর্ষের উল্লেখযোগ্য এলাকা পুনরুদ্ধার করে। পূর্ববঙ্গে সিপাহীদের মূল ঘাঁটি ছিল ঢাকার লালবাগ কেল্লায়। ১৮৫৭ সালের ২৬ নভেম্বর ভোরে ইংরেজ বাহিনী লে. লুইসের নেতৃত্বে অতর্কিত লালবাগ কেল্লা আক্রমণ করে। এর জবাবে সিপাহীরাও পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং পরী বিবির মাজারসংলগ্ন স্থানে স্থাপিত কামান থেকে সিপাহীরা গোলা ছুড়তে থাকে, ফলে ইংরেজ সেনাদের ভিতরে প্রবেশ ব্যাহত হয় এরপর ইংরেজ সেনারা প্রাচীর অতিক্রম করে সিপাহীদের ওপর ভয়ানক চার্জ শুরু করে। এ সময় সিপাহীরা প্রাণভয়ে পালাতে শুরু করে। এই যুদ্ধে ৩১ জন সিপাহী নিহত হন। ইংরেজদের পক্ষে নিহত হয় ৫ জন এবং আহত হয় ১৪ জন। তারা ২০ জন সিপাহীকে গ্রেফতার করে। ৩০ নভেম্বর ভিক্টোরিয়া উদ্যানে ৩ জনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। এর আগে আরও ৮ জনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। বাকি বন্দীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ভিক্টোরিয়া পার্কে দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে জীবন উৎসর্গকারী সিপাহীদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় এবং উদ্যানটির নামকরণ করা হয়। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের নামানুসারে 'বাহাদুর শাহ পার্ক' নামকরণ করা হয়।

    মো. রিয়াজুল ইসলাম 
    সুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/index.php?view=details&type=pratidin&pub_no=190&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=2

    লাশের জাদুঘর

    ১৯২০ সালের আগ পর্যন্ত প্রায় তিনশ বছর ধরে সিসিলির পালমেরো অঞ্চলে যেসব ধনী লোক মারা যেত তাদের সাধারণভাবে সমাধিস্থ করা হতো না। তাদের সাজানো হতো আকর্ষণীয় সব পোশাকে। তারপর সেগুলো সমাহিত না করে রেখে দেওয়া হতো এক মৃতদেহ সংরক্ষণাগারে। সিসিলি শহরের ক্যাটাকম্ব অঞ্চলের শব সংরক্ষণাগারের দেয়ালে এগুলো সারি বেঁধে সাজিয়ে রাখা হতো। এভাবেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেক অনেক মৃতদেহ, ঠিক যেন লাশের 'জাদুঘর'! অবিশ্বাস্য হলেও গা শিউরানো এ জায়গাটি সত্যিকার অস্তিত্ব রয়েছে ইতালির সিলিতে।

    অনেকগুলো মৃতদেহে কাপড় পরানো আছে। কাপড়গুলো দেখলে পুরনো আমলের এবং নোংরা মনে হতে পারে। কিন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে লেস দেয়া কাপড়গুলো এক সময়কার সবচেয়ে দামি কাপড়। সুতির কাপড়গুলো এখনো সিল্কের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। সবার গলায় ঝুলানো আছে মৃতের নাম। কিন্তু কালে কালে লেখা উঠে যাচ্ছে বেশির ভাগ পরিচয়পত্রেরই। কারো গলায় ঝুলানো জীবিত বয়সের ছবি।

    এই লাশের জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণকারী এখানকারই কিছু ধর্মযাজক। এরা এক সময় এই মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনকে এখানে জড়ো করে আয়োজন করতেন প্রার্থনার। এমনকি ভোজসভারও আয়োজন করা হতো। আসলে, রীতি অনুযায়ী ইতালিতে মৃতদেহে আত্মা না থাকলেও এভাবে পরিবারের সবাই জড়ো হলে, আনন্দিত হয়ে পিকনিকের আয়োজন করলে নাকি শান্তি পায় ওই আত্মাও! তাই যুগ যুগ ধরে এই মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন ওখানে এসে প্রার্থনা করেছে, উৎসবে মেতেছে এ মৃতদেহের হাত হাত রেখে খুঁজছে পরামর্শ!

    এখন অবশ্য অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। এখন আর এখানে পিকনিকের আয়োজন করা হয় না। ভল্টে খাবার নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ। ঢোকার মুখে পাওয়া যায় রুটি ভাজার গন্ধ। দরিদ্র মানুষের মধ্যে ধর্মযাজকরা রুটি বিলি করেন।

    এই জায়গাটা কতোটা ভয়ঙ্কর ভেতরে না ঢুকলে কল্পনাও করা যাবে না। সাধারণত দুপুরের খাবার পর খুব কম সময়ের জন্য এখানে ভ্রমণে আসে পর্যটকরা। পর্যটকদের জন্য বরাদ্দ গাইড বইতে তেমন তথ্যের উল্লেখ নেই। সংরক্ষণাগারের দেয়ালেও ঝোলানো নেই কোনো সতর্কবাণী আসলে ধর্মযাজকরা এখানে পর্যটকদের আনাগোনা চান না। তবে এখানকার রক্ষণাবেক্ষণে আর ধর্মপ্রচার সাহায্য ইত্যাদির জন্য টাকার অভাবেই তারা পর্যটকদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে। এখানে ওই অর্থে কোনো প্রবেশমূল্য নেই, কিন্তু যে কোনো দান গ্রহণ করা হয় সাদরে।

    ভিতরে প্রবেশ করা মাত্র যে কোনো সাহসী মানুষেরও গা ছমছম করে ওঠবে। ভয়, আতঙ্ক, বিস্ময়, সবকিছু একসঙ্গে এসে জাপটে ধরবে। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। নকল বা ডামি নয়। সত্যিকারের লাশ- থরে থরে সাজানো। মোমের জাদুঘরের মতো কৃত্রিম নয়। অথবা মমির মতো কফিনে ঢাকা নয়। একেবারে সত্যিকারের মৃতদেহ। সরু করিডরের দু'পাশে সারি করে বাঁধা মৃতদেহ; হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে এমন দূরত্বে। কেউ হতবাক হয়ে যান, কেউ কেঁপে ওঠেন আতঙ্কে, কেউ চিৎকার করে ওঠেন, কেঁদে ওঠেন অনেকে। আবার ভয় কিংবা ঘৃণা সত্ত্বেও কৌতূহলবশত অনেকেই আলতো করে কোনো মৃতদেহের গায়ে বা কাপড়ে হাত ছুঁইয়ে দেয়! আবার পরমুহূর্তেই শিউরে উঠে সরিয়ে নেয় হাত। এসব কারণে কর্তৃপক্ষ মৃতদেহগুলোর চারদিকে লোহার গ্রিল দিতে বাধ্য হয়েছে। অসাবধানতাবশত সিগারেটের আগুনেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক মৃতদেহ। অনেক শিশু ঘটিয়েছে নানান ঘটনা। তাই এখন মৃতদেহগুলো লোহার গ্রিল ঘেরা জায়গায় ফ্লুরোসেন্ট বাতির নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, কিংবা শুয়ে থাকে। এখন আর ঝাড়ু দেয়া হয় না। মৃতদেহগুলোর হাড় কাপড় এতই পুরনো হয়ে গেছে যে ঝাঁটার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে; তাই ব্যবহার করা হয় ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। তাছাড়া সংরক্ষণের স্বার্থে এখন প্রতিদিনের বদলে শুধুমাত্র রবিবার দর্শনার্থীদের জন্য এ জাদুঘর উন্মুক্ত হয়।

    ক্যাটাকম্বে প্রথম সংরক্ষত হয় ফাদার সিলভেস্ত্রো দ্য গাবি'ওর দেহ। উনি মারা যান ১৫৯৯ সালে। একই সময় সংরক্ষিত হয় চলি্লশ জন সন্ন্যাসীর মৃতদেহ। বলা হয়, ওই সময়কার প্লেগ রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা করতে গিয়ে ওই সন্ন্যাসীরাও আক্রান্ত হন প্লেগে, মারা যান কাছাকাছি সময়ে আর এ ঘটনার পর থেকেই ক্যাটাকম্ব পরিচিত হয়ে ওঠে পবিত্র ভাবগাম্বীর্যপূর্ণ এক জায়গা হিসেবে। আর তৎকালীন ধনী অভিজাত ব্যক্তিরাও উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। যে তাদের আত্মীয়দের মৃতদেহ কিংবা মৃত্যুর পর নিজেদের মৃতদেহকেও যেন এই পবিত্র স্থানে সংরক্ষিত করা হয়। কালক্রমে ক্যাটাকম্ব হয়ে ওঠে গোরস্তানের দামি বিকল্প। মৃতদেহগুলোকে প্রথমে বিশেষ করে সেলারে ভরে রাখা হতো এক বছর। বদ্ধ ওই জায়গায় ওই সময়ের ভিতরে শুকিয়ে যেত মৃতদেহের জলীয় সব উপকরণ। তারপর রোদে শুকিয়ে মৃদতেহগুলোকে গোসল করানো হতো ভিনেগারে। তারপর খড়ে মুড়ে নানান জবিটি দিয়ে পরিয়ে দেয়া হতো দামি-ঝলমলে একপ্রস্থ জামা। উনিশ শতকে এসে অবশ্য মৃতদেহ সংরক্ষণের নতুন পদ্ধতি বের হয়। তখন মৃতদেহগুলোকে গোসল করানো হতো আর্সেনিক কিংবা মিল্ক অব ম্যাগনেসিয়া দিয়ে, যাতে নাকি ত্বক থাকে আরো জীবন্ত-সতেজ! তবে এসব নিয়ে এখনকার ধর্মযাজকরা, যারা বর্তমানে ক্যাটাকম্বর দেখাশোনা করছেন তারা খুব বেশি মুখ খুলতে চান না।

    ১৮৮০ সালে এসে এভাবে মৃতদেহ সংরক্ষণ বন্ধ করা হয়। যেসব মৃতদেহ তখনো পুরোপুরি সংরক্ষণ করা হয়নি সেগুলো করুণ পরিণতি ঘটে, পচে ক্ষয়ে একাকার হতে থাকে ওগুলো। সেই থেকেই ক্যাটাকম্বের সুদিন আর ফেরত আসেনি।

    এখন আর কেউ ক্যাটাকম্বের মৃতদেহের বিদেহী আত্মার জন্য ফুল আনে না। একমাত্র ব্যতিক্রম রোজালিয়া লোম্বার্ডোর মৃতদেহ। হতভাগ্য এই মেয়েটি মারা যায় মাত্র দু'বছর বয়সে ১৯২০ সালে। তার হতভাগ্য বাবা উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে মৃতদেহ সংরক্ষণ না করার নিয়ম ভেঙে তার মেয়ের মৃতদেহটিকে সংরক্ষণ করেন। ভদ্রলোক ছিলেন চিকিৎসক, ইনজেকশন, প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি তার মেয়ের মৃতদেহটি সংরক্ষণ করে রাখেন। ওই ছোট্ট মেয়েটির মৃতদেহটি ক্যাটাকম্বে সংরক্ষণ করা আছে কাচের ঢাকনা দেওয়া এক কফিনে। এখনো কি ভীষণ জীবন্ত শরীর। মনে হয় ঘুমিয়ে আছে। ডাকলেই উঠে আসছে এক্ষুনি।

    নানান বিপদ আছে এই ক্যাটাকম্বে। এ শত শত মৃতদেহের মাঝে এসে আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে যান অনেকেই। কেবল পর্যটকদের বিপদই নয় বিপদে আছে ক্যাটাকম্ব নিজেও। ভূ-গর্ভস্থ এই শব জাদুঘর উপরের যান চলাচলে এর টিকে থাকাই এখন রীতিমতো হুমকির মুখে। তা ছাড়া যারা এর দেখভাল করে রাখবেন সেই সন্ন্যাসীদের সংখ্যা ৫০০ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র চলি্লশে। লাশের জাদুঘর আস্তে আস্তে নিজেই লাশে পরিণত হতে চলেছে! 
    * রণক ইকরাম
    সুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/index.php?view=details&type=pratidin&pub_no=190&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=0 

    Tuesday, November 2, 2010

    পরবাস

    পূর্ণিমা রাত। শরীরে জোছনা মেখে ১৫ জন মানুষ উবু হয়ে বসে আছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে। অরণ্যের মাঝখানেই সীমান্ত। ও পাশে আমেরিকা। এ পাশে মেক্সিকো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানব পাচারকারী দালালের হাত ধরে তারা সাত দিন আগে এই এলাকায় জড়ো হয়েছে। তাদের সবারই গন্তব্য তথাকথিত স্বর্গরাজ্য আমেরিকায়। আমেরিকা মানে ডলার। ডলার মানে সুখ। সেই সুখ অধরা হয়ে অপেক্ষা করছে সীমান্তের ওপারে। দালালেরা বলেছে, রাত গাঢ় হলে সীমান্তরক্ষীরা পাহারায় অসতর্ক হবে। ঠিক তখনই দৌড় দিতে হবে ঊর্ধ্বশ্বাসে। ও পাশে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এল পাসো। সেখানে বসে থাকবে এই দালালদের বন্ধু অন্য দালাল। ওদের হাত ধরেই পৌঁছে যাওয়া যাবে নিউইয়র্ক শহরে। নিউইয়র্ক যেতে চাওয়া এই ১৫ জনের দলে তিনজন বাঙালি। এদেরই একজনের নাম জয়নাল। এই জয়নালের মুখে গল্পটি শুনেছিলাম গত এপ্রিল মাসে নিউইয়র্ক শহরের ব্রুকলিনের এক সন্ধ্যায়।
    জয়নালের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপায়। জমি বিক্রির ২২ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিল দালালদের হাতে। বিশ্বস্ত দালাল। কারণ, প্রায়ই সে মানব পাচার করে পৌঁছে দেয় বিভিন্ন দেশে। সেখানে পৌঁছে উৎফুল্ল লোকজন নিকটাত্মীয়ের কাছে সংবাদ পাঠায়, পৌঁছে গেছি। জয়নাল ও আরও তিনজন প্রথমে পৌঁছাল কলকাতায়। কলকাতা থেকে মস্কো। মস্কো থেকে লাতিন আমেরিকার দেশ এল সালভাদর। অপরিচিত একদল মানব পাচারকারীর হাতে গিয়ে পড়ল তিন বঙ্গসন্তান। বহুকাল আগে আফ্রিকা থেকে কালো মানুষকে কিনে নিত শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা ‘দাস’ হিসেবে। পশুর চেয়েও অধম ছিল তাদের জীবন। চাবুকের কষাঘাতে, দাসসুলভ সেই জীবনে কালো মানুষের হাহাকার, কান্না নিয়ে কত গল্প, উপন্যাস, সংগীত, চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তা পড়ে, শুনে ও দেখে পৃথিবীর কত মানুষ চোখের জল ফেলেছে। এল সালভাদরে জয়নালরা মুখোমুখি হলো সেই জীবনের। উচ্চমাধ্যমিক পাস করা জয়নালকে বাধ্য করা হলো ঘোড়ার আস্তাবলে কাজ করতে। সারা দিন কাজ শেষে রাতের গভীরে গুমরে গুমরে কান্না। সবুজ রঙের বাংলাদেশের পাসপোর্ট আর লুকিয়ে রাখা দুই হাজার আমেরিকান ডলার একমাত্র সম্বল। সঙ্গে অন্য দুজনের কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই; দালালেরা এল সালভাদরে পৌঁছে দেওয়ার আগেই সেসব হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যেই এক দিন যোগাযোগ হয়ে গেল আরেকজন দালালের সঙ্গে। শেষ সম্বল দুই হাজার ডলার বিনিময় হলো, সঙ্গী দুজন আর চোখের জল এল সালভাদরে রেখে জয়নাল বহু পথ ঘুরে পৌঁছাল কলম্বিয়ায়। ঢাকা থেকে উড়াল দেওয়ার পর পাঁচ মাস চলে গেছে মহাকালের গর্ভে। বাড়িতে জানানো হয়নি কিছুই। কী-ই বা জানানোর আছে! কলম্বিয়ায় এসে শোনা গেল দুঃসংবাদ; ওদের যাওয়ার পথ মেক্সিকো হয়ে। মেক্সিকোর সীমান্তে এখন অনেক কড়া নজরদারি। দেখামাত্র গুলির নির্দেশ আছে। তাহলে? আবার অপেক্ষা। পেটের খাবার জোগাড় করতে জয়নাল দালালের পরামর্শে ভিড়ে গেল মাদক পাচারকারীদের দলে। এক রাত এখানে তো, অন্য রাত ওখানে। বাড়তি উদ্বেগ, পুলিশের ধাওয়া। দুঃসহ সেই জীবন কাটাল জয়নাল আরও দুই মাস। তারপর সেখান থেকে মেক্সিকো।
    দালালেরা বলেছিল, একটা পূর্ণিমা রাত এলে রওনা দিতে হবে। তো, পূর্ণিমা রাতে জোছনার নিচে উবু হয়ে বসে আছে ১৫ জন মানুষ। সংকেতের অপেক্ষা। ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। হূৎপিণ্ডের দ্রুতলয় ধাক্কা ছাড়া মগজে আর কোনো ছন্দ নেই। আর একটু পরই আমেরিকা। আমেরিকা মানে ছোট বোনের বিয়ে। বাবার হাসিমুখ। সংসারে রঙিন বেলুনের ওড়াউড়ি। হঠাৎ কানে ভেসে এল হালকা শিসের শব্দ। জয়নাল দেখল, বসে থাকা সঙ্গীরা দৌড় শুরু করেছে গভীর জঙ্গলের দিকে। চলতে চলতে তৈরি হওয়া একটা সরু পথ জোছনার আলোতে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল যেন। দৌড় দৌড় দৌড়। আর তখনই শুরু হলো অবিরাম গুলির বৃষ্টি। মাথা নিচু করে কোমর বাঁকিয়ে দুপেয়ে পশুর মতো করে একদল মানুষ জোছনার আলোতে দৌড়াচ্ছে দিগ্বিদিক, গুলির কান ফাটানো শব্দ ছাপিয়ে উঠছে তাদের আর্তস্বর, যেন তাদের তাড়া করেছে হিংস্র শ্বাপদ, তাদের থেমে যাওয়ার কিংবা পেছনে ফিরে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই। এ যেন জ্যা থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের মতো, যার কখনো পেছনে ফেরা হবে না আর।
    জয়নালরা ১৫ জন দৌড় দিয়েছিল। আমেরিকার ভূখণ্ডে পৌঁছেছিল পাঁচজন। বাকিরা কোথায়? আমার এই প্রশ্নে জয়নাল নির্বিকার বলেছিল, হয়তো মরে গেছে। অথবা ফিরে গেছে মেক্সিকোয়। নিউইয়র্কে পৌঁছানোর টাকা জোগাড় করতে হয়েছিল ভিক্ষা করে। একটা দীর্ঘ পথ, মৃত্যুভয়, আর বিচিত্র জীবনযাপনের সকাল, দুপুর, রাত কি তাকে অপ্রকৃতিস্থ করে তুলেছে? এতগুলো টাকা দিয়ে দেশেই তো অনেক কিছু করা যেত—আমার এমন মন্তব্যে নিউইয়র্কে অবৈধ বাঙালি অভিবাসী জয়নাল পাথরের চোখে চার্চ ম্যাকডোনাল্ড পাতাল রেল স্টেশনের নিচে নামার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল। কোনো উত্তর মেলেনি। তবে কি জয়নাল নিরুপায় হয়ে এই ভ্রমণে গেছে?
    আমার এই মনে হওয়াটা সাম্প্রতিক বাংলাদেশকে দেখে। সেই যখন ছাত্রজীবনে শিক্ষানীতির সুষ্ঠু বিধান চেয়ে স্লোগানমুখর পথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম, কিংবা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম বুকের উঠোন সাম্যবাদের বিশ্বাসে, তখন বাংলাদেশে শাসকেরা মানুষকে ধমক দিতেন, ক্ষমতার রক্তচক্ষু রাঙাতেন এবং নিজেরাই নিজেদের স্তুতি করতেন। আর আমরা দেশের বাকি মানুষেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম। সেই অবস্থা এখনো আছে। ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই কানই ক্ষতিগ্রস্ত হলো। দেশের অন্যতম প্রধান কানের চিকিৎসক প্রাণ গোপাল দত্ত অনেক যত্ন নিয়ে সেই কানের চিকিৎসা করলেও স্বাচিপের (আওয়ামীপন্থী সংগঠন) নেতারা প্রাণ গোপালের কান বরাবর মারমুখী হাত তুলে ফেললেন। গণমাধ্যমের প্রতি আইন প্রণেতাদের হুমকি, বেসামরিক প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের হাপুস নয়নে কান্না, আর রাজনীতির নামে অবাধ স্বেচ্ছাচারিতার এই স্বদেশে আজকাল খুব পরবাসী লাগে। আমাদের স্বদেশ কোথায়? মানুষের?
    মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
    Che21c@yahoo.com
    সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-10-02/news/97935